সবুজ বাতিজ্বলা কাচের ঘরটার নাম লাইটহাউজ। না না, হোয়াটস্যাপ। কথা হয় মা আর মেয়ের। দুই শহরে থাকে মা মেয়ে। সন্ধে সাড়ে সাতটার সময়ে তনুশ্রী মেয়েকে একটা সিনেমার লিংক পাঠাল। মিতুল দত্তের পরিচালনায় দ্য বাটন হোল।
সাড়ে আটটায় উশখুশ শুরু। পুতলি কেন চুপ। আবার খোঁচা দিল সবুজ বাতির দেশে... হালকা সবুজের আস্তরণে আঁচড় লাগল।
—তুই ওই সিনেমাটা দেখলি, পুতলি? তোকে লিংক পাঠালাম?
—কোনটা, মা, কোন গ্রুপে দিলি?
—ফ্যামিলি গ্রুপে দিইনি। বাবাকে দেখানোর কোন বাসনা নেই, তোকেই তো দিলাম।
—তাই, চেক করি তো ফোনটা। উহুঁ এটায় আসেনি ... আচ্ছা আ আ , অন্যটায় দিয়েছিস। উফ মা, ওটা আমার আগের ফোন নং। নতুনটায় দে। আমার এই ডিভাইসে ওটা আসেনা তো।
—ও হ্যাঁ তো । দেখেছিস কেমন ভুল করলাম? দিলাম এবার, দ্যাখ সময় করে। মাত্র ২৪ মিনিটের ছবি। মিতুল বানিয়েছে। একটা অ্যাবন—... ইয়ে মানে অটিস্টিক বাচ্চাকে নিয়ে।
—উফফ মা। তুই না। সব ভুলভাল করিস। আরেকটু হলেই অ্যাবনর্মাল বলতে যাচ্ছিলি ত? বল, স্পেশালি এবলড ।
—আচ্ছা আচ্ছা খবরদারি পরে করো মাম্মাম। দ্যাখ, আমিই এখন তোর কাছে রোজ শিখি। তুই আগে দ্যাখ ত, ছবিটা।
— কি দেখিয়েছে?
— একটা অ্যাডোলেসেন্ট স্পেশালি এবলড ছেলে...। বোতামঘরে বোতাম লাগাতে পারেনা।
— ওহ, তাই নাম বাটন হোল? ওক্কে!
— জানতিস? এইটে নাকি একটা সমস্যার জায়গা ওদের। আমি জানতাম না।
—আমি জুতোর ফিতে বাঁধাটা যে ওদের জন্য প্রবলেম সেটা জানতাম। ওকে ওকে, দেখছি। ফোন রাখছি।
—দেখিস কিন্তু। ভুলিস না।
—হুম। এখনই দেখে নি। পরে ভুলে যাব। সাইকল করছি, করতে করতে দেখি।
পুতলি এক্সারসাইজ সাইকল করতে চলে গেল। আধ ঘন্টা পর আবার মেসেজ করল।
দেখা হয়ে গেছে, মা।
তারপর সব চুপচাপ। ইতিমধ্যে তনুশ্রী নিজের কাজ সারল। বেসিনের জলে হাত দিলে হাত ছ্যাঁক করে ওঠার মতন ঠান্ডা। তবু আজ বাসন মাজতেই হবে। কলকাতার বাতাস হঠাৎ সন্ধের পর কিরকম ঠান্ডা হয়ে যায়। সন্ধেবেলা জলে হাত দিতে ইচ্ছে করে না। অথচ এখন কদিন মাজতে হবে। জয়ার স্বামী মারা গিয়েছে। অন্তত দু সপ্তাহ আসবে না জয়া। কাঁচের চুড়ি ভাঙার মত করে হাসা জয়ার, বাকি সময়ে খকখকিয়ে কাশা জয়ার... সত্যি এখন শাঁখাপলা ভেঙেছে। কে জানে ওকে এখন গ্রামের সমস্ত আত্মীয়কে খাইয়ে শ্রাদ্ধের আয়োজন করতে কত টাকা ধার নিতে হয়। শুনেছে এরকম ধারকর্জ করে লোক খাওয়ানোর প্রথা আছে আজো গ্রামের দিকে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এসে জয়ার ওপরে চড়াও হয়ে আর কী কী প্রায়শ্চিত্ত করায় ওকে দিয়ে, কে জানে।
তনুশ্রীর মনের মধ্যে হালকা উদবেগ। পুতলির কেমন লাগল সিনেমাটা। নিজের কিছু ভাল লাগলেই ও তার ভাগ পুতলিকে না দিয়ে পারে না। কিন্তু তার মানেই তো এই নয় যে পুতলির সেসব ভাল লাগবে।
অনেক দূরে চলে গেছে এমনিতেই মেয়েটা। শরীরে মনে। শহর পাল্টেছে, চাকরি নিয়েছে। রুচির দিক থেকে এখনো পুতলি তার মায়ের মত, এটা তনুশ্রী ধরে নিতে পারে কি?
না পারে না, হটবক্সে গরম রুটি ভরতে ভরতে তনুশ্রী ভাবছিল। এখন বানাল রুটিটা। ঠান্ডা জলের পর গরম তাওয়া। এবার আরাম আসছে শরীরে। খুব উষ্ণ লাগে। গ্যাসের ওপর গোল রুটিটাকে চিমটে দিয়ে ধরে দেখে রুটির ফুলে ওঠা৷ একটু একটু করে রুটির বুক থেকে বাষ্প বেরিয়ে যাচ্ছে।
নিজের দিকেও যেন একটা প্রশ্ন নিয়েই তাকিয়ে আছে ও৷ আমিও মা, সিনেমার ওই বাচ্চাটার মায়ের মতন৷ কেমন মা আমি? পুতলির রুচির কাছাকাছি আসবে বলে তনুশ্রী পুতলির সাথেই দেখেছে কত অ্যানিমে৷ কত কার্টুন ছবি৷ স্পাইডার ম্যান থেকে বার্বি। সবকিছুই দেখেছে। গত দশ বছরে। পুতলির সঙ্গে ভাগ করে। এখন দূর থেকেও পুতলিই ওর নানা দেখা রেগুলেট করে। ওর রেকো দেওয়া ওটিটি সিরিজ দেখে মন দিয়ে তনুশ্রী৷ একা একাই। তারপর তা নিয়ে কথাও বলে।
পুতলিকে মন্দ মা হবে না, কনট্রোলিং মা হবে না বলে, কখনো জিগ্যেস করে না, ওরে তুই কী খেলি। সময়ে খেলি কিনা। স্নান করা নিয়ে জেরা করে না। হায়দ্রাবাদে বসে পুতলি যা খুশি তাই খায় যখন খুশি ঘুমায়। অথচ এই কদিন আগেই চুল টেনে টেনে আঁচড়ে ওকে ইশকুলে পাঠানো ছিল তনুশ্রীর সপ্তাহের প্রতিটি দিনের রুটিনের প্রথম কাজ। ছোট্ট প্রেশার কুকারে চাল ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে সেই খিচুড়ি কয়েক চামচ মুখে ঠুসে দিত।
বেগুনের ঘ্যাঁট পাকাল আজ ও। জয়া নেই। দ্রুতহাতে রান্না সারতে হবে। যা কিছু একটা সহজ করে পারা যায় রেঁধে রাখবে। পুতলি বড় হয়ে দূরে চলে যাবার পর থেকে আর বেশি রাঁধতে ভাল লাগে না। শৌখিন রান্না তো নয়ই৷ সুব্রতর খাওয়াদাওয়া এখন মেপে। একবার সুগার ও প্রেশারের কবলে পড়লে ফিফটি প্লাস পুরুষের জীবন থেকে মিষ্টি তেল নুন সব চলে যায়। স্বাদহীন খাবারেই নাকি আছে মোক্ষ! রান্নার পর আবার ঠান্ডা জলে হাত দিতে হল বাধ্যতামূলক।
জল থেকে হাত তুলে হাত মুছল তনুশ্রী। বার্বি ডল তোয়ালেতে। পুরনো বলে রান্নাঘরের ন্যাতা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই তোয়ালেটাও পুতলির। বার্বি আঁকা তোয়ালেটা পুতলির ছোটবেলার স্মৃতিচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। শুধু খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেছে পাখি। বাসা খালি। বুড়োবুড়ি দুই পাখি বসে বসে রোমন্থন করে। রোজ হোয়াটস্যাপে পুতলির কলের জন্য হা পিত্যেস। অনেক সময় পুতলি ফোন ধরেই না দিনের পর দিন। আজ মিতুলের ছবি ওর কেমন লেগেছে জানার উৎকন্ঠাতে তনুশ্রী হাত মুছতে মুছতেই ফোন করে ফেলল। আজ আর তর সইছে না।
কেমন লাগল? ছবিটা।
ভাল মা।
পুতলি কথা বলার মুডে নেই? তবে কি ওর ভাল্লাগেনি?
কয়েক মিনিট কাটল।
তনুশ্রী টেবিল সাজিয়ে ফেলল। এবার ও গিয়ে একটু বসবে। বসার কোন ফুরসত পায় না কখনো, কেন যেন... সারাক্ষণ যন্ত্রের মত কাজ করেই যায় করেই যায়। বই, ম্যাগাজিন, টিভি৷ কিছু ওকে বসিয়ে রাখতে পারে না৷
পুতলি আবার লিখল।
মা যে সেজেছে, সে তো তোমার ফেসবুক ফ্রেন্ড? সঞ্জিতা?
হ্যাঁ তুই চিনে ফেললি?
হুঁ ছবি দেখেছি৷ আর, স্পেশালি এবলড বাচ্চাটার রোলে যে ছেলেটা করেছে ও কী করে এত ভাল অ্যাক্টিং করল কে জানে। দুর্দান্ত।
ইয়েস দুর্দান্ত।
আচ্ছা উনি, মানে ডিরেক্টর, কি কোন স্পেশালি এবলড বাচ্চাকে দেখেছেন?
হ্যাঁ, ওর এক আত্মীয়ের ছেলেকেই... সেজন্যেই বানিয়েছে। ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স রে।
ওহ, তাই!!! এত্ত ডিটেইলড আর ভীষণ সেন্সিটিভ। তবে মায়ের রোলটা... একটু ভাবাল।
মানে? পছন্দ হল না?
না না। পছন্দ তো খুবই হল। কিন্তু অবাস্তব। আইডিয়ালিস্টিক। ওরকম ভাল মা, হয়?
হ্যাঁ, ঠিকই কিন্তু আইডিয়ালকেও তো কোন কোন জায়গায় দেখাতে হয়, না, সোনা? জাস্ট টু সেট অ্যান একজ্যাম্পল?
হুম। আসলে আমরা তো দেখি, সো কলড নর্মাল ছেলেমেয়েদের সেক্সুয়ালিটি নিয়েই বাবা মায়েরা যা ভয়ানক অবসেসড, যা রিপ্রেশনের মুখোমুখি হয় তারা, সেখানে প্রাইভেট টাইম অ্যালাউ করছে একটি স্পেশালি এবলড বাচ্চার মা? এতটা প্রগ্রেসিভ? আরেকটা দারুণ লেগেছে, মা এখানে সিংগল মাদার। সিংগল হ্যান্ডেডলি পেরেন্টিং করছে।
আরে হ্যাঁ, আর বাবাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখেছে। বাবা মায়ের ঝগড়াটা আছে অ্যাজ এ ব্যাকড্রপ কিন্তু সেটা এই ছবির বড় বিষয় না।
ঠিক। বাবা ছাড়া ওরা কীভাবে থাকে, মা কী চাকরি করে সব বলা নেই৷ বিষয়গুলো আন্ডার স্টেটেড। কিন্তু দেখতে তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। অন্তত আমার হচ্ছে না। অন্য দর্শকদের হবে না তো?
কে জানে। ইভলভড দর্শক হলে হবে না। তোর মত কমবয়সী, এখনকার ছেলেপিলেদের হবে না। মনে হয়। নিশ্চিত এই ছবি একটা মেসেজ দিচ্ছে পুতলি... যে লেখাপড়া শেখা, ইভলভড মায়েদের এরকম হতে হবে। হওয়া উচিত। শেষটা দেখলি তো? অদ্ভুত একটা ইউনিভার্সাল ব্যাপার আছে না? পজিটিভ এন্ডিং। একটা ভিক্টরি। জয়। নিজের দুর্বলতা থেকে উঠতে আমরা তো সবাই চাই। কোথায় যেন সব টিনেজার বাচ্চাদের জন্যেও এটা পজিটিভ মেসেজ, তাই না, বল?
একদম। তনুশ্রী ভাবছিল, এই মুহূর্তে পুতলির অন্য কাজ চলছে। সামনে ল্যাপটপ খোলা। ও কিছু লিখছে। কাজ করছে। মাল্টি টাস্কিং করছে। মনশ্চক্ষে ও পুতলিকে দেখছিল। সোফা ছেড়ে উঠে তনুশ্রী আবার ঘুরছিল ঘরের মধ্যে। টুকটাক জিনিস গোছাচ্ছিল। সারাক্ষণ তনুশ্রী কিছু গোছাচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে গোছাচ্ছে। গোছাতে গোছাতে ভাবছে। পুতলির খাট গোছাতে পারছে না বলে ওর মন ছটফট করছে। ভিডিও কলে পুতলি এলেই খাটের ওপর রাখা স্তূপ স্তূপ জামাকাপড়, বই, ল্যাপটপ এটা ওটা সেটা দেখলে ওর অ্যাংজাইটি হয়।
আবার লিখল তনুশ্রী।
— নর্মাল বাচ্চারাও তো ট্রোলড হয়। হয় না?
— নর্মাল বলতে?
—তুই, আমি।
— আসলে নর্মাল বলেই কিছু নেই, মা। নর্ম ব্যাপারটাই গোলমেলে। সবাই আমরা একটা স্পেকট্রামে আছি। কেউ বেশি কেউ কম... সবাই আমরা অস্বাভাবিক। সো কলড অস্বাভাবিক।
—হ্যাঁ মিতুল সেটাও আমাকে বলছিল। চুপচাপ, মিশতে পারে না, এরকম ছেলেদের মারাত্মক ট্রোলড হতে হয়। একটা স্বাভাবিক বাচ্চা ছেলে, তাকে ভুলভাল বুঝিয়ে, মাস্টারবেট করতে বাধ্য করে, ড্রোন দিয়ে তা শ্যুট করে নেটে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। করছে তারই ক্লাসের ছেলেরা। এই কদিন আগে যাদবপুরে যে বাংলা বিভাগের ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেটি মারা গেল... তাকেও "অস্বাভাবিক যৌনতা" বলে দাগিয়ে দিয়েছিল নাকি সিনিয়ররা... বাধ্য করেছিল নগ্ন হতে... 'ওটা' দাঁড়ায় কিনা দেখাতে।
যেন এই সেদিন অবদি তনুশ্রী পুতলিকে দাঁত মাজিয়ে দিত। আরো কদিন আগেও ঠেলে স্নানে পাঠাত। তনুশ্রী অবাক হয় মাঝে মাঝে। মেয়েটা এত বড় হয়ে গেল এখন? অবাধে এত নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা চলে ওদের মধ্যে। তনুশ্রী আর তনুশ্রীর মায়ের মধ্যে তো এমন ছিল না। সেখানে তো যুগ যুগান্তব্যাপী নীরবতার কালো অন্ধকার ক্রেভিস। খাঁড়ি।
—হ্যাঁ মা। Being bullied is a common story for every "weird" kid... সবাই বুলিড হয় কম বেশি। আমিও খুব উইয়ার্ড ছিলাম মনে হয়, জানিস! Happened to me... আমারও এরকম অভিজ্ঞতা আছে।
পুতলি মাকে তুই বলে ডাকে। তুই তুই করে মায়ের সাথে কথা বলাটা ওদের ইন্টিমেসির অঙ্গ এখন।
— তোর বুলিড হবার অভিজ্ঞতা? সেই ক্লাস ওয়ানে তোদের ক্লাস থ্রি এর একটা মেয়ে পেন্সিল দিয়ে খুঁচিয়েছিল সেই ঘটনাটা?
—না না, সেটা তো কিচ্ছু না। আরেকটা ব্যাপার ছিল। তোকে বলিইনি কখনো!
—সেকি। কী, বল।
—ওই একটা বড়সড় চেহারার মেয়ে পড়ত আমাদেরই ক্লাসে। লপিতা। ও একবার আমার আর পরির সঙ্গে টয়লেটে গিয়ে বলেছিল আমাদের জাঙ্গু খুলে দেখাতে। থ্রেটেন করেছিল প্রায়। ক্লাস থ্রিতে পড়তাম তখন!
তনুশ্রী কাপড় ভাঁজ করে রাখতে রাখতে হঠাৎ জানালার সামনে ফ্রিজ হয়ে গেল। পুতলির কথাটা শুনে... একটা ধাক্কা লাগল। চব্বিশ বছর বয়স অব্দি পুতলি কোনদিন শেয়ার করেনি... মায়ের সঙ্গেও। আর ও, নিজে? সেই ঘটনাটা মনে পড়া মাত্র শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ভয়, অস্বস্তি, ঘেন্না বয়ে গেছে। এই কথাটা এই মুহূর্তে শেয়ার করতে পুতলির সাথেও পারবে না তনুশ্রী। ওর পাঁচ বছর বয়সে বাড়ির কাজের লোক গোবর্ধন মায়ের অ্যাবসেন্সে ওকে সেক্সুয়ালি অ্যাব্যুজ করেছিল। করত নিয়মিত। চলো একটা খেলা খেলি, বলে ওর ওপর শুয়ে পড়ত গোবর্ধন। সেই গা ঘিনঘিনে অনুভূতিটা হঠাৎ ফিরে আসতেই সপাটে তাকে এক ঝটকায় আবার মনের গহন কোণে পাঠাল সে।
—ও মাই গড। সে কি। তুই বলেছিলি অন্য একটা গল্প। আরেকজন ছিল, তোর ব্যাগ জানালা বা বারান্দার বাইরে ঝুলিয়ে বলত ফেলে দেবে।
—না এটা বিচ্ছিরি। লিখতে গিয়েই আমার কান্না পাচ্ছে। লপিতা পরেও ক্লাসের মধ্যেও বুলি করত। আমি একবার ডিফাই করেছিলাম। তখন আমাকে অন্য চ্যালাদের সামনে হিউমিলিয়েট করেছিল।
— ওহ। বুলির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খুব কঠিন। তুই পেরেছিলি সেইজন্য এখন তোকে একটা আদর।
মা মেয়েকে লাভ ইমোজি দিল।
—আমি এখন বুঝতে পারি লপিতাকে বাড়িতে কেউ অ্যাবিউজ করত। ওর জাঙ্গু খুলে কেউ হয়ত দেখতে চাইত। সেইটা ও আমাদের অ্যাগ্রেস করার মধ্যে দিয়ে বার করে দিত। অ্যাগ্রেশনের ভিক্টিম ও-ই ছিল। ডেফিনিটলি ছিল৷
অনেকক্ষণ চুপচাপ। মা মেয়ে দুজনে নিজের কাজ করে। তনুশ্রী পর্দা টেনে দিতে দিতে বাইরের জলো আলো দেখে। কুয়াশার জন্য সব আলোকে জলঢালা দেখাচ্ছে আজ। কান্না পায় কেন যেন। বুকটা ভার ভার লাগে। ইস্কুলের মাঠের ঘাসের গন্ধটাও যেন হঠাৎ ওর কাছে এসে গেছে। ও ছুঁতে পারছে কমলালেবুর খোসা রিং করে করে ছুলে তাই দিয়ে সাপ বানানোর সেই দিনগুলো। পরস্পরের চোখে কমলালেবুর খোসা থেকে রস চিপকে দিয়ে জ্বালা ধরানোর কথা মনে পড়ছে। চোখের কোল জ্বালাজ্বালা করে উঠছে তনুশ্রীর।
—ইস্কুলে আসলে আমি কিছু বুঝতামই না, কেমন যেন ন্যালাক্যাবলা ছিলাম... জানিস পুতলি। ক্লাস ওয়ান বা টুতে, ক্লাসের কোন ইনস্ট্রাকশন ফলো করতে পারতাম না। টিচাররা যা বলতেন সেগুলো কেমন মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেত। তারে জমিন পরের বাচ্চাটার মতন ডিসলেক্সিক টাইপ ছিলাম...
—মা, ডিসলেক্সিয়া খুব কমন । ইনফ্যাক্ট মনে হয় আসলে কেউই নেই এমন যে ছোটবেলায় সব ব্যাপারে পুরোপুরি সমান এগিয়ে গেছে ... আমিও তো খেলাধুলোয় খুব খারাপ ছিলাম। কারণ খেলার রুলস ফলো করতে পারতাম না।
—আমিও! ঠিক। আর লেফট রাইট কোঅর্ডিনেশন খারাপ ছিল। আমি তো বাঁ-হাতি। তাই বোধ হয় রাইট বললে বাঁ-পা ফেলতাম। ক্লাস শুদ্ধ সবাইকে নিয়ে স্পোর্টস-এর সময়ে মার্চ পাস্ট হত। আমাকে প্রায়শ ওই মার্চ পাস্ট থেকে বের করে দেওয়া হত, পা মেলাতে পারতাম না বলে।
— ওহ ভাল জিনিস মনে করিয়ে দিলে। পিটি ক্লাস! আমার পিটি ক্লাস ভাবলে এখনো বমি বমি পায়, মা।
— আমি তো ক্রাউডের সঙ্গে, বা কোন রেজিমেন্টেড গ্রুপের সঙ্গে পা মেলাতে আজো পারি না, জানিস তো পুতলি!
—উফফফ মা, এ টা কি বললে। এক্সট্রিমলি ডিপ কথা বললে। সেইজন্য তুমি ডিফারেন্ট। সেইজন্য তুমি অন্যদিকে অনেক কিছু করতে পেরেছ।
—কী জানি!
—কী অদ্ভুত একটা আরামের কথাবার্তা হচ্ছে মা। আচ্ছা, তুই তো আমাকে কোনদিন এসব বলিসনি! আমাকে তো এখন শর্মিলা অনেক খেলা শিখিয়েছে। এই বড় বয়সে। আমি যে এখন রোজ ওয়ার্ক আউট করি, স্ট্রেচ করি, অ্যাব এক্সারসাইজ করি, সেগুলো শর্মিলার অবদান। স্কুলে আমি ওই ইনস্ট্রাকশন ফলো না করতে পারার জন্যই কত্তো কিচ্ছু খেলা থেকে বাইরে থাকতাম।
শর্মিলা পুতলির পি জির বন্ধু। দুজনেই এক সাথে হায়দ্রাবাদে চাকরি করছে। নাহ, ওই প্রজন্মের ভাষায়, 'জব' করছে। সারারাত ল্যাপটপ খুলে বসে থাকাই ওদের জব করা। অনেকদিন হল এইরকম হয়ে গেছে কাজের পৃথিবীগুলো।
—আমিও একা সিঁড়িতে বসে অন্যদের খেলা দেখতাম। বন্ধুরা কিতকিত খেলত। মাটিতে চক দিয়ে ঘর কেটে, সেপ্টিপিন ছুঁড়ে ছুঁড়ে এক পায়ে লাফানোর সেই খেলা। নিয়মকানুন আমি কিচ্ছু বুঝতে পারতাম না। লাফাতেও পারতাম না বোধ হয়। ওখানেও লেফট রাইট কো-অর্ডিনেশনের ব্যাপার ছিল একটা। পরে ওরা থ্রো বল খেলত, খো খো, ডজ বল। অনেক কিছু। সবেতেই আমি ঢ্যাঁড়া। দ্রুত আউট হয়ে যেতাম। রিফ্লেক্স নিশ্চিতভাবেই খুব খারাপ ছিল। খুব খুব।
—ঠিক। আমার তো ওই প্রবলেমটা ছিল না। বাঁ ডান নিয়ে। আর এখন তো তুইও কি দারুণ যোগা করিস। বাঁ ডানের কো অর্ডিনেশনের কোন প্রবলেম তো নেই!
— হ্যাঁ বাই দ্য ওয়ে যোগা ম্যামের লাস্ট মেসেজ দেখেছিস? কালকের ক্লাস হবে না। তুই কেন উইকে দুদিনের বদলে একদিন করে নিলি বল ত! বেশ দুজনে দুদিন এক সাথে করতাম। এক ঘন্টা হলেও তোকে দেখতে পেতাম। বেশ একটা গ্রুপের মধ্যে থাকা, সোশ্যালিও এনগেজিং ব্যাপার।
—মা, তুই আবার আমাকে ডিক্টেট করছিস। মা গজাচ্ছিস!!! হি হি! আমার অন্য এক্সারসাইজও আছে তো। করছি তো সবই।
—স্যরি স্যরি মাম্মাম! আবার মা গিরি শুরু করেছি। আচ্ছা করব না, বেশ৷ তা, দেখা যাচ্ছে, যে তোর আমার দুজনেরই খেলাধুলোর ব্যাপারটাও লেটে! ... দেরিতে সব কুঁড়িগুলো ফুটেছে আমাদের। শুরুতে অদ্ভুত ছিলাম আমরা, হা হা হা। ইস্কুলে আমাদের আরেকটা বিশাল ঝামেলার জিনিস ছিল। সেলাই ক্লাস। ওখানেও এক প্রবলেম। সূচ সুতো ধরা। বাঁ হাতে ধরতাম আর টিচাররা জোর করে ডান হাতে ধরাতেন । আর উল বোনা। উল বোনা তো পুরোটাই ডিজাইনড ফর ডানহাতি মানুষ। বাঁ-হাতিদের জন্য উল বোনার রুলসগুলোকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে।
—কিন্তু এখন তো তুই খুব সেলাই করিস মাম্মা।
—বড় হয়ে দেখলাম সেলাই দারুণ মজার জিনিস। মা, দিদুকে সর্বক্ষণ সেলাই করতে দেখেছি তো।
—ঠিক। নিজে শিখলি। স্কুল থেকে না।
—হ্যাঁ অধিকাংশ লাইফ লেসন বাইরেই শেখা বুড়ি। স্কুল জীবন মোটেই সুখের ছিল না রে আমার। তবে আমার মনে হয়, আমরা পারিবারিকভাবে সবাই একটু হ্যালহেলে টাইপ ছিলাম ছোটবেলায়।
— হ্যাঁ মা। I was a square peg in a round hole...
—হ্যাঁ বেখাপ্পা। মিসম্যাচ। সামাজিকভাবে অচল।
— তোরাও ছিলি, এটা আমি জানতাম না। বুঝতাম না। ছোটবেলায় তো বাচ্চারা ভাবে তাদের বাবা মা সব পারে।
—অল পাওয়ারফুল। সর্বগুণসম্পন্ন।
— তুই বলিস তাই এখন বুঝি আমরা একইরকম। তোরটা জানলাম। আর বাবারটা আগের থেকেই বুঝি। বাবা এখনো ভুলো টাইপ। অসামাজিক। সোশিওপ্যাথ!
—ছেলেরা অনেকেই অ্যাফোর্ড করতে পারে। মেয়েরা পারে না। বাচ্চার জন্ম হলেই মাতৃত্ব এলেই৷ সমাজ তাদের একটা খোপে ঢুকিয়ে দিয়ে কনফর্ম করতে বাধ্য করে । মা হিসেবে একটা ছাঁচে ভরে দেয়। তাইজন্য আমিও।
—এখন তো আর তুই রাউন্ড পেগ ইন এ স্কোয়ার হোল নেই।
— না না, এখন আমি স্মার্টুস!!! ছোটবেলায় যা যা পারিনি এখন সব পারি।
—ইয়েসসস।
হঠাৎ হেসে ফেলল তনুশ্রী। আরেকটা গল্প মনে পড়ে গেছে।
এই জানিস? আমাকে ক্লাস ওয়ানে একটা মেয়ে বলেছিল তোর বাবাটা নাকি মরে ভূত হয়ে গেছে? কী পাকা ভাব!৷ আর কী র্যুড, অসভ্য! আমি রেগে রেগে উত্তর দিয়েছিলাম, না আমার বাবা স্বর্গে চলে গেছে, স্বর্গ থেকে আমাকে দেখছে, তুই কিচ্ছু জানিস না।
—ইশ মা! তোর ওই বন্ধুটাকে পেটাতে ইচ্ছে করছে। কী খারাপ!
—হ্যাঁ ও লম্বা চওড়ায় আমার চেয়ে অনেকটা বড় ছিল।
গলা জড়াজড়ি করে আদরের ইমোজি পাঠাল পুতলি। আই অ্যাম ফিলিং ভেরি প্রোটেক্টিভ অ্যাবাউট ইউ, মা!
— বাচ্চা আমি-র ব্যাপারে?
—হ্যাঁ। যাই আমি এবার ডিনার খাই। গুন্নাইট। তোর খাওয়া হয়ে গেছে?
—এবার খাব।
— কী খাবি?
—রুটি বেগুনপোড়া। তুই?
—টোফু দিয়ে তরকারি আর ভাত।
—বাহ, ভাত খাচ্ছিস। বেশ।
—না না দুপুরেই র্যামেন নুডলস খেয়েছিলাম তো। হা হা হা।
খাবার ঘরে এসে তনুশ্রীর কান্না পাচ্ছিল। ও দেখতে পাচ্ছিল। চব্বিশ বছরের পুতলি ছ বছরের তনুশ্রীকে গলা জড়িয়ে আদর করে দিচ্ছে।