সঙ্গীত বহমান। তার প্রবহমানতার কারণেই সে চিরনতুন। যে কোনোও সৃষ্টিতেই সময়ের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকে। কখনো কখনো সৃষ্টি সময়কে ছাপিয়ে হয়ে ওঠে চিরকালীন। এই বইটি সেই চিরকালীন কিছু শ্রুত কিছু অশ্রুত চাঁদের হাট। স্মৃতি রোমন্থনের পরতে পরতে ঝরেছে দুষ্প্রাপ্য জহরৎ, যা গুণী মানুষদের সান্নিধ্যের ফসল। গান যখন নিজের চরিত্র বজায় রেখে সুর দিয়ে আঁকা ছবি হয়ে ওঠে তখনই বোধহয় শ্রোতা পারে তার ভাবনার মহাকাশে পাড়ি দিতে। যেখানে সমস্ত বাঁধন মূল্যহীন সেখানেই তো তার বিস্তার।
‘স্মৃতিকথার এ-ও এক চলন’ বইটি সম্পর্কে বলতে হলে আগেই বলে রাখা দরকার এটি কোনোও প্রচলিত স্মৃতিকথা নয়। আর-পাঁচটা ডাল ভাতে বেড়ে ওঠা সাধারণ জীবনকাহিনি নয়। শুধুমাত্র গান দিয়ে গাঁথা স্মৃতির মালা। একটি গান একটি শিল্পীর পরিচয় হয়ে উঠতে পারে, একটি গান বাল্য থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন বা আরও বেশি সময় ধরে শ্রোতার মন-মস্তিষ্ককে সম্মোহিত করে রাখতে পারে। লেখিকা রুশতী সেন এই বইয়ের প্রতিটা শব্দে সেই ভাবনাকেই বহন করেছেন। গান ধরে ধরে লেখিকা তার সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং তা নিজের ভাবনার রঙে রাঙিয়েছেন। ব্যক্তিগত হয়েও সে মত ব্যক্তি পরিসর ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে সর্বজনগ্রাহ্য। তাইতো পাঠকের বইটি পড়তে পড়তে মনে হতেই পারে, এ ভাবনা তো তারও শুধু লেখিকার মতো এমন করে ভেবে ওঠা হয়নি।
বইটিতে মোট এগারোটি অধ্যায় রয়েছে, যেগুলি আলাদা আলাদা ভাবে নামাঙ্কিত। যেমন, ‘মিছে তাই ফিরিনু যে’, ‘সুর লাগি আঁখি ঝুরে’, ‘শ্রবণ আমার গভীর সুরে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তু স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত। বইটির শুরুতেই লেখিকা বলছেন, “স্বপ্নেও কোনোদিন ছিল না যে, আমার মতো সাধারণ শ্রোতার গান শুনবার অভিজ্ঞতা নিয়ে বই দূরে থাক, কোনো একটি লেখাও তৈরি হতে পারে।”(পৃ-৯) তবে এই বইটি পড়ার পর গান সম্বন্ধে লেখিকার প্রশ্নাতীত প্রাজ্ঞতা সম্পর্কে পাঠকের মনে কোনোও দ্বিমত থাকবে না। গান এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা জীবন এই দুয়ের সহাবস্থান ‘স্মৃতিকথার এ-ও এক চলন’। এই বইতে একদিকে যেমন আছে দেবব্রত বিশ্বাস সম্বন্ধে অনেক অজানা কথা, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে সুচিত্রা মিত্র এবং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়কির তুলনামূলক আলোচনা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি ভারতীয় রাগসংগীত, যন্ত্রসংগীত, লোকসংগীত এবং আধুনিক, সবটাই জায়গা করে নিয়েছে তার লেখায়। ছোটবেলা থেকেই মায়ের হাত ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবদন্তি শিল্পীদের দেখা এবং শোনার অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে রয়েছে। শুধু তাই নয় আছে অনেক মজার ঘটনাও। ছোটবেলায় দেখা ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের একটি অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে লেখিকা বলছেন, “কে যেন প্রশ্ন করলেন মেয়েটির মাকে—‘খাঁ সাহেব তো কিছুদিন হলো সিনিয়র তবলিয়াদের নিয়ে বসছেন না। ওই দিন কে ছিলেন তবলায়?’ মা বললেন—‘নামটা তো মনে করতে পারছি না, তবে আগে শুনিনি, নতুন। ভালো, তবে একটু লাউড—খুব রূপবান।’ বালিকা সঙ্গে সঙ্গে বলে বসল, ‘যিনি সরোদ বাজাচ্ছিলেন, তিনিও খুব সুন্দর দেখতে —-তবলার চেয়েও ভালো দেখতে।’ এক মুহূর্ত সবাই চুপ। তারপর সাবালকদের ঘর –ফাটানো হাসি।” (পৃ-২৬)
এই প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। যেখানে লেখিকা বলছেন, “বাসস্টপের লাগোয়া ফুটপাতে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়ানো একজন, মাকে দেখে হাসলেন। মাও হেসে এগিয়ে গেলেন বাসস্টপ ছেড়ে, মেয়েকে বললেন ‘জানো কে? — দেবব্রত বিশ্বাস।’ তারপর ভদ্রলোককে বললেন ‘আকাশ ভরা আর যেতে যেতে —এ দুটো গান ওকে রোজ শোনাতে হয়।’ ভদ্রলোক হাসলেন, ‘হ, পোলাপানে আমার গান খুব পছন্দ করে, বড় হইল্যে আর অতটা করে না —-যাক, পোলাপান থাইকতে থাইকতে একদিন লইয়্যা আইস মাইয়্যারে আমার বাড়িতে।’ কিন্তু ওই পোলাপানবেলায় আলাপচারিতার পর ভদ্রলোক চোখের আড়াল হতেই মেয়ে গদগদভাবে মাকে বলল, ‘যেমন সুন্দর গলা, তেমনি সুন্দর দেখতে।’” (পৃ-২৭)
মেয়েটির কথায় ব্যথিত হয়ে মা সেদিন বুঝিয়েছিলেন, এত বড় মানুষের চেহারা নিয়ে এমন কথা সে যেন আর না বলে। সেদিনের সেই বালিকা বড়দের বোঝাতে পারেনি শিশু মনের সরলতায় যে অনুভূতিকে সে স্পর্শ করেছে তাতে শিল্প এবং শিল্পীর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে সে মেলাতে পেরেছে।
কখনো কখনো প্রচলিত ধারনা বা ভাবনাকে সঙ্গী করে একটু অন্যপথে হাঁটলে শুধু যে সাধারণের থেকে তফাৎ তৈরি করা যায় তাই নয় নিজের ভাবনার মূল্যায়নও করা যায়। সঠিক সময়ে সঠিক প্রয়োগই সাধারণকে অসাধারণ করে তোলে। উলটোদিকের দর্শক-শ্রোতাও পারে না তার আত্মিক টান উপেক্ষা করতে। এ ব্যাপারে লেখিকা সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন। যেখানে সত্যজিৎ রায় ঘরে-বাইরে ছবির শেষ দৃশ্যের আবহে টোড়ি ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেছেন, “টোড়ি ব্যবহার করব, এটা প্রথম থেকেই ভাবা ছিল। আরো অনেক সকালের রাগ আছে ঠিকই। কিন্তু ঐ মুহূর্তে ভৈরবী চলে না, আশাবরী, রামকেলি, ললিত কিছুই আসে না। আসলে সুরের ব্যাপারটা তো ঠিক মুখের কথায় বলে বোঝানো যায় না, তবে সকালের উদাস ভাবটা ছাড়াও টোড়িতে এমন একটা কিছু আমি পাই, যেটা ওই starkness-এর আবহ হতে পারে, মনে হয়।”(পৃ-১০) (অশোক সেন স. বারোমাস, মার্চ- এপ্রিল ১৯৮৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)
অন্যদিকে লেখিকা নিজের স্মৃতির ঝুলি থেকে একটি ঘটনা বের করে এনে বলেছেন, “গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ার দিকে ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স-এর এক রাতভর অনুষ্ঠানে সদ্য তখন পাদপ্রদীপের আলোয় আসা রশিদ খানের দরবারী কানাড়ায় রাত ভোর হয়েছিল। শিল্পীকে পরবর্তীকালে যখনই শুনেছি, সেই দরবারী কানাড়াকে পেরোতে পারিনি। এ নিশ্চয় শ্রোতা হিসেবে আমার সীমা কিংবা অজ্ঞতা! আবার সামনে বসে যতবার শুনেছি ভীমসেন যোশীকে, প্রতিবারই সুরমণ্ডলে ঝংকার দিয়ে প্রথম সুরক্ষেপটি যখন করতেন কণ্ঠে, কেমন এক আচ্ছন্নতা ঘিরে ধরত।” (পৃ-১৭) ভালোলাগার আচ্ছন্নতায় যখন শ্রোতার নিজস্ব ভাবনার বৃত্ত অবরুদ্ধ হয় তখনই মনের মধ্যে জন্ম হয় এই দ্বিধাবিভক্তির। আসলে ‘ভালোলাগা’ এই শব্দটা কোনো ব্যাকরণ মানে না। কানের ভিতর দিয়ে কীভাবে মরমে ‘পশিবে’ সেটা একান্তই আপেক্ষিক এবং ব্যক্তিগতও বটে। শিল্পী এবং শ্রোতার মধ্যে কথা-সুরের সেতুবন্ধনের দায় খানিকটা পরিবেশ পরিস্থিতির ওপরও বর্তায়। তবে শিল্পী তাঁর গায়কির মাধ্যমে যতক্ষণ না মনের দুটি সূক্ষ্ম তারে জোড়া লাগাতে পারছেন ততক্ষণ এ ভালোলাগা সম্পূর্ণ হয় না।
অনেক সময় অনুভূতি আর অভিব্যক্তির মধ্যে থাকে বিস্তর ফারাক। অভিব্যক্তি কখনো কখনো তার যৌক্তিকতা হারালেও অনুভূতি একেবারেই নয়। এই দুটি আপাত বিপরীতমুখী রেখাকে একই সরলরেখায় মিলিয়ে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। যা অনায়াসেই করেছেন লেখিকা রুশতী সেন। শিশুকাল থেকে তার গান নিয়ে ভালোলাগা না লাগা, পছন্দ-অপছন্দের এক অদ্ভুত বর্ণনাময় উপাখ্যান “স্মৃতিকথার এ-ও এক চলন”। সব ধরনের পাঠকের কাছে এ বই সুখপাঠ্য নাও হতে পারে কিন্তু গুণমানের বিচারে কাছে থাকলে অবশ্যই এ বই একটি মূল্যবান সংগ্রহ।