• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৩ | জানুয়ারি ২০২৪ | গল্প
    Share
  • রমাপতির রেল যাত্রা : রিঙ্কি দাস

    লোভে পাপ, পাপে শাস্তি। যেমন কর্ম, তেমনি ফল। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট।

    প্রবচনগুলো ক্রমান্বয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল রমাপতি চন্দ্রের মাথায়। দুপুরে একটা নতুন ধাবায় বেশ সস্তা খাবারের খোঁজ পেয়ে সদলবলে খেতে ঢুকেছিল রমাপতিদের যাত্রাদল, মানে আদ্যাশক্তি অপেরার সবাই। ডিম তড়কার রিফিল ফ্রি শুনে পর পর দু প্লেট অর্ডার করে চেটেপুটে খেয়েছিল রমাপতি।

    ব্যাস, আর যায় কোথায়, ধাবায় এক প্লেট কিনলে আরেক প্লেট ফ্রি হতে পারে, কিন্তু রমাপতির দই চিঁড়ে, পাতলা খিচুড়ি খাওয়া পেটখানা তো এমন দানখয়রাতে অভ্যস্ত নয়! বদান্যতার দু-প্লেট তড়কার ধাক্কা সামলাতে তাকে ঘন ঘন শৌচালয় খুঁজতে হচ্ছে।

    আইটেম ডান্সার মুনিয়া একটা ওয়ার্নিং দিয়েছিল বটে, রাত নটায় মণিগঞ্জের ট্রেন, জ্যোতিপুরে মিনিট পাঁচেকের বেশি দাঁড়াবে না, এখন ট্রেনে না চড়া পর্যন্ত পেট চেপে বসে থাকতে পেরে উঠলো না রমাপতি । সাড়ে নটা বেজে গেছে, ট্রেন যখন লেট করছে, একবার শেষ সুযোগ নিয়ে দেখা যাক, ভেবে দুদ্দাড় দৌড় মারল রেলওয়ে টয়লেটে। ছোট স্টেশন, মাত্র একটাই টয়লেট, কোন এক সাধুবাবা ভিতরে বসে গাঁজায় দম দিচ্ছিল, দরজায় বেশ কবার ধাক্কা দিতে হলো রমাপতিকে। সাধু মহারাজ ধীরেসুস্থে হেলেদুলে বেরোনোর পর রমাপতি যথাসাধ্য তাড়াহুড়ো করলেও যখন ছুটতে ছুটতে বাইরে এল ততক্ষণে পুরো প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। মণিগঞ্জগামী ট্রেন রাতের অন্ধকারে বিলীয়মান, শুধু ওই গাঁজাখোর সাধুবাবা ছাড়া প্ল্যাটফর্মে কোনো জনমানুষ নেই! আদ্যাশক্তি অপেরার সুহৃদরা তার টিনের স্যুটকেসটা নিয়ে গেছে, অথচ বেঞ্চির ওপর হারমোনিয়াম খানা ফেলে গেছে! এই শীতের রাতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কি সে স্টেশনে বসে গান গাইবে? স্যুটকেসটা থাকলে না হয় মোটা চাদরখানা বার করে গায়ে জড়াতে পারত! শীতটাও জাঁকিয়ে পড়েছে এ বছর, এর মধ্যে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে!

    "ও সাধুবাবাজি! পরের ট্রেন কটায় জানো কি? মণিগঞ্জ যাব।"

    সাধুবাবাজি একটা নির্বাক হাসি হাসল, যার অর্থ কোন ট্রেন কখন এল, কোথায় গেল, এসব তুচ্ছ জাগতিক প্রশ্ন নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।

    তৃতীয় একজনের আগমন ঘটে অকুস্থলে। "এঃহে, ন’টার লোকালটা মিস করে গেলেন বুঝি!"

    মেজাজটা এমনিতেই তেতো হয়ে ছিল, এই অযাচিত সহানুভূতিতে আরো তিরিক্ষি হয়ে গেল।

    "কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছেন! তা দিন!" বিরস গলায় বললো রমাপতি।

    "আহা ওত দুঃখ পাবেন না। আমি হলাম গিয়ে স্টেশন মাস্টার, এই জ্যোতিপুর স্টেশনের গোটা টাইম টেবিল আমার নখের ডগায়। পরের ট্রেন ভোর চারটে, কখনো সাড়ে চারটে কি পাঁচটা বাজে, আপনারা চাইলে আমার কেবিনে ঢুকে পড়ুন, তালা দিয়ে বাড়ি যাচ্ছি, চারটে নাগাদ এসে খুলে দেবো।"

    "আর চারটে নাগাদ যদি আপনার ঘুম না ভাঙে, আমরা তালাবন্ধ কেবিন থেকে দেখবো ট্রেন কু-ঝিকঝিক করে চলে যাচ্ছে! না না ওসব ব্যবস্থায় কাজ নেই।"

    "ভুল করলেন। ভিতরে তোষক কম্বল বালিশ সমেত একটা ক্যাম্পখাটও ছিল!" শিস দিয়ে "হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হ্যায়" গাইতে গাইতে স্টেশন মাস্টার চলে গেল।

    অন্ধকারে শীতটাও বেশি লাগছিল। এই স্টেশনে সাকুল্যে একটাই চায়ের দোকান, সে লোকটাও কখন ঝাঁপ ফেলে কেটে পড়েছে। দুপুরে ওই মারকাটারি তড়কা সাঁটানোর পর পেটে আর কিছু পড়েনি, এবার একটু একটু খিদেও পাচ্ছে। কি আর করা, হারমোনিয়াম মাথার কাছে রেখে কুকুরকুণ্ডলী ভঙ্গিতে বেঞ্চির ওপর শুয়ে পড়ে রমাপতি। সাধুবাবাটির কোনো হেলদোল নেই, দিব্যি কল্কে নিয়ে ঝিমোচ্ছে। ওই ছিলিমের আগুনের জোরেই বোধহয় ওর শীত কেটে যায়! একটু ভাগ চাইবে নাকি? নাহ, কাজ নেই, রমাপতি কোনোদিন বিড়ি-সিগারেট খায় না গলা খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়ে, আজ একবার লোভের শাস্তি পাওয়া হয়ে গেছে, আর সাধুর গাঁজার দিকে নজর দেওয়া উচিত নয়।

    ঢুলতে ঢুলতে বেশ ঘুমিয়ে পড়েছিল রমাপতি, ট্রেনের শব্দেই ঘুমটা চটকে গেল। সাধুবাবা চোখ লাল করে তখনও দিব্যি জেগে, তবে ট্রেন ধরার জন্য বিশেষ আগ্রহ দেখালো না। রমাপতি হারমোনিয়াম বগলদাবা করে এক ছুটে ট্রেনে উঠে পড়ল। শেষ রাতের ট্রেন হিসেবে বেশ ভালো ভিড়! ঠেলেঠুলে এগোতে এগোতে একটাও খালি সিট চোখে পড়ল না। আর লোকজন দিব্যি জেগে, লোয়ার বার্থে ঘুমন্ত প্যাসেঞ্জার-এর পাশে গুটিশুটি মেরে বসে পড়বে, তারও জো নেই!

    তার ওপর পড়বি তো পড় এক্কেবারে টিকিট কালেক্টরের সামনে! কালো কোট পরা দশাসই ভদ্রলোক পথ আটকে বললো, "টিকিট কেটেছ? খেলারাম সরখেলের কম্পার্টমেন্টে টিকিট ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়।"

    সেরেছে! দল বেঁধে ট্রেনে ওঠার সময়ে টিকিটগুলো সব মদন শিকদারের জিম্মায় থাকে, মদন মোটামুটি জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ , অর্থাৎ এই প্রচণ্ড শিল্পকেন্দ্রিক মানুষের দলের বেশিরভাগ অশৈল্পিক কাজকর্মগুলো সামলায়, মদনের অনুপস্থিতিতে আবার টিকিট কাটার কথা মাথায় আসেনি রমাপতির। কি কেলেঙ্কারি!

    "বুঝেছি! টিকিট সঙ্গে নেই! এই মাঝরাত্তিরে এই ছোটোখাটো স্টেশনগুলো থেকে যতসব চোর পকেটমার ওঠে! আমাকে ফাঁকি দেওয়া অবশ্য তোমার মত কচিকাঁচাদের কাজ নয়, সেই ফিফটি ফোরে এক টিকিট ফাঁকি দেওয়া ছ্যাঁচড়কে এমন জব্দ করলুম, পরে দেখা গেল সে ব্যাটা ছদ্মবেশী দাগী আসামি, সরকারের কাছে অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলুম। তুমি তো বাপু সেদিনকার ছেলে!"

    রমাপতির বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, এক দফায় চোর, পকেটমার শুনে বেশ অপমানিত বোধ করছিলো, "কচিকাঁচা" শুনে আরো বেশি আঁতে ঘা লাগলো। খেলারাম সরখেলকে তার তুলনায় তেমন মারাত্মক বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছিল না, একটা যাত্রাদলের অট্টহাসি দেওয়া ভিলেন ভিলেন ভাব চেহারায়; রং চাপা, তবে দিব্যি টান টান চামড়া, কুচকুচে কালো চুল, লম্বা জুলফিতে, গোঁফে একটুও রুপোলি রেখা নেই, নির্ঘাত কলপ লাগায়, ফিফটি ফোর বা তার আগের থেকে কাজ করছে বোঝার উপায় নেই! আতান্তরে পড়ে রমাপতি অপমানটুকু হজম করে বললো, "আজ্ঞে আমি দলছুট যাত্রাশিল্পী, দলের সবাই আগের ট্রেনে চলে গেল, আমি সে ট্রেন মিস করে পরের ট্রেনে উঠলাম। মণিগঞ্জে নেমে যাব। টিকিট আমাদের দলের আরেকজনের কাছে ছিল।"

    "এই অজুহাতটা বেশ নতুন তো! তা যাত্রায় কোন শিল্পের চর্চা করা হয়?"

    "আজ্ঞে, আমি গাই!" হারমোনিয়ামখানা তুলে দেখায় রমাপতি। "অনেক সময় গান লিখি, সুর দিই!"

    "এ ছোকরা গান গায়, গান লেখে বলছে।" আশপাশের প্যাসেঞ্জারদের উদ্দ্যেশে বলে ওঠে টিকিট কালেক্টর। "কি মনে হয় আপনাদের, সত্যি বলছে?"

    "সে পরীক্ষা নিলেই হয়!" উপরের বার্থে আধশোয়া এক বয়স্ক ভদ্রলোক বলে ওঠেন। "নিধুবাবুর টপ্পা জানো? গেয়ে শোনাও দেখি!"

    যাহ, বিশ্ব সংসারে এত গান থাকতে শেষমেশ নিধুবাবুর টপ্পা? একটু মাথা চুলকে ভাবলো রমাপতি, তার দাদু ছোটবেলায় মাঝে মধ্যে গাইতেন, কষ্টেসৃষ্টে মনে করে রমাপতি গাইলো "ছাড়িলে তো ছাড়া নাহি যায়।"

    দু-ছত্র শুনে বয়স্ক ভদ্রলোক বেশ খুশি মনে বললেন, "কেয়াবাত! নাহ্, একে ছেড়ে দাও, খেলারাম, এ সত্যি গান জানে।"

    একজন খয়েরি বেলবটম প্যান্ট-পরা ছোকরা বসে একটা চটি বই পড়ছিল, বই থেকে মুখ তুলে বললো, "এসব বস্তাপচা গান না গেয়ে একটা হিন্দি সিনেমার নতুন হিট গান শোনাও দেখি! শাম্মী কাপুরকে ভালো লাগে? আমার দারুণ লাগে। শাম্মী র জংলী সিনেমার একখানা গান গাও দেখি? দুদিন আগেই ম্যাটিনিতে দেখলাম! এই নিয়ে তিন বার!"

    বাবা, এখনও সিনেমা হলে এসব সাত পুরোনো ছবি দেখায়! যাক গে, এত ভেবে কাজ নেই, ওই দৈত্যাকৃতির টিকিট কালেক্টরের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য যদি জনতার পছন্দের গান গাইতে হয় তবে তাই গাইবে রমাপতি। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ঠ্যাং ব্যথা করছে বলে ঝপ করে মেঝেতে বসে "ইয়াহু" বলে একটা চিল চিৎকার দিলো সে। খয়েরি বেলবটমের মুখে আর হাসি থামে না, খসখসে বেসুরো গলায় সেও গলা মেলালো, "হাম প্যার কি তুফানো মে গিরে হ্যায়, হাম ক্যা করে!"

    টপ্পা শুনতে চাওয়া বয়স্ক ভদ্রলোক তড়াক করে বার্থ থেকে নেমে বললেন, "বাপু ওসব ছাইপাঁশ গেয়ে নিজের রেওয়াজি গলা নষ্ট করো না, এই দুটো টাকা রাখো, ওই আজেবাজে গান না গাওয়ার জন্য আমার দক্ষিণা ধরে নাও!" একরকম জোর করেই রমাপতির ফতুয়ার পকেটে টাকা গুঁজে দিলেন তিনি।

    "আপনি মাটিতে না বসে সিটে বসতে পারেন।" ভারী মধুর স্বরে বলে উঠলেন এক ভদ্রমহিলা। মাথায় বিশাল খোঁপা, চোখে পুরু কাজল, বেশ ঘরোয়া গোছের সুন্দরী, এই সালওয়ার-কামিজ, কুর্তি-জিন্সের বাজারে কমলা একরঙা শাড়িতে আরো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। "আমার পাশের সিটটা খালি আছে।"

    রমাপতিকে দুবার সাধতে হলো না। হারমোনিয়াম কোলে যুবতীর পাশে ধপাস করে বসে পড়লো সে।

    "আচ্ছা, এই শেষরাতে এই ট্রেনে কেউ ঘুমোচ্ছে না কেন বলুন তো?" রমাপতি সাগ্রহে কমলা শাড়ি পরা যুবতীর সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে। "ধরে নিচ্ছি কয়েকজন না হয় আমার মত মণিগঞ্জে নামবে বলে জেগে আছে, তবে ট্রেনসুদ্ধু সবাই কেন জেগে?"

    "কত আর ঘুমোবে, কেনই বা ঘুমোবে!" কমলা শাড়ি উদাসভাবে বলে। "ঘুমের মধ্যেই আমাদের যা সর্বনাশ হয়ে গেল! ট্রেনের দু-একজনও যদি জেগে থাকত, একটা উপায় হতে পারত!"

    "কি সর্বনাশ হয়ে গেল?" ভদ্রমহিলার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করে রমাপতি।

    "ও কিছু না। পুরোনো কথা। আপনি তাহলে মণিগঞ্জে নামবেন?"

    "হ্যাঁ। শুনেছিলাম বেশি দূর নয়। একটু পরেই আসবে নিশ্চয়ই! আমার কিন্তু ভীষণ ঘুম পাচ্ছে, মণিগঞ্জে ট্রেন থামলে একটু ডেকে দেবেন?" রমাপতি অনুনয় করে।

    "এ ট্রেন থামার নয়। এ ট্রেন চলতে থাকবে। চলতে চলতে জ্বলতে থাকবে। জ্বলতে জ্বলতে চলতে থাকবে। এ চলার শেষ নেই, জ্বলারও শেষ নেই।"

    কি অদ্ভুত কথাবার্তা রে বাবা! সুন্দরী হলেও ভদ্রমহিলার মাথায় যে সামান্য ছিট আছে সে নিয়ে সন্দেহ নেই! একটা অস্বস্তির হাসি হেসে ভদ্রমহিলার সিটের পাশে রাখা একপ্রস্থ খবরের কাগজ-পত্রিকার মধ্যে থেকে বাংলা নিউজপেপারটা তুলে নিলো রমাপতি। এই ভদ্রমহিলার ওপর ভরসা না করে বরঞ্চ কাগজ পড়ে জেগে থাকার চেষ্টা করা উচিত।

    পুরো ট্রেনের কামরা জুড়ে হঠাৎ অস্বস্তিকর একটা স্তব্ধতা। উল্টো দিকের এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বলল, "সময় হয়ে এলো প্রায়। আর মিনিট দশেক বড়জোর!"

    খবরের কাগজটা কেমন ভুলভাল মনে হচ্ছিল রমাপতির। কেমন যেন সব অদ্ভুতুড়ে হেডলাইন, রাজনীতি, খেলা, সব পাতাতেই নাম-না-জানা চরিত্রের ভিড়। বিরক্ত হয়ে কাগজটা গুটিয়ে ফতুয়ার পকেটে রাখলো রমাপতি। তারপর সামনের মাঝবয়সী ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল, "সময় হয়ে এলো মানে? দশ মিনিটে মণিগঞ্জ পৌঁছব? আপনিও কি ওখানেই…"

    খয়েরি প্যান্ট-পরা যে ছেলেটি একটু আগে ডগমগ হয়ে জংলীর গান গাইছিল, সেও কেমন দুঃখী গলায় বললো, "আর দু-মিনিট পর প্রথম ধোঁয়া দেখা যাবে। পাঁচ মিনিট পর গলগল করে কালো ধোঁয়া এসে শ্বাস বন্ধ করে দেবে। আর সাত মিনিটে আগুন এসে..."

    সব গুলিয়ে যাচ্ছে রমাপতির। এই কামরায় সবাই কি বদ্ধ উন্মাদ? আর অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে হারমোনিয়াম আগলে দরজার দিকে দৌড় দিল সে। সত্যিই জানালা দিয়ে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, এ সব কি হচ্ছেটা কি?

    ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকায় সে। একটা প্ল্যাটফর্ম আসছে, মণিগঞ্জ কিনা জানা নেই। তবু এখানেই নামবে ঠিক করল সে।

    ধোঁয়ায় ভরে গেছে ট্রেনের কামরা। খেলারাম সরখেলকে দরজায় দাঁড়িয়ে কাশতে দেখে রমাপতি।‌ একটা রহস্যময় হাসি খেলারামের মুখে। "এ আমার রোজকার ব্যাপার রে ভাই! রোজ রাতে ঠিক এই সময়ে‌ এটা সহ্য করতে হয়। এই নিয়ে…”

    রমাপতি বাকি গল্প শোনার চেষ্টা করে না। ধোঁয়া-ভরা ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ঘেঁষে দৌড়চ্ছে, সুযোগ বুঝে হারমোনিয়াম শুদ্ধু প্রাণপণ লাফ মারে সে। প্ল্যাটফর্মের ভূমিতে আছাড় খেয়ে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে রমাপতি। তারপর জ্ঞান হারায়।

    একটা পাবলিক হাসপাতালের খাটে ঘুম ভাঙে তার। মুনিয়া, মদন শিকদার ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মাথা তুলতে গিয়ে যন্ত্রণাটা টের পায় রমাপতি। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, একটা ঠ্যাং প্লাস্টার করা।

    মদনই বুঝিয়ে বলে। যে স্টেশনে সে ঝাঁপ মেরেছিল, সেটা সত্যি মণিগঞ্জ। সে ছটায় পৌঁছবে হিসেব করে তাকে স্টেশন থেকে লজে নিয়ে যাবে বলে এসেছিল মদন। দেখেছিল সাত সকালে একটা অজ্ঞান লোককে ঘিরে বেশ কিছু মানুষের জটলা। তাদের বক্তব্য, ঘোর কুয়াশা ভেদ করে হারমোনিয়াম সমেত রমাপতিকে প্ল্যাটফর্মে লাফিয়ে পড়তে দেখেছে কয়েকজন। সবার সাহায্য নিয়ে রমাপতিকে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে ভর্তি করেছে মদন, গত দুদিন কোনো জ্ঞান ছিল না তার। কাজেই নিরুপায় হয়ে আদ্যাশক্তি অপেরার জনগণ এবার মণিগঞ্জে কম গানওয়ালা পালাগুলো নামাচ্ছে লিড সিঙ্গারের অভাবে।

    "একটা কথা বলো দেখি রমাদা, এত পুরোনো একটা খবরের কাগজ এমন নতুন অবস্থায় কোত্থেকে জোগাড় করলে তুমি?" মুনিয়ার হাতে রমাপতির ট্রেনে পাওয়া খবরের কাগজ। "১৯৬১ সালের কাগজ, তবু একটুও রং জ্বলে যায়নি, ঝকঝকে ছাপার অক্ষর! বেশ অদ্ভুত ব্যাপার।"

    রমাপতির গায়ে কাঁটা দেয়।

    মুনিয়া বলতে থাকে, "এই কদিন ঘোরের মধ্যে কি সব যেন বকছিলে তুমি। ট্রেনে আগুন, ধোঁয়া, এসব। প্ল্যাটফর্মে অজ্ঞান হওয়ার আগে কি হয়েছিল মনে পড়ে?"

    "ট্রেনে আগুন?" পাশের খাট থেকে এক সাদা চুল-দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মন্তব্য করে। "সে একবার দেখেছি বটে। আমি তখন অনেক ছোটো, ইস্কুলে পড়ি, শেষ রাতের ট্রেনে মামাবাড়ি কালিগঞ্জ যাব বলে মা-বাবার সঙ্গে স্টেশনে বসেছিলাম। কিভাবে যেন আগুন লেগেছিল এক দুর পাল্লার ট্রেনে, আগুন ধোঁয়ায় মাখামাখি হয়ে ট্রেনটা আমাদের মণিগঞ্জ পার হয়েছিল। বড়ো বীভৎস সে দৃশ্য, একজন যাত্রীও বাঁচেনি। শেষ কাজ করার জন্য আত্মীয়স্বজন শবদেহ নিতে এসে দেখেছিল, জ্বলে পুড়ে সব প্যাসেঞ্জারের এমন অবস্থা, কাউকে চেনা যায়নি।"

    রমাপতি চুপচাপ শুনে যায়। তার ফতুয়ার পকেট থেকে পাওয়া জিনিসগুলো পাশের টেবিলে রাখা। একটা শস্তা ডট পেন, রঙ জ্বলা পার্স আর দুটো এক টাকার নোট; নোট দুটো ১৯৬১ সালের খবরের কাগজটার মতই আনকোরা, ঝকঝকে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments