গল্পের এমন হরেক বাহার দু-মলাটে উঠে এসেছে বিবিধ রতন-এ। সন্দীপ দাশগুপ্ত প্রণীত এবং সুব্রত চৌধুরী চিত্রিত। বইটির প্রকাশক একলব্য, নামলিপি ও গ্রন্থ পরিকল্পনা সোমনাথ ঘোষের, বিন্যাস কৌশিক আকীর, মুদ্রিত মূল্য পাঁচশো। দাম শুনে চমকে উঠতে পারেন কেউ কেউ। অনেকে আবার বলতে পারেন ২২০ পাতার একটি অড সাইজের বইয়ের এত দাম! কিন্তু একবার হাতে নিলে আশা করি দামের বিষয়টি জায়েজ বলেই মনে হবে। তবে একথাও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কারও কারও নির্ধারিত মূল্য প্রদানে সমস্যা হতে পারে আর্থিক পরিস্থিতি অনুযায়ী। কেন বললাম মুদ্রিত বিক্রয়মূল্যটি জায়েজ। এমন চমৎকার প্রোডাকশন এই সময়ে খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। ছাইরঙা টেক্সচার পেপারের উপর সুব্রত চৌধুরীর অসাধারণ কাজ ফুটে উঠেছে কালো সিল্ক স্ক্রিনে। তার উপর লাল সিল্ক স্ক্রিনে বইয়ের নাম। পুস্তানিতে দুধে আলতা রঙের কাছাকাছি কোনো রঙের (কারণ রঙ বিষয়ে বিশেষ ধারণা নেই) এক অপূর্ব সুন্দর কাগজ। ভিতরের কাগজ যেমন ভালো, ছাপা তেমনই ঝকঝকে, স্পষ্টভাবে সুব্রত চৌধুরীর প্রতিটি ছবি ফুটে উঠেছে প্রিন্টিংয়ের কারিগরিতে। তাই সবমিলিয়ে প্রকাশককে একটি বাড়তি তারিফ করতেই হয়।
এবার আসি গল্পের কথায়। সব গল্পের বিবরণ দিয়ে যাঁরা এই বই এখনও পড়েননি, তাঁদের অনাস্বাদিত স্বাদকে নষ্ট করতে চাই না। দুধের স্বাদ যাতে ঘোলে না মেটে, সেই বন্দোবস্ত করেই কয়েক কথা বলি। কী কী বিষয় অবশ্যই আপনার চোখে পড়বে? পাতা ওল্টালেই দু-পাতা জুড়ে পাতার নীচে টানা ছবি, গুরুমশাই এবং তার টোলের পড়ুয়ারা পরপর, উপরে বইয়ের নাম, লেখকের নাম, আলংকারিকের নাম। কপিরাইট পেজ পেরোলেই চোখে পড়বে উৎসর্গের পাতা, ‘প্রণম্য শ্রীপান্থ ও ইন্দ্রমিত্রের স্মৃতিতে’। এরপর চিরাচরিত সূচির বদলে দেখতে পাবেন নিধি নামক অংশ। সেখানে লেখাগুলির শিরোনাম এবং ভূমিকার পরিবর্তে লেখকের কৈফিয়তসূচক অংশ, শিরোনাম বিবিধ রতন। কেন এমন নাম এই অংশটির? কেনই বা বইটিরই এমন নাম? মধুকবির বঙ্গভাণ্ডারে বিবিধ রতন খোঁজার আয়াস থেকে আমাদের গ্রন্থপ্রণেতা যে বিলক্ষণ অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সে কথা নিজেই জানিয়েছেন এই অংশে। সংবাদপত্রে কাজ করতে করতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাহচর্য এবং প্রশ্রয় থেকেই এই লেখাগুলির তৈরি হওয়া। যেভাবে তিনি গল্প শুনেছেন, সেভাবেই বলার চেষ্টা করেছেন গল্পগুলিকে। নিয়মশৃঙ্খলার যাঁতাকলে অ্যাকাডেমিক নিবন্ধ লিখতে না পারার কিঞ্চিত আক্ষেপ তাঁর রয়ে গেছে বটে, তবে যে বিপুল পরিমাণ গবেষণা এই লেখাগুলির হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে, তার পরিচয় পাঠকমাত্রই পাবেন যদি লেখাগুলিকে পড়ে ফেলেন। এ ছাড়াও পরিচয় পাবেন ডুবায়ে অতল জলে শীর্ষক অংশে পৌঁছলেই। বিবিধ রতন এবং ডুবায়ে অতল জলে-কে বাদ দিলে সর্বমোট ১৪-টি লেখা এবং ততোধিক আকর্ষণীয় শিরোনাম। শুরুর লেখার নাম দিনান্তে হইলা বন্দী, শেষ লেখার নাম হা পুত্র হা বীরবাহু। মধু কবির দ্বারা আমাদের লেখক কতখানি প্রভাবিত তার পরিচয় উনি নিজেই দিয়েছেন, তাই অতিকথনে কাজ নেই। বাঙালিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পৃথিবীর নানাখানে ছড়িয়ে গেছেন। কাজে-অ-কাজে তাঁদের অনেককেই আমরা মনে রেখেছি, আবার অনেকের কথা একেবারেই মনে রাখিনি, রাখার খুব বেশি প্রয়োজনও পড়েনি। যেমন ধরুন একসময়ের দাস-দাসী বিক্রির কাহিনি। অনেকেই শুনেছি বটে কিন্তু মারিয়া বা আনার মতো কিছু নাম যে আদতে বাঙালি এবং তারা যে এক বাঙালি ক্রীতদাসী অ্যাঞ্জেলার মেয়ে, এমন তাক লাগানো কাহিনি আমি অন্তত শুনিনি। তেমনই আপনি জানতে পারবেন টাইটাসদের কথা, তারাও বাঙালি। আর এসব কাহিনি আজকের নয়, সেই ১৬৫৬, ১৬৬২-র সময়ের, ভারত থেকে বহুদূরে কেপটাউন, বাটাভিয়ার কাহিনি সব। কোন লেখায় পাবেন এই গল্প? খুঁজে নিতে হবে একটু কষ্ট করে, নামটা বলে দিলে সব কৌতূহলই মাটি। গুরুমশাইদের শাস্তির হরেক রকমের বাহার ঠিক কেমন হাল করেছিল শিক্ষাব্যবস্থার সেই নিয়েও রয়েছে গল্প। সেই গল্পে দীনেশচন্দ্র সেনকেও পাবেন আবার শিবনাথ শাস্ত্রীও বাদ যাবেন না। গল্পের বিষয় এবং কথন, অতিশয় সুখপাঠ্য।
গল্পের ডালির এই সবে শুরুয়াৎ। একটু এগোলেই জানতে পারবেন বিদ্যাসাগর নিজের স্ত্রীকে পড়াশোনা করানোর অনুমতি নিজের বাবার কাছে না পেয়ে, বাবার আদেশকেই মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন। পেয়ে যাবেন হেমাঙ্গিনীর গল্প, জানতে পারবেন চঞ্চলবালা দাসীর কথা। চঞ্চলবালা এক মহিলা ফোটোগ্রাফার। তার দোকানের ঠিকানা ছিল প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটে পতিতা পল্লী হিসেবে চিহ্নিত হাড়কাটা গলিতে। রাসসুন্দরীর কথা আমরা অনেকে জানি। এখানে তাঁর প্রসঙ্গের পাশাপাশি জানতে পারবেন শোভা ঘোষের গল্প। বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেলেও তিনি তার আগেই পড়াশোনা করেছেন গুরুমশাইয়ের কাছে। তাঁর শাশুড়ি অন্নদাসুন্দরীও পড়াশোনা করেছেন, কবিতা লিখেছেন। এইসব আজ থেকে কয়েকশো বছর আগের গল্প। পাতার পর পাতা ওল্টালেই বিবিধ রতনেরা আপনাকে অনেক দূরের দেশে নিয়ে যাবে। আপনি চলে যাবেন সুদূর মেসোপটেমিয়ায়। সেইখানে গিয়ে পাবেন প্রবোধ ঘোষের কথা। ‘হুজুগে’ বাঙালির যুদ্ধযাত্রার নানা কিসিমের গল্প আপনাকে অবাক করতে পারে। ‘রবিনহুড’ সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের নাম আমরা অনেকেই জানি না। কীভাবে বাংলা থেকে সুদূর ব্রাজিলে পৌঁছে একজন যোদ্ধা হয়ে উঠলেন তিনি, সেই গল্পও মিলবে বিবিধ রতন-এর ভাণ্ডারে।
গল্পের বিশদ বিবরণ বিস্তৃত। আয়তনের বিচারে সেই সমস্ত বিবরণ তুলে ধরা সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়। আরও যে যে গল্প আপনাকে চোরা স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে তার কয়েকটা প্রসঙ্গ জানিয়েই অন্যদিকে যাব। রাজা রামমোহন রায়ের দত্তক পুত্রকে নিয়ে আগ্রহ থাকুক বা নাই থাকুক, এই বই আপনার আগ্রহ তৈরি করতে পারে অনায়াসে। তেমনই সেকালের বাবা-ছেলের সম্পর্ক কেমন ছিল তাও একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবেন। রজনীকান্ত গুহ শৈশবে কীভাবে বাবার প্রহার সহ্য করেছেন হেতুক এবং অহেতুক তার গল্প জানতে পারবেন এই বইয়ের পাতার ভিতর থেকে। আর কী কী গল্প জানতে পারবেন? তার জন্য খুঁজতে হবে এবং পড়তে হবে। একটি বইয়ের পুনর্মূল্যায়ন করার কাজ খুব কঠিন। এখনও পর্যন্ত আমার লেখা থেকে কেবল প্রশংসাবাণীই খুঁজে পাওয়া স্বাভাবিক কারণ এর বাইরে সত্যিই কিছু বলার নেই। কেন পড়বেন এই বই? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, গল্প জানতে। কোনো ভাষার জটিলতা বা দূরূহ বিষয়-আশয়ের প্যাঁচপয়জার দিয়ে কুহক তৈরির চেষ্টা লেখক করেননি। একদম সোজাসাপটা গল্প বলেছেন পাঠকদের। এই গল্পেই বুঁদ হয়ে পড়ে ফেলা যায় বিবিধ রতন। যে তিনটে কথা অবশ্যই বলার, এক. সুব্রত চৌধুরীর হাতের কাজ। প্রতিটি গল্পকে জীবন্ত করে তোলে তাঁর লিনোকাটধর্মী ছবিগুলি। একটি করে গল্পের শুরুতে সেই গল্পের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে একটি ছবি। এছাড়াও প্রায় সবক্ষেত্রেই গল্পের ভিতরে ভিতরে অলংকরণ। এ প্রাপ্তির কোনো তুলনা নেই। ছবি গল্পের স্বাদকে অনেকখানিই বাড়িয়ে তুলেছে। এই বই যতটা সন্দীপ দাশগুপ্তের, ততটা সুব্রত চৌধুরীর। প্রমাণ প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে গোটা বই জুড়েই। লেখা ব্যতীত চাইলে ছবি দিয়েও পড়ে ফেলতে পারেন। দুই. বানান। যিনি বা যাঁরা (অবন বসুর নাম আগেই উল্লিখিত, তবে তাঁর সঙ্গে আরও কেউ থাকতে পারেন ভেবে লেখা) সামগ্রিকভাবে বইটির পাঠ সম্পাদনা করেছেন, তিনি বা তাঁরা যথেষ্ট সচেতনভাবেই কাজটি করেছেন। যেটুকু প্রমাদ চোখে পড়েছে, তা অতি সামান্য। তাই আলাদা করে আলোচনার জায়গায় যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। তবে একটা বিষয় বলার, দ্বিতীয় সংস্করণের পূর্বে সম্ভব এবং সুযোগ হলে আরেকবার পাঠ সম্পাদনা করা যেতে পারে। তিন. লে আউট এবং নামলিপি। সোমনাথ ঘোষ এবং কৌশিক আকী অনবদ্য সাজিয়েছেন বইটিকে। এত পরিশীলিত লে আউট এবং নামলিপি পাঠককে আকর্ষণ করতে বাধ্য। সন্দীপ দাশগুপ্ত জানিয়েছেন তাঁর বাবার কথা, শ্রদ্ধেয় সুবোধ দাশগুপ্ত। তাঁর পরিচয় এবং খ্যাতির কথা অনেকেই জানেন। এই বই সংগ্রহ করতে গেলে কেউ কেউ হয়তো সন্দীপ দাশগুপ্তকে সুবোধ দাশগুপ্তের ছেলের পরিচিতিতেই সংগ্রহ করবেন। কিন্তু এই পরিচয় ব্যতী রেখে বিবিধ রতন সন্দীপ দাশগুপ্তেরই বই হয়ে উঠেছে। তাঁর পরিচয় তিনি নিজেই প্রমাণ করেছেন সমগ্র রত্নভাণ্ডার জুড়ে। প্রকাশক একলব্য এবং সুশোভন প্রামাণিককে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা এমন একটি বই পাঠকের সামনে এইভাবে পরিবেশনের জন্য।