ওলন্দাজদের শহরে রাস্তাঘাট খুব ভালো - সমতল, মসৃণ, সুন্দর। গাড়ি যাবার পথের পাশেই সাইকেল যাবার আলাদা পথ আর তার পাশে পদযাত্রীর ফুটপাথ। তিন সমান্তরাল পথ পাশাপাশি চলেছে। আমরা ক’জন হেঁটে যাচ্ছিলাম ফুটপাথে। গিন্নি দেখতে চাইলেন কোনো সাইকেল আসছে কিনা। ও দেশে সাইকেল-চালকরাই রাজা, কারুর জন্য থামে না। পথে কোনো পদচারীকে দেখলে – বা না দেখলে – ধাক্কা মারতেই পারে। গাড়ি-চালকরা কিন্তু সাধারণত অমায়িক। কেউ যদি জে.ব্রা ক্রসিঙে রাস্তা পার হয়, তাহলে গাড়ি থামবে। কেউ যদি অন্যত্র রাস্তা পার হতে চায়, তাহলে অবস্থা বিশেষে থামতেও পারে। সাইকেল-চালকরা অন্য নিয়মে চলে – ঝড়ের বেগে, বিনা-হেলমেটে, কারুর তোয়াক্কা না ক’রে। এইসব মাথায় ছিল ব’লেই বোধহয় গিন্নি কাছাকাছি কোনো সাইকেল আছে কিনা সে বিষয়ে একটু ওয়াকিবহাল হ’তে চাইছিলেন। আমরা কিছুটা লক্ষ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম শহরে। হয়তো তিনি ভাবছিলেন সম্ভাব্য রাস্তা পার হওয়ার কথা।
একটা সমস্যা হল।
ফুট-পথ আর সাইকেল-পথের উচ্চতায় সামান্য হেরফের ছিল। ইঞ্চি দুয়েক। গিন্নির ডান পা পড়ল ঠিক সেই সঙ্গমস্থলে – বেঁকে, ত্যারছাভাবে। আমার চোখে পড়ল না, কারণ তিনি পেছনে ছিলেন। কল্পনা ক’রে নিতে পারি যে তাঁকে এক মুহূর্ত হয়তো ত্রিভঙ্গ বরনারীর মত দেখালো। তিনি ভারসাম্য হারালেন এবং পড়লেন মুখ থুবড়ে। অর্ধেক এদিকে। অর্ধেক ওদিকে। ব্যাকুলিতবাহু অবনতমুণ্ড বিস্তৃতপদ।
পড়তে কতক্ষণ লাগে? এক সেকেন্ড? দেড়? সময় তো আপেক্ষিক!
যেই অণু-মুহূর্তে পা বেঁকেছে এবং মাধ্যাকর্ষক শক্তির প্রলোভন জেগেছে, তৎক্ষণে তাঁর মাথার মধ্যে কালের যাত্রা গেছে শিথিল হ’য়ে। নতজানু হ’তে হ’তে তিনি ভেবেছেন: জান্ যায় পর্ জানু না যায়।
কেন এ হেন চিন্তা?
ছ’মাস আগে তাঁর দুই হাঁটুই বদলি হয়ে গেছে। অতি-বাবহৃত মালাইচাকি বাতিল ক’রে, টাইটেনিয়ামের পাত বসানো হয়েছে বিস্তর নাট-বল্টু দিয়ে। ছ’মাস ধ’রে চলেছে আরোগ্য, ব্যথার ওষুধ, অঙ্গসংবাহন, ব্যায়াম। ইদানিং প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। টানা এক ঘন্টা হাঁটতে পারছিলেন। এ হেন অবস্থায় যদি হাঁটুতে হঠাৎ হোঁচট লাগে, তবে মহাবিপদ। তাই মাটির আকর্ষণে তিনি যখন নিম্নগামী এবং বাঁ পা ভূমিস্পর্শহীন, হাঁটু বাঁচানোর প্রবল প্রয়াসে তিনি সমস্ত ভার ছাড়লেন ডান গোড়ালিতে। যাকে বলে রাজ মোচড়। তারপর আর্তনাদ।
তাড়াতাড়ি উবের ডেকে বাড়ি ফিরলাম। ক্রেপ্ ব্যান্ডেজ্। ব্যথার ওষুধ।
রাত কাটলো। হাড় বোধহয় ভাঙেনি।
এক দিন গেল। পা ফুলে আছে। ব্যথাও আছে, কিন্তু মর্মান্তিক নয়।
দুই দিন গেল। ব্যান্ডেজ চলছে। স্নান বন্ধ। আর একদিন পরে কলকাতা ফেরার টিকিট। তাই গাড়ি ক’রে অল্প ঘোরাঘুরি, বেড়ানো।
হাড় বোধহয় ভাঙেনি।
তারপর উইলচেয়ার সহযোগে দীর্ঘ যাত্রা। কলকাতা।
“একি! ডাক্তার দেখাসনি? ফুলে আছে তো! এক্সরে করিসনি?”
দুর্গা পুজোর বাজার। তাও ষষ্ঠীর দিন ডাক্তার পাওয়া গেল। তিনি বললেন, “এ তো মনে হচ্ছে ভেঙেছে।”
এক্সরে হ’ল। গোড়ালির হাড়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটা সদ্যকৃত ফাঁক।
হাড় ভেঙেছে।
ডাক্তারবাবু একটা খুব দামী ও বেজায় ভারী জুতো গছালেন। সেটা দিনরাত প’রে থাকতে হবে। আগেকার দিনের মত প্লাস্টার না ক’রে, অপসারণযোগ্য প্লাস্টার। বলা যেতে পারে স্থাবরতা-সঞ্চারক। স্নান করা যাবে না।
দশদিন পর আবার এক্সরে হ’ল। ডাক্তারবাবু বললেন, “এ তো সারছে না! ফাঁকটা বেড়ে যাচ্ছে।” প্রমাণস্বরূপ এক্সরে ছবি দেখালেন। বললেন, “অপারেশন করতে হবে।” হাঁটুর মত গোড়ালিতেও টাইটেনিয়াম লাগাতে হবে।
এবার হাসপাতাল।
কলকাতায় হাসপাতালের ছড়াছড়ি। এমন কি বিদেশ থেকেও বেড়া টপকে লোক আসে চিকিৎসা করাতে। কোনো কোনো হাসপাতাল খুব বড়, উঁচু উঁচু বাড়ি, সারাক্ষণ গমগম করছে, অনন্ত জনস্রোত। অসুস্থ মানুষের আরোগ্যের জন্য কারবার চলেছে রাতদিন। ডাক্তার, নার্স আর প্রশাসকদের অক্লান্ত সাধনা। কোনো কোনো হাসপাতাল আবার গ্রীক রোমান দেবতাদের নামে। সেরকমই এক স্বনামধন্য হাসপাতালে গিন্নিকে ভর্তি করলাম। সেখানে আবার আমাদের “চেনাশোনা” আছে, তাই হয়তো বিশেষ সুবিধে পেতে পারি। ভারতবর্ষের আরেক নাম তো চেশোবিসু।
ভর্তি হবার আগে অবশ্য দু-একদিন হাসপাতালে যাওয়া চাই। ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানি আর হাসপাতালের ঘটকালি করতে। কয়েক ঘন্টার মামলা। ভাগ্যিস আমার সময়ের কোনো দাম নেই!
ডাক্তারের সহকারীকে ধ’রে একটা মহাভারত-সাইজে.র ফর্ম পাওয়া গেল। আমার সঙ্গে পেন নেই। সহকারীটি খুবই সহানুভূতিশীল একটি যুবতী। পেন ধার দিলেন (যেটা আমি ফেরত দিতে ভুলে গেলাম)। সব শূন্যস্থান পূরণ করার পর বললেন ইন্সিয়োরেন্স ডেস্কে যেতে। গেলাম।
দুটো পাশাপাশি আপিস, কাঁচের দেওয়াল, বাইরে থেকে অভ্যন্তর দেখা যায়। একটা হ’ল ইন্সিয়োরেন্স ‘অফিস’ আর একটা হ’ল ইন্সিয়োরেন্স ‘ডেস্ক’। একটা বড়, একটা ছোট। ছোটটাতে ঢোকার লম্বা লাইন লেগেছে। তাই বড়টাতে গেলাম, মানে ইন্সিয়োরেন্স অফিসে।
“এখানে না।” তর্জনি তুলে ভদ্রলোক পাশের দেওয়ালের দিকে দেখালেন। “ওই দিকে ইন্সিয়োরেন্স ডেস্কে যান।”
গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। একটু গুঁতোগুঁতি, ঠেলাঠেলি। সবার খুব তাড়া। ভাগ্যিস আমার কোনো তাড়া নেই।
খানিকক্ষণ পর পৌঁছলাম ডেস্কে। ভদ্রলোক অনেক কিছু বললেন। কিছু অবান্তর, কিছু দুর্বোধ্য। মোদ্দা কথা বুঝলাম: গিন্নির দুটো ছবি লাগবে, চার বছরের ইন্সিয়োরেন্সের প্রমাণ লাগবে এবং আরো কিছু কাগজপত্র।
বাড়ি ফিরে এলাম।
সব কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস জড়ো ক’রে আবার হাসপাতাল গেলাম। ভারী আধুনিক জায়গা, আলোকোজ্জল, কম্পুটারাইজ.ড। অক্লান্ত কর্মচারীদলের অবিরাম কর্মযজ্ঞ। ইন্সিয়োরেন্স ডেস্কে লোক বদলে গেছে। যাবেই তো। পাঁচঘন্টা কেটে গেছে।
নতুন লোক সব দেখে-টেখে বললেন, “পাশের অফিসে নিয়ে যান।” মানে আমার পদোন্নতি মনজুর করলেন। এবার ইন্সিয়োরেন্স ’অফিস’।
গেলাম। সেখানকার ভদ্রলোক বললেন, “এ তো নিতে পারব না।”
অ্যাঁ!
আমাকে বোঝালেন, “পাশের অফিস থেকে সই করিয়ে আনুন।”
“আমি তো ওখান থেকেই এলাম।”
“সই ছাড়া আমি নিতে পারব না।”
ফিরে গেলাম ‘ডেস্কে’। পদোন্নতি এখনো হয়নি। কিন্তু আমার মনে আশা আছে।
লাইনে না দাঁড়িয়ে, একজনের যাওয়া এবং আরেকজনের আসার মধ্যে সুড়ুত ক’রে নিজেকে সেঁধিয়ে বেপরোয়া হয়ে বললাম, “আপনি সই করেননি, স্যার!”
অবাক দৃষ্টি মেলে তিনি আমার হাত-বাড়ানো কাগজ দেখলেন।
“ঠিক কথা। কেন সই করিনি বলুন তো?”
আমি সৎ মনে বললাম, “আমি তো জানি না, স্যার!”
উনি কাগজ নিয়ে অত্যন্ত দক্ষ ভাবে দ্রুত একটা আরশোলার ঠ্যাং আঁকলেন। আমি মুদ্রাঙ্কিত নথিপত্র নিয়ে ফিরে গেলাম ইন্সিয়োরেন্স ‘অফিসে’।
সেখানকার ভদ্রলোক তখন ফোনে। কোনো এক নাছোড়বান্দা মক্কেলের বিবিধ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন অসীম ধৈর্যসহকারে অনেকক্ষণ ধ’রে। পরিশেষে ছাড়া পেয়ে ফোন রাখামাত্র, আবার ক্রিং ক্রিং। আরেক খদ্দের। আরো অনেক প্রশ্নোত্তর, পুনরাবৃত্তি, অমায়িকতা। আমি হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার তাড়া নেই। প্রশ্নগুলো শুনতে পাচ্ছি না, কিন্ত অনেক উত্তরই যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক।
এই নিরাশা-পরিপূর্ণ মানব জীবনে একটা চিরন্তন আশা হ’ল এই, যে সবকিছুই কোনো না কোনো সময়ে শেষ হয়, সে আগেই হোক বা পরেই হোক।
অনেক অদৃশ্য ক্রেতার সাথে অনেক অবোধ পুনরুক্তির পর আমার পালা এল।
না, দুটো ছবি লাগবে না, একটা ছবি লাগবে। না, চার বছরের ইন্সিয়োরেন্সের প্রমাণ লাগবে না, এক বছরের লাগবে।
ভাবলাম… পাশাপাশি ঘর – তার দেওয়াল ভেদ ক’রে যদি সঠিক তথ্য এদিক-ওদিক হ’ত, আমার একটু সময়, একটু টাকা আর একটু প্রয়াস বাঁচত। ভাগ্যিস আমার এসবের কোনো দাম নেই!
পরদিন সন্ধ্যায় গিন্নি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। তার পরদিন সকালের দিকে অপারেশন। ওয়েটিং রুমে ব’সে ব’সে কম্পিউটার স্ক্রীনে বিভিন্ন রুগীর উপর অস্ত্রোপচারের হাল ও অগ্রগতির খবর দেখতে দেখতে খিদে পেয়ে গেল। রোগীর নাম কোথাও নেই, শুধু ডাক্তারের নাম ও ব্যারাম। হাসপাতালে মোট নটা ‘ওটি’ আর ‘কিউ’-তে বাইশটা রুগী – কেউ অপেক্ষারত, কেউ প্রস্তুত, কেউ অজ্ঞান, কেউ সমাপিত। এখানে মরতে চাইলেও লাইনে দাঁড়াতে, থুড়ি শুতে, হয়।
একতলায় নেমে ‘কাফে’-তে কিছু ভয়াবহ বস্তু খেলাম, সাথে কাগজের কাপে উষ্ণ কোনো তরল পদার্থ যার স্বাদটা চেনা চেনা।
দু’দিন পর ডিসচার্জ। দুপুর বারোটায় পৌঁছলাম। নার্স স্টেশনে ব’লে দিলাম আজ ছাড়বে, যেন ওনারা কাগজপত্র তৈরি রাখেন।
খানিক পর ইন্সিয়োরেন্স অফিস। তারপর রোগীর ঘর। আবার ইন্সিয়োরেন্স অফিস – এটা অন্য ইন্সিয়োরেন্স অফিস, এখান থেকে ছাড়পত্র বেরোয়।
দু’টো বাজল। ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানি আর হাসপাতালের যে ঘটকালি করেছিলাম ক’দিন আগে, তাতে কোনো গন্ডগোল বেঁধেছে। বোধহয় যৌতুক নিয়ে। এ কৌতুকের কোনো শেষ নেই।
তিন’টে বাজল। চারটে।
রোগী প্রথমে ক্রুদ্ধ, তারপর মরিয়া, তারপর নিরাশ্বাস, শেষে পরাজিত।
পাঁচটার সময় সেই প্রথমে-যাওয়া ইন্সিয়োরেন্স অফিসে – যেখানে অনেক রসাল টেলিফোন-কথোপকথন শুনতে ও আরশোলার ঠ্যাং দ্যাখাতে হয়েছিল – এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা ও তাঁর কুড়ি বছর বয়সের ছেলের সাথে আলাপ হ’ল। স্বামী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কোনো চিকিৎসার জন্য। হাসপাতালের কাজ ফুরিয়েছে, তবু গত ছত্রিশ ঘন্টা ধ’রে স্বামীকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে এখনো কৃতকার্য হ’তে পারেননি। ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানি ও হাসপাতাল কিছুতেই সমঝোতায় আসতে পারছে না।
বুঝলাম এবার ওই ‘বিশেষ সুবিধে’ নেবার সময় হয়েছে।
কয়েকটা ফোনকল। আরো কিছু অপেক্ষা। ইত্যাদি।
সাতটা নাগাদ তলব পড়লো বিলিং অফিসে যাবার জন্য। একটা চিঠি লিখে দিতে হবে যে আমি নিজদায়িত্বে রোগী নিয়ে যাচ্ছি, আমি নেশাগ্রস্ত নই এবং যদি ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানি পুরো টাকা না দেয় তাহলে আমি ভবিষ্যতে সেই ভার বহন করব। সোজা ব্যাপার, সিধে পথ। বিলিং অফিসে এক ভদ্রলোক বললেন, “সব জালি, বুঝলেন? সব জালি।” মাথা নাড়লাম। আরো অনেকেই সম্মতি জানালো। ভদ্রলোক আরো বললেন, “পিসেমশায়কে বাহাত্তর ঘন্টা ভেন্টিলেটার দিয়েছিল, মশাই। আর বিল করেছে দু’শ ঘন্টার।” আমি আর কি বলব?
শেষে ন’টার সময় ছাড়া পেলাম। গিন্নিকে সাথে নিয়ে গাড়ি ক’রে বাড়ির উদ্দেশে পাড়ি। মানসিক ভাবে আসলে আমি দৌড়চ্ছিলাম।
সাতদিন কেটে গেছে। হাসপাতাল থেকে বা ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানি থেকে আর কোনো খবর আসেনি। গিন্নি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন।
ফোন বাজল।
“হ্যালো?”
“আমি হাসপাতাল থেকে ফোন করছি।”
“বলুন।”
“আপনাদের কুড়ি হাজার টাকা দিতে হবে। বাকি সব ইন্সিয়োরেন্স দিয়ে দিয়েছে।”
“বেশ।”
“কি ভাবে টাকাটা দিতে চান? অনলাইন?”
“না।”
“তাহলে বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দিই?”
“বেশ।”
“কবে পাঠাব? কাল সকালে?”
“ঠিক আছে।”
“সকাল দশটা নাগাদ?”
“না, না। নটায় আসুন। আমি দরজার বাইরে একটা চেয়ার পেতে দেব। দিনে দু’বার চা-বিস্কুট দেব। আর যদি সারাদিন ওখানে ব’সে থাকেন, তাহলে সন্ধে ছ’টা নাগাদ টাকাটা পাবেন।”
ফোন নামিয়ে রাখলাম।