…শীতের নিজস্ব কিছু রঙ আছে? কোনওদিন আমি তা দেখিনিঃপ্রদীপ রায়গুপ্তের কবিতা আমি একটিও পড়িনি। সেই লজ্জা ঢাকতে তাঁর স্মৃতিকথা ‘ছিন্ন পাতার তরণী’ র পাঠ পরিক্রমা শুরু করলাম এই গ্রন্থ থেকে তাঁর উদ্ধৃত একটি কবিতা দিয়ে।
আমিষসদৃশ শাদা, বিষে নীল, কিংবা রূঢ় রুক্ষতায় ঈষৎ বাদামি?
বাস্তবভাবে আমি চোখ মেলে দেখে গেছি কুয়াশার শ্বেত
ছিঁড়ে ছোটে নীল জীপ, ধূসর উলের কোটে শিশুর সন্তোষ,
চুম্বনবর্জিত ঠোঁট ফেটে যায় মানুষের বাদামের মতো।
গির্জার ঘড়ির শব্দে মধ্যরাতে প্রদীপের বুক জ্বলে ওঠেঃ
আলো নিভে যায় ঘরে, অন্ধ পায়রার পিঠে জ্যোৎস্নার দীর্ঘতর হাত
দীপাধার পূর্ণ করে, এখন মাঘের ঘুম…
আমি প্রদীপকে চিনতাম একজন ভাষাবিদ হিসাবে। এই গ্রন্থে তাঁকে বহুরূপে পেলাম। স্বচর্চিত শাব্দিক, গল্পকার, লোকাচার-আগ্রহী, খাদ্যরসিক, পারিবারিক মায়ায় আবদ্ধ গৃহস্থী এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ পদস্থ সরকারি আধিকারিক। স্বাভাবিকভাবেই তিনশ পৃষ্ঠার অধিক এই গ্রন্থটিকে একটিমাত্র গ্রন্থ হিসাবে ধরে নিলে পাঠক অসুবিধেয় পড়বেন। গ্রন্থটিতে প্রতিটি পরিচ্ছেদের একটি করে শিরোনাম আছে কিন্তু অধ্যায় নির্দিষ্ট করা নেই। তবে সুচিপত্র অনুসারে এগারোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বই ধারণ করেছে বিভিন্ন গোত্রের (আজকাল যাকে ল্যাটিন > ফরাসি > ইংরাজি genre শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ করে জঁর বলা হচ্ছে) লেখা। অধ্যায়গুলিকে সুস্পষ্ট গোত্রে ভাগ করা খুব মুশকিল, সেই চেষ্টা থেকে বিরত থেকে আমি বরং গোড়া থেকেই তাঁর স্মৃতিকথাটিকে পরিক্রমণ করি।
কথা শুরু বাবাকে নিয়ে। প্রথম অধ্যায়ের পাঁচটি পরিচ্ছেদে আছেন যথাক্রমে বাবা, মা, জেঠু, দাদা এবং দিদি। পাঁচজন ব্যক্তিমানুষ ছাড়াও এই অধ্যায়ে উঠে এসেছে লেখকের পারিবারিক প্রেক্ষিতও। পূর্বপ্রান্তের দেশভাগজনিত সামাজিক ইতিহাসের মূলত দুটি ধারা। একটি ধারায় আছেন প্রাণ ও মান বাঁচানোর অসহায় তাগিদে শিকড় ছিঁড়ে এপারে আসতে বাধ্য হওয়া মানুষজন এবং অন্য ধারায় আছেন সেইসব পরিবার যাঁরা দেশভাগের আগে থেকেই এপারে তাঁদের শিকড় বিছিয়ে রেখেছিলেন। প্রদীপ রায়গুপ্তের পরিবার এই দ্বিতীয় ধারার। দুই প্রজন্ম আগেই তাঁর বাবার দাদামশায় বরিশাল থেকে এসে কুচবিহারে স্থিত হয়েছিলেন। অল্পবয়সে বিধবা প্রদীপের ঠাকুমা তাঁর বাবার পরিবারেই স্থায়ী হন। অন্যদিকে প্রদীপের মাতৃবংশও স্বাধীনতার আগেই বরিশাল ত্যাগ করে কলকাতায় চাকরি নিয়ে চলে আসেন। ফলে এ বঙ্গে এসে তাঁদেরকে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার লড়াই করতে হয়নি। বরং আধুনিক শিক্ষার সুযোগ পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করতে পেরেছিলেন এই দুটি পরিবারই। সেই কোন ৪৯ সালেই প্রদীপের মা বেথুন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। বিয়ের পর সংসার এবং শিক্ষয়িত্রীর কাজ দুটোই তিনি সমান নিষ্ঠায় নির্বাহ করেছিলেন। এই গ্রন্থে পাঠক যে-প্রদীপকে দেখবেন তা তাঁর জৈবসূত্রে প্রাপ্ত মেধা এবং সুস্থিত ও সুশিক্ষিত পরিবারের ছায়ায় গড়ে ওঠা মননের যোগফল।
এই অধ্যায়েই আমরা পেয়ে যাই লেখকের সাহিত্যিক সত্তার অঙ্কুরিত হওয়ার সূত্রটিকেও। প্রদীপের বাবার সাহিত্যপ্রীতি জন্ম নিয়েছিল তাঁর গ্রন্থাগারিক দাদামশাইয়ের প্রভাবে। এবং লেখক ও তাঁর ভাইদের পাঠাভ্যাস এবং সাহিত্যরুচি গড়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবাই। প্রদীপ লিখেছেন, “তাঁর (বাবার) নিজেরও লেখালেখির একটা স্বাভাবিক নৈপুণ্য ছিল, ইংরাজিতে যাকে বলে ‘ফ্লেয়ার’।”
এই বাক্যে এসে প্রদীপ রায়গুপ্তের গল্পের সঙ্গে পরিচিত পাঠকের মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠতে পারে ‘শ্রবণা নক্ষত্রের রাত্রি’। নষ্ট সম্ভাবনার নিভৃত যাপন কি কোনোভাবে এই গল্পের জন্মের জন্য দায়ি? বাবার শেষ জীবনে, যখন তিনি স্মৃতিভ্রংশের শিকার, প্রদীপ তাঁর এক ভাই এবং স্ত্রীর সহায়তায় তাঁর লেখাপত্র সংগ্রহ করে একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে একটি বই প্রকাশ করেন। সেই বই হাতে পেয়ে খুব খুশি হয়ে তিনি প্রদীপকেই সেই খবর জানিয়ে বইটি পড়ে দেখতে বলেন। এই ঘটনায় নিহিত যে করুণ সুর সেটাই হয়তো আমাকে প্রভাবিত করল এই পাঠপরিক্রমার এমন একটি শিরোনাম বেছে নিতে।
মা-বাবা ছাড়াও এই অধ্যায়ে যে-জেঠু আছেন, তিনি লেখকের আপন জেঠু নন, তাঁর বাবার জেঠতুতো দাদা এবং যে দাদা ও দিদি – তাঁরা তাঁর সহোদর নন, ওই জেঠুরই ছেলেমেয়ে। পরিবারের এই বিস্তৃতি বড়ো মায়ায় জড়ানো, এই শতকের ক্ষুদ্রতায় এসে তাকে গল্পকথা মনে হতে পারে।
পরবর্তী তিনটি অধ্যায়ে সময়ের ধারাবাহিকতা আছে। লেখকের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন; চাকুরি জীবনে প্রবেশ ও বিভিন্ন জায়গায় বদলির বৃত্তান্তের স্মৃতি-পরিক্রমা। এই পরিক্রমায় আছে কুচবিহার ছাড়াও নরেন্দ্রপুর, কলকাতা, চন্দননগর, অশোকনগর, নাগপুর, দিল্লি। আছেন লেখকের বন্ধুবান্ধব – সহপাঠী, সহকর্মী – অধস্তন ঊর্ধ্বতন। বহু নাম যারা চরিত্র হয়ে ওঠার পরিসর পায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখক অতি দ্রুত তাঁদের বহির্জীবনকে ছুঁয়ে এগিয়ে গেছেন। তারই মধ্যে আমাকে থামতে হবে দু-একটা জায়গায়, দু-একটি মানুষের কাছে।
প্রথমে অশোকনগর। টালিগঞ্জের অশোকনগরে লেখক এম এ পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে বছর পাঁচেক ছিলেন। সেটা চাকরিতে ইতিউতি ঢুঁ মারার সময়। এখানে লেখকের সঙ্গী ছিলেন তাঁর কলেজ-য়্যুনিভার্সিটির সহপাঠী স্বপন দাসাধিকারী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন বিভাগের বন্ধু মেদিনীপুরের অশোক ভট্টাচার্য। এমন নয় যে লেখকের কলমে তাঁরা খুব চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছেন। তাঁদের কাছে থামার কারণ এই যে ‘জলার্ক’ পত্রিকার ইতিহাস মাথায় রাখতে হলে এই স্বপনের নামটি মনে রাখা দরকার। কারণ লেখক এবং স্বপনের যৌথ কলমে এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদকীয়টি লেখা হয়েছিল। সেটা যদিও ঘটেছিল অশোকনগরের কিছু পূর্ববর্তী সময়ে কিন্তু এই পর্বটি বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে হল, কারণ মানব চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রদীপ রায়গুপ্তের প্রথম পরিচয় হয় এখানেই যা সূচনা করেছিল এই পত্রিকার দীর্ঘ পথ চলার। অন্যজন - অশোক, পরে বীতশোক এবং কবি হিসাবে সুখ্যাত হয়েছেন। অশোকনগর স্মতর্ব্য আরও দুটো কারণে। জীবনের পথে কখনও কখনও সম্পূর্ণ অনাত্মীয় মানুষও এক অহৈতুকি বোধে একান্ত আপন হয়ে ওঠেন। তেমনই হয়ে উঠেছিলেন লেখকের বন্ধু গণেশের মাতৃসমা দিদি, যাঁর বাড়ির একতলায় তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন। পাঠকের মনে ঠাঁই করে নেবেন অশোকনগরের আরও তিনজন মানুষ। প্রথমজন এক মুদির দোকানের মালিক, সৎ ও মেজাজি মুকুন্দবাবু, বাকি দুজন অব্যবসায়িক সজ্জন ডাক্তার এস সি গুহ এবং তাঁরই দোসর ওষুধের দোকানের মালিক, রমেনবাবু। তিনটিই ‘টাইপ’ চরিত্র যাঁরা সাহিত্যের পাতায় থেকে গেলেও বাস্তব জীবন থেকে ক্রমশই বিলীয়মান।
উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন প্রদীপ। ছাত্রজীবন শেষ করে চাকরি পেতে সমস্যা হয়নি, সমস্যা হয়েছিল চাকরি বেছে নিতে। এই পর্বও অশোকনগরেই। কাঙ্ক্ষিত চাকরিটি পেলেন প্রতিযোগিতামূলক যে-পরীক্ষায় সফল হয়ে, সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং তার বিশেষ একটি পেপার নিয়ে সবিশেষ হয়েছেন তিনি। ‘এসে’ পেপারে একটি ভাব-উদ্রেককারী রচনা – ‘টু অ্যান এম্পটি স্টমাক ফুড ইজ় গড’ লিখতে গিয়ে উপনিষদীয় ‘অন্নই ব্রহ্ম’-এর ভাবনা তার মাথায় ভর করে তাঁকে সগৌরবে উদ্ধার করেছিল। আমার মতো যেসব পাঠক প্রদীপের সমসাময়িক, তারা এই পর্বে এসে নিঃসন্দেহে রোমন্থন-প্রয়াসী হয়ে উঠবেন। অন্যদিকে জেনারেশন জ়েড-এর প্রযুক্তি শাখার এম সি কিউ-অভ্যস্ত ছাত্ররা এই লেখা যদি পড়ে, একটা পূর্ণ সময়ের ১৫০ নম্বরের পেপারের পরীক্ষায় বসে বসে কেবলমাত্র একটা রচনা লিখতে হত জেনে তারা সে-যুগের মানুষের মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠতে পারে।
এরপর আমাকে থামতে হল ‘একবিন্দু শ্রাবণী’র কাছে। মাত্র তিন পৃষ্ঠার পরিচ্ছেদ। ভারী চিত্তাকর্ষক। এবং মনোরমও। ঘটনা নাগপুরের। প্রদীপ তখন সেখানে ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস-এ প্রবেশনার। তাদের একটি বিভাগীয় দ্বিভাষিক(ইংরাজি-হিন্দি)জার্নাল বেরোবে। হিন্দি বিভাগের সম্পাদকের অনুরোধে প্রদীপ হিন্দিতে একটি গল্প লিখে দিলেন। একটি মেয়ের থুতনিতে আঁকা তিল। সেই হল একবিন্দু শ্রাবণী। গল্পের সারসংক্ষেপ দিয়েছেন প্রদীপ। বলেছেন, ‘অল্প বয়সের কাঁচা সেন্টিমেন্টাল গল্প’। আমার কিন্তু অতি চমৎকার লেগেছে সেই প্লট। পাঠকদের কাছে আমি ফাঁস করছি না গল্পটি। তাঁরা থুতনির তিলের সূত্রে কল্পনা করে নিতে পারেন অথবা বইটি সংগ্রহ করে পড়ে নিতে পারেন। হিন্দি বিভাগের সেই সম্পাদক, অজয় ফোতেদার অল্প বয়সে মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। গল্পটির চাইতে তাঁর স্মৃতিই লেখকের কাছে দামি। একবিন্দু শ্রাবণী নামটি যে অজয়েরই দেওয়া!
পঞ্চম অধ্যায়টি ভিন্ন চরিত্রের। এই অধ্যায়ের ছ’টি পরিচ্ছেদ জুড়ে লোকাচার, পূজাপার্বণ, পুরাণচর্চা, কুচবিহারের রাসযাত্রা, রথের মেলা নিয়ে বিবরণের ভিতর থেকে প্রায়ই উঁকি দিয়েছেন শাব্দিক প্রদীপ। এখানে আমি ‘লটকা’-র কাছে একটু থামব। কুচবিহারে বেশ কিছুদিন থাকা সত্ত্বেও আমি এই ফলটির নাম শুনিনি। ফলটির বর্ণনা পড়ে আরও বুঝলাম আমি এটি দেখিও-নি, খাইও-নি। তবে আমাকে মোহিত করল লেখকের ‘লটকা’ নামে কবিতাটি। শেষ চার লাইন উদ্ধৃত করার খুব ইচ্ছে হল –
তুমি এ-ফলের নাম শোননি গো রাধারানি, উত্তরবঙ্গেরষষ্ঠ অধ্যায়ের শেষ দুটি পরিচ্ছেদে প্রয়াত দুই সহকর্মী-বন্ধুর স্মৃতিচারণ করেছেন লেখক। প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদ ভিন্ন গোত্রের। প্রথম পরিচ্ছেদে লেখকের নর্থ-ইস্টে পোস্টিং থাকাকালীন অভিজ্ঞতার স্বাদু বিবরণ। তার মধ্যে অরুণাচলের নামডাফা ফরেস্টে নাগা জঙ্গিদের কবলে পড়তে পড়তে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়ার বিবরণ পড়ে পাঠকের রোমহর্ষ হতে পারে। অবজার্ভার হিসেবে ভোটের ডিউটি করতে প্রদীপকে যেতে হয়েছিল ছত্তিসগড়ের বিলাসপুরে। তৃতীয় পরিচ্ছেদে সেই বিবরণও কম চিত্তাকর্ষক নয়। তবে আমি থেমে গেলাম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে সরকারের বিরুদ্ধে প্রদীপের মামলা করার বৃত্তান্তে। কারণ দুটো। প্রথমটা নেহাতই ব্যক্তিগত। আমি আমার চাকুরিজীবনের শেষ তিনটে বছর কাটিয়েছি সরকারি মামলা নিয়ে হাইকোর্ট আর সুপ্রিম কোর্টে চক্কর কাটতে কাটতে। স্বভাবতই এই মামলাটি আমার কৌতূহল জাগাল। দ্বিতীয় কারণটি আমার বিস্ময়সঞ্জাত। প্রদীপ যা-ই বলুন, এই স্মৃতিকথায় কেবলই বহির্জীবন নয়, অন্তর্জীবনও ফল্গুধারায় বহমান। তা থেকে প্রদীপের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের যে যে দিক উঠে আসে তার মধ্যে অন্যতম এই যে তিনি সোজা পথে চলা নির্বিবাদী এবং নীতিনিষ্ঠ মানুষ। সেই তিনিই কিনা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করলেন! একটু ভাবার পর অবশ্য আবিষ্কার করলাম তাঁর এই সিদ্ধান্তের পিছনে নিহিত আছে এই দুই বৈশিষ্ট্যেরই একটি – নীতিনিষ্ঠা। তিনি যখন তাঁর নিজের বিভাগ অর্থাৎ ট্যাক্স বোর্ড এবং গৃহমন্ত্রকের বদলি-সংক্রান্ত নিয়মনীতি খতিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন তাঁকে বদলি করতে গিয়ে বোর্ড গৃহমন্ত্রকের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে, তখনই তিনি সেই লঙ্ঘনাচারকে অনাবৃত করার উদ্দেশ্যে নিজের নির্বিবাদী সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার অন্তত মনে হয়েছে যে কেবল নিজের জন্য ন্যায়বিচার নয়, তার থেকেও বেশি এই লঙ্ঘনের দিকে তর্জনী নির্দিষ্ট করার দায় বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল তাঁর কাছে। যে-উকিল তাঁর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে মামলা লড়লেন, তাঁকে বেশি কিছু করতে হয়নি। খুঁটিনাটির মধ্যে যাচ্ছি না, সংক্ষেপে বলি, প্রদীপ বলটি এমনভাবে সাজিয়ে দিলেন যে তাতে পা ছোঁয়ানো ছাড়া উকিলবাবুকে কিছু করতে হল না, গোল হয়ে গেল। প্রদীপবাবুর জয় হল। তারপরেও যে তাঁকে অন্য কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি সেটা তাঁর ভাগ্যই বলতে হবে। তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে এব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন, আমার অভিজ্ঞতাও তাই বলে। তবে এসব মামলা নিয়ে বিস্তৃত হওয়ার জন্য আমার কলম যতই সুড়সুড় করুক, মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে সেই ফাঁদে পা বাড়ালে এই লেখা আর রিভিয়্যু পদবাচ্য থাকবে না।
এ-শহরে এই ফল রথের সময় ওঠে খুব।
ভালোই হয়েছে মেয়ে এখানে হারাওনি তুমি, আমি তো তোমার
কোঁচড়টি ভরে শুধু লটকা দিতে পারতাম, তার বেশি আর কিছু নয়।
জীবনের অনেক ঘটনাই গল্পের মুহূর্ত সৃষ্টি করে, অঙ্কুরিত হয় গল্প-উপন্যাসের বীজ। তেমনই সব ঘটনা নিয়ে সাজানো হয়েছে সপ্তম অধ্যায়ের প্রথম চারটি পরিচ্ছেদ। চতুর্থ পরিচ্ছেদ ‘গঙ্গাজল’ এবং শেষ পরিচ্ছেদ ‘কাক’ নিয়ে যদিও কোনো গল্প সৃষ্টি করেননি প্রদীপ, ‘কাক’ মূলত তাঁর শব্দচর্চার আসর, কিন্তু এই দুটির মধ্যেও নিহিত ছিল গল্পের বীজ। নবম অধ্যায়ের ‘লেখালেখি’ এই অধ্যায়ে নিয়ে এলে সাহিত্যপাঠকের একাগ্র পাঠের উপাদেয়তায় ছেদ পড়ত না। সপ্তম অধ্যায়ের বাকি পরিচ্ছেদগুলি দশম অধ্যায়ে নিয়ে গেলে দিব্যি খাপ খেয়ে যেত বলে মনে হয়। দশম অধ্যায়ের পুরোটা জুড়েই লেখকের স্মৃতি-অনুধ্যান। লেখক-ভাবুক প্রদীপকে এখানে তাঁর নিজস্ব বর্ণে পেয়ে যাবেন পাঠক।
অষ্টম অধ্যায়ে ‘করোনাকালের ডায়েরি’ নামে একটি পরিচ্ছেদ আছে। সেই আতঙ্কপীড়িত, হতবুদ্ধিকর সময়ের স্মৃতি প্রত্যেকের মনেই আমৃত্যু অমোচনীয় হয়ে থেকে যাবে। যাঁরা লেখেন, তাঁদের মধ্যে সম্ভবত একজনকেও পাওয়া যাবে না যিনি করোনাকাল নিয়ে লেখেননি। এবং সেই কালের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকা লকডাউনকে নিয়েও। প্রদীপের এই লেখা খুবই সংক্ষিপ্ত। তিনি আর পাঁচজন শিক্ষিত, সচেতন, বিতর্ক এড়িয়ে চলা মানুষের মতোই নিজের এবং পরিবারের অসহ অভিজ্ঞতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন লেখাটিকে। তিনি, এমনকি লকডাউনের মহড়ার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীর হাততালি ইত্যাদি দেওয়ার নিদানকেও মান্যতা দিয়েছেন। যদিও এখানে অপ্রাসঙ্গিক, তবুও না বলে পারছি না যে এতদিন পরে আজ এটা পরিষ্কার যে, করোনার মোকাবিলায় আতঙ্ক ছড়ানো থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন পর্ব পর্যন্ত যা-কিছু হয়েছে, তার পিছনে বিজ্ঞান যতোটা ছিল, তার থেকেও বেশি ছিল সুচতুর বাণিজ্য-পরিকল্পনা।
তাঁর ছাত্র ও চাকুরিজীবনের নানা প্রসঙ্গে উঠে এসেছে ক্রিকেট খেলার প্রতি লেখকের অনুরাগের কথা। কেবল অনুরাগ নয়, এই খেলায়, বিশেষত, একজন স্পিন বোলার হিসাবে যে তাঁর বেশ নৈপুণ্যও ছিল তাও আমরা জেনে গেছি। অষ্টম অধ্যায়ে দু-দুটি পরিচ্ছদ আছে এই খেলাটি নিয়ে। প্রথমটি জীবনের নানা পর্বে তাঁর ক্রিকেট খেলা নিয়ে। পরিণত বয়সেও খেলাটির প্রতি তাঁর ভালবাসা এবং খেলার ইচ্ছা অম্লান। জীবনের শেষ লক্ষ্য নাতির সঙ্গে ক্রিকেট খেলা। আশা করা যায় এতদিনে তাঁর সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।
অন্য পরিচ্ছেদটির বিষয় ১৯৮৩ সালে আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় ভারতের বিশ্ববিজয়। আমার মতো অনেক পাঠকের স্মৃতিতে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ঘটনা না বলে অঘটনই বলতে হয়। বিশেষ করে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কপিলদেবের অবিশ্বাস্য ব্যাটিং-এ নিশ্চিত হারকে বিজয়ে রূপান্তরিত করে ভারতকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখা এবং ফাইনালে তখনকার দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে অল্প রানের পুঁজি এবং সীমিত মাপের বোলিং শক্তি নিয়ে জয় হাসিল করা। রেডিও মারফত শুনেছিলাম সেই সব ম্যাচের ধারাবিবরণী। এই পরিচ্ছেদে অতি বিশদে চমৎকারভাবে বর্ণনা দিয়ে প্রদীপ ফিরিয়ে আনলেন সেই স্মৃতি। পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘এইট্টি-থ্রীঃ একটি নস্টালজিয়া’ সার্থকনামা হয়ে উঠল।
এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায় ‘জ্যোৎস্নাপথের আলোছায়ায়’। সব পাঠকের গ্রন্থের সব পরিচ্ছেদই ভালো না-ও লাগতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত এই পরিচ্ছেদ পড়া-শেষে প্রতিটি পাঠক দুদণ্ড বুঁদ হয়ে বসে থাকবেন, আপন মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের আনাচকানাচ হাতড়ে বেড়াবেন – শিথিলতা এল কি কোথাও?
এই পরিচ্ছেদের নামটি কাব্যিক হলেও বিষয়বস্তু, প্রায় আগাগোড়াই, যাকে বলে ম্যাটার অব ফ্যাক্ট; তবুও এর মধ্য থেকে উঠে আসে এমন এক দর্শন যা সিক্ত করে হৃদয়কে। লেখকের বাবা এবং মা – দুজনেই শেষ বয়সে আক্রান্ত হন অ্যালজ়াইমার্সে। এই অসুখের উপসর্গ, কারণ, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে যাবতীয় জ্ঞাতব্য তথ্য আহরণ করে লেখক এখানে উপস্থাপিত করেছেন। বলা যায় অসুখটিকে নিয়ে উস্তম খুস্তম করেছেন। মনে দুর্ভাবনা, তিনিও হয়তো এই রোগের শিকার হবেন। নিজের স্মৃতিভ্রংশের কিছু কিছু উদাহরণ দিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেগুলি অ্যালজ়াইমার্সের পূর্বলক্ষণ কি-না। তাঁকে আশ্বস্ত করতে পারি যে ওইসব ভুল যদি অ্যালজ়াইমার্সের পূর্বলক্ষণ হয় তাহলে আমিও ওই রোগে আক্রান্ত হতে চলেছি। শুধু আমি কেন, ষাট বা সত্তরোর্ধ্ব প্রায় সব মানুষই অ্যালজ়াইমার্সে আক্রান্ত হতে চলেছেন। মা ও/অথবা বাবার ক্রোমোজোম থেকে আসা কোনো জিন যদি এই রোগের কারণও হয়, মনে রাখতে হবে এইসব দুষ্ট জিনের বেশির ভাগই আজীবন নিষ্ক্রিয় থেকে যায়।
‘রিমেমবার দোজ় হু ক্যানট রিমেমবার’ – এই বাক্য দিয়ে শুরু হয়েছে পরিচ্ছেদ, শেষও হয়েছে এই বাক্যে; যেন ধ্রুবপদ। বেহালার ছড়ে আলতো একটি টান, এক বিষণ্ণ মায়া স্পর্শ করে পাঠককে, গ্রন্থ শেষ হয়। প্রদীপ রায়গুপ্তের স্মৃতিকথা ‘ছিন্ন পাতার তরণী’র শেষ বাক্যটি দীর্ঘক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখবে পাঠককে। সুব্রত চৌধুরীর প্রচ্ছদ যেন গ্রন্থনামের প্রতিচ্ছবি।