• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৩ | জানুয়ারি ২০২৪ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • এক সমুদ্র, আট সৈকত : সুব্রত সরকার



    আমার ভ্রামণিক জীবনের প্রথম পছন্দ জঙ্গল। সে জঙ্গলে বন্যপ্রাণ থাকুক বা না থাকুক...অরণ্য থাকবে আদিম, বনজোছনায় যেন ভেসে যেতে পারি এমনই সুন্দর গহীন গভীর হবে সে বনজ আনন্দ।

    তার পরের পছন্দ পাহাড়। পাহাড়ে চড়ি না চড়ি, পাহাড়তলীতে পৌঁছে যাওয়ার আনন্দ বড় সুন্দর। তারপর ভালো লাগে নদী। জল থৈ থৈ ভরা নদী যেমন দেখতে ভালো লাগে, তেমনই ভালো লাগে বালুচরে শুয়ে থাকা শুখা নদীও। নদী দেখার অনেক রকম আনন্দ আছে। আমার এই বালাই ষাটের জীবনে কত যে নদী দেখা হল, নদীর সাথে মিতালী হল, নদীর জলে ভেসে বেড়ানো হল, নদীর নামে নামও রাখলাম আত্মজার! সবশেষে ভালো লাগে যাকে, সে হল সমুদ্র!... সমুদ্রযাত্রা আমার কাছে খানিকটা যেন বিলাসিতা! সৈকতে শুয়ে বসে রোদ পোহাব, বিশ্রাম নেব, জোছনা গায়ে মাখব, নোনা জলে ভাসব, ডুবব!... কোনও ব্যস্ততা নেই। অগাধ জলরাশির আহ্বানে সৈকতে দাঁড়িয়ে এ বিরাটের কাছে নিজেকে নতজানু করে নতুন ভাবে আরও একবার জেনে বুঝে নেব... "হায়! জীবন এত ছোট ক্যানে, ভালোবেসে মিটিল না সাধ এ জীবনে!..."

    আজ বহুদিন পর সমুদ্রের পথে পা বাড়িয়েছি।

    সফর সঙ্গীরা নতুন বন্ধু! দূরভাষে কথা হয়েছে অনেক, দেখা হল আজ প্রথম। সাত ইয়ারির পুরী যাত্রা নয়, এ এক সমুদ্র, আট সৈকত ভ্রমণে চলেছি।

    আমরা "দীপুদা" শব্দটির সাথে খুব পরিচিত। মজা করে সবসময় বলি, বাঙ্গালির প্রিয় তিন জায়গা দীঘা, পুরী, দার্জিলিং। এমন বাঙ্গালি ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে যে "দীপুদা" ঘোরে নি! আমরা এবার চলেছি সেই দীপুদার পাশের পাড়াগুলোয়। অর্থাৎ দীঘায় নয়, দীঘার পাশে, দীঘার কাছে পর পর যে আট সৈকত রয়েছে সেই এক সমুদ্র আট সৈকতের ডাকে সাত সকালেই সাত ইয়ার চলেছি!

    ধর্মতলা থেকে সরকারী বাসে দরকারী টিকিটগুলো চটজলদি কেটেই উঠে পড়লাম।

    মাটির ভাড়ে এক কাপ চা পর্যন্ত খেতে সময় দিল না ছটফটে চালকবাবাজী!.."এগিয়ে চলুন, পরে খাবেন।" গিয়ার চেঞ্জ করতে করতে গম্ভীর ভাবে কথাটা বলেই গাড়ি ছোটাতে শুরু করে দিল।

    ভোরের কলকাতাকে অনেকদিন পর আজ দেখলাম। গতকাল রাতে একটু বৃষ্টি হয়েছে। তাই ভেজা ভেজা চারপাশ। বাতাসে ঠান্ডার আমেজ। ময়দানের পাশ দিয়ে ছুটছে গাড়ি। বৃষ্টি ভেজা বিরাট বিরাট গাছগুলোকে কি নির্মল সুন্দর দেখাচ্ছে। ড্রাইভার কেবিনে একটা সিট যোগাড় করে নিয়েছি। তাই সামনে থেকে সব কিছু প্রথম দেখার আনন্দ মুসাফিরের ঝুলিতে সঞ্চয় করতে করতে চলেছি। টপ গিয়ারের এক দৌড়ে পৌঁছে গেলাম বিদ্যাসাগর সেতুতে। ভোরের রাজপথ একদম ফাঁকা। তাই গাড়িকে হুশ করে ছুটিয়ে নিয়ে চলে এল গঙ্গা পেরিয়ে একদম টোল গেটে।


    ধর্মতলা থেকে চাউলখোলা মোটামুটি চার ঘন্টার সফর। চাউলখোলায় নেমে অটোয় করে যাব পুরুষোত্তমপুর। সেখানকার রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনে দু'রাত থেকে এই সাত ইয়ারি আট সৈকতে ঘুরে বেড়াব। দু'রাত তিনদিনের জমাটি সফর। এই সফর সাজিয়েছে আমাদের দলের ক্যাপ্টেন কল্যাণদা। আশ্রমের ঘর বুক থেকে অটো বুক সব কল্যাণদার কল্যাণে চমৎকার। আমরা শুধু ফুরফুরে মেজাজে সমুদ্র দেখব, সৈকতে বেড়াব। বিধু মহারাজের আশ্রমিক নিয়ম মেনে চলব। একটা নয়, আট আটটা সৈকত দর্শন হবে এই এক সফরে! তাই সাত ইয়ারী বেশ চনমনে।

    নিয়মমাফিক সব গাড়ি চা-টিফিনের বিরতি দিয়ে একবার দাঁড়ায় কোলাঘাটে। আমাদের সরকারী বাস অবাক করে দিয়ে না দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলল। "কি হল? দাঁড়ালেন না কেন?"

    কয়েকজন গুনগুন করে উঠতেই চালকবাবাজী আবার সেই গম্ভীর স্বরে গিয়ার চেঞ্জ করতে করতে বলল, "নন্দকুমারে দাঁড়াব।"

    নন্দকুমারেই প্রথম চা খেয়ে তৃষ্ণা মেটালাম। একেই বলে, পড়েছি যবনের হাতে, চা পাবে না সুপ্রভাতে!" এমন বদখেয়ালী চালক খুব কম দেখেছি!..

    নন্দকুমার থেকে পিছাবনী চলে এলাম তড়িৎ গতিতে। পরের স্টপেজ চাউলখোলা। নামতে হবে এখানে। সবাই তৈরী হয়ে চলে এলাম গেটের কাছে। প্রায় চার ঘন্টার বাস সফর ঝড়ের গতিতে এলাম।

    চাউলখোলায় বাস থেকে নেমেই কল্যাণদা হারুকে খুঁজে বের করল। হারুর অটোয় চেপে এগারো কিমি দূরের দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনে চললাম।

    লাল কাঁকড়ার বিচ বলে খ্যাত পুরুষোত্তমপুর। এই সৈকতের নির্জনতা আর মিশনের সুন্দর ব্যবস্থাপনার গুনগান অনেক শুনেছিলাম। সব শোনা কথা সত্যি হয় না। মনোভঙ্গ হয় অনেকসময়ই। কিন্তু পুরুষোত্তমপুরে এসে তা হল না। মন খুশ!.. কল্যাণদা জিন্দাবাদ!..

    মিশনের বিজু মহারাজের সাথে সাক্ষাৎ সেরে আমাদের জন্য রাখা চারটে ঘরে আমরা চলে গেলাম। দোতলায় সব কটা ঘর। বারান্দায় বসে-দাঁড়িয়ে দূরের সমুদ্রকে বেশ দেখা যায়। পথশ্রমের যেটুকু ক্লান্তি ছিল, আজ অনেকদিন পর সমুদ্র দর্শনের আনন্দে তা চলে গেল। চা টিফিন খেয়ে এসে বসলাম সবাই মিলে বারান্দায়। বাইরে রোদ বেশ গনগনে। ভাদ্র মাস। গুমোট হয়ে আছে চারপাশ। তাই সমুদ্র স্নানের ইচ্ছে আপাতত কারোরই হল না। আছি তো দুদিন। একবার ঠিক নোনাজলে ঝাঁপাব। ঢেউ ভেঙে ভেঙে লাফাব। অঙ্গ ভিজিয়ে রঙ্গ করার এই আনন্দের কোনও তুলনাই হয় না!


    কখনো কখনো বেড়ানোর আসল মজা সাইট সিয়িং। চারপাশে কি কি আছে চলো দেখব। খুঁজে বের করব। আবার কখনো কখনো বেড়ানো মানে সেই জায়গাটায় পৌঁছে তাকে আবিষ্কার করব। নিজেকে আত্মস্থ করব। শান্ত হৃদয়ে শুয়ে বসে থাকব। গান শুনব। একটু বই পড়ব। কোনও হুড়োহুড়ি নয়। ছোটাছুটি নয়। অনেক তো ছুটে বেড়াই সবসময়, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে এখানে এসেছি, তাই শুধুই অবসর যাপনের আনন্দ উপভোগ করব! নো সাইট সিয়িং, নট নড়নচড়ন!..

    আমরা এসেছি একটু বিশ্রাম আর অনেকটা সাইট সিয়িং এর আনন্দকে শুষে নেওয়ার জন্যই। কারণ এক সমুদ্র, আট সৈকতের ডাক আমরা যে শুনেছি শহরে বসে বসেই!

    দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন সুব্যবস্থা নিয়ে চমৎকার। ছোট্ট ছুটির দারুণ ঠিকানা। কিছুটা মজা করে বলা যায়, সস্তায় পুষ্টিকর! এখানে থাকা ও খাওয়া একদম সাধ্যের মধ্যে।

    মিশনের মধ্যে রয়েছে রামকৃষ্ণ মন্দির, নিজেদের হাই স্কুল, হোস্টেল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কম্পিউটার ক্লাসরুম ও শিশু উদ্যান। প্রায় ছ’শো ছাত্রছাত্রী। পঁচিশ জন টিচার। এই মিশনটাও ঘুরে দেখার মতো। বিধু মহারাজের সুশাসনে সব কিছু সুন্দর নিয়ম মেনে চলছে।

    মাত্র তেরো বছর আগে স্থানীয় একজন মানুষের কাছ থেকে জমি কিনে এই মিশন মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। আজ মিশন এই অঞ্চলের গর্ব।

    আমাদের আট সৈকতের মধ্য সৈকত, অর্থাৎ চতুর্থ সৈকতই হল দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর। আমরা এখানকার এই মিশনে থেকেই বাকি সাত সৈকতে যাব, ঘুরে বেড়িয়ে আসব।

    আজ দুপুরের আহার সেরে নাম মাত্র বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তিন সৈকত দর্শনে। হারুদা অটো নিয়ে সময় মেনেই হাজির। আমরাও রেডি।

    আজ চললাম মিশনের ডানদিক ধরে অর্থাৎ দীঘামুখী রাস্তায় পড়বে পরপর তিনটে সৈকত। মন্দারমণি, তাজপুর ও শংকরপুর। পুরুষোত্তমপুর থেকে মন্দারমণি ৬ কিমি। তাজপুর ২২ কিমি, শংকরপুর ২৪ কিমি।

    দাদনপাত্রবাড় মোড় থেকে অটো মন্দারমণির দিকে ঘুরে গেল। এপথের অবস্থা এখন করুণ। রাস্তার দু'ধারে হোটেল। এখনো তৈরী হচ্ছে বহু হোটেল। কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হবে অচিরেই মন্দারমণি। ইট বালির বড় বড় ট্রাক- লরির দৌরাত্ম্যে রাস্তা ভেঙ্গে তছনছ। অটোয় বসে লাফাতে লাফাতে চললাম। মনে হচ্ছিল, সেই বিখ্যাত গানটার প্যারোডি করে গাই, "এই পথ যদি তাড়াতাড়ি শেষ হয়, তবে কেমন হোত কল্যাণদা..." কল্যাণদা বেজায় বিরক্ত, মুখের আগল খুলেই বলল, "ট্যুরিজমের দারুণ বিজ্ঞাপন হতে পারে মন্দারমণি ও তার রাস্তা!.."


    মন্দারমণির সৈকত ফেরার পথে দেখব। একটু ছায়া নেমে আসুক। রোদ মরুক। সৈকতে দাঁড়িয়ে তখন সমুদ্র দর্শন ভালো লাগবে। তাই আমরা প্রথমে সোজা চললাম শংকরপুর। মন্দারমণি পার করে রাস্তা আর খারাপ নেই। তাজপুরেও থামলাম না। সমুদ্রধার ধরে এগিয়ে চললাম। মেরিন ড্রাইভ বলে এখন অনেকে এই সুন্দর বাঁধানো রাস্তাটাকে। বড় বড় বোল্ডার দিয়ে পাড় যত্ন করে সাজানো। ঢেউগুলো এসে এখানে ধাক্কা মারছে। সমুদ্রে এখন বড় বড় ঢেউ। হারুদা বলল, "অমাবস্যার কোটাল দুদিন পর। সমুদ্র তাই ফুলে ফেঁপে উঠছে।" ঢেউগুলো ছোবল মারার মতো পাড়ে এসে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। তখন সেই জলোচ্ছ্বাস দেখার যে কি মজা আর আনন্দ। এ বড় দৃশ্যসুখ। মন ভরে গেল। কল্যাণদার অনুরোধে একটু থামল অটো, বোল্ডারে দাঁড়িয়ে আনমনে সমুদ্রকে দেখলাম, শরীরে মাখলাম নোনা বাতাস, ছিটকে আসা ঢেউ এর জলে গা ভেজালাম। আহ্ কি আনন্দ!. কি অপূর্ব!.. আমরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, হারুদা হঠাৎ বলল, "এটা চাঁদপুর। পরশুদিন এইখানে একটা ডেডবডি পড়ে ছিল। মেয়েটিকে খুন করে ফেলে রেখে চলে গেছে খুনীরা!." শুনেই মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। সৈকতে খুন করে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়ার গল্পগুলো সেই প্রাচীন কাল থেকে শুনে আসছি!

    চাঁদপুর থেকে শংকরপুর একটুখানি পথ। কয়েককদম এগোতেই গাড়ি দাঁড় করাল অল্পবয়সী কিছু ছেলে। হাতে বিল বই। খুব সামান্য আবদার, "গণেশ পুজো করব। কুড়ি টাকা চাঁদা দিন।" চাঁদপুরে কুড়ি টাকা চাঁদা দিলাম। গণেশ ঠাকুর বাংলার মাটিতেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। জয় জয় গণপতি বাপ্পা!..


    শংকরপুরে এসে বেশ ভালো লাগার একটা আবেশে মন ভরে গেল। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লাগল চারপাশকে। সৈকতে ছোট্ট একটা পার্ক। সুন্দর বসার জায়গা। নিরিবিলি নির্জনতা নিয়ে শংকরপুর খুব উপভোগ্য। আমরা বাঁধানো সৈকতে অনেকটা হাঁটলাম। বালুচরে নামা যাবে না। জোয়ারের জলে সমুদ্র উত্তাল। বড় বড় ঢেউ দেখলাম দুচোখ ভরে। চিরচেনা সেই বঙ্গোপসাগর বয়ে চলেছে ক্লান্তিহীন ভাবে আপনখেয়ালে। সমুদ্রের বুকে ভাসছে অনেক জেলে নৌকো। ট্রলার। সাদা বক। বিকেলের আলোয় শংকরপুরকে খুব মায়াবী লাগছিল। মন ভরে গেল শংকরপুরে কিছুটা সময় কাটিয়ে।

    তাজপুরে ফিরে এলাম। তাজপুরের সৈকতে সুন্দর ছড়ানো বালুচর পেলাম। চরে নেমে আনন্দে হাঁটা শুরু করলাম। লাল কাঁকড়ার দল আমাদের পায়ের শব্দে সুড়সুড় করে গর্তে ঢুকে গেল সব। কিলবিল করছিল লাল কাঁকড়ারা। তাজপুরের সৈকতে সমুদ্রের জল এসে লুটিয়ে পড়ছে। ঢেউগুলো ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এসে এলিয়ে পড়ছে বালুচরে। আমরা সেই ঢেউয়ের জলে পা ভিজিয়ে সূর্য়াস্তের নরম আলো গায়ে মাখলাম।

    তাজপুরের তৃপ্তি নিয়ে এবার চলে এলাম মন্দারমণি। সন্ধ্যার মন্দারমণিতে বড় কোলাহল। সৈকতে ভিড়। ঢেউ দেখার আনন্দ বিঘ্ন ঘটায় অবিবেচক পর্যটকের দল। তাঁরা ভিড়ের আনন্দ উত্তেজনায় শান্ত ভাবে কিছু উপভোগ করতে দিতে চায় না। হৈ হৈ চিৎকারে আনন্দ করা যেন তাদের জন্মগত অধিকার। আমাদের তাই আর মন্দারমণিতে মন টেকে না। ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়। ফিরে আসি পুরুষোত্তমপুরে।

    রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনে ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে মিশনের চা টিফিন খেয়ে চলে গেলাম পুরুষোত্তমপুরের সৈকতে। মিশনের ঠিক উল্টোদিকে এই নিরালা নির্জন অপূর্ব সৈকত। মাটির পায়ে চলা পাঁচ মিনিটের পথ পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় এক অপার্থিব আনন্দের আঙিনায়। এই সৈকতের মহার্ঘ সুন্দর নির্জনতা এক বড় প্রাপ্তি। চুপ করে বসে সমুদ্রের রূপ দেখলাম। ঢেউয়ের গর্জন শুনলাম। বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজকে কান পেতে গ্রহণ করলাম। সব নিয়ে পুরুষোত্তমপুরের এই সৈকতের প্রথম সন্ধ্যারাত্রি মনকে মাতিয়ে দিল। আজই এসেছি সকালে। এক বিকেলে চার চারটে সৈকত দেখা হয়ে গেল। এক সমুদ্র চার সৈকতের আনন্দ স্মৃতি নিয়ে ঘুমের দেশে চলে যেতে যেতে ঠিক হয়ে থাকল কথা আগামীকাল আমরা যাব আরও চার সৈকত সফরে।

    আজ হীরক এসেছে অটো নিয়ে। হারুর ছুটি।

    হীরক সফর সাজিয়ে বলল, আমরা প্রথমে যাব বগুড়ান-জালপাই। পুরুষোত্তমপুর থেকে দশ কিমি। এই ছোট্ট অটো সফরটা চমৎকার। বগুড়ান-জালপাই পৌঁছে আমরা যেন হারিয়ে গেলাম। ধূ ধূ করছে বিস্তীর্ণ বালুচর। তার ওপর রোদ ঝলমলে এক আশ্চর্য সুন্দর নীল আকাশ। এমন আকাশ দেখার আনন্দ মনকে মাতিয়ে দিল। বগুড়ানে এখন সমুদ্রের জলরাশি দেখা হল না। জল ভাটার টানে বহুদূরে চিকচিক করছে। কিন্তু জলহীন এই শুষ্ক বালুচর দেখার মধ্যেও এক অন্য আনন্দ খুঁজে আনন্দ করা যায়। এই সৈকতেও লাল কাঁকড়ার দল হামাগুড়ি দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। বগুড়ান নির্জনতা আর নিসর্গ নিয়ে মনমাতাল করা এক অপরূপ সমুদ্র সৈকত। হাতে সময় অল্প তাই বগুড়ানে ইচ্ছে থাকলেও গল্প করে বেশি সময় কাটানো সম্ভব হল না।

    হীরক তাড়া দিয়ে বলল, চলুন আগে দূরের সৈকতগুলো দেখে আসি। ফেরার পথে হরিপুর দেখিয়ে পুরুষোত্তমপুরে ফিরে যাব।

    এবার চলেছি জুনপুট। বগুড়ান থেকে কম বেশি চার কিমি পথ। এই সৈকত সংলগ্ন সড়ক পথটা খুব মসৃণ সুন্দর। অটোয় করে গল্প করতে করতে যাওয়ার মজাই আলাদা। জুনপুট সমুদ্র সৈকতে এখন বনবিভাগ থেকে নিষেধ থাকার দরুন আমরা সৈকতের কাছে পৌঁছাতে পারলাম না। একটু আগেই একটা খাঁড়ির কাছে আটকে গিয়ে জুনপুটের ঝাউবনের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এই খাঁড়ির সৌন্দর্যও মনকে খুশি উপহার দেয়। নীল আকাশ, ঝাউবন, খাঁড়ির চলন আর দূর সমুদ্রের জলগর্জন শুনতে শুনতে নিষেধ মানা পর্যটক হয়ে আমরা সবাই কিছুটা সময় জুনপুটকে উপভোগ করলাম।

    বাঁকিপুট দর্শনে এবার চলেছি। আমাদের অটো ছুটছে। রাস্তা কম বেশি দশ বারো কিমি হবে। ভ্রমণে একটু আধটু পথ ভুল করার আনন্দ উদ্বেগও একটা অভিজ্ঞতা। হীরক বাঁকিপুটের সৈকত খুঁজে না পেয়ে এগিয়ে চলে গিয়েছিল অনেকটা। আসলে বাঁকিপুটের সৈকত যেন আড়ালে থাকা এক আহ্লাদী! তাকে যখন আবিস্কার করলাম, প্রথম দেখাতেই মন ভরে গেল। বিকেলের নরম আলোয় বাঁকিপুটের নিরালা নির্জন সৈকত মহার্ঘ্য এক উপহার পাওয়ার মতো আনন্দ। সৈকতের পাড়ে কংক্রিটের সিঁড়িতে বসে দুচোখ ভরে বাঁকিপুটকে দেখেছি। এই এক সমুদ্র আট সৈকত ভ্রমণ মনকে বারবার আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। কাল থেকে একে একে সাত সৈকত দর্শন হয়ে গেল। শংকরপুর, তাজপুর, মন্দারমণি, পুরুষোত্তমপুর, বগুড়ান, জুনপুট, বাঁকিপুট। সবাই কত কাছাকাছি। পাশাপাশি। অথচ প্রত্যেককেই ভালো লাগছে। এই সাত সৈকত সাত রকমের সুন্দর। বাঁকিপুটে সূর্যের শেষ আলোর খেলা দেখতে দেখতে মুসাফির জীবনকে ধন্য করলাম। সৈকতে সূর্যাস্তের রং কত জলছবি যে এঁকে এঁকে যাচ্ছে তা দুচোখ ভরে শুধু দেখলাম আর দেখলাম।

    হরিপুরে পৌঁছাতে বিকেল ফুরিয়ে গেল। সৈকতে তখন মাঝি মাল্লা ও জেলেদের ভিড়। আমরাই কয়েকজন শেষ বিকেলের পর্যটক। লম্বা লম্বা জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে রাখছে জেলে ভাইরা। কত রকমের সামুদ্রিক মাছ। আমার প্রিয় লোটে মাছ, ভোলা মাছ অনেক দেখতে পেলাম। চিংড়ি চার পাঁচ রকমের। পমফ্রেট, ইলিশও ছিল।

    মাছ দেখার আনন্দ নিয়ে সৈকতের শেষ আলোয় দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মন উদাস হয়ে যায়। হঠাৎ চোখে পড়ে আকাশে রামধনুর সাত রং। সে দেখা বড় অপূর্ব আনন্দ। প্রতিদিনের তুচ্ছতা, দিন যাপনের একঘেয়েমিয়তা হারিয়ে মন বাউল হয়ে যায়। কি শান্ত সুন্দর এক অনুভব অনুভূতি এসে বুকের পাঁজরে খেলা করে। গান করে, 'হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না!'.. জীবনটাকে আরও ভালোবাসতে শেখায়। স্বপ্ন ফেরি করার মতো গল্প জমা হয় হৃদ কুঠুরিতে। প্রতিটি ঘুরে বেড়ানোই এক একটা গল্প খোঁজার আনন্দ।

    ছোট্ট ছুটিতে ঘরের পাশের এই এক সমুদ্র, আট সৈকত ভ্রমণ এক অনাবিল অপরূপ আনন্দযাত্রার আনন্দ!..



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments