বৃষ্টি আবার বাড়ল। ল্যাপটপের আলোকিত পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে পাশের জানলা দিয়ে অনেক নীচের দুরন্ত বেগে বয়ে যাওয়া নদীটার দিকে তাকালেন প্রফেসর অন্বেষ সেন। এই বৃষ্টি ভেজা শেষ বিকেলে আর একটা কফির অর্ডার দিলেন তিনি। আজ সকালেই দিল্লী থেকে দেরাদুন বিমানবন্দরে নেমে সটান একটা গাড়ি নিয়ে পৌঁছেছেন উত্তরাখণ্ডের ‘লঙ্গাসু’ নামের পাহাড়ি জনপদের খাদের একেবারে কিনারঘেঁষা এই রেস্তোরাঁটিতে। একটু যেন চিন্তা নিয়ে সামনের রাস্তার দিকেও একবার তাকালেন তিনি। উরভির পৌঁছতে এত দেরি হচ্ছে কেন? রাস্তায় কোথাও আটকে গেল নাকি? ইন্সটিটিউটে তার প্রিয় ছাত্রী ছিল উরভি। রিটায়ারমেন্টের পরে প্রফেসর নিজে এখন একটা গ্লোবাল ওয়ারমিং-এর আন্তর্জাতিক প্রজেক্টে কাজ করছেন। ভারতে তার পাইলট ফেজে প্রফেসরের সঙ্গে কাজ করার জন্য উরভিকেই নির্বাচিত করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা। ও এখন আসছে ওর কর্মস্থল কলোরাডো থেকে।
একটু আগে বিদ্যুৎ চলে গেছে। মোমবাতির আবছা আলোতে অস্পষ্ট দেখলেন একজন বিদেশি মানুষ কাউন্টারে এসে অধৈর্য ভঙ্গিতে পিৎজা, স্যান্ডুইচ ইত্যাদি চাইছে। অ্যাক্সেন্টে আমেরিকান বলেই মনে হল। রুটি সবজি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না শুনে ব্যাজার মুখে তাই অর্ডার দিয়ে একটা খাম্বার পেছনের টেবিলে বসে পড়ল। তাকে দেখা না গেলেও কিছুক্ষণ পর প্রফেসর শুনতে পেলেন, চলে যাবার সময় মানুষটি কাউন্টারে জিজ্ঞেস করছে ‘গরসন যেতে এখান থেকে কত সময় লাগবে?’ শুনে খেয়াল হল আরে তাদেরও তো ওইদিকেই যেতে হবে।
সঙ্গের পোর্টেবল ওআই-ফাই থেকে নেটওয়ার্ক যতটুকু আসছে তাতে প্রফেসর দেখলেন দুটো হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজ এসেছে। একটায় উরভি লিখেছে রাস্তায় একটা ছোট্ট ধ্বস নামাতে পৌঁছতে দেরি হচ্ছে। অন্যটা এসেছে একটা অজানা নাম্বার থেকে। তার বাংলা তর্জমা খানিকটা এইরকম- ‘পাহাড় থেকে নামবি / হুমড়ি খেয়ে পড়বি / মারবো বরফ ঢেলা / জীবন নিয়ে পালা’।
সাহেব চলে যেতেই উরভির গাড়ি এসে থামল সামনের রাস্তায়।
******
এই জলবিদ্যুৎ অফিসের গেস্ট হাউসের লনটি চমৎকার। চারদিকের পাহাড়ের চুড়োতে বরফের মুকুট সকালের রোদ পড়ে ঝক ঝক করছে। নেমে আসা হিমবাহগুলো যেন মাঝপথে ঝুলছে। দরকারি কিছু কাজ সেরে এখান থেকে রওনা দিতে হবে আরও ওপরে হিমবাহের উৎসের দিকে।
তাদের এবারের কাজ হল, হিমালয়ের হিমবাহগুলোর পশ্চাদপসরণের জন্য গ্রিন-হাউস গ্যাস কতটা দায়ী সেটা জানা। এই গ্যাসের নিঃসরণের জন্য বিশ্ব উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠছে। স্নো-লাইন ওপরে উঠছে আর হিমবাহের বরফ গলে বন্যা হচ্ছে। এর ফলে নানাভাবে ধ্বংসাত্মক ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ।
কলোরাডোর মাইনিং স্কুলে ইউ-এন স্পন্সরড এই গবেষণা হবে গ্লোবাল স্কেলে। যদি গত বেশ কিছু বছরের ক্লাইমেট ও অন্যান্য ডেটা নিয়ে রিগ্রেসন মডেল বানিয়ে ভবিষ্যৎ উষ্ণায়ন বলা যায় তবে হিমবাহের বিপজ্জনক জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে বরফ গলে বিপর্যয় আটকানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা করা যাবে। এরকম গবেষণার জন্য বিশ্বের প্রায় সমস্ত জায়গার হিমবাহ থেকে ফিল্ড-ডেটা প্রচুর দরকার। সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা কাজটা করবেন। প্রফেসর সেনের নেতৃত্বে প্রজেক্টের পাইলট ফেজ শুরু হচ্ছে ভারতের উত্তারাখন্ডে, হিমালয়ের হিমবাহতে।
প্রাতরাশের জন্য চৌকিদারের ডাক শুনেই জগিং শেষ করলেন সেনসাহেব। এই ঠাণ্ডাতেও তাঁর ছফুটের মেদহীন শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসতেই উরভি বলল, ‘স্যার একটু আগে ডঃ মরিসের একটা ইমেল এসেছে আপনার কাছে। আমাকে কপি পাঠিয়েছে। দেখে নেবেন।’
******
ডঃ মরিসের কাজটা গ্লেসিওলজি নিয়ে। কলোরাডো স্কুলের মাইনস নিউজ রুমে তার একটা প্রজেক্টের আলোচনা এবারে খুব আলোড়ন তুলেছে। গ্লোবাল ওয়ারমিং-এর জন্য তাপমাত্রা কত বাড়লে হিমবাহের কতটা বরফ গলবে সেটারই সঠিক পরিমাপ করার জন্য একটা মডেলিং সফ্টওয়্যার বানিয়েছেন তিনি। এই সফ্টওয়্যার লোড করে একটা ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রও বানানো হয়েছে যেটার সাহায্যে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে যে অজস্র হিমবাহ ছড়িয়ে আছে, অ্যাডভান্সড মাস ব্যালেন্স মেথডের সাহায্য নিয়ে বের করা যাবে তাদের সম্ভাব্য গলন ও প্লাবনের হিসেব। এছাড়াও হিমবাহ গলা জলে যে অজস্র গ্লেসিয়াল লেক বা হিমহ্রদ তৈরি হয়েছে, পরিমাপ করা যাবে, তাদের ক্যাচমেন্টে জলের আয়তন। বলা যাবে ক্যাচমেন্টের প্রাচীর কতটা শক্ত ও জলের ভারে তা ফেটে কোন বিপর্যয় হতে পারে কিনা। দুটি এরকম যন্ত্র আপাতত বানানো হয়েছে, তারই একটা নিয়েই দুজন ভুতাত্বিক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক প্রফেসর অন্বেষ সেন এবং তার ছাত্রী ডঃ উরভি এখন উত্তারাখন্ডের হিমবাহতে ফিল্ডওয়ার্ক করছেন। মরিস তার কাছে থাকা দ্বিতীয় মডেলিং যন্ত্রটির সাহায্যে হিমবাহে সংগৃহীত ডেটার একটা তাৎক্ষণিক স্টাডি করে উরভিদের ফিল্ডওয়ার্ক কিছুটা গাইডও করবেন।
এখন অনেক রাত, কলোরাডোতে ল্যাব থেকে বেরিয়ে হেঁটে নিজের ছোট্ট স্কলারস অ্যাপার্টমেন্টে যাবার সময় উরভির কাছ থেকে একটা মেসেজ এল মোবাইলে। তাতে লেখা ‘কাল থেকে কাজ শুরু হচ্ছে।’ আর রয়েছে কাজ সম্পর্কিত কিছু আলোচনা। প্রজেক্ট নিয়ে চিন্তা করতে করতে নিজের রুমের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হলেন মরিস। দরজাটা শুধু ভেজানো, লক করা নেই। তিনি কি ভুলে গেছেন লক করতে?
সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করাতে ও বলল ‘স্যার আপনি তো এসেছিলেন লাঞ্চে। লক করতে ভুলে গেছেন নিশ্চয়ই।’ চিন্তিত মনে নিজের ঘরে ঢুকলেন মরিস। তিনি তো ল্যাবেই লাঞ্চ করেছেন আজ। তবে এখানে কে এসেছিল? গার্ড তো তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ঢুকতে দেবে না।
ভেতরে ঢুকে আরও অবাক হলেন। টেবিলের ওপরে রাখা স্যাটেলাইট ম্যাপের প্রিন্ট-আউটটা নেই। এই ম্যাপেই হিমালয়ে ফিল্ডের জায়গাগুলো হাইলাইট করা ছিল। পরিষ্কার মনে আছে কাল রাতে ম্যাপটা উরভিদের মেল করার পর একটা প্রিন্ট নিয়ে সেটা টেবিলের ওপরেই রেখেছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন টেবিলের নীচে পড়ে আছে ম্যাপটা। নিশ্চিন্ত হবার পরেও খটকা একটা থেকেই গেল। হাওয়া নেই তবু ম্যাপটা টেবিলের নীচে গেল কি করে? নিশ্চয়ই তার রুমে কেউ এসেছিল। তবে কি কোন বিপদ আসছে? প্রফেসরকে এখুনি সাবধান করতে হবে।
টেবিলের তলা থেকে ম্যাপটা বের করে আনবার সময় হঠাৎ মাথায় একটা ভারী কিছুর আঘাত লাগল। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন মরিস।
******
‘বরুণ, শুনেছি হিমবাহের মধ্যে চলার অভিজ্ঞতা আছে তোমার। রাস্তাও মোটামুটি চেনা আছে এদিককার।’
‘হ্যাঁ আমি অভিযাত্রীদের সঙ্গে অনেক ওপর পর্যন্ত গেছি। মালপত্র বহন করতে পারবো। অল্টিচুড ট্রেনিং আমার আছে। গত প্রায় বছর পাঁচেক এখানে আছি। পাহাড় আমার নেশা।’
এই লোকটিই বরুণ দাস। মাঝারি উচ্চতার শক্তপোক্ত মানুষ। বাড়ি কোলকাতার কাছেই মধ্যমগ্রামে। এখানকার হাইডেল প্রজেক্ট-এর শ্রমিক। চৌকিদার বিস্টজী একে নিয়ে এসেছে। গতবছর এখানকার হিমনদের হ্রদ-ভাঙ্গা বন্যায় বরুণও অনেকের সঙ্গে একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে আটকে ছিল। পরে আর্মি তাদের উদ্ধার করে। প্রজেক্টের কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও সে আর বাংলায় ফিরে যায়নি।
‘আমাদের কিছু কাজ আছে হিমবাহ নিয়ে। তুমি আমাদের সাহায্য করবে?’
‘নিশ্চয়ই করব স্যার। হাইডেল প্রজেক্ট আবার চালু হওয়া পর্যন্ত আমার কোন কাজ নেই। তাই আপনাদের সঙ্গে গেলে কোন আসুবিধে হবে না। কতদিনের কাজ?’
‘ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে দিন পনেরো তো লাগবেই।’
‘ঠিক আছে। আমি যাব।’
‘পরশু দিন আমরা রওনা হব। কাল রাতে রেডি হয়ে গেস্ট-হাউসে চলে এস।’
******
দরজার সামনে এসে সিকিউরিটি দেখল অ্যাপার্টমেন্টের মেঝেতে পড়ে আছেন মরিস। ভোর হতে বেশি বাকি নেই। দরজাটা খোলা। সিকিউরিটিকে দেখে সামান্য টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
‘স্যার, টহল দিতে এসে দেখলাম আপনি মেঝেতে পড়ে আছেন। কি হয়েছে?’ গার্ড জিজ্ঞেস করল।
‘মাথাটা ঘুরে গেল। ভাল করে দাঁড়াতে পারছি না। অ্যাম্বুলেন্সে একটা খবর দিচ্ছি। একটু চেক আপ দরকার মনে হচ্ছে। কাল আবার বস্টন যেতে হবে। তুমি অ্যাম্বুলেন্সের লোককে আমার রুম দেখিয়ে দিয়ো তাহলেই হবে। কদিন থাকবো না। দেখো কেউ যেন আমার দরজার কাছে না আসে।’
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল স্কলারস হস্টেলের সামনে।
******
বাজারে কিছু জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে সেন সাহেবের দেখা হল গাড়োয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক ডঃ তন্ময় নন্দীর সঙ্গে। এখানে উনি ফিল্ডে এসেছিলেন। প্রফেসর সেনকে তিনিও গুরু বলে মানেন।
কথায় কথায় ডঃ নন্দী বললেন, ‘স্যার, আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে হিমালয়ে যেভাবে হোটেল, কটেজ, দোকানপাট, অন্যান্য নানা সরকারি, বেসরকারি প্রকল্প তৈরি হচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে টুরিস্ট, তীর্থযাত্রী, যানবাহন ইত্যাদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলেছে তাতে পরিবেশের ভারসাম্য একেবারেই বজায় থাকছে না। গ্রিন-হাউস গ্যাসের নিঃসরণের সঙ্গে তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটা কেউ ভাবছে না। আমাদের রিপোর্টগুলো শুধু আলঙ্কারিক মর্যাদা পাচ্ছে।’
‘ঠিকই বলেছেন। সারা পৃথিবীতেই একই কাণ্ড চলছে। আমদের দেশে হয়ত একটু বেশি।’
‘হ্যাঁ। আপনাদের প্রজেক্ট শেষ হলে লোকে বুঝবে যে আমরা বিপর্যয়ের কত কাছে আছি। কিছু গ্লোবাল পলিসি হয়তো তৈরি হবে। আর একটা কথা স্যার। আপনাদের একটু সাবধানে থাকতে হবে। কাজটা খুব মূল্যবান হলেও এতে অনেকের স্বার্থে ঘা লাগতে পারে।’
যেতে যেতে উনি নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন, যদি কোন দরকার হয় ওনাকে যেন জানান হয়। প্রফেসর জানেন যে ডঃ নন্দীর ওপরমহলে অনেক যোগাযোগ আছে। সম্মতি ও ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁকে বিদায় জানালেন সেন সাহেব।
সন্ধ্যা বেলা বরুণ চলে এল। এসেই জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, গতকাল বিকেলে একজন বিদেশী এসে আমাকে পাহাড়ে চড়ার জন্য সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত করতে চাইছিল। তিনি কি আপনাদেরই কেউ?’
‘না তো। আমরা এই দুজন আর তুমি, এই আমাদের টীম। সকলের জন্য আর্মির পারমিশনও করিয়ে নিয়েছি। একটা কথা, আমাদের এই কাজ নিয়ে কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’
রাতে গেস্ট-হাউসে মরিসের ইমেইল আবার দেখেলেন প্রফেসর। মেলে পাঠানো রিভাইজড ম্যাপে অতিরিক্ত কিছু হাই-অলটিটিউড পয়েন্টও দেখিয়েছে। সেই জায়গাগুলোতেও কাজ হবে। যন্ত্রটার ব্যাপারে কিছু প্রয়োজনীয় আলোচনাও করেছে। যন্ত্রটিকে বাংলায় হিমগণক বলা যেতে পারে। প্রফেসর মনে মনে ভাবলেন।
হিমগণকটির একটি নিজস্ব হিমবাহ-ডেটাবেস আছে। এটি ইলেক্ট্রিকাল সিগন্যালের মাধ্যমে মাপতে পারে হিমবাহের বরফ কতটা পুরু এবং জায়গাটার ঢাল। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, চাপ, ঐ স্থানের বাৎসরিক বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, ইত্যাদি প্যারামিটার যন্ত্রে ফিড করে দিলে এটা নিজেই বলতে পারে হিমবাহ এবং হিমহ্রদগুলো সেই মুহূর্তে কতটা স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। এরপর ফিল্ড থেকে সংগৃহীত বরফ, পাথর ও বায়ুমণ্ডলের গ্যাস স্যাম্পলের বিশদ ল্যাব-বিশ্লেষণের ফলাফল নিয়ে হিমগণক ডেটা সিমুলেসন করে এবং রোবাস্ট মডেল বানায়। তাতে জানা যায় কোন হিমবাহ এলাকা কত দুর্যোগপ্রবণ আর কোথায় কোথায় হতে পারে বিপর্যয়।
উত্তরাখণ্ডে হিমনদের ঝিল বা হিমহ্রদের সংখ্যা প্রায় ১৪০০। সেগুলো রয়েছে ৩০০০ থেকে ৬০০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে। ম্যাপে দেখানো এইরকম প্রায় ৫০টি হিমহ্রদে তারা কাজ করবে পুরো উত্তরাখণ্ডে। এখানকার উল্লেখযোগ্য হিমবাহগুলির প্রত্যেকটাতেই অনেকগুলো করে হিমনদের ঝিল রয়েছে। এর মধ্যে বেশ গুরুতর অবস্থায় আছে এই ৫০টি হিমনদের ঝিল। কিছুদিন আগেই এখানে এক হিমহ্রদ ভেঙ্গে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু ও অন্যান্য অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কাজেই সেখানকার ডেটা রিয়েলিটি চেক করার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এই বৈজ্ঞানিক চিন্তার মধ্যে আর একটা ঘ্যানঘ্যানে চিন্তাও প্রফেসরের মনটাকে ভরিয়ে দিল। গত দুদিনে আগের মতোই কয়েকটা ‘মজার ছলে সাবধান করা’ মেসেজ এসেছে তার মোবাইলে। একটা তো বেশ মজার- ‘হিমবাহে ভাসবি / বরফ চাপা পড়বি/ পালাতে হলে দেরি / ডুববে জীবনতরী।’
কে বা কারা তাদের ভয় দেখাচ্ছে? বরুণের কাছে কোন সাহেব এসেছিল? তাদের অনুসরণ করা হচ্ছে কি? পাহাড়ের নির্জনে কী ঘটতে চলেছে?
******
দিন দশেক কাজ হয়েছে। কাজের অগ্রগতি খুব ভালো। হিমবাহ তো নয়, পাহাড় থেকে নামা দুরন্ত হিম-ঝরনাগুলোকে কে যেন জাদুবলে ‘স্ট্যাচু’ বলে থামিয়ে দিয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ বরফ যেন অপেক্ষা করছে উষ্ণতাজনিত প্রাকৃতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের, যার ফলশ্রুতিতে যে কোন সময়ে প্রবল বেগে তারা নেমে এসে প্লাবিত করবে সবকিছু।
ওপরের দিকে ওঠার সময় তারা দেখেছেন যে অনেক জায়গায় এই হিমবাহগুলোর উপত্যকায় বরফ প্রায় নেই বললেই চলে। তবে আশপাশে বেশ কিছু বোল্ডার দেখা গেছে যারা স্থানীয় নয়। এরা গ্লেশিয়াল ইরাটিক্স। এগুলো পাহাড়ের অনেক উচ্চতা থেকে হিমবাহ বাহিত হয়ে এখানে এসে পৌঁছেছিল কোন এক সময়ে। পরে হিমবাহ অপ্রসৃত হয়ে ফিরে গেছে কিন্তু পাথরগুলো রয়ে গেছে।
এই পাথরে যে ভেজিটেশন আছে সেগুলোও তাদের অনেক উচ্চতায় জন্মের সাক্ষ্য বহন করে। আশপাশে নানা দিক থেকে ঝুলন্ত উপত্যকাও রয়েছে যেগুলোতে আগে হিমবাহের চলন ছিল; এখন সেগুলো খালি, কারণ হিমবাহের বরফ গলে গেছে। উষ্ণায়ন এই হিমবাহের অপসরণে কী ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে তা দেখে প্রফেসর সেন ও উরভি দুজনেই যথেষ্ট আশ্চর্য হয়েছেন। দূষণজনিত গ্রিন-হাউস গ্যাসের কারণে অনেক হিমবাহ শীর্ণ হয়ে গেছে, শুকিয়ে গেছে। ফলত এইসব জায়গার পুরো ল্যান্ডস্কেপ পালটে গেছে। এমনকি বায়োডাইভারসিটিও অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশপাশের বা নীচের গ্রামগুলোতে জলের জন্য হাহাকার দেখা দিচ্ছে। তাছাড়া বরফের মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা জীবাণুগুলো বরফ গলে যাবার পর সক্রিয় হয়ে উঠছে। বিচিত্র অসুখের প্রাদুর্ভাবে হয়তো গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে।
প্রফেসর সেনের তত্ত্বাবধানে উরভি আর বরুণ মিলে যন্ত্রটাকে বিভিন্ন হিমবাহের এক-একটা উপযুক্ত জায়গায় বসিয়ে নানা ডেটা রেকর্ড করছে প্রতিদিন। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫০০র মতো জায়গায় রিডিং নেওয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পাথর, বরফ ও বাতাসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এদিককার কাজ প্রায় শেষ।
সন্ধ্যে বেলা তাঁবুতে বসে একটা বেশ খারাপ খবরে দুজনেই মুহ্যমান হয়ে গেলেন। কাজ শুরু করার পরের দিন থেকেই মরিসের সঙ্গে সম্পর্ক করা যাচ্ছিল না। ফোনে, ইমেইলে বা হোয়াটসঅ্যাপে, কোনভাবেই নয়। প্রফেসর উরভিকে বলেছিলেন, মরিস নিজে না যোগাযোগ করা পর্যন্ত তাকে যেন কোনরকম ডেটা পাঠানো না হয়। কিন্তু আজ কলোরাডোতে ফোন করে জানা গেল দিন দশেক আগে এক সকালে হসপিটালে চেক-আপ করাবার জন্য বের হবার পর থেকে মরিসকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
ডক্টর সেন বললেন ‘বড় রহস্যময় ভাবে উধাও হয়েছে ও। ওকে ডেটা পাঠালে কাদের হাতে সেটা পড়তো কে জানে। যাই হোক আমাদের এখন আরও সাবধানে থাকতে হবে। কারণ মূল্যবান ডেটা রয়েছে আমাদের কাছে।’
‘কাল ট্রেকিং করে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতা পর্যন্ত উঠতে হবে স্যার।’ উরভি খানিকটা ভাবিত।
‘হ্যাঁ, উত্তরাখণ্ডের বাকি হিমবাহে কাজ হয়ে গেছে, শুধু হিমালয়ের উচ্চতম কিছু হিমবাহ আর হিমহ্রদের ডেটা নেওয়া বাকি। দুদিনের ফিল্ড-ওয়ার্ক। ওখানে নেটওয়ার্ক পাবে না। আর্মির দেওয়া স্যাটেলাইট ফোনই ভরসা।’
‘গ্রামের লোক বলছিল এটাই মোটামুটি শেষ জনবসতি।’ উরভি সাবধান করল।
‘হ্যাঁ। আমরা অত্যন্ত জরুরি কিছু হাই-অল্টিচুড ডেটা সংগ্রহ করেই এই বেসক্যাম্পে নেমে আসব। এখানে আর্মি হেলকপ্টার আমাদের দেরাদুন নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করবে।’
******
তাঁবুর বাইরে অন্ধকার, বরফ পড়ছে। তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রী হবে। প্রফেসর আর উরভি শুকনো কিছু খাবার খেয়ে নিয়েছেন। বরুণ এখন নিজের তাঁবুতে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল ফিরতে হবে। এত উচ্চতাতেও অনেক জায়গায় বরফের মধ্যে কালো কালো ছোপ দেখা গেছে। এগুলো গ্রিন-হাউস গ্যাসের দূষণের জন্যেই হয়েছে মনে হয়। যথেষ্ট পরিমাণে ডেটা আর সবরকম স্যাম্পল নেওয়া গেছে। বিশদ বিশ্লেষণ এবং ডেটা সিমুলেসন হবে কলোরাডোর ল্যাব-এ। তবে এখানকার ডেটা যন্ত্রে ফীড করতেই যন্ত্র লাল সঙ্কেত দেখাচ্ছে। ফলাফল বেশ উদ্বেগজনক। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেন ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।
কাছাকাছি কয়েকটা হিমবাহের হ্রদ আছে যেগুলোর কোনটাই খুব স্থিতিশীল নয়। সবচেয়ে কাছের কয়েকটা হিম-হ্রদের দেওয়ালে ফাটল আছে। জল আর বরফ ধারণ-ক্ষমতার শেষ সীমায় আছে দেওয়াল। হিমবাহের অবস্থাও খুবই উদ্বেগজনক। কয়েকদিনের ভারী তুষারপাত বা কোন ছোটখাটো ভূমিকম্পের অভিঘাতেও গড়িয়ে নেমে আসতে পারে হিমবাহের বরফের চাঁই বা আভালাঞ্চ, মোরেন পাথরের দেওয়াল ভেঙ্গেও নেমে আসতে পারে হিমহ্রদের বরফ, পাথর আর জলের প্লাবন। নীচের গ্রামের মানুষগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তখন। তাদের তাঁবুটা নিরাপদ জায়গায় থাকলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে তাদের ফেরার রাস্তা যেকোন মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের নেমে যেতে হবে। প্রকৃতির মধ্যে একটা থমথমে ভাব রয়েছে। মনে হয় একটা তুষার ঝড় আসছে।
******
প্রফেসর কতক্ষণ ঘুমেয়েছিলেন কে জানে। একটা খস খস আওয়াজ ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল তার। নিজের রিভলভারটা নিয়ে তাঁবুর বাইরে বের হলেন তিনি। সূর্য ওঠার সময় হয়ে গেছে। হাওয়া ও তুষারপাত বেড়েছে। বরুণের তাঁবুর দিকে যেতেই ভীষণ চমকালেন। ওর তাঁবুটা মাটিতে পড়ে, কয়েকটা জিনিসপত্র এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। বরুণ আশপাশে কোথাও নেই। তুষারপাতের মধ্যে পায়ের কোন ছাপও দেখতে পাওয়া গেল না।
তাড়াতাড়ি তাঁবুতে এসে উরভিকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, ‘বরুণকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের এখুনি বের হতে হবে।’
‘অসুবিধা নেই। সবই গোছানো আছে স্যার।’
‘খুব দরকারি কয়েকটা জিনিস আর শুকনো কিছু খাবারদাবার ছাড়া আর কিছু নেব না। গতি বাড়াতে হবে আমাদের।’
******
অবিরত তুষারপাতের জন্য পায়ের নীচের বরফগুলো একেবারে নরম। পা ঢুকে যাচ্ছে। প্রফেসরের প্ল্যান অনুযায়ী দুজনে পাহাড়ের দুপাশের রাস্তা দিয়ে নামবেন। এতে বিপদ হলেও বরুণকে পাবার সম্ভাবনা বাড়বে। প্রায় দেড় কিলোমিটার পর যেখানে দুটো রাস্তা আবার এক হয়েছে সেখানে মিলিত হবেন তাঁরা। দুয়েকটা জরুরি জিনিস, ল্যাপটপ আর চামড়ার ব্যাগে ভরা হিমগণকটা নিয়ে উরভি পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পাহাড়ের ওপাশে উরভির রাস্তায় ঝড়ের প্রকোপ অনেকটা কম হবে। ফরম্যাট করা ডেটা সম্বলিত পেন ড্রাইভ নিজের কাছেই রেখেছেন প্রফেসর। একটা তাঁবু ও সাম্পেল ব্যাগও রয়েছে তাঁর কাছে। সঙ্গে রাখা রিভলভারটা আর একবার পরীক্ষা করে নিলেন তিনি।
কিছুক্ষণ খুঁজে বরুণের কোন চিহ্ন পেলেন না ডঃ সেন। আর অপেক্ষা না করে নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে থাকলেন তিনি। কিছুটা যেতেই খাদের দিক থেকে আসা একটা গোঙানির আওয়াজে সচকিত হলেন। একটু ঝুঁকে নীচে যা দেখলেন তাতে তার মত সাহসী মানুষও শিউরে উঠলেন। খাদের দিকে দুটো পাথরের মধ্যে কোনরকমে আটকে রয়েছে বরুণ। নীচে দেখা যাচ্ছে হিমবাহ। মাথা রক্তে ভাসছে। একদম দেরি না করে ব্যাগের থেকে রশি বার করে ছুড়ে দিলেন বরুণের দিকে। ও দড়িটা কোনমতে ধরতেই অমানুষিক শক্তিতে বরুণকে টেনে তুললেন তিনি। দেখলেন তার মাথার ক্ষত তত গভীর নয়। জলটল খেয়ে একটু শক্তি ফিরে পেয়ে বরুণ যা বলল তা মোটামুটি এইরকম-
রাতে একটা শব্দ শুনে তাঁবুর বাইরে এসেছিল বরুণ। তখনই প্রফেসরের তাঁবু থেকে একটা লোককে পা টিপে টিপে বের হতে দেখেছিল সে। মানুষটার গ্লাভস পরা হাতে বোধ হয় ছোট কয়েকটা জিনিস ছিল। সে প্রথমে চেঁচিয়েছিল কিন্তু হাওয়ার উল্টোদিক হওয়াতে বোধ হয় প্রফেসর শুনতে পাননি। এরপর লোকটা তাকে আক্রমণ করে। ধস্তাধস্তিতে তাঁবু ছিঁড়ে যায়। এরপর সে দৌড়ে পালাতে শুরু করাতে বরুণও তাকে অনুসরণ করতে থাকে। পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল লোকটা। বরুণ সরু বরফঢাকা পথে দাঁড়িয়ে খুঁজছিল তাকে। হঠাৎই সে কোথা থেকে এসে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বরুণকে খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এত উঁচু থেকে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে লোকটা আর দাঁড়ায়নি। বরুণ কিন্তু পাহাড়ের গায়ে দুটো পাথরের খাঁজে আটকে গিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে সাহায্যের জন্য আওয়াজ করছিল। তার আশা ছিল প্রফেসররা এই রাস্তা দিয়েই নামবেন।
আবহাওয়া খারাপ হচ্ছে। রাস্তায় যদি দুর্যোগ বাড়ে তাহলে হেলিকপ্টার অবধি আজ যাওয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি উরভির কাছে পৌঁছতে হবে। ওই লোকটা যদি আগে উরভিকে দেখতে পায় তবে বেশ ভয়ের ব্যাপার। বরুণ প্রফেসরকে বলল- ‘আপনি তাড়াতাড়ি নামুন স্যার। আমি সরাসরি বেস ক্যাম্পে পৌঁছে যাব।’ বরুণের কথা শুনে গতিবেগ অনেকটা বাড়িয়ে দিলেন প্রফেসর। পাকদণ্ডী বেয়ে নামতে নামতে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছলেন তিনি। এখানেই উরভির অপেক্ষা করার কথা। কিন্তু কোথায় উরভি? ওর তো অনেক আগেই এখানে পৌঁছোবার কথা ছিল। ও কি কোন কারণে আরও এগিয়ে গেছে? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সেন সাহেবও নীচের দিকে নামতে শুরু করলেন। খানিকটা নেমেই দেখলেন, বরফ-রাস্তার ধারে সাদা ঝোপে পড়ে আছে উরভির গলার পশমের স্কার্ফটা। উরভি নীচের দিকে গেছে, এটা বোধহয় তারই সংকেত।
শূন্য থেকে অবিরাম ঝরে পড়ছে বরফের তুলো। কোথাও উরভির চিহ্নমাত্র নেই। কিছুদূর এসে একটা অন্য চিন্তা গ্রাস করল প্রফেসরকে। কারো পেছনে ধাওয়া করছে কি ও? হঠাৎ রাস্তার পাশে হিমবাহের দিকের বরফ ঢাকা একটা গাছের নীচে দেখলেন কয়েকটা পায়ের অস্পষ্ট ছাপ। গাছের নীচে বলে বরফ পড়ে ছাপ পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। তবে কি উরভি হিমবাহতে নেমেছে? ও তো জানে যে হিমবাহের মধ্যে চলা ভীষণ বিপজ্জনক। খানিক চিন্তা করে নিজেও দ্রুত হিমবাহে নেমে পড়লেন প্রফেসর। কিছুটা যেতেই বুঝলেন তার ভাবনা সঠিক। বরফের মধ্যে পড়ে আছে উরভির হ্যামারটা। পুরোপুরি এখনও বরফে ঢেকে যায়নি সেটা। মানে এখানে উরভি ছিল কিছুক্ষণ আগেও। তাহলে দৃষ্টিসীমার মধ্যেই ওর থাকা উচিত। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। যদিও বরফ পতনের জন্য দৃশ্যমানতা ভালো নয় জায়গাটার। চারদিকে এত বরফের মধ্যে কোথায় খুঁজবেন তাকে? চিন্তামগ্ন হয়ে কিছুটা এগোতেই হিমবাহের ধারের দিকে পাথরে একটা লম্বাটে ফাটল বা ফিশার দেখতে পেলেন। সামনের দিকে গিয়ে ফাটল আরও চওড়া হয়েছে। পেছনে তাকালে অবশ্য এই ফাটলের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। কারণ ফাটলের মুখ বরফে ঢেকে গেছে। কী একটা চিন্তা মাথায় আসতে প্রফেসর দ্রুত পেছন ফিরলেন। চলতে চলতে যেখানে উরভির হ্যামারটা পড়ে ছিল সেখানে এসে থামলেন। এখান থেকে হিমবাহের ধার পর্যন্ত জায়গাটায় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে কিছু খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎই কী মনে হওয়াতে এক জায়গায় জমে থাকা সদ্য-পতিত বরফ সরাতে লাগলেন পাগলের মত। মিনিট খানেক পরেই একটা ফুট খানেক ব্যাসার্ধের গর্ত নজরে আসলো তার। বুঝলেন এটা ফাটলেরই এপাশের অংশ আর এর ওপরের বরফের পাতলা আস্তরণ ভেঙ্গে গর্ত তৈরি হয়েছে। ভেতরে উঁকি মেরে দেখলেন বরফঢাকা সঙ্কীর্ণ ফাটলের মধ্যে ঝুলছে উরভির শরীর। বেশি গভীরে না যাওয়াতে উরভির অর্ধচেতন দেহ হাত দিয়ে টেনে ওপরে তুলে ফেললেন তিনি। চোখে মুখে একটু জল দেওয়াতে সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান ফিরে এল তার। কোন রকমে পাশের রাস্তায় উঠে এসে দুজনে একটু বসলেন। বেসক্যাম্পে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। স্যাটেলাইট ফোন কাজ করছে না।
******
‘যাই হোক না কেন তোমার কিছুতেই হিমবাহের মধ্যে নামা উচিত হয়নি। আর কিছুটা দেরি হলে ফিশারের বা ফাটলের মুখের জমা বরফ শক্ত হয়ে যেত। আর তোমাকে খুঁজেই পেতাম না। ভগবানকে ধন্যবাদ দাও। উনিই হাতুড়ি দেখিয়ে তোমাকে বরফ-সমাধি থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।’
‘একটা লোক পেছন থেকে হিমগণকটা কেড়ে নিয়ে পালাতেই কেমন যেন একটা রোখ চেপে গিয়েছিল যন্ত্রটা উদ্ধার করার। হিমবাহে না নামার কথাটা মনেই আসে নি।’
‘লোকটাকে তুষারপাতের মধ্যে ঠিকমত দেখতে পেয়েছিলে?
‘না স্যার। তবে মাঝারি উচ্চতার লোক। ভারতীয় বলেই মনে হল। ও হিমবাহে নেমে কিছুটা গিয়ে আবার রাস্তায় উঠে গেল। আর ধারের দিকে যেতে গিয়েই আমি ফাটলের মধ্যে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম।’
‘হেলিকপ্টার পাবার আশা নেই। যদি শরীর ঠিক থাকে তো চলা শুরু করতে হবে এখুনি। দেখি কতদূর যাওয়া যায়। বরুণ হয়ত অনেকটা এগিয়ে গেছে।’
কিছুটা চলার পর তুষার-ঝড় বাড়াতে আর এগোনো গেল না। একটা নিরাপদ জায়গা দেখে তাঁবু গেড়ে রাতটা অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁরা।
******
ভোরের আলো ফুটলেও আবহাওয়া এখনও ঠিক হয়নি। তুষার ঝড়ের মধ্যেই বেস ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন তাঁরা।
‘স্যার হিমগণকের কী হবে?’ উরভির গলায় উদ্বেগ। ‘যন্ত্রের মধ্যে কিছু ডেটা তো রয়ে গেছে। তাছাড়া যন্ত্রটা খারাপ লোকের হাতে পড়লে সর্বনাশ হবে।’
‘প্রাথমিক স্টাডি রিপোর্ট সহ পুরো ডেটাসেট আমাদের কাছেই আছে উরভি। তুমি চিন্তা কোরো না।’
বললেন বটে কিন্তু উনি জানেন যন্ত্রটা ফিরে পাওয়া কতটা জরুরি।
‘চলো তাড়াতাড়ি নামতে হবে। এরা খুব বিপজ্জনক লোক। আমি আগে আগে যাব। তুমি কিছুটা দূরত্ব রেখে আমাকে অনুসরণ করবে। আমার কোন বিপদ হলে তুমি অবশ্যই লুকিয়ে পড়বে। যাতে দুজনে একসঙ্গে ধরা না পড়ি।
‘লুকিয়ে কেন? ওদের বাধা দেব না?’
‘কোন কিছু করবে না। সোজা বেসক্যাম্পে গিয়ে সাহায্য চাইবে। একজন নিরাপদ থাকলেও ডেটার একটা সেট অন্তত পৌঁছতে পারবে।’
‘বরুণের কী হল কে জানে স্যার?’
‘আশা করি ও আর কারো পাল্লায় পড়েনি। আমার মনে হচ্ছে শিগগির হয়তো ওদের পালের গোদার সঙ্গে দেখা হবে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা জেনে গেছে যে যন্ত্রের মধ্যে ডেটা বিশেষ নেই। রিপোর্টও নেই। আমার মন বলছে ডেটা নিতে ওরা অবশ্যই ফিরে আসবে। আমি সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছি।’ প্রফেসরের গলায় আশা আত্মবিশ্বাস মাখামাখি।
বরফের কষ্টকর রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পরেও কাউকেই দেখা গেল না। সেন সাহেব চিন্তিত হলেন। যত সময় যাবে, যন্ত্রটা ফিরে পাবার আশা তত ক্ষীণ হয়ে আসবে। এই যন্ত্রটা ফিরে না পেলে অন্য যন্ত্রটা পুরোপুরি সেট করতে সময় লাগবে বেশ কিছুটা। আর তারপরই ডেটা লোড করে স্টাডি করা যাবে। প্রজেক্ট কিছুটা পিছিয়ে যাবে।
******
‘প্রফেসর! স্টপ দেয়ার।’
বাজখাঁই গলায় কেউ তাঁকে থামতে বলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন হিমবাহের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে একজন বিদেশি। বেশ লম্বা। পর্বতারোহীদের পোশাকে সবকিছু ঢাকা। এক হাতে রয়েছে হিমগণক যন্ত্রটি। অন্য হাতে একটা রিভলভার তাঁর দিকেই তাক করা। এই তাহলে পালের গোদা? তিনি নিশ্চিত পেছনে উরভি এতক্ষণে লুকিয়ে পড়েছে।
‘এখুনি আপনাদের ডেটা আমাকে দিয়ে দিন। নাহলে গুলি চলবে।’
‘ডেটা যা ছিল তা ওই যন্ত্রের মধ্যেই আছে।’
‘কী যে বলেন প্রফেসর? আমি নিজে সব চেক করেছি। আমার পুরো ডেটা চাই। আপনি না দিলে আপনাকে খুন করে ডেটা নিতে হবে। তবে খুন আমার পছন্দ নয়। বরং আপনি নিজে থেকে ডেটা দিলে আমি উপযুক্ত দাম দেব। এবার ভাবুন আপনি ছাত্রী-সহ খুন হবেন না ডেটা আর রিপোর্ট দিয়ে, প্রচুর অর্থ নিয়ে দুজনে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরবেন’ ।
প্রফেসর যেন ঠিক এরকমই কিছুর অপেক্ষায় ছিলেন। বিদেশি আবার বললেন,
‘আপনি ডেটা দিলে আমি নিজে যন্ত্রে চেক করে নেব। সব ঠিক থাকলে আপনারা নিশ্চিন্তে ফিরবেন। আর যদি চালাকি করেন তো লাশ পড়বে।’
প্রফেসর জানেন যে তার কাছে থাকা ফরম্যাটেড ডেটা সম্বলিত পেন ড্রাইভ লাগালেই যন্ত্র চলবে। আর একবার যন্ত্র চলতে শুরু করলে তাদের আর বাঁচিয়ে রাখার দরকার থাকবে না।
‘ঠিক আছে পেন ড্রাইভ আমি পকেট থেকে বার করছি তুমি কাছে এসে নিয়ে যাও। অতদূরে তো আর পেন ড্রাইভ ছুঁড়ে দিতে পারবো না।’ কেটে কেটে কথাগুলো বললেন প্রফেসর। সাহেব কী ভেবে রিভলভার তার দিকে তাক করে হিমবাহের ধারের দিকে এগোতে থাকলেন।
‘আমি আসছি। কিন্তু কোনরকম চালাকি নয় প্রফেসর।’
এই ফ্রেশ বরফের ওপর হাঁটার অনেক বিপদ আছে। অনেক জায়গায় বরফের নীচে জল আছে, সেখানে পা ঢুকে গেলে বের করতে সময় লাগে। অনেক সময় কোমর পর্যন্ত ঢুকে যেতে পারে। সাহেব তার দিকে আরও এগোতেই হঠাৎ বরফের নীচের একটা পাথরে হোঁচট খেলেন। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সামলে নিতে গিয়ে নরম বরফে পা অনেকটা ঢুকে গেল। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন ডঃ সেন। অতি ক্ষিপ্রগতিতে নিজের রিভলভারটা কোমর থেকে বার করে ফেললেন। কিন্তু এত জিনিসপত্র নিয়ে তাক করার আগেই কানের পাশ দিয়ে একটা গুলি সাঁ করে চলে গেল। এত ঠাণ্ডার মধ্যেও একটা গরম ভাব যেন কানে টের পেলেন তিনি। সেই সঙ্গে বিকট শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। হিমবাহের দুদিকের পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আওয়াজটা। পরের গুলির আওয়াজ শুনতে শুনতেই বুঝলেন পেছন থেকে উরভি তাকে আগেই ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। এই গুলিটাও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তার পেছনের পাহাড়ের বরফের দেওয়ালে ঢুকে গেছে।
‘আরে ম্যাডাম এবারে তো আপনি আমার বন্দুকের নিশানায়। আপনার প্রাণটাই আগে নিয়ে নিই তাহলে।’ মানুষটি পিস্তল তাক করলেন উরভির দিকে।
আর একটা গুলি ছোঁড়ার আগেই প্রফেসর পা দিয়ে উরভির পায়ে সজোরে ধাক্কা মেরে উরভিকে বরফের ওপর ফেলে দিলেন।
ঠিক তক্ষুনি চড়াৎ চড়াৎ করে আওয়াজ শুনতে পেলেন।
******
প্রফেসর দেখলেন ওপাশের পাহাড় থেকে বরফের চাই ভেঙ্গে হিমবাহের ওপর পড়তে শুরু করেছে। আশপাশের পাহাড়ে জমে থাকা বরফের পুরু আস্তরণ ভারসাম্য হারিয়েছে দুটি গুলির বিরাট শব্দের অভিঘাতে। রাস্তার বরফে শুয়ে সাহেবকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আর দেরি না করে প্রফেসর আন্দাজে গুলি চালাতে লাগলেন সাহেবের চারদিকের হিমবাহের বরফের মেঝেতে। তিনি জানেন এতে সাহেব কিছুটা বিভ্রান্ত হবে আর ফাটবে হিমবাহের মেঝের পাতলা জায়গার বরফ। ঠিক তাই হল। বরফ ফাটল। নীচে জল থাকাতে স্থির হিমবাহ ভেঙ্গে সচল হল। ভেসে চলতে শুরু করল মানুষটির পায়ের তলার বরফের চাঙড়। ডঃ সেনের গলার আওয়াজ শোনা গেল- ‘গুডবাই ডঃ মরিস। যদি বেঁচে যাও তোমার ভাগ্য।’ ঠিক তখনই হিমবাহের ওপরের দিকের পাহাড় থেকে প্রবল শব্দ করে পাথর, জল ও বরফ একসঙ্গে পড়তে শুরু করল। প্রমাদ গণলেন প্রফেসর। এটারই ভয় করছিলেন। ওপরের দিকে একটা বড় গ্লেসিয়াল লেক দেখেছিলেন স্যাটেলাইট ম্যাপে। শব্দের অভিঘাতে বা অত্যধিক বরফ পতনের ফলে সেটার মোরেন পাথরের দেওয়াল ভেঙ্গে গেছে নিশ্চয়ই।
‘উরভি, আমাদের এখনই পালাতে হবে।
‘হিমগণকের কী হবে স্যার?’
হাত ধরে উরভিকে অমানুষিক শক্তিতে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলেন প্রফেসর।
‘এবারে প্রাণ নিয়ে পালাতে হবে। না হলে বন্যার তোড়ে ভেসে যাবো বা বরফের নীচে চাপা পড়ে যাব। জিনিসপত্র সব ছেড়ে তাড়াতাড়ি দৌড়ও। ওই পাশের বরফের টিলাটার ওপরে উঠতেই হবে আমাদের। জানি না সেটাও যথেষ্ট হবে কি না।’
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওপরের টিলার দিকে চলতে লাগলেন তারা। প্রফেসর বুঝলেন এই হিমবন্যা ভাসিয়ে নিয়েছে হিমবাহকে পাশের রাস্তাসুদ্ধ। বুকের মধ্যে দামামা বাজাচ্ছে হৃদপিণ্ড। অক্সিজেন কম হচ্ছে ফুসফুসে। শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ ফিরে দেখলেন, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল উরভি। পেছনে ধাওয়া করে আসছে নিশ্চিত মৃত্যুরূপী জল আর ভাসমান বরফের চাঁই। দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে উরভিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন তিনি। যতটুকু প্রাণ অবশিষ্ট আছে তাই সম্বল করে উঠতে লাগলেন টিলাটার ওপরে। কিন্তু বোধহয় শেষরক্ষা হল না। আরও কিছুটা উঠেই উরভিকে নিয়ে হাঁটু মুড়ে পড়ে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে জল এসে পা ছোঁবে তাঁর। বরফ এসে চাপা দেবে তাঁদের। অথবা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দেশে। চোখ বুজে এল। কানে আসছে শুধু বয়ে যাওয়া বরফ আর জলের বিপুল শব্দ। তারপর আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে শব্দরাও।
******
হাততালির শব্দে কান ফেটে যাবার জোগাড়। কলোরাডোর মাইন-স্কুলের নিউজ রুমে প্রফেসর সেনের প্রেজেন্টেসন সবে শেষ হয়েছে। এখানকার ডিরেক্টর ডঃ ব্রাউন সবাইকে আভিনন্দন জানিয়ে ঘোষণা করলেন ‘আমাদের উষ্ণায়ন প্রজেক্টের পাইলট ফেজ আপাতত শেষ হয়েছে। পরের রোল-আউট ফেজের প্রিলিমিনারি আপ্রুভালও পাওয়া গেছে এখানে উপস্থিত ইউএনএ-র দুজন প্রতিনিধির কাছ থেকে। এবারে এই ফেজের বাকি কাজ শেষ করে ফাইনাল প্রেজেন্টেসন করতে হবে ইউএনএ-র দফতরে। পৃথিবীর সব জায়গার বিজ্ঞানীরা ওখানে থাকবেন। গ্লোবাল পলিসির ব্যাপারেও কথা শুরু হবে।’ পোডিয়াম থেকে নেমে এসে ডিরেক্টর ব্রাউন হাত মেলালেন প্রফেসর সেনের সঙ্গে।
এই প্রজেক্টের গ্লোবাল কো-অরডিনেটর ডঃ ডেনিশ ডঃ সেনকে তাঁর টীম-সহ নিজের চেম্বারে নিয়ে বসালেন। বললেন ‘যে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছিলেন, আপনাদের বেঁচে ফেরা আমাদের সকলের কাছে ভগবানের আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছু নয়।’
‘হ্যাঁ। ভাগ্যিস আমাদের সহযোগী বরুণ আগের দিনই বেসক্যাম্পে সরাসরি পৌঁছেছিল। সেই গিয়ে ওদের জানায় যে খারাপ আবহাওয়ার জন্য আমরা বিপদে পড়েছি। পরের দিন তাই হেলিকপ্টার গিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় আমাদের দুজনকে বরফের নদী থেকে উদ্ধার করে। আমাদের সাম্পেল ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্রও ওরাই উদ্ধার করে। ভাগ্যক্রমে হিমহ্রদের দেওয়াল ভেঙে জল ও বরফের প্লাবনও সেদিন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।’ প্রফেসর বললেন।
‘দয়া করে আজ ডিনারে আপনি ও আপনার টীম আমার আতিথি হবেন মাইন-স্কুলের বাগানে। সেখানে এখানকার পুলিসকর্তাও থাকবেন। উনি আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। আশা করি আপনার কাছ থেকে অনেক জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর পাব।’ ডঃ ডেনিশ নেমন্তন্ন করলেন।
‘ঠিক আছে, সব কৌতূহল মেটাব। তবে দয়া করে বিষয়টা নিজেদের মধ্যেই রাখবেন, কারণ কেউ এখনও ধরা পড়েনি।’ প্রফেসর সাবধান করলেন।
কলোরাডো মাইন-স্কুলের চত্বরে বিশাল লেকের মাঝে রয়েছে অতি সুদৃশ্য একটা ভাসমান বাগান। সেখানেই নিশিভোজের ব্যবস্থা।
আলোচনার শুরুতেই মরিস বেপরোয়াভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যার প্রথমে বলুন আমাকে আপনার কেন সন্দেহ হল?’
প্রফেসর বললেন, ‘দুঃখিত মরিস। আমার মনে হয়েছিল যেহেতু তুমি কিডন্যাপড হয়েছিলে তাই নিজের প্রাণের বিনিময়ে ওদেরকে ডেটা আর যন্ত্র দেবার চুক্তি করার সম্ভাবনা তোমারই বেশি। তাছাড়া আমাদের ফিল্ডের জায়গাগুলো একমাত্র তুমিই জানতে। ওইসব জায়গায় সহজে পৌঁছান তোমার পক্ষেই সম্ভব।’
‘কখন জানলেন যে এ লোকটা মরিস নয় অন্য কেউ?’ ডেনিশ জিজ্ঞেস করলেন।
‘সেটা ভাগ্যক্রমে। ফেরার পথে দেরাদুন বিমানবন্দরে চেক-ইন করার পর ওয়াশ-রুমে গিয়ে একেবারে কোণের দিকের বেসিনটায় দেখলাম এক সাহেব এসে দাঁড়াল। দেখেই চিনলাম এ সেই মরিস যে আমাদের মারতে চেয়েছিল। এও বেঁচে গেছে? ওকে পুলিসে দেব বলে মনস্থ করলাম। ঠিক তখনই চোখে পড়ল ও হাত ধুচ্ছে আর ওর ডান হাতে ছটা আঙ্গুল। বুড়ো আঙ্গুলের সঙ্গে ঝুলছে ছোট অতিরিক্ত আঙ্গুলটা। স্থির করলাম এ মরিস কিনা এখুনি যাচাই করতে হবে। কিন্তু আমি ভিডিও কনফারেন্সে শুধু ওর মুখই দেখেছি। বাইরে এসে উরভিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে মরিসের হাতে কোন অতিরিক্ত আঙ্গুল নেই। বুঝলাম এ মরিস নয় আর আসল মরিস ভীষণ বিপদের মধ্যে আছে। সেই মুহূর্তে ডঃ নন্দীকে ফোন করে ওনার জনসংযোগ ব্যাবহার করে এয়ারলাইন্সের যাত্রীদের ডেটাবেস থেকে জেনে নিলাম এই সাহেবের নাম আর গন্তব্যের বিমানবন্দর। আর সেটা পাঠিয়ে দিলাম কলোরাডোর পুলিশকে। ওদের বলেছিলাম একে এয়ারপোর্টে গ্রেফতার না করে বরং ফলো করে আসল মরিসের খোঁজ পেতে। আমার মনে হয়েছিল লোকটি আসল মরিসের কাছে যাবেই।’ প্রফেসর বললেন।
‘হ্যাঁ আপনার কথামত এয়ারপোর্ট থেকে লোকটাকে ফলো করে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে মৃতপ্রায় মরিসকে উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু বাকিরা পালিয়ে গিয়েছিল।’ পুলিসকর্তা জানালেন।
‘মরিসের জীবনের ঝুঁকি ছিল। ওরা যখন বুঝত যন্ত্র ছাড়া কাজের আর কিছু পাওয়া যায় নি। তখন ওরা মরিসকে টোপ বানিয়ে আমাদের কাছ থেকে পুরো ডেটা ও দ্বিতীয় হিমগণকটাকেও কব্জা করার চেষ্টা করত। সেটা সম্ভব না হলে মরিসের ওপর অত্যাচার বাড়ত এমন কি প্রাণও যেতে পারত।’ প্রফেসরের গলায় উদ্বেগের সুর।
‘আপনি কেন বলছেন হারানো যন্ত্রটা ওদের জিম্মায় আছে?’ উরভির প্রশ্ন।
‘যন্ত্রটা কোথায় আছে এখনও আমরা জানি না উরভি। হতে পারে ওটা হিমবাহতেই পড়ে আছে। আমি আর্মিকে অনুরোধ করেছি যাতে ওরা গিয়ে যন্ত্রটার খোঁজ করে। আবার এমনও হতে পারে যন্ত্র লোকটার সঙ্গেই ওদের কাছে পৌঁছে গেছে।’ প্রফেসরের গলায় অনিশ্চয়তা।
‘আমার কিন্তু মনে হয় স্যার, ওটা বরফের নীচে চাপা পড়ে গিয়েছে। আমাদের প্রজেক্টের তাই আর কোন বিপদ নেই।’ উরভি ভাবনা আশাব্যাঞ্জক।
‘আমাদের এই পাইলট প্রজেক্টের রিপোর্ট বের হলে ব্যাপারটা অত সহজ থাকবে না উরভি। প্রথমত, যে সমস্ত সংস্থা এইসব পাহাড়ে প্রচুর টাকা ইনভেস্ট করেছে অথবা করবে তারা সব বিগ প্লেয়ার। তারা একেবারেই চাইবে না আমাদের কাজের জন্য তাদের প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যাক। যাদের আমাদের পেছনে লাগান হয়েছে তারা আন্তর্জাতিক লেভেলে অপারেট করে। আমাদের প্রাণ নিতে এরা দুবার ভাববে না। দ্বিতীয়ত হিমগণক যদি কোনভাবে ওরা পায় তবে এর সফ্টওয়্যারের কিছু এল্গরিদম পরিবর্তন করে আমাদের পাবলিশড ডেটা দিয়েই বেশ স্বাভাবিক ফল ওরা দেখাতে পারে। এতে অনাবশ্যক দ্বন্দ্ব তৈরি হবে আমাদের রিপোর্ট নিয়ে। তাই যন্ত্রটা তাড়াতাড়ি উদ্ধার করা খুব জরুরি।’
‘একটা শেষ প্রশ্ন প্রফেসর, এত সিকিউরিটির মধ্যে মরিসকে ওরা কিডন্যাপ করল কী করে?’ ডেনিশ খুব কৌতূহলী।
‘যে লোকটিকে আমার মরিস বলে সন্দেহ হয়েছিল, সে মরিসের লুক-এলাইক বা যাকে বলে ডোপলগ্যাঙ্গার অথবা প্রস্থেটিক মেকআপ করা অন্য কেউ। একরকম দেখতে না হলে সিকিউরিটির চোখে ধুলো দিয়ে মরিসের স্কলারস অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকা অসম্ভব ছিল। লোকটা মাইন-স্কুল আর তার সিকিউরিটি সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল। প্রথম দিন সে মরিসকে মাথায় আঘাত করে টেবিলের নীচে অজ্ঞান করেছিল আর পরের দিন সে-ই অসুস্থ মরিস সেজে সিকিউরিটির সঙ্গে কথা বলে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিল। এরপর আসল মরিসকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্রেচারে করে বেরিয়ে যাওয়া কঠিন হয়নি। ওরা ভেবেছিল মরিসকে আমরা নিয়মিত ডেটা পাঠাব। কিন্তু মরিসকে প্রাথমিক সন্দেহের কারণে সেটা আমরা করিনি। ওদিকে বরফের লেক ফেটে বন্যা হওয়াতে ওরা আমাদের কাছ থেকে ডেটাও পায়নি। শুধু একটাই খটকা রয়ে গেল। লোকটি ধরা না পড়াতে জানা গেল না যে কলোরাডোর লোক এবং হিমালয়ের লোক একই নাকি দুজন আলাদা মানুষ।’ প্রফেসর থামলেন।
******
ডিনার শেষে গেস্টহাউসে ফেরার পথে প্রফেসর নিজের টীমকে বললেন, ‘আমাদের ফাইনাল প্রেজেন্টেশনটা যতদিন না ইউএনএ-র সদর দফতরে হয়, ততদিন সবাইকে কিন্তু খুব সাবধানে থাকতে হবে। যদিও বাকি ল্যাব আনালিসিস আর ডেটা সিমুলেসনের কাজ মাইন-স্কুলের ল্যাবেই হবে এবং নিরাপত্তার ব্যাপারটা এখানকার পুলিস দেখছে, তবু ভুলে গেলে চলবে না যে দুষ্কৃতিরা কেউ এখনও ধরা পড়েনি।’
রাত হয়েছে। মসৃণ রাস্তা দিয়ে তাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে মাইন-স্কুলের গেস্ট হাউসের দিকে।
হঠাৎ একটা ব্যাপার মনে পড়াতে প্রবল অস্বস্তি গ্রাস করল প্রফেসরকে--আজ হাত মেলাবার সময় তিনি দেখেছিলেন মাইন-স্কুলের ডিরেক্টর ডঃ ব্রাউনের ডান হাতে ছটা আঙ্গুল। বুড়ো আঙ্গুলের সঙ্গে ঝুলছে ছোট অতিরিক্ত আঙ্গুলটা।