১৯২৩-এ ফিগুরার মিউনিসিপাল লাইব্রেরির প্রদর্শনীতে দালির ছবি প্রশংসিত হয়। ১৯২৫-এ প্রথম একক প্রদর্শনী বার্সেলোনার দালমাউ গ্যালারিতে। এই প্রদর্শনীর দুটি ছবি পাবলো পিকাসো ও হুয়ান মিরোর প্রশংসা অর্জন করে। বোঝা যাচ্ছিল, তিনি খুঁজে পেতে চলেছেন নিজস্ব স্টাইল। ক্রমে দালি হয়ে উঠেছেন পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পী কিন্তু আত্মপ্রচারে দালি চরম উৎসাহী। তাঁর কথাতেই সেটি স্পষ্ট, ‘আমার দৃষ্টির ধার এত বেশি, এবং একাগ্রতা অতীব তীব্র, আর আমার সৃষ্টি প্রমাণ করেছে যে এই শতাব্দীতে আমার চেয়ে বীরোচিত কিংবা বিস্ময়কর আর কেউ নেই।’ আসলে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এক অন্যরকম আত্মপরিচয়।
আদর্শগত দিক থেকে সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা দালিকে দূরে রাখতেন, দালি নানান হ্যালুসিনেশন দেখতেন, তিনি পিয়ানোর সাদা-কালো রিডগুলোর মাথায় মাথায় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মুখ দেখেছিলেন এবং সেটা এঁকেওছিলেন। কিন্তু এটাও সত্যি এই হ্যালুসিনেশনের প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে অনেক বিখ্যাত ছবি। সুররিয়ালিস্ট লেখক ও বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা লুই আরাগ দালির এই চিত্রকর্ম পছন্দ করেননি। দালির এই হ্যালুসিনেশনগ্রস্ত একান্ত ব্যক্তিগত প্রতীকের ব্যবহার ও বামপন্থা নিয়ে তামাসা সুররিয়ালিস্টরা তীব্রভাবে সমালোচনা করেন। অঁদ্রে রোবের ব্র্যতোঁ-র খোলাখুলি মন্তব্য— ‘দালি প্রতিভাবান, জিনিয়াস, কিন্তু সে যা করে সবই বিতর্কমূলক।’ দালি বললেন, তাঁর ছবি ‘সাইকোপ্যাথোলজিকাল আইকনগ্রাফি, এরকম ছবি আর কারো নেই।’ তিনি একথাও বলছেন, ‘আমিই একমাত্র সুররিয়ালিস্ট।’ এই আত্মঅহংকারে দালি ডুবে থাকতেন। এমনকি মাদ্রিদে আর্ট কলেজে পড়ার সময় তিনি সর্বসমক্ষে বলতেন এই কলেজে এমন কোনো যোগ্যতাসম্পন্ন মাস্টার নেই যিনি তাঁর পরীক্ষা নিতে পারেন। তাঁর এই মন্তব্যে অসন্তুষ্ট কর্তৃপক্ষ ফাইনাল পরীক্ষার আগে দালিকে আকাদেমি থেকে বরাবরের মতো বহিষ্কার করে দেয়। দালির মুখে হিটলার ও ফ্রাঙ্কোর প্রশস্তির কারণে ১৯৩৬ সালে দালি সুররিয়ালিস্ট দল থেকে বহিষ্কৃত হন। সুররিয়ালিস্টদের কাছে দালি একজন অর্থলোভী আর্ট ডিলারের চেয়ে বেশি কিছু নয়, এবং তাঁদের বিশ্বাস দালি ক্রমশই ক্যাথলিসিজমে ডুবে যাচ্ছেন। সমালোচকদের এসব কথা দালি গ্রাহ্য করতেন না। দালির জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল ‘জিনিয়াস’ হয়ে ওঠা ও অর্থবৈভবে পৌঁছানো। আর সেজন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে তখন দালি সেই আগুন থেকে পরিত্রাণ পেতে সস্ত্রীক আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন এবং বলেওছিলেন, ‘আমেরিকা যাচ্ছি নতুন করে অর্থবান হতে।’ মার্কিন কনজিউমার সোসাইটি যে বিপুল উপার্জনের আদর্শ জায়গা, সেটা অনুধাবনে তাঁর বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। চল্লিশের দশকে তিনি প্রচারের আলোয় তুঙ্গে, তিনি তখন ‘আর্ট হিরো’। তাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ তাঁর ছবিতে অনবদ্য নিখুঁত রিয়ালিজমের সঙ্গে জুড়ে থাকা অবচেতন মনের দৃশ্যময় রূপ যা দর্শককে মোহাবিষ্ট করত। তাঁর আচরণ, কথাবার্তা সংবাদমাধ্যমকে আকর্ষণ করত, তাই প্রচারের শীর্ষে তাঁর অবস্থান, বিপুল দামে বিক্রি হত তাঁর ছবি।
১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আণবিক বোমার ভয়াবহতা সালভাদোর দালিকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেইসময়ের ছবিতে সে প্রভাব পড়ে। দালি সস্ত্রীক আমেরিকা ছেড়ে আবার ফিরে আসেন ইউরোপে। ‘আর্ট এজ’ পত্রিকাতে মন্তব্যও বেরোলো—দালি কি এবার তাহলে অবচেতন থেকে সচেতন বাস্তবের পথে চললেন?
দালির জীবনযাত্রাও ছিল অদ্ভুত। অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি প্রকাশ্যে এমনভাবে সাজতেন বা আচরণ করতেন যা সচরাচর গড়পড়তা মানুষের মতো নয়। লোককে দেখানোর জন্য বিচিত্র রং ও ডিজাইনের আলখাল্লা পরতেন, চিতাবাঘের মতো দেখতে আমেরিকান বনবেড়াল ওসিলট পুষেছিলেন এবং তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট যেতেন, পড়ে যেত বিশাল হইচই, ফুলকপি দিয়ে রোলস্ রয়েস গাড়ি সাজিয়ে রাস্তায় ঘুরেছেন, নিউইয়র্কের একটি দোকানের পাবলিসিটিতে শোকেসের বাথটবে নিজেই নগ্ন হয়ে শুয়ে পড়েছেন, নিজের গোঁফকে মোম দিয়ে পাকিয়ে বিচিত্র দর্শন করেছিলেন, কখনো তার সূচালো দুই আগায় লাগাতেন দুটি ফুল—আসলে এসবই তাঁর অন্যকে আকর্ষণের জন্য প্রচ্ছন্ন অভীপ্সার প্রতিফলন। তাঁর স্বভাবই ছিল মিডিয়ার প্রচারের শিরোনামে থাকা।
১৯৩১-এ আঁকা দালির ছবি ‘পারসিসটেন্স অফ মেমরি’—তাঁর সমগ্র চিত্রকর্মের অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছিল। শুধু রং-তুলি-ক্যানভাস নয়, ১৯৪২-এ ফরাসি ভাষায় লিখলেন তাঁর বিতর্কিত আত্মকথা— ‘সিক্রেট লাইফ অফ সালভাদোর দালি’। ১৯৪৪-এ তাঁর প্রথম ও শেষ উপন্যাস, ‘হিডেন ফেসেস’— ত্রিশের দশকের অবক্ষয়ী ইউরোপের ছবি— ধনী মানুষজনদের প্রেম, বিলাস, অমিতব্যয়ী জীবনের আখ্যান। ১৯৬৩-তে লিখলেন, ‘ডায়েরি অফ এ জিনিয়াস’। ছাত্রজীবনের বন্ধু লুইস বুনিউয়েলের সঙ্গে নির্মাণ করেছিলেন ষোলো মিনিটের নির্বাক ছবি ‘Un Chien Andalou’। দালি ছিলেন ফ্রয়েডের চরম ভক্ত। দালির ছবি প্রশংসা করতেন ফ্রয়েড। সালভাদোর দালির যৌবনের অপর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। দুজনের ঘনিষ্ঠতায় সমকামিতার স্পষ্ট আসঙ্গ এসে যাচ্ছিল। ১৯৩৬-এ জাতীয়তাবাদী সেনাদের গুলিতে লোরকার মৃত্যু হয়। দালি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে আমার বন্ধু লোরকা প্রাণ হারায়। তাঁকে মেরে রাজনৈতিক অপপ্রচারের সুবিধে হয়েছিল। তবে আমি জানি লোরকা ছিল একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কোনো অপরাধী নয়।... তাঁর বলিদান ঘটলো বিপ্লবের চিরকালীন দ্বিধাদীর্ণতার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে।’ আসলে স্পেনের গৃহযুদ্ধে তাঁর স্বদেশ রক্তাক্ত হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে—এই ভাবনায় প্রতিনিয়ত নিজের ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন সালভাদোর দালি। ১৯৩৮-এ এঁকেছিলেন ‘স্পেন’। দালি বরাবরই অরাজনৈতিক, যখন সমগ্র ইউরোপে তরুণ শিল্পী-কবি-নাট্যকার-ঔপন্যাসিকরা বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, তখন দালি সেই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে পিকাসোর তীব্র প্রতিবাদী ভূমিকার তুলনায় দালি ছিলেন আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। তাঁর এই নীরবতা সমালোচিত হয়েছিল। এসময় তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন রেনেসাঁসের ছবির জগতে। অবশ্য এটাও মানতে হবে, রাজনীতির সুযোগ নিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির কথা কোনোদিন ভাবেননি। তিনি শুধু নিজের অসামান্য প্রতিভাতেই বিশ্বাস রেখেছেন।
১৯২৯ সালে পারিতে পল এলুয়ারের স্ত্রী গালা এলুয়ারের সঙ্গে সালভাদোর দালির বন্ধুত্ব হয় এবং সেই বন্ধুত্বের পরিণতি পৌঁছয় গভীর প্রেমে। দালির জীবনে গালার প্রবেশ স্বাভাবিকভাবে অনেকেই মেনে নেননি। অনধিকার প্রবেশ হিশেবেই বিষয়টি চিহ্নিত হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৩০ সালে দালি এঁকেছিলেন ‘গুইলাউম টেল’ (Guillaume Tell)। ১৯৩৪-এ দালি ও গালার বিবাহ হয়। ১৯৪৫ সালে আঁকলেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘Portrait of Galarina’. ১৯৩৪-১৯৮২ — আটচল্লিশ বছরের দাম্পত্যজীবন দালি ও গালার। দালি গালাকে এতটাই ভালোবাসতেন, ছবি আঁকতে আঁকতে দালির মনে হয়েছে এ ছবি তিনি একা নন, তিনি নিজে আর গালা দুজনে মিলে আঁকছেন। এমনকি ছবির শেষে সইও করছেন দুজনেই। ‘দালি’ গ্রন্থটিতে লেখক দালি ও গালার প্রেমের যে বর্ণিল চিত্রভাষ নির্মাণ করেছেন তা এককথায় অতুলনীয়।
চুরাশি বছর বয়েসে ১৯৮৯-এর ২৩ জানুয়ারী দালি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। জীবনের শেষ ছয় বছর দালির কোনো সৃষ্টি নেই। ১৯৮৩ সালের মে মাসে তেল-রং-এ দালি জীবনের শেষ ছবি আঁকেন ‘সোয়ালো পাখির লেজ’। মৃত্যুর আগে তিনি উইল করে তাঁর সম্পত্তি স্পেন দেশকে দিয়ে যান। মৃত্যুশয্যায় হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে দালি শুনতে চাইতেন গ্রামাফোন রেকর্ডে সুবিখ্যাত জার্মান সংগীতস্রষ্টা রিচার্ড ভাগনার-এর সৃষ্টি ‘ত্রিস্তান এন্ড ইসোল্ড’, সেই চিরকালীন অপরিতৃপ্ত প্রণয়কাহিনির গীতিরূপ। তাঁর সমাধি হয় দালি মিউজিয়ামের প্রাঙ্গণে। অন্তিম সময়ে দালির মুখে যে অস্ফুট শব্দ শোনা গিয়েছিল তা হল—‘যবনিকা’। বিস্ময়কর প্রতিভাবান শিল্পীর যবনিকাপাতই বটে।
‘দালি’ গ্রন্থের রচয়িতা শ্রী গৌতম সেনগুপ্ত গভীর অধ্যাবসায় ও অনুশীলনে বইটি নির্মাণ করেছেন। ষোলটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এ গ্রন্থে শুধু দালির শিল্পকর্ম নয়, তাঁর শৈশব, কৈশোর, অনুশীলন পর্ব, তাঁর বন্ধুবর্গ, তাঁর ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক চেতনা, তাঁর প্রেম, যৌনতা সব কিছুই উঠে এসেছে। দালির ছবির অসংখ্য প্রিন্ট এ গ্রন্থের অমূল্য সম্পদ।