অজয়বাবুর নেশা রাত জেগে সিনেমা দেখা। না, না ব্লু ফিল্ম-টিল্ম নয়। ছোটবেলায় দেখেননি তা নয়, যেমন সবাই দেখে। এখন আর সে বয়স নেই। উনি ক্ল্যাসিক সিনেমা দেখতে ভালবাসেন। বাংলায় ক্ল্যাসিক সিনেমা যা পাওয়া যায় তা তিনি দেখে ফেলেছেন, বেশ কয়েকবার। ইংরেজি ক্ল্যাসিকও অনেক দেখা। একসময় গ্লোব, মেট্রো, নিউ এম্পায়ার, এলিট এসব চষে বেড়াতেন। কী সব ছবি! ‘রোমান হলিডে’-তে গ্রেগরী পেক-এর চেহারা আর অভিনয় দেখে অজয়বাবু যাকে বলে একবারে বোওলড্ আউট। ঠোঁটের দুই ফাঁকে সিগারেট চেপে ধরার কায়দাটা তিনি রপ্ত করেছিলেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, তার সাথে অবশ্যই গ্রেগরী পেক-এর ঘাড় একটু কাত করে তাকানো। এসব অজয়বাবুর রপ্ত করা। ঘাড় একটু হেলানো অবশ্য নতুন কিছু নয়, বাংলা সিলভার স্ক্রীনের একচ্ছত্র রাণী সুচিত্রা সেন ঘাড় একটু এক পাশে হেলিয়ে, মুখে মৃদু হাসি টেনে এনে অনেক পুরুষের হৃদয়েই তির বিঁধেছিলেন। সেসব তির এখনো সেখানেই রয়ে গেছে। সুচিত্রা সেন কবে সরে গেছেন রুপোলি পর্দা থেকে।
তারপর আস্তে আস্তে সবই পাল্টে গেল। প্রথম প্রথম সেই শুধু-ইংরেজি সিনেমা-দেখানো হলগুলিতে একটা দুটো বম্বের বা বর্তমানের বলিউডের হিন্দি সিনেমা দেখানো শুরু হল। একটা নাক-সিঁটকানো ভাব থাকলেও তা মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় রইল না। তারপর ব্যাপারটা ঠিক উল্টে গেল, অর্থাৎ হিন্দি সিনেমার মাঝে ক্বচিৎ দেখানো শুরু হল ইংরেজি সিনেমা।
এরপর এল ভিডিও ক্যাসেটের যুগ। টিভি-র ছোট্ট পর্দায় দেখা আর সিনেমা হলের বড় পর্দার অভিজ্ঞতা কি এক? এদিকে সব সিনেমা হল এক-এক করে বন্ধ হল। আর সঙ্গে শেষ হল অল্প বয়সের সেই রোমহর্ষক বা মধুর স্মৃতিগুলি। এরপর ভিডিও ক্যাসেট পাশ কাটিয়ে এল ছোট্ট-ছোট্ট, গোল, চ্যাপ্টা ডিভিডি-র যুগ। কিন্তু আবার সেই কম্প্যুটারের ছোট পর্দা। অজয়বাবু বীতশ্রদ্ধ হয়ে সিনেমা দেখা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আবার অজয়বাবু সিনেমা দেখতে আরম্ভ করেছেন ছেলের কল্যাণে। অল্প রোগভোগের পর স্ত্রী মারা গেছেন বহু বছর আগে। রিটায়ারমেন্টের পর কয়েক বছর ভবানীপুরে একটা ফ্ল্যাটে ছিলেন বছর তিনেক। ইতিমধ্যে তাঁদের একমাত্র সন্তান কল্যাণ বা বাবু পড়াশুনো শেষ করে খুব ভাল একটা চাকরি পেয়েছে। আর সেই সুবাদে সাউথ সিটিতে একটা টু বেড-রুম ফ্ল্যাট কিনেছে, আর তার বাবাকেও সেখানে নিয়ে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই সে তার বাবার খুব ন্যাওটা।
হয়তো বাবার সিনেমা দেখার নেশার কথা মাথায় রেখে বাবু একটা মস্ত স্ক্রীনওয়ালা টিভি কিনেছে। তাদের সাউথ সিটির ফ্ল্যাটের বসার ঘরের একটা দেওয়াল জোড়া। সিনেমা হলের মতো না হলেও তাতে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যায় কিছুটা। বাবু তার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে. তার টিভি, সিনেমা ইত্যাদি দেখার সময় খুব বেশি নেই। তবে অজয়বাবু বুঝদার লোক। তাই রাতে সবাই শুতে যাওয়ার পর তিনি সিনেমা নিয়ে পড়েন।
যৌবনের সেই থ্রীলগুলো যেন আস্তে আস্তে ডানা মেলে ফিরে আসছে। আবার নতুন করে দেখা সুচিত্রা-উত্তমের ছবিগুলো, সত্যজিৎ রায়, ফেলুদা, আবার রোমান হলিডে দেখার থ্রীল, আবার লরেন্স অফ আরেবিয়া, টু কিল অ্যা মকিংবার্ড। বর্ন ফ্রী-তে মানুষীর সাথে এলসা নামের সিংহীর মর্মস্পর্শী সম্পর্ক। মস্ত বড় স্ক্রীনে আর একটা ব্যাপার তিনি দারুণ উপভোগ করেন – তা হল পুরনো মেট্রো-গোল্ডউইন-মায়ার-এর প্রযোজিত ছবির আরম্ভে এপাশ থেকে ওপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে কেশর-ওলা মস্ত সিংহটার গম্ভীর মেঘের মত ডাক।
অজয়বাবু সাধারণত অনেক রাত অব্দি ছবি দেখে ঘুমোতে যান। সকালে উঠে অফিস যাওয়ার তো কোন তাড়া নেই। অধিকাংশ দিনই ঘুম থেকে উঠে মুখে একটা পরিতৃপ্তির মৃদু হাসি লেগে থাকে। কিন্তু সেদিন রাতে সোফি’স চয়েস নামের ছবিটা দেখার পর চোখে ঘুম আসেনি। শুয়েছেন, কিন্তু মন থেকে এই সিনেমায় দেখা আতঙ্ক বা তার আভাস সরিয়ে ফেলতে পারেননি। যতবারই চোখের দুটো পাতা এক হয়েছে তখনই তাঁর মনে এই ছবির নায়িকা মেরিল স্ট্রিপ-এর ভয়ার্ত চোখ দুটো ভেসে এসেছে। উনি ঘুমোতে পারেননি।
অজয়বাবু ছবিটা আগে দেখেননি। খুবই নাম করেছিল, বেশ কয়েকটা অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিল, তা তিনি শুনেছিলেন। কিন্তু ততদিনে ইংরেজি ছবি দেখানোর হলগুলো এগসিস্টটেনশিয়াল থ্রেট-এ ভুগতে শুরু করেছে। আর সেই ডামাডোলে ছবিটা কলকাতায় দেখানো হয়েছিল কিনা তা অজয়বাবুর মনে নেই। মোদ্দা কথা, ইচ্ছে থাকলেও দেখা হয়নি।
তিনি অনেক সাসপেন্স থ্রীলার, ভয়, ভুত, আতঙ্ক, তন্ত্র-মন্ত্র ইত্যাদির ছবি দেখেছেন। এই ছবির সব ভয়ই ভয়ের আশঙ্কা, কিন্তু সেই ভয়ের বিভীষিকা এড়ানো অত্যন্ত কঠিন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচে তখন সারা ইউরোপ ঝলসে যাচ্ছে। জার্মানি-অধ্যুষিত পোল্যান্ডে গেস্টাপোরা সোফি জাউইস্টোউইস্কি আর তার অল্পবয়স্ক ছেলে-মেয়ে জ্যান আর ইভাকে ধরতে এসেছে তারা ইহুদি বলে। সোফির বাবা নাৎসি-সিম্প্যাথাইসার ছিলেন তাই গেস্টাপোর চীফ এক শর্ত দিল – সোফি বাঁচবে। তবে তার এক সন্তানকে এক্ষুনি নিয়ে গিয়ে ‘গ্যাস’ করা হবে, আর একজনকে পাঠানো হবে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। এখন সোফিকে বলতে হবে তার ছেলে বা মেয়ে কে এক্ষুনি যাবে জল্লাদের হাতে।
অনেক কষ্টে অজয়বাবুর দুটো চোখ এক হয়েছিল। কিন্তু সোফির কান্নায় ভেঙে পড়া দৃশ্যটা আবার মনে ভেসে আসতে তিনি মন-ভরা আতঙ্ক আর ঘামে জবজবে ভিজে অবস্থায় জেগে উঠলেন। ইভাকে নাৎসিরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে, গ্যাস চেম্বারে দেবে। আর সে মা, মা করে কেঁদে চলেছে। সেই কাতর আর্তনাদ দূর থেকে আরও দূরে মিলিয়ে গেল। সোফি প্রাণে বেঁচে যায়, কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও ছেলের কোন খোঁজ মেলেনি।
অজয়বাবুর ঘুমের দফা-গয়া। তাই উঠতেও দেরি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সকাল প্রায় দশটা বেজে গেছে। কাজের লোকটা চা দিয়ে গেছে। অল্প-অল্প চুমুক দিতে দিতে অজয়বাবু অনেকটা পিছনে ফিরে গেলেন।
সে এক ভয়ঙ্কর সময়। সারা কলকাতা শহরটা তখন নকশাল আন্দোলনের ভারে কাঁপছে। ভবানীপুরে ভাড়া নেওয়ার আগে অজয়বাবু সদ্য বিয়ে-করা বউ মালতীকে নিয়ে বরানগরে গঙ্গার ধারে একটা চমৎকার দোতলা বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকতেন। এই বরানগর-কাশীপুর অঞ্চল তখন নকশালদের ঘাঁটি বলে পরিচিত। প্রায়ই লোড-শেডিঙের অন্ধকারে পুলিশ-রেইড হয়। একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর শ্মশানের স্তব্ধতা ভেঙে বেজে ওঠে পুলিসের হুইশেল, আর ধর-ধর, পালা-পালা আওয়াজ। পাড়ার সব বাড়ির জানলা-দরজা বন্ধ, শুধু খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে জোড়া জোড়া চোখ এইসব ঘটনার সাক্ষী থাকে। সব শেষে অন্ধকার খান খান করে জ্বলে ওঠে কালো গাড়ির হেড লাইট আর তার ভিতরে একরাশ অল্পবয়সি ছেলে-মেয়ের গলায় ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’ ধ্বনিত হতে হতে সেই গাড়িগুলো কোথায় হাওয়া হয়ে যায়।
কিছু দিনের মধ্যেই পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির শুরু। দিন-দুপুরে খুন হয় একজন। আর সেই রাত থেকেই শুরু হয় প্রতিশোধের নামে পুলিশ আর গুন্ডা-বাহিনীর নারকীয়তা। দলে-দলে নকশাল সমর্থকদের বাড়ি থেকে টেনে বার করে চোখ উপড়ে, গলা কেটে ভাসিয়ে দেওয়া হয় গঙ্গায়, মুখে আলকাতরা মাখিয়ে।
উনিশশো সত্তর দশকের প্রথম দিকের এই নারকীয়তার ইতিহাস এত বছর বাদে অনেকে ভুলে গেছে, কিন্তু অজয়বাবুর তা ভোলার কথা নয়। অন্যদিনের মতো সেই বিভীষিকাময় রাতের প্রথম দিকে অজয়বাবু আর মালতী জানলার খড়খড়ির ফাঁকে চোখ দিয়েছিলেন বাইরে কী হচ্ছে তা জানতে। তবে শীগিগিরই মরণাপন্ন ছেলেমেয়েদের অন্তিম চিৎকার আর গুন্ডা-বাহিনীর উল্লাসে বোঝা যায় যে ব্যাপারটা অন্যদিনের মতো, অর্থাৎ পুলিশ-বাহিনী এসে কিছু ছেলেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তা নয়। তাঁরা খড়খড়ি থেকে চোখ সরিয়ে দরজায় দেখে নিলেন ভালো করে খিল লাগানো আছে কী না। এদিকে অন্তিম আর্তনাদ আর উল্লাসের আওয়াজ বেড়েই চলেছে। দুহাতে কান শক্ত করে চেপে ধরেও এই নারকীয়তা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। চোখের সামনে না দেখতে পেলেও বাইরে যে কী হচ্ছে তা অনুমান করে নেওয়া কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। অজয়বাবুর গা-টা কেমন ঘুলিয়ে উঠল। মালতীরও একই অবস্থা। সে কেবল কান শক্ত করে চেপে ধরে টেবিলে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। মুখে কথা নেই, কিন্তু দু-চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে।
অজয়বাবু বাথরুমে যেতেই হড়হড় করে বমি হয়ে পেটের সব খাবার বেরিয়ে এল। আর তখনই তিনি মৃদু টোকার আওয়াজটা শুনতে পেলেন। ভীত অজয়বাবু কান পেতে শুনলেন। আবার মৃদু টোকা, আর সেটা বাথরুমের দেওয়ালের ঠিক বাইরে থেকে আসছে। বুঝতে আসুবিধে হল না প্রাণের ভয়ে কেউ বা কারা ঘরের ভিতরে আসার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় কী করা উচিত না বুঝতে পেরে অজয়বাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ঠিক করলেন যা হয় হোক বাইরে যে আছে তাকে ঘরে আশ্রয় দেওয়া প্রয়োজন। নিজের ও মালতীর ঝুঁকির কথা আদৌ মনে এল না। শুধু মাথায় এল বিধবা মার মুখে অনেকদিন আগে শোনা একটা ঘটনার কথা। অজয়বাবুর বাবা বাড়ির কারো কথা, মার কথা কানে না নিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী দলে যোগ দেন। তখনকার দিনে হিংসার কোন অভাব ছিল না। মা বলেছিলেন এরকম একটা দিনের কথা। একজন এসে চুপি চুপি খবর দিল যে বাবা বাড়িতে আসছেন, কিন্তু তিনি জানেন না যে সারা পাড়া পুলিশে ঘিরে ফেলেছে। সেদিন রাতে বাড়ির পিছনে একটা চোরা সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থেকে বাবা পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যান। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বছরখানেক বাদে উনি ধরা পড়েন ও হিজলী জেলে পুলিশ তাঁকে গুলি করে শেষ করে।
এই বাড়িতে ভাড়া নিয়ে আসার পরই পাশের দিকে প্রায় লুকিয়ে থাকা ছোট্ট জঙ্গলটাকে আবিষ্কার করেন অজয়বাবু। প্রায় কলেজ যাওয়ার সময় থেকেই তিনি পাক্কা ধূমপায়ী, আর মালতী সিগারেট খাওয়া একেবারে পছন্দ করে না। বাড়ির ভিতরে খাওয়া তো চিন্তার বাইরে। তাহলে খাবেন কোথায়? তাই ধূমপানের নিরিবিলি জায়গা খুঁজতে গিয়ে অজয়বাবু এই জায়গাটা খুঁজে পান। কিছু আসশ্যাওড়া, তেঁতুল এইসব গাছে জায়গাটা ভরা। দিনের বেলায়ও সেখানে আলো ঢোকে না। আর অজয়বাবুর ধূমপানের জন্য জায়গাটা একেবারে আইডিয়াল। তাছাড়া অজয়বাবু আবিষ্কার করেছেন যে ওই জঙ্গলের ঠিক পিছনে, বাথরুমের দেওয়ালের পাশেই একটা খিড়কির দরজা আছে। যা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকা যায়, কিন্তু অব্যবহারের ফলে চামচিকে, ইঁদুর ইত্যাদির দখলে। এখন কেউ বা কারা পুলিশ আর গুন্ডা ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচতে ওইখানে লুকিয়ে আছে।
অজয়বাবু প্রথমে ভাবলেন মালতীকে ডাকবেন। তারপর তাতে যদি চেঁচামেচি হয় সেই ভয়ে একা-একাই সেই মাকড়শার জালে ভর্তি খিড়কির দরজা অল্প একটু খুলে দিতেই চাঁদের খুব অল্প আলোতে দেখতে পেলেন যে একটি যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কোলে কী একটা ধরা রয়েছে। অন্ধকার চোখে একটু সহ্য হতেই বুঝতে পারলেন যে মেয়েটির কোলে একটি শিশু রয়েছে। অজয়বাবু মুখের ওপর আঙ্গুল তুলে চুপ করতে বলে আস্তে আস্তে দরজা খুলে তাদের ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিয়ে চলে এলেন বউকে সব কথা বলতে।
সেই রাতে শেষরক্ষা হয়নি। অজয়বাবু জানতে পারেননি যে কেউ পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। মিনিট পনেরো বাদেই সামনের দরজায় প্রচণ্ড কড়া নাড়া। অজয়বাবু দরজা খুলে দেখেন আধো অন্ধকারে দুজন পুলিশ আর কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। একজন পুলিশ অফিসার সামনে এগিয়ে এসে বলে উঠলো, “আপনি যে একটি মেয়েকে আপনার পিছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে জায়গা দিয়েছেন তা আমরা জানি।”
ডুবে যাওয়া মানুষের কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করার গলায় অজয়বাবু বলে উঠলেন, “আমার কাছে আশ্রয় চাইল। কী করি।”
“আশ্রয় চাইল?” পুলিশ অফিসারের মুখে ক্রূর হাসি এই অন্ধকারেও দেখতে পেলেন অজয়বাবু। “আপনি জানেন মেয়েটি কে?”
“না, জানিনা তো।”
“আপনার সাহায্যে আপনারই বাড়ির ভিতর লুকিয়ে থাকা মেয়েটি এক নামজাদা নকশাল নেতা।”
একটু থেমে পুলিশ অফিসারটি বলল, “আপনি যদি ওকে আমার হাতে তুলে না দেন, তাহলে,” তারপর একটু থেমে পিছনে দাঁড়ান লোকগুলির দিকে অল্প তাকিয়ে কথা শেষ করলেন, “ওরা ওকে ছিঁড়ে খাবে।”
হঠাৎ পেটের পিত্তি মুখে উঠে এসে অজয়বাবুর মুখটা একেবারে তেতো করে দিল। তাঁর অস্বস্তি দেখে পুলিশ অফিসারটি বলে উঠল, “মিঃ সরকার। আমাদের কাছে সব খবর থাকে। আমি জানি আপনি রাজনীতি–টাজনীতির মধ্যে নেই। কেন খামোখা এই মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের বিপদ নিজেই টেনে আনছেন?”
“আপনি বলছেন কী?” অজয়বাবু আর্তনাদ করে উঠলেন।
পুলিশ অফিসার এসব পাত্তা না দিয়ে অজয়বাবুর দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন, “আর আপনি যদি কোঅপারেট না করেন তখন—” এই বলে ঘরের ভিতরের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি হেনে
বললেন, “ওরা আপনাকে ও আপনার স্ত্রীকেও ছেড়ে দেবে না। আর তখন কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারব না।”
তারপর একটু থেমে, “এটা আপনার চয়েস। আপনিই ঠিক করুন।”
অজয়বাবু বোবা দৃষ্টি দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“মনে রাখবেন, আমার ধৈর্য কিন্তু অফুরন্ত নয়।” হিসহিস করে বলে উঠলেন সেই পুলিশ অফিসার।
অজয়বাবুর মাথায় তখন নানা চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর উপায় নেই। তিনি হাতের আঙ্গুল তুলে খিড়কির দিকে দেখালেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই মেয়েটিকে নিয়ে এলেন পুলিশ অফিসার। মেয়েটি বাচ্চাটাকে একেবারে আঁকড়ে ধরেছে।
পুলিশ লাইনের পিছন থেকে কে বলে উঠল, “পুলিশ খতম, জোতদার খতম--এসব করার সময় মনে ছিল না। এখন বাচ্চা নিয়ে ন্যাকামো করা হচ্ছে।”
মালতী এতক্ষণ ভিতরের ঘরে ছিল। সে হঠাৎ ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়ল, “স্যার! আপনারা মেয়েটিকে জেলে পুরে দিন, ওদের হাত থেকে বাঁচান। কিন্তু ওরা এই শিশুটাকে শেষ করে দেবে। ওকে, ওকে আমায় দিন। এইটুকু দুধের বাচ্চা। দয়া করুন, দয়া করুন স্যার।”
এই কথায় পুলিশ অফিসারটি একটু থেমে মেয়েটির কোল থেকে ছোঁ মেরে বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে মালতীর হাতে দিয়ে দিলেন। তারপর মেয়েটির হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে সবাই বেরিয়ে গেল। অজয়বাবু ধার্মিক নন, কিন্তু তাঁদের দুজনের মুখ থেকেই বেরিয়ে এল – দুর্গা, দুর্গা। আর সবাই চলে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই ফিরে এল লোড শেডিঙের ঘন কালো অন্ধকার।
সেই মেয়েটির কোন খবর কোনদিন পাওয়া যায়নি। অন্য অনেকের মতো সে স্রেফ হারিয়ে গেছে। এদিকে অজয়বাবু ও মালতীর নিজেদের কোন সন্তান হয়নি। আর সেই বিভীষিকার রাতে পাওয়া সেই শিশুটিকে তাঁরা নিজেদের ছেলে বলে পালন করেছেন। কোন কিছু না জেনেই বাবু বড় হয়েছে।
আজ কত কত বছর পর সেইসব পুরনো কথা মনে পড়ে যাওয়ায় অজয়বাবুর মনে কোথা থেকে একটা অপরাধবোধ এসে জড় হল। মালতী কবে চলে গেছে। সে দেখে যায়নি সেই ছেলে এখন কত বড় হয়েছে, কত ভাল চাকরি করে বড় ফ্ল্যাট কিনেছে, বাবাকে সঙ্গে রেখেছে। কিন্তু ছেলের আসল পরিচয় না-দেওয়ার জন্য যে অপরাধবোধ, তা অজয়বাবুকে একাই নিতে হবে, তার ভাগীদার হওয়ার কেউ নেই। ঠিক করলেন আজই ছেলেকে সব খুলে বলে নিজে হালকা হবেন।
রাতে খাওয়ার টেবিলে অজয়বাবুর মনে নানা প্রশ্নের ঝড়। বাবু কীভাবে কথাটা নেবে? দুঃখ পাবে, রাগে ফেটে পড়বে এতদিন তাকে জানানো হয়নি বলে? খাওয়া মুখে তুলবেন কী চিন্তার মেঘ এসে মাথায় জড় হচ্ছে, হাত যাচ্ছে থেমে।
“বাবা, তুমি কিছু খাচ্ছ না কেন? শরীর ঠিক আছে?”
“শরীর ঠিক, কিন্তু একটা জরুরি কথা তোকে যে কীভাবে বলব তা বুঝতে পারছি না।”
“কী এমন কথা যা তুমি আমায় বলতে ভয় পাচ্ছ?”
“অনেকদিন ধরে ভেবেছি তোকে বলব, কিন্তু সাহস করে উঠতে পারিনি। যদি তোকে হারাতে হয়।”
বাবার কথা শুনে বাবু খাওয়া থামিয়ে, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটু ম্লান হেসে বলল, “না, তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই। তুমি কী বলবে তা আমি জানি।”
“তুই জানিস?” অজয়বাবু একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। কিন্তু এরপর কী বলবেন বুঝতে পারলেন না।
“হ্যাঁ। আমি তোমায় বলিনি।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাবু শুরু করল, “প্রায় বছর দশেক আগে, মা তখন বেঁচে, কোথা থেকে এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একেবারে হঠাৎই। আমি কে উনি জানতেন না, তোমার নাম করে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তবে তোমার সঙ্গে না করে আমার সঙ্গে কেন যোগাযোগ করেন তাতে আমি বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম। উনি নাকি এক পুলিশ অফিসার। বহু বছর আগে উনি বরানগর অঞ্চলে পোস্টেড ছিলেন। এখন রিটায়ার্ড।”
অজয়বাবু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন, “সেই পুলিশ অফিসার।”
“হ্যাঁ, উনি আমায় নিজের বাড়িতে ডাকেন ও সেই রাতের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা খুলে বলেন। এও বলেন যে উনি আমার মাকে থানায় আটকে না রাখলে সেই গুণ্ডারা সেই রাতেই মাকে শেষ করে দিত।”
“সেই মেয়েটি এখন কোথায়?”
“সেই ভদ্রলোক যখন আমার সাথে যোগাযোগ করেন তখনো মা বেঁচে। তবে এক উন্মাদ আশ্রমে।”
“উন্মাদ আশ্রমে?”
“সেই পুলিশ অফিসার আমার কাছে কিছুই লুকোননি। মাকে প্রাণে বাঁচিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু তার বেশি কিছু করতে পারেননি। জেলে মার ওপর অকথ্য অত্যাচার চলে, রেপ করতেও ছাড়েনি। তার ফলে মা প্রায় উন্মাদ হয়ে যায়। এই ভদ্রলোকই নিজের খরচায় মাকে এক উন্মাদ আশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করেন।”
“সে কী!”
“হ্যাঁ। আমি সেখানে গিয়ে মার সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু আমার মা তখন আমায় চেনার মতো অবস্থায় ছিল না।”
“এসব কথা তো তুই আমাদের কিছু বলিসনি।”
“কী হত বলে?” বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “আমি তখন কলেজে ঢুকেছি। আর আমার সামনে এল এক মস্ত কঠিন চয়েস।”
“কী চয়েস?”
“আমার নিজের মা, না আমার পালিতা মা। কাকে মা বলে ডাকি?” তারপর একটু ম্লান হেসে, “এখন ভাবলে আশ্চর্য মনে হয় টিউশানি করে যা অল্প পেতাম তাই দিয়েই মার সাথে থাকার মতো প্রায় অবাস্তব কথাও মাথায় এসেছিল।”
“তারপর।”
“তোমাদের ঋণ কি আমি এইভাবে শেষ করতে পারি?”
বাবুর চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছে। মুছে নিয়ে বলল, “তোমরা না থাকলে আমি বেঁচেই থাকতাম না। তোমাদের কি আমি দুঃখ দিতে পারি? তাই অনেক ভেবে ঠিক করলাম তোমাদের কিছু না বলাই সবচেয়ে ভাল।”
“মেয়েটি এখন কোথায়?
“আমার সব মানসিক অশান্তি, সব দোলাচল শেষ করে দিয়ে দেখা হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই মা মারা যান।”