বইটি হাতে পেয়ে উলটেপালটে আলোকচিত্রগুলো আগে দেখতে থাকি। তারপর মজে যাই সাবলীল ও ঝরঝরে গদ্যে। শব্দ ও বাক্যের তুলিতে চরিত্রগুলি তাদের সমস্ত রঙ নিয়ে অনায়াসে উঠে এসেছে ক্যানভাসের নীরব অবয়বে। এইসব অঞ্চলে আমরাও গেছি, নয় কোনো কাজে বা ট্যাংরায় চিনে খাবার খেতে, কিন্তু এভাবে দেখিনি ঘরের কাছে আরশিনগর — যা বিজয় আবিষ্কার করেছেন। কারটিয়ের ব্রেসোঁ বলেছিলেন, “সময় সতত চলে যায়, শুধু চলমান মানুষদের আবিষ্কার করো—তারা তোমার কাঁচে ধরা দেবে নিঃশব্দ প্রতিবিম্বের মতো।”
আমি পেশাদারী গ্রন্থসমালোচক নই। তবে ওদেশে দীর্ঘদিন বসবাসের সুবাদে চিন দেশের ভাষা, মানুষ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমার সামান্য অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল ‘কলকাতার চিনে পাড়া’ বইটি ঠিক চিন দেশের যাপন ও সংস্কৃতির অনুপুঙ্খ বিবরণ নয়, বরং বলা যায় দেশত্যাগী এক জাতির পরদেশী এক শহরে মানিয়ে নেওয়া এবং এক সংকর যাপন-সংস্কৃতির ধারাচিত্র। এই সংকর যাপন আরও বর্ণময় হয়ে উঠেছে নানা চরিত্রের বিচিত্র সমাবেশে। এইসব চরিত্রেরা চিনের উত্তর দিশায় মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দা নয়, এরা চিনের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তিক প্রদেশের খেটে খাওয়া মানুষ, যারা কাজের খোঁজে দেশত্যাগী হয়েছিলেন। শুধু ভারতই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশেই ছড়িয়ে রয়েছে এঁদের স্থাপিত বসতি। এদেশে সবচেয়ে বেশি এসেছেন মূলত ‘খ চিয়া হুয়া’ বা আমরা যাদের ‘হাক্কা’ বলি তাঁরা । ‘হাক্কা’ সম্প্রদায় প্রধানত এসেছেন দক্ষিণ-পশ্চিম চিনের ফুচিয়ান, চিয়াংসি, সিচুয়ান, কুয়ানতং ও কিছুটা সাংহাই থেকে আনুমানিক দুশো বছর আগে। সাবেক কলকাতার বৌবাজার থেকে ট্যাংরা অঞ্চলে এঁরা থাকতে শুরু করেন। এঁদের পূর্বপুরুষ চা ব্যবসায়ী তুং আছিউ ১৭৭৮ সালে কলকাতায় এসে বজবজ অঞ্চলে চিনির কল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কোম্পানীর কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে। ১৭৮১ সালে ‘হিকির গেজেট’ জানাচ্ছে, সে সময় ক্যান্টন থেকে কলকাতায় জাহাজে প্রচুর চিনা দ্রব্য আসত। কলকাতার ‘চিনা বাজার স্ট্রিট’ বা সাবেক তেরিত্তি বাজার, বর্তমানে টেরিটি বাজার এলাকায় এইসব চিনা মাল বিকিকিনির সুবাদে চিনাদের বসতি গড়ে ওঠে। ক্রমশ চিনা মানুষের আসা-যাওয়া চলতে থাকে এবং ১৯১০ সাল নাগাদ ট্যাংরা অঞ্চলে চিনাদের বড় বসতি তৈরি হয় চামড়ার ট্যানারিকে কেন্দ্র করে। চিনের প্রান্তিক প্রদেশের এক বড় সংখ্যক চিনা মানুষ ট্যাংরায় শুরু করেন চামড়ার ব্যবসা।
সবচেয়ে লক্ষণীয় হল এই চিনা কমিউনিটির প্রায় নব্বই শতাংশ অধিবাসী ‘পুতং হুয়া’ বা ‘ম্যান্ডারিন’ চিনে ভাষা বলতে পারেন না। এঁরা বেশিরভাগই ‘ক্যান্টনিস’ বা ‘কুয়ানতং হুয়া’ বলেন। এঁরা যে সময়ে এদেশে এসেছেন তখন ‘ম্যান্ডারিন’ ভাষার চল প্রাদেশিক অঞ্চলে ছিল না। ১৯৪৯-উত্তর কমিউনিস্ট চিনে প্রাদেশিক মানুষদের মধ্যে বাধ্যতামূলক ভাবে ‘ম্যান্ডারিন’ ভাষার প্রচলন হয় একমাত্রিক ভাষা সংযোগের জন্য। দীর্ঘকাল কলকাতায় বসবাসের সূত্রে এঁরা শিখে নিয়েছেন হিন্দি, ভাঙা ইংরাজি ও বাংলা।
কালের প্রবাহে কলকাতায় অনাবাসী চিনাদের সংখ্যা বর্তমানে অনেকটাই কমে গেছে। বহু চিনা সচ্ছল জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছেন সিঙ্গাপুর-, কানাডা-সহ চিনের মূল ভূখণ্ডে। কলকাতা শহরে বসবাসের সূত্রে ১৯৪১-এ চিন-জাপান ও ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের ফলস্বরূপ আজও চলতে থাকা চিন-ভারত রাজনৈতিক টানাপোড়েনে এঁদের বহু দুর্ভোগ পোয়াতে হলেও এঁরা কলকাতা শহরের আস্তানা ছাড়েননি। টেরিটি বাজার অঞ্চল ও ট্যাংরাতে শুধু এঁরা ব্যবসাই করেননি, ছোটো মফস্বল শহরে অনেকে হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তারিও করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জীবিকা নির্বাহের জন্য কলকাতার মতো ভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পরদেশী শহরে নানান ব্যবসা করলেও এঁরা তাঁদের নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস ও লোকায়ত সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো পালন করেছেন বা করে আসছেন রীতি মেনে। চিনাদের এও এক ধরনের নিজস্বতা। বলা যায় এটা ‘চুং কুও’ বা ‘মিডল কিংডম আত্মাভিমান’—যেখানেই থাকবে সেখানেই নিজ দেশের বাৎসরিক উৎসব পালন করবে। প্রবাসী চিনাদের ভারতে আসা-যাওয়া, তাঁদের এই শহরে বসবাস এবং নিজেদের মানিয়ে নেওয়া – এই সব তথ্য ‘কলকাতার চিনে পাড়া’ বইটিতে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। তবে আর একটু চিনা দেশাচার ও সংস্কৃতি নিয়ে চর্চার প্রয়োজন ছিল মনে হয়। যাই হোক, পরবাসী চিনা কমিউনিটির সঙ্গে মিশে বিজয় যে এক সংবেদী কথোপকথন গড়ে তুলেছেন তা এই বইটির সম্পদ। অবশ্য এ কথাও বলা প্রয়োজন যে এই অনাবাসী চিনারা কলকাতা শহরে ব্যবসাসূত্রে যথেষ্ট রোজগার করলেও মাইনরিটি হিসাবে সুবিধা ভোগ করেন। অথচ একটিও পয়সা এলাকার উন্নয়নে খরচ করেন না। এঁরা চিনা সনাতনী রীতিনীতি, প্রথাচার, উৎসব পালন করলেও সামগ্রিকভাবে চিনা নান্দনিক চেতনা ব্যবহার করতে পারেননি। তাই কলকাতার চিনা পাড়া নোংরাই থেকে গেছে। কলকাতার চিনা অঞ্চল সিঙ্গাপুর বা আমেরিকার চিনা টাউন হয়ে উঠতে পারেনি। বিজয়ের বইতে অবশ্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে ‘উলোং’ বা ‘ড্রাগন উৎসব’ আর ‘উশি’ বা ‘সিংহ উৎসব’। শুধু তাই নয় লেখক চলে গেছেন বজবজের আছিপুর, ‘তুং আছির’ উদ্দেশ্যে পালিত উৎসবে। সতত চারণিক বিজয় বহু দিন ঘুরেছেন শুধু ট্যাংরাতে নয়, কোন্নগর থেকে খুব ভোরে চলে এসেছেন পোদ্দার কোর্ট সংলগ্ন টেরিটি বাজারে সকালের চিনা খাবারের মার্কেটে। এই সূত্রেই খুঁটিয়ে বিবরণ দিয়েছেন বিভিন্ন চিনা খাবারের। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল এই খাবারের বিক্রেতাদের জীবনবোধ থেকে ব্যক্তিমানুষের চরিত্র বর্ণনা। আলোকচিত্রী বিজয় চরিত্র বিশ্লেষণে প্রায় সত্তর শতাংশ কাজ সেরে ফেলেছেন তাঁর আলোকচিত্রে। তিনি তুলে ধরেছেন চিনা সনাতনী ‘জুয়া মাচিয়াং’-এর আড্ডার দৃশ্য থেকে নামসুন কবরস্থান ও লরেন্স, জো, স্টেলা চেন, মনিকা লিউ-এর মতো চরিত্রগুলো। সবচেয়ে দাগ কেটে যায় ভাটিয়ার মতো মানুষের চরিত্র বর্ণনার দক্ষতা। ‘মাচিয়াং’ নিয়ে আমার একটা বিশেষ আকর্ষণ আছে। চিন দেশে বসবাসের সময় আমি নিজেও মাচিয়াং আড্ডায় যোগ দিতাম। দেখেছি এটা একটা নিছক জুয়া নয় – বরং এক কমিউনিটির যৌথ যাপন ও সংলাপের মাধ্যম মাত্র।
এই বইটির আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল অসামান্য মানব চরিত্র বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে এ শহরে চলে আসা চিনা মানুষের যাপন চিত্রকে শুধু লেখার মাধ্যমে নয়, বিচিত্র আলোছায়ার দ্বান্দ্বিক সম্পাতে এদের প্রান্তিক অবস্থানকে তুলে আনা। শুধু তাই নয়, বিজয় তাঁর গদ্যে তুলে ধরেছেন আমাদের প্রতিবেশী দেশ থেকে চলে আসা এইসব মানুষদের জীবনে চিন-ভারত রাজনৈতিক টানাপোড়েনের নেতিবাচক প্রভাবকেও। বিজয় এই পরদেশীদের সঙ্গে নিবিড় ভালোবাসায় গড়ে তুলেছেন এক সংবেদি সম্পর্ক, যার প্রত্যক্ষ স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর লেখায়।
‘সুরেন হাওপানসি’ — একটি চিনা প্রবাদ, অর্থাৎ ‘স্বজন সঙ্গ সর্বদা স্বাস্থ্যকর’। এই প্রবাদকথাকে অক্ষরে অক্ষরে হৃদয়ে স্থাপন করে বিজয় এই প্রান্তিক অবস্থানে থাকা প্রবাসী জনভূমিতে ক্যামেরা নিয়ে নিছকই ভ্রমণ করেননি, ঠিক যেন স্বজন সঙ্গ করেছেন এবং আমাদের উপহার দিয়েছেন এক মানবিক দলিল।
প্রতিবেশী হয়েও এতদিন ধরে অচেনা বঙ্গীয় চিনা সমাজের অজানা জীবন চিত্রকে সাধারণের সামনে তুলে ধরে বিজয় একটি জরুরি কাজ সম্পূর্ণ করলেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এই বইটি শুধু সাধারণ পাঠকই নয় চিন-ভারত সম্পর্কিত গবেষণার কাজে যুক্ত গবেষকদেরও কাজে লাগবে।