মানব চক্রবর্তী পর্যটক হিসেবে পুরুলিয়ায় যাননি। কলকাতার নাগরিক ফুটপাত ছেড়ে কাঁকুড়ে লাল মাটির দেশে তিনি পা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন জীবিকার বাধ্যবাধকতায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মচারী মানববাবু ‘১৯৯১ সালের ২৮ কি ২৯ এপ্রিল’ ( পৃ-১৫) বদলি হলেন অযোধ্যা পাহাড়ের কাছাকাছি একটা গ্রাম আহাড়রায়। পঁচিশ কিলোমিটার দূরের পুরুলিয়া শহরের ভাড়াবাড়ি থেকে বাসে-ট্রেকারে করে নিয়মিত তাঁকে পৌঁছোতে হত আহাড়রায়। আহাড়রা একটি ‘ওয়ান-ম্যানব্র্যাঞ্চ’। (পৃ-৯৩) ফলে ম্যানেজার, ক্যাশিয়ার, করণিক, লোন অফিসার — সবই তিনি। তিন বছরের বসবাস, নিয়মিত যাতায়াতের পঞ্চাশ কিলোমিটার, ব্যাঙ্কের একমাত্র অফিসার হিসেবে পুরুলিয়ার পাহাড়-অরণ্য ছোঁয়া, সে সময় বাস্তবিকই দুর্গম এই সব এলাকায় কাজের সূত্রে ঘুরতে ঘুরতে লেখক খুব কাছ থেকে দেখেছেন এখানকার সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি এবং মানুষকে। অদ্ভুত একধরনের সহজিয়া কথনভঙ্গিতে রসের ছিটে ছড়িয়ে মানব চক্রবর্তী এঁকেছেন সেসব স্মৃতি-চিত্র তাঁর এই বইয়ে। তাই পুরুলিয়া বিষয়ে লেখা আলোচ্য বইটি কিছুটা ভিন্ন গোত্রের। ভৌগোলিক বা নৃতত্ত্বের অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিকোণ, নিছক ভ্রমণ কাহিনি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিশ্লেষণ — কোনও শ্রেণিতেই “পুরুলিয়াবাস : ছিন্ন স্মৃতি” পড়ে না। কিন্তু আগ্রহী পাঠক এই বিষয়গুলির সবকটিকেই খুঁজে পাবেন এই স্মৃতিকথায়। শুধু এই সব অতি পরিচিত বিষয় নয়, এই বইয়ে লেখকের দিনলিপির মধ্যে দিয়ে পাঠক বুঝতে পারবেন ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের কেজো জীবনের হাল-হকিকত। উপার্জনের নিরিখে ‘হোয়াইট কলার’ ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের আমরা সাধারণত ঈর্ষার চোখেই দেখি কিন্তু এঁদের দায়িত্ব, পরিশ্রম, জীবিকাগত ঝক্কি-ঝামেলার খবর কতটা রাখি? সেই অজানা জীবিকা-জীবনের অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মানব চক্রবর্তীর এই বইয়ে। এই বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট অংশের উল্লেখ না করে পারছি না। ‘২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯২’ (পৃ-২৩) লেখক সাপ্তাহিক ছুটিতে কলকাতায়। সেদিন রবিবার। ২৮ সোমবার তাঁকে ফিরতে হবে পুরুলিয়ায়। বাবার কাছ থেকে খবর পেলেন, ‘পুরুলিয়ায় খুব বৃষ্টি হচ্ছে, কংসাবতীর জল নাকি বিপদসীমা ছুঁয়ে ফেলেছে।’ (পৃ-২৩) সেদিনই রাতে তিনি পুরুলিয়ায় ফিরতে বাধ্য হলেন, ‘আমার চার্জে ব্র্যাঞ্চ, তার চাবিও আমার কাছে।’ ( পৃ-২৩) সেদিনই তড়িঘড়ি ন-টার বাসে চড়ে পরদিন পুরুলিয়া পৌঁছলেন। তারপর ঘুরপথে বন্যায় ভেঙে পড়া কাঁসাই ব্রিজকে এড়িয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে বর্ষার জলে খরস্রোতা নদী পেরিয়ে ‘অবশেষে যখন কাঙ্ক্ষিত আহাড়রা ব্র্যাঞ্চে পৌঁছোলাম তখন সন্ধে ছটা।’ (পৃ-২৬) দু-দিন বাদেই ইয়ারলি ক্লোজিং। তাই এই পরিশ্রম। পুরুলিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে অতীত এবং বর্তমানেও অভাবিত এই বন্যার প্রাদুর্ভাব পেরিয়ে কষ্ট করেই লেখক ফিরেছিলেন পুরুলিয়ায় ২৯ সেপ্টেম্বর। এ ঘটনা তিরিশ বছর আগের কিন্তু উত্তর বা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, উত্তরবঙ্গ কিংবা পুরুলিয়াতেও বহু প্রত্যন্ত গ্রামে ব্যাঙ্ক সহ অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের এভাবে দুর্গমতাকে হারিয়েই প্রতিনিয়ত কাজ করতে হয়।
এই সমস্ত প্রত্যন্ত দরিদ্র অঞ্চলে ব্যাঙ্কে টাকা জমার চেয়ে লোন নেবার খতিয়ান অনেক অনেক বেশি। এই ঋণ দিতে বা বকেয়া উদ্ধারের জন্য লেখককে ঘুরে বেড়াতে হত আদিবাসী অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রামে। কাছ থেকে দেখেছেন এদের গরিবি, সহজ-সরল সাধারণ জীবন এবং সহজ কথার জলরঙে এঁকেছেন সেই সব ছবি। আছে রসিকতার ছোঁয়াও। এইরকমই একটি প্রসঙ্গ — নাম সমস্যা। লেখকের কথায়, ‘একজন এসেছে তার গ্রামের পঞ্চায়েত-প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে, নাম তার সিপিএম মাহাতো। এখন, ইংরেজিতে sipiem mahato লিখব না ভাওয়েল-বর্জিত cpm mahato লিখব?’ (পৃ-৪৫) লেখক এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ঠেলে দিলেন প্রধানের কোর্টে। উত্তর এলো, “আপনি ম্যানজার আপনি যেটা ‘নাহ্য’ মনে কইরবেন ওইটিই হবেক। হামরা গরিব বটি, হামরা কী বইলব?” (পৃ-৪৫) শুধু এই একটি নয় এইরকম আরও অনেক ছোট ছোট ঘটনা-মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে লেখক এখানকার সহজ-সরল-নিরক্ষর জীবনকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এই সরল জীবনে সেই তিরিশ বছর আগে থেকেই যে ক্ষমতার রাজনীতির রক্তচক্ষুর আধিপত্য, সরকারি লোনের পিচ্ছিল পথ ধরে অর্থনৈতিক দুর্নীতি কমবেশি প্রবেশ করতে শুরু করেছিল, বিভিন্ন ঘটনা সূত্রে উঠে এসেছে মানব চক্রবর্তীর লেখায়।
সার্থক স্মৃতিকথায় গল্প, উপন্যাসের মতো চরিত্রকেন্দ্রিক বিচিত্র জীবনরহস্যের আস্বাদও পাওয়া যায়। লেখকের স্মৃতির পথ ধরে হেঁটে আসা সেই সব চরিত্র-কথার মধ্যে দিয়ে পাঠকের হৃদয় আন্দোলিত হয় প্রহেলিকাময় জীবনের ভাল-মন্দে, আনন্দ-বেদনায়। আলোচ্য স্মৃতিকথায়ও তার অন্যথা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে লেখকের কলমের রেখায় জীবন্ত একটি অদ্ভুত চরিত্রের কথা বলা যায়। পুরুলিয়া শহরের বাসাবাড়িতে লেখকের কর্ম-সহায়িকা ছিল কিশোরী কিরণ। সে দোতলার বাসিন্দা বাড়িওয়ালারও কাজ করত। বাড়িওয়ালাই কিরণকে সুপারিশ করেছিলেন এবং মাসমাইনে যে চল্লিশ টাকা তাও ঠিক করে দিয়েছিলেন। কয়েকমাস পরে কিরণের অবস্থার কথা ভেবে মানববাবু দশ টাকা বাড়িয়ে পঞ্চাশ টাকা করেছিলেন। তারপর লেখকের কথায়, “চৌধুরী রাগে ফেটে পড়লেন। ‘আপনি নাকি কিরণের মাইনে পঞ্চাশ টাকা করে দিয়েছেন। কী ভেবেছেন বলুন তো? কলকাতা থেকে এসে বাবুয়ানি দেখাবেন আর ছোটলোকগুলোকে মাথায় তুলবেন?” (পৃ-১৩৩) এই জন্য বাড়িওলা লেখককে তাঁর বাড়ি ছেড়েও দিতে বলেন। শুধু এইরকম নেতিবাচক চরিত্রই নয়, বেশ কিছু ইতিবাচক চরিত্রের ছবিও পাওয়া যায় এই বইয়ে।
কোলাজের মতো ছোট ছোট অধ্যায়ে লেখক তাঁর পুরুলিয়া জীবনের প্রসঙ্গগুলিকে বিন্যস্ত করে একটি সামগ্রিক অবয়ব তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। লেখক জানিয়েছেন প্রায় সব অধ্যায়গুলিই বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদা ভাবে ফেসবুকে লিখেছিলেন। কিন্তু সেগুলিকে গ্রন্থবদ্ধ করার সময় সম্পাদকীয় কাটাছেঁড়া না করায় বারবার একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির সমস্যা পাঠ করার সময়ে গতি রোধ করেছে। এছাড়া একশো ষাট পাতার “পুরুলিয়াবাস: ছিন্ন স্মৃতি” অত্যন্ত সুখপাঠ্য। সুব্রত চৌধুরীর প্রচ্ছদ ও অলংকরণ আকর্ষণীয়।