সামাজিক ইতিহাস ও জনশ্রুতি মিলিয়ে ডোম জাতির সৃষ্টিতত্ত্বর কল্পকথা শুনিয়ে কথাকার তাঁর মূল উপাখ্যানের দরজা খুলে দেন পাঠকের কাছে। ডোমদের পূর্বপুরুষ কালুবীর ছিলেন ‘লেট’ পুরুষ ও ‘চণ্ডাল’ রমণীর সন্তান। ডোম সম্প্রদায়ের চারটি উপগোষ্ঠী— ‘আকুঁড়িয়া’, ‘বিশদেলিয়া’, ‘বাজুনিয়া’ এবং ‘মঘৈয়া’। এদের মধ্যে ‘আকুঁড়িয়া’ ও ‘বাজুনিয়া’ বঙ্গজ বংশোদ্ভুত ডোম হিসেবে পরিচিত। ‘বিশদেলিয়া’ উপগোষ্ঠী বাংলায় দেখা যায় না। ‘মঘৈয়া’ উপগোষ্ঠীর আদি নিবাস বিহার ও ঝাড়খণ্ড। আবার, একই জনজাতির উপগোষ্ঠী হলেও ‘আকুঁড়িয়া’ ডোমদের সামাজিক অবস্থান ‘বাজুনিয়া’ ডোমদের থেকে উঁচুতে। এই ‘বাজুনিয়া’ ডোম জনজাতি ‘বাদ্যকর’ ডোম রূপেও পরিচিত।
নৃতত্ত্ব, সামাজিক সংস্কার, আচরণবিধি, ধর্ম, উপগোষ্ঠীগত বিভাজনকে মাথায় রাখলে বাংলার ডোম সম্প্রদায়ের সঙ্গে বহির্বঙ্গের ডোম সম্প্রদায়ের পার্থক্য সুস্পষ্ট। বাংলার ডোমজাতি মূলত বাজুনিয়া গোষ্ঠীর। রাঢ়বাংলার অন্যতম ভূমিপুত্র এই ডোম সম্প্রদায়। বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় এদের বাস। ঐতিহ্যের সূত্র ধরে এরা বাঁশ-বেত ইত্যাদির হস্তশিল্প এবং ঢোল কাঁসর-সানাই সমন্বিত যন্ত্রসংগীতশিল্প— দুই পেশাতেই সমান পারদর্শী।
H. H. Risley তাঁর ‘The Tribes and Castes of Bengal’ গ্রন্থে ডোম সম্প্রদায় সম্পর্কে লিখছেন— “Doms believe their original profession to be the making baskets and mats, and even the menial and scavenging sub-castes follow these occupations to some extent.[……..] The Bajunia sub–caste are employed to make highly discordant music at marriages and festivals. His women-folk, however, only perform as musicians at the wedding of their own people, it being considered highly derogatory for them to do so for outsiders. At home the Domni manufactures baskets and rattles for children.”
বিনয় ঘোষ তাঁর ‘বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ঝুড়ি বোনা বাংলাদেশের ডোম জাতির প্রধান পেশা, ...এ শিল্পে, ডোম জাতির পুরুষ, নারী এমনকি শিশুদেরও রয়েছে এক বংশগত দক্ষতা”।
একাধিক গবেষক বারবার ডোমদের পরিচয় লিপিতে সেঁটে দিয়েছেন নিম্নতম তথা প্রান্তিকতম ‘অন্ত্যজ’ ছাপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ গবেষক Wise–এর ভাষায়— “By all classes of Hindus, the Dom is regarded with both disgust and fear, not only on account of his habits being abhorrent and abominable, but also because he is believed to have no humane or kindly feelings.” বলা বাহুল্য, এ ধরণের বহুল প্রচারিত জাতি-বিবরণীর চাপে বিশেষজ্ঞ পর্যালোচনায় প্রায়শই উহ্য থেকে যায় ডোম সম্প্রদায়ের হস্তশিল্প দক্ষতা তথা লোকায়ত শিল্পমনস্কতা ও সাংগীতিক যন্ত্রকুশলতার মতো বিরল, উন্নততর ও নান্দনিক চারিত্র বৈশিষ্ট্যের মূল্যবান তথ্যানুসঙ্গ।
ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ কার্নেগি ডোমদের বৃত্তি সম্পর্কে লিখেছেন, “দেশীয় রাজা ও শাসকগণ ডোম সম্প্রদায়ের মানুষদের যন্ত্রসংগীতশিল্পী হিসাবে নিয়োগ করতেন ও তাঁদের উচ্চ সম্মানে ভূষিত করতেন”।
বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের আমলের পরবর্তী কিছু সময় বিভিন্ন আঞ্চলিক বা দেশীয় সামন্ত শাসকদের যুগে সমাজ-সংস্কৃতিতে ডোম সম্প্রদায়ের গৌরবময় পর্বের পরেই হয়তো ক্রমশ তাদের জীবনে নেমে এসেছিলো বিপর্যয়, যার প্রধান কারণ হিসাবে একদিকে যেমন উল্লেখ করা যায় পাল-পরবর্তী আমলে উগ্র ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের নিপীড়ন, অন্যদিকে তেমনই উল্লেখ্য, আরও পরবর্তী সময়ের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের শোষণ-শাসন-নিপীড়ন।
ডোমদের সামাজিক হীনদশার বর্ণনা প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায় লিখছেন, “ডোম...প্রভৃতিরা গ্রামের বাইরে উঁচু জায়গায় বাস করিতেন, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের লোকেরা ইঁহাদের ছুঁইতেন না। ...বাঁশের তাঁত, চ্যাঙারি ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রয় ছিল ইঁহাদের বৃত্তি”। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও ডোম জাতির জীবিকা নির্বাহের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইভাবে—
“বিয়নী চালুনী ঝাঁটাডোম সম্প্রদায় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ‘দীনের হতে দীন’, সমাজের চোখেও ‘সবার অধম’। কোনো সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতিকে অপবিত্র মনে করা হয় ভদ্রসমাজে। ঔপনিবেশিক শাসকদের বর্ণনায় তাদের গণ্য করা হয় অপরাধপ্রবণ উপজাতি বা ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ হিসাবে। বিখ্যাত সমাজকর্মী, ঐতিহাসিক শ্রী রণজিৎ গুহ বলেছেন, “ডোম জন্মায় অড়হর খেতে, ছোটবেলা থেকেই সে চুরি করতে শেখে। জীবনের প্রথম থেকেই সে পতিতের মতো ঘুরে বেড়ায়। মাথার ওপর ছাদ ছাড়াই সে বাঁচে, থাকে না পরের দিনের অন্নের কোনো সংস্থান। পুলিশের তাড়নায় জীবনভর সে পালিয়ে বেড়ায় এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে। গ্রাম থেকে সে সদাই বহিষ্কৃত।...সে আছে হিন্দু ধর্মের নাগালের বাইরে। সভ্যতার অগ্রগতি তাকে শুধু আরও অবনমনের দিকেই ঠেলে দিয়েছে”।
ডোম করে টোকাছাতা।
জীবিকার হেতু এক চিত্তে”।
এই উপন্যাসের লেখক মণিশঙ্কর মূলত বাজুনিয়া ডোম জনজাতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা তাদের জীবিকা সংকট, বিশ্বাস, সংস্কার, দরিদ্রের প্রান্তসীমায় বেঁচে থাকার জন্য গৃহীত সামাজিক রীতিনীতিকে তুলে ধরেছেন মরমি অক্ষরের বুনোটে। এই উপন্যাসটি সার্থকভাবেই ডোমদের সামাজিক দলিল। বারব্যান্দা গ্রাম এই উপন্যাসের পটভূমি। কথাকার প্রান্তজনের যাপনের চিত্র এঁকেছেন অত্যন্ত মরমি-দক্ষতায়।
বাজুনিয়া ডোমদের বাজনা ছাড়া কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান পূর্ণ হয় না। এদের কাঁধের ঢোলই হয়ে ওঠে মূর্তিমান মঙ্গলের প্রতীক। ডোমরা নিজেদের অভাবী পেটের জ্বালাকে চাপা দিয়ে বেসুরো গলায় ঝরিয়ে দেয় গান। গানে গানেই কামনা করে গৃহস্থের মঙ্গল, নবদম্পতির সুখসমৃদ্ধি, মেয়ে বিদায়ের কান্না, নবজাতকের দীর্ঘায়ু। হতদরিদ্র ডোমদের বিভিন্ন রকম রোষানলে পুড়তে পুড়তে বাঁচতে হয়, তারা জানে এটাই তাদের ভবিতব্য, দেবতার অভিশাপ তারা মেনে নেয়, ধর্মরাজের থানে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে, বিপদ থেকে উদ্ধারের প্রার্থনা জানায়, আর মনে মনে ভাবে কেউ হয়তো পৃথিবীতে নেমে আসবে তাদের শাপমুক্ত করতে, যেমন একদিন এসেছিল তাদের পূর্বপুরুষ কালুবীর। এক প্রবল ঝড় বিদ্যুতের রাতে দেবতার সাথে লড়াই করে তারা টিকিয়ে রেখেছিল নিজেদের অস্তিত্ব।
ঠিক সেই রকমই বৈশাখের এক গুমোট দুপুরের পর পশ্চিমে জমে ওঠা কালো মেঘকে যখন উড়িয়ে দিলো এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া ঠিক তখনই জন্ম হলো কালুডোমের। এই শিশুর জন্ম হতেই কালো মেঘ কেটে গেল, তখন তার বাবা, পঞ্চপ্রধান বিষাণ ঘোষণা করলো কালুবীর আবার ফিরে এসেছে তাদের রক্ষা করতে। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে সে প্রথা ভেঙে ফেললো, ষষ্ঠীর আগেই শিশুকে বের করে আনলো জনসমক্ষে— “কালুবীর! ই আমরার কালুবীর বটে লো ধাঁইবুড়ি।...আমরার পুব্বপুরুষ। নাইলে অতবড় দুয্যোগ এমনি এমনিয়েই পা লাই গেইচে কখনু?” কিন্তু প্রথা ভাঙার খেসারৎ দিতে হলো ডোমদের, প্রলয়ে তাদের ঘরদোর তছনছ হয়ে গেল, কালুর জন্মদাত্রী মা মারা গেল, বিষাণ সংসার হারিয়ে বিবাগী হলো, ছোট্ট কালুর আশ্রয় হলো দুধমা বাসীর কাছে।
কালু ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, তার উদাসী মনের আশ্রয় হয়ে উঠলো পাতার বাঁশি। কালুর কাছে প্রকৃতিই ছিল সব। তার দুঃখের সাথী। তার কান্নার দোসর, তার সুরের যোগানদার। এমন কি তার ভালোলাগা মন্দলাগার ভাগীদারও— “এমনিই একদিন বসেছিল বাউনদের ডোবার দক্ষিণপাড়ের তালতলায়। ওই তালগাছটাকে আশ্রয় করে উঠে গেছে একটা বটগাছ। সেই বটেরই একটা পাতা ছিল কালুর হাতে। আনমনেই নাড়াচড়া করছিল সেটা। সেদিন ভিতরটা তার একেবারে ভেঙে পড়তে চাইছিল কান্নায়।...কালু বটপাতাটাকেই চেপে ধরল জিভের তলায়। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলল বারকতক। অমনি প্রতিটি শ্বাসে পাতাটা যেন কেঁদে কেঁদে উঠল সুরে”। কালুর আশ্চর্য বাঁশির সুর মুগ্ধ করলো গ্রামের সবাইকে। তার নাম ছড়িয়ে পড়ল লোকমুখে।
কিন্তু কালুর মনে শান্তি নেই। শিল্পীর মনের তীব্র অস্থিরতা, এক সর্বগ্রাসী আগুনকে লেখক খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কালুর চরিত্রে। কালুর অতৃপ্তি তাকে নিয়ে যায় পালাগানের দিকে, যা বাজুনিয়া ডোমদের নিষিদ্ধ। কালুর স্ত্রী লক্ষ্মী তাকে স্বপ্নপূরণের দিকে এগিয়ে দেয়। প্রথা ভাঙার অপরাধে তার জীবনে নেমে আসে অমঙ্গলের ছায়া।
সময় গড়াল। কালু ও লক্ষ্মীর ঘর আলো করে জন্ম নিল কালুর হৃদয়, বদলে যাওয়া সমাজের হৃদয়। লক্ষ্মী তার সমস্ত ক্ষোভ, সমস্ত না পাওয়া দিয়ে হৃদয়কে গড়ে তোলে। আর কালু তার মনের সমস্ত দাউদাউ নিয়ে একা থেকে আরো একা হতে থাকে।
সময়ের সাথে সাথে সমস্ত বারব্যান্দা গ্রামই তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে যুব সমাজের দল নিজেদের জাতিগত পেশার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘিরে ধরে ডোমদের। সেই সময়েই হঠাৎ একদিন প্রবল শব্দে কেঁপে উঠলো ডোমপাড়ার ঘরের দেওয়াল। পাথর খাদান হবে, পাথর ভেঙ্গে চিপস তৈরি হবে। সব উঠতি ছেলেরা কাজ পাবে, কাঁচা পয়সা। তাদের ডোমবৃত্তি ছেড়ে ভালোভাবে বাঁচবে। একদল ধূর্ত লোক পয়সার লোভ, ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে, গ্রামের ছেলেদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় মুনাফা লোটার উদ্দেশ্যে। ডোমসিনির দিকেও পা বাড়ায় পাথর খাদান। সভ্যতার উন্নাসিক পদক্ষেপ। ডোমসিনিকে ডোমরা ঠাকুর মনে করে, “জিয়ন্ত ঠাকুর, রাত বিরেতে পাড়ায় ঘুরে বুলে, পাহারা দেয় ডমপাড়াকে, বিপদে আপদে রইক্ষ্যা করে।” কালু হাহাকার করে ওঠে— “অনত্থ্য হঁইয়ে যাবেক হে! অনত্থ্য হঁইয়ে যাবেক। অতবড় পাপ যে ধম্মে সইবেক নাই রে।”
একসময়ে ডোমরাই ছিল বীরের জাত। তবু আজ তারা বাবুদের ঘরে একটা কুলো বা একটা খাঁচি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ দেয় সের খানেক মুড়ি, কেউ বা আধসের চাল। কখনো মনিবদের ঘরে মুনিষ-কামিন খেতে সব ধান রোয়া পোতা করে। অঘ্রাণে সেই ধানই তুলে দেয় মনিবদের মরাইয়ে। হৃদয় যেন তার ডোমজন্মের সমস্ত ক্ষোভ উগরে দেয়, “কী রইক্ষ্যাটা করিচে শুনি? থাইলে বছর বছর জলে ঝড়ে ক্যানে পড়ে যায় ডোমরার ঘর? ক্যানে তারার প্যাটে দুবেলা দুমুঠা ভাত থাকে নাই? ক্যানে বল? ক্যানে ছুটোলোক বলে ডোমরাকে সুবাই দুচ্ছাই করে? সোব ঠাকুর ঠাকুর করেই মল্লি ছির জেবনটা --”
কিন্তু শেষপর্যন্ত অনর্থ ঘটলো, ক্রেসারে কাজ করতে গিয়ে হৃদয়ের ফুসফুসে পাথর গুঁড়ো চেপে বসে। ঢলে পড়ে মৃত্যুমুখে, উমির সাথে তার সংসার গড়ার সাধ অপূর্ণ থেকে যায়। বেশিরভাগ গ্রামবাসীই ভুগতে থাকে শ্বাসকষ্টে। মধুডাক্তার, এই গল্পের কথক, যিনি বিপদে আপদে ডোম সমাজকে আগলে রাখেন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কালুর দিকে। কারণ বহু দুঃখে পুড়েই কালু তার সত্যের সন্ধান পেয়েছে। লেখকের ভাষায়— “প্রাণ প্রাণই লয়, যদি তাতে সামগ্রিকতার বোধ না থাকে। সামগ্রিকতা! এবোধই তো পারে সব সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠে জীবনকে মোহনীয় করে তুলতে! এ পৃথিবীতে সবার সবটুকু অধিকার ফিরিয়ে দিতে!”
কালু আবার পালা বাঁধে, গলায় ঢোল ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ে গাঁয়ে, শূন্য খাদানে খাদানে। উমি গায়—
“জনম দুখিনী আমার অ গ পিকিতি মালেখক এই উপন্যাসে পুরুষতান্ত্রিক ডোম সমাজে প্রতিটি নারী চরিত্রকে অসাধারণ ভাবে সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি নারী অসম্ভব দৃঢ়, তেজী, স্বাধীন, এবং সময় ও সমাজের কুসংস্কারকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখে। সাথে তুলে ধরেছেন তাদের হৃদয়ের কোমল রূপটিও। লেখকের মরমি কলমে নারী হৃদয়ে মাতৃত্বের জন্য হাহাকার ফুটে উঠেছে— “ওরে নিঠুর বিধি একটি বাছা দে /আর কিছু চাইনা বিধি মরণকালে মুখে আমার অগ্নি দেবে কে?” মণিশঙ্কর মায়েদের সন্তান আকাংখার অনিবার্যতার সাথে নিপুণ ভাবে জুড়ে দিয়েছেন নারীর স্নেহ ও প্রেমকে। সেকারণে উমিও উপাখ্যানের মাতৃবলয়ের অন্যতমা হয়ে ওঠে।
আমরার হাতে পালে তুমি কত যাতনা
লোভ তাড়সে কেউ বুজিনা
কী দুঃখু আনচি ঘরে”।।
‘কালু ডোমের উপাখ্যান’-এর আগাগোড়া সুরে সুরে সুখদুঃখের প্রাকৃত উচ্চারণ। ডোম জনজাতির বিয়ের গান, সত্যনারায়ণ পালার গান, মেলায় ছেলেমেয়েদের প্রেমপিরিতির গান বা শ্মশান ডোমের না সাধা গলার বাধ্যকতার গান এই উপাখ্যানের অন্যতম সম্পদ।
ভাষা আখ্যানে জল সিঞ্চনের কাজ করে। উপন্যাস জীবনের প্রসঙ্গকে উন্মোচিত করে ভাষার শিল্পীত রূপ দিয়ে। সেই কাজে লেখক দক্ষ কারিগর। ডোম পরিবারের কথোপকথনে বা দম্পতির খুনসুটি বা পড়শীর ঈর্ষা কিংবা সামগ্রিক অসহায়তা সবই লেখক প্রকাশ করেছেন আঞ্চলিক ভাষায় মুন্সিয়ানার সাথে। তাঁর উপন্যাসে ডোমদের দুঃখ, যন্ত্রণা, বিষাদ, আনন্দ— সবকিছুই প্রকাশ পেয়েছে তাদেরই নিজস্ব ব্যবহৃত শব্দের ভুবনে। এবং সেজন্যই নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে চলতি উপন্যাস থেকে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে তাঁর ‘কালু ডোমের উপাখ্যান’ উপন্যাস।
সময়, মানুষ আর সমাজ— এই তিনটের বুনোটে একটা উপন্যাস গড়ে ওঠে। জীবনের সামগ্রিক অবস্থানের অনুসন্ধানই উপন্যাসের লক্ষ্য। এই উপাখ্যান কালুডোমকে ঘিরে, তার জন্ম ও তার পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে। প্রকৃতির রুক্ষতা, শুষ্কতা, ভীষণতা— সমস্ত কিছুই আবহ তৈরি করে এই উপন্যাস। মানুষের মন-বুদ্ধি-আত্মার চিরকালের টানাপোড়েনকে নিয়ে আসে একেবারে আলোর সামনে। নিজের তৈরি নিয়মে, নিজের বিশ্বাসের অন্তরালে, নিজের সংস্কারের প্রাচীরে মানুষ নিজেই দিশেহারা হয়ে ওঠে, কোনো একটা সময়কে স্থির জেনে সেই সময়ের মধ্যেই সমাজের যাবতীয় ধারাকে রুদ্ধ করে ফেলতে চায়। বাধে লড়াই, নতুনের সাথে পুরাতনের। কোথাও যেন একটা আবর্ত সৃষ্টি করে শেষে এসে। মণিশঙ্করের ‘কালুডোমের উপাখ্যান’ শুধু একটি অঞ্চলের ডোম জনজাতির জীবনকথা নয়। এই উপন্যাস সব অর্থেই মানুষের বহির্জগৎ ও অন্তর্জগতের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুসংহত বিন্যাস। এক নতুন অবগাহন আমাদের সমাজ, জনজীবন, প্রান্তিকজনের জীবনকথা ও গ্রামীণজীবনকে দেওয়া একটি জরুরি বার্তা।
তথ্য সহায়তাঃ
H. H. Risley. 1891. The Tribes and Castes of Bengal. Calcutta: Bengal Secretariat Press.
নীহাররঞ্জন রায়। ১৩৫৯। বাঙালীর ইতিহাস। কলকাতাঃ দেজ পাবলিশিং।
বিনয় ঘোষ। ১৯৫০। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি। কলকাতাঃ পুস্তক প্রকাশক।
ভব রায়। ২০১০। বাংলার ‘ডোম’ সম্প্রদায়। এবং আমরা। ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। কলকাতা।