আ হা হা চটছেন কেন পাঠিকা, ওই অঙ্ক অঙ্ক চেহারার জিনিসটা আসলে আরো শক্ত - ভূগোল। ওটা দিয়েই আমি এই ৮০/২০ কাহিনীর নামকরণ করেছি। অবতারণাও। নাতনী নাতি কাউকে ডেকে গুগল খুলিয়ে যদি ওই অক্ষাংশ-দ্রাঘিমা বা ল্যাটিচিউড-লঞ্জিচিউড পৌঁছতে পারেন তো দেখবেন একটা ঝাঁকড়া গাছ ওখানে। কি গাছ কে জানে।
তবে গাছটি অর্বাচীন। পরে হয়েছে। ওখানে আগে ছিলো "শৈল নিবাস"। ছিলো কেন, এখনো আছে। গুগলের ছবিতেই দোতলা সেই বাংলোটির ধ্বংসাবশেষের ছাদটা দেখা যায়।
সে যুগে এলাকাটায় খুব একটা বাড়ি টাড়ি ছিলো না। আর আজ সেই জায়গাটাই একটা চৌমাথা গোছের হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার উত্তরে কুণ্ডু বাংলো আর দক্ষিণে শেখপুরা আর বড়বাদ। পুব দিকে রামভরোসের গোয়াল, কুশমা আর পশ্চিমে জঙ্গল-ঘেঁষা ভুট্টা-খেত। একটু তেরছা করে, গুগল যেমন দেখাচ্ছে, চৌমাথার বায়ু বা উত্তর-পশ্চিম কোণটা হলো শৈল নিবাস, আর নৈর্ঋত বা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণটা হলো সার আশুতোষের জামাতা পি এন ব্যানার্জির অসম্পূর্ণ মস্ত বড়ো একতলা বাংলো-বাড়ি, যেটির বিস্তারিত ইতিহাস আগে আপনাদের অন্যত্র জানিয়েছি। এই দুটি বাড়ির ফাঁক দিয়ে পশ্চিম মুখো একটি গলি যেতো, এখনো যায়, ঐ যে বললাম, ছোট শালবনটা পেরিয়ে ভুট্টা-খেতের দিকে, কিন্তু তার আগে বাঁ-হাতি পড়তো এক আদিবাসী বিধবা বুড়ীর বাড়ি। রাতে এক বিশাল ভাল্লুক ওকে পাহারা দিতো, তার সঙ্গে অনেক সময়ে থাকতো পাড়ার একটা বুড়ো শজারু। সাঁওতালরা কেউ কেউ বলতো বুড়ীর ৺বুড়ো ভাল্লুক হয়ে ফিরে এসেছে, আবার কেউ কেউ বলতো না, ৺বুড়ো শজারু হয়ে এসেছে।
ওই ব্যানার্জি খন্ডহরেই একদিন সন্ধ্যেবেলা আমাদের সালিসি করতে হয়েছিলো হাটফেরতা আদিবাসীদের হাটের রোজগারের ভাগ নিয়ে। সে কাহিনী তো আপনারা জানেন।
আর ওই ভাঙাচোরা ব্যানার্জি বাড়িরই পাশে গলিটার মোড়ে ঝক্ ঝক্ করতো শৈল নিবাস। অথচ কোনোদিন শৈল নিবাসে কোনো লোকজন দেখা যায়নি।
তা আমরা কয়েকজন একদিন ও দিগরে বেড়াতে বেড়াতে ফোকলা বুড়ীকে শুধোলাম -
- গ্যে দাদী, ই সৈল নিওয়াস মাকানোয়া এইসান সাফ্ সুতরা কাইসে রহত রে? (ও ঠাকুমা, এই শৈল নিবাস বাড়িটা এমন পরিষ্কার থাকে কেমন করে?)
বুড়ী মুন্ডারিতে বললো -
- না রে, মাঝে মাঝে দুটো টেসকি করে কয়েকজন বাঙালী আসে, বাড়িটা সাফা করে গুছিয়ে দিয়ে চলে যায়। আবার কয়েক মাস পরে আসে। কক্ষণো থাকে না। বুডঢা ওদের চেনে।
টেসকি মানে ট্যাক্সি মানে মোটরগাড়ি।
যে বুডঢা এখন হয় ভাল্লুক নয় শজারু তার চেনাজানা টেসকিবাহন বাঙালীদের কথা আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না। চুপ করে গেলাম।
আমাদের তখন বিরাট দল, স্টেশনে চেনাশোনা, সোলেমান দারোগা মাঝে মাঝে ঘোড়ায় চড়ে এসে দাদুকে স্যাল্যুট করে যায়, অতএব প্রচণ্ড সাহস। তা একদিন ঠিক করা হলো শৈল নিবাসে ঢুকে দেখতে হবে অন্ততঃ বাগানটা কেমন। ঐ যে বললাম না, সাহস প্রচণ্ড!
গেটে তালা টালা কিছু ছিলো না। চারজনে ভারী গেট ফাঁক করে ঢোকা হলো। সামনেই বড় গোলাপ আর বিলিতি ইম্পেশেন্স মতন ফুলের সুন্দর কেয়ারী করা বাগান। পরিষ্কার কুয়ো, কপিকল, পেতলের একটা বালতি। লোহার গরাদ কুয়োর মুখের অনেকটা জুড়ে। পাড়ে চড়বার ধাপ। আর পাড়ে একটা ছোট্ট জলভর্তি চৌবাচ্চা, তার গায়ে একটা পেতলের কল। কুয়োতলাটা অবশ্য শুকনো।
সমস্ত দরজা জানালাও শুধু ভেজিয়ে রাখা বা খোলা রাখা। ছিটকিনি সব জায়গায় আছে, কিন্তু কোথাও কোনোটাই আটকানো নেই। কাজেই ঢুকলাম। বাড়ির ভেতর গিয়ে দেখা গেলো একতলায় বসবার ঘর, কয়েকটা বন্ধ বইয়ের আলমারির একটা ঘর, খাওয়ার ঘর, রান্নাঘর আর কয়েকটি বড় বাথরুম। বাথরুমে জল তৈরী। সব কিছু সাজানো গোছানো, তবে সবেতেই বেশ ধুলো জমেছে। রান্নাঘরে জল, কয়লা, কাঠ সব রয়েছে। তাকের ওপর মশলার কৌটো। বাসন কোসন সব মাজা। কিন্ত ধুলোয় ঢাকা।
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ষদোতলায় দেখা গেলো তিনটে বড় বড় শোবার ঘর। বিছানা, মশারি সব তৈরী পরিপাটি। আয়না টেবিল। তবে ঐ, ধুলো।
আরো ওপরে উঠে তিনতলার পেছন দিকটা দেখা গেলো বিশাল একটা খোলা বারান্দা। এক কোণে একটা হাতমুখ ধোয়ার জায়গা। যদিও সেটা একটা দোতলা বাড়ির ছাদ ছাড়া কিছুই নয়, তবু তিন দিকের ভারী সুন্দর দৃশ্য সেখান থেকে। সে যুগে আমাদের মধুপুরে দোতলা বাড়ি খুব কমই ছিলো। মনে আছে, রতনাটা বলেই ফেলেছিলো - দেখ, ঠিক মনে হচ্ছে বড় গাছের মগডালে চড়েছি!
নিস্তব্ধ বিকেলে হঠাৎ মোটরগাড়ি জাতীয় একটা আওয়াজ শোনা গেলো। ভয় আমরা মোটেও পাইনি, ওই মুখগুলো একটু শুকিয়ে গেলো, আর ইয়ে, হাঁটুগুলো কেমন কাঁপতে লাগলো। আর আমাদের কুণ্ডু বাংলোর দিক থেকে বড়বাদের দিকে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেলো ইঁটখোলার ভাঙাচোরা ছোট বেডফোর্ড লরিটা!
একটু ধাতস্থ হয়ে - কি রে, চল এবার যাওয়া যাক - বলে আমি বীরের মতো দরজা জানালাগুলো ভেজিয়ে দিতে শুরু করলাম। বাগানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসছি, পচাটা বোকার মতো একটা কালো গোলাপ তুলতে গেলো, আর এমন একটা কাঁটা বিঁধলো যে আঙুলটা পরে পেকে গিয়ে ওকে একমাস ভুগিয়েছিলো।
গেট যখন আমি বন্ধ করছি তখন হঠাৎ বাড়ীর ভেতরের কোথা থেকে একটা অচেনা বেড়াল আর একটা বাহারে কুকুর দৌড়ে এসে বিচ্ছিরি ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমরা অবিশ্যি মোটেই ভয় পাইনি।
বুড়ী পরে শুনে খুব বকেছিলো -
- আর বুডঢা যদি জানতে পারে যে তোরা ওদের বাড়িতে ঢুকেছিস তাহলে কি হবে বল দিকি? আর কখনো যাস না বাবুরা। বেড়ালটা আর কুকুরটা তোদের কিছু বলেনি তো?
কাঁথা সেলাই করার জন্য এই দাদীকেই বাঁশের খড়কে দিয়ে ছুঁচ তৈরী করে দিতো ওই বিজুরিয়াটা।
আর এই বুড়ীর কাছেই ম্যাচের আগে গোড় লাগিয়ে যেতো সাঁওতালী ফুটবল দলটা।
ও হো, বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, রতনের বাড়ী থেকে তো শৈল নিবাস কাছেই পড়তো, তা ও বললো যে ও নাকি কুকুরটাকে দেখেই চিনতে পেরেছিলো, ওটা ঐ শৈল নিবাসেরই কুকুর। ও নাকি কয়েকবার দেখেছে আদিবাসী দাদী শালপাতায় করে কিসব খাবার বাড়ীটার গেটের সামনে রেখে দিয়েছে আর গেটের ভেতর থেকে বাহারে কুকুরটা দু'তিন হাত লম্বা বিরাট জিভ দিয়ে খাবারটা খেয়ে নিচ্ছে। তাই থেকে রতনার ধারণা বিলিতি কুকুরদের জিভ অত লম্বা হয়!
তবে বেড়ালটাকে আমরা কেউ আগে দেখিনি।