গিয়েছিলাম হাতিবাগান। উপলক্ষ্য পুজোর আগে জমে থাকা কিছু পিসে সালোয়ার কুর্তির অর্ডার দিয়ে দেওয়া টেলারিং-এ ভিড় বাড়ার আগেভাগে। উপলক্ষ্য ছাড়িয়ে যা দেখলাম তাই লিখি। এমনিতে হাতিবাগান যাওয়া আসা আমাদের বরাবরেরই। তাই বড় রাস্তার দুদিকে ফুটপাথ সমেত-ই, নতুন পুরনো দোকান, হাতিবাগান মার্কেটের ভিতর মাছ সব্জির স্টল, রবিদার নাম করা বড়ির দোকান, বদ্রী টেক্সটাইলের লেপ কম্বলের খোল, বালিশের ওয়াড়ের ভাল স্টকের খবর আমাদের জানা ছিল। শীতের খেজুর পাটালি, অরন্ধনের চালতা, মোরব্বার কাঁচা বেল, মশলাপাতি বলতে পাঁচফোড়নের রাঁধুনি আমরা হাতিবাগানে ভাল দরে পেয়েছি (যা এখন অনলাইন হয়ে সবই এক রকম হয়ে গ্যাছে)। –হাতিবাগানের সাথে এই অবধি আমাদের পরিচয়। আসলে সদ্য সল্টলেকে এসে এ শহরকে তখন আমরা একটু সন্দেহের চোখেই দেখতাম, দামের ব্যাপারে ঠিক সবটা বিশ্বাস হোতো না, তাই হাতিবাগান কথায় কথায় যাওয়াও হয়ে যেত।
এবার অবশ্য হাতিবাগান মার্কেটের উল্টো ফুটে টাউন স্কুলের দিকে মিনার সিনেমার কাছেই আমার গন্তব্য ছিল। ঠিক এদিকটা জানা ছিল না। সল্টলেকের দর্জি কুল নানান অজুহাতে অর্ডার না নেওয়ায় এতদূর ছুটে আসা। এই আসাতেই আর একটা বিস্ময়ের দরজা খুলে গেল। ড্রেসের অর্ডার দিয়ে ওড়না পিকো করার জন্য যেখানে ঢুকলাম সে যেন এক রূপকথার দেশ। আলিবাবা ডাকাত গুহায় ঢুকে আসলি হীরে জহরতে চোখ ধাঁধিয়েছিলেন, আমার চোখ ধাঁধালো ইমিটেশন গহনা, জরি ফিতে, সস্তা ব্রোকেড ব্লাউজের হাজার আলোর ঝলকানিতে। শুধু কি তাই? আর ও কত কি টুকিটাকিতে ভরা এ যেন মধ্যবিত্তের স্বর্গপুরী। হয়ত সেদিন ঝড়ে আপনার ছাতাটা গ্যাছে—আর একটা তো চাইই চাই। কি হবে ডাকব্যাক, মহেন্দ্র দত্ত, কে সি পালে, --এখানে একশো, দেড়শো টাকায় দেদার বিকোচ্ছে, ভাঙ্গলে কি এসে যায়, সামনের বছর আর একটা হবে, নতুন কেনার একটা ছুতোও থাকবে। ঠিক তেমনি যদি ভাবেন পুজোর আগে টেবল ম্যাটগুলো পালটে ফেললে বেশ হোতো, তাও আছে, তার সাথে অল্প আরো কিছু খরচে মেলামিনের ছটা ডিনার প্লেট, বাড়িতে মানুষজনের আসা যাওয়া তো লেগেই থাকে—আর কটা চিনে মাটির পেয়ালা; তার সাথে ঘন সবুজ রঙা কাঁচের ফুলদানিতে ছটা হলুদ সাটিনের গোলাপ, --- পুজো যে এসে গেল। বেশ তো মন ভরে যাবে, ব্র্যাণ্ডে কাম কি।
ছোটো ছোটো খুপরি দোকানে ভরা শ্রী মার্কেট, উত্তরা মার্কেটের কথাই বলছিলাম। কোথাও মেশিন পেড়ে নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে কারিগর সেলাই করে চলেছেন, চোখের নিমেষে দশ টাকায় ওড়না পিকো শেষ। সকলেই ব্যগ্র, ডাকাডাকি করছেন তাদের কাজের দক্ষতা পরীক্ষা করে নিতে। মূল্যও নগণ্য। বেশির ভাগ পণ্য বিক্রী হচ্ছে গোছা গোছা, থাক থাক দড়িবাঁধা। হয়তো হোলসেলের ব্যাপারও থাকতে পারে। কসমেটিকস – তাও আছে তবে তাদের মান কেমন বলতে পারব না। যাই হোক পকেট নাইবা ভারি হ’ল, -- একবার অটো করে হাতিবাগান মোড় পৌঁছে গেলেই কেল্লা ফতে।
বাজার কলকাতার মত মার্কেট কমপ্লেক্সও হাতাহাতি করে ঢুকে পড়েছে ফুটপাত মার্কেটের পাশে। ক্রেতা নতুনের খোঁজে সেসব মলে ঢুকলেও জিত হয় বরাবর ছোটো দোকানিদেরই।
শ্রী মার্কেট থেকে বেরিয়ে মনে হল একবার ফুটপাত স্টলগুলোতেও ঢুঁ মেরে নিই, দেখলাম আমরা আগে দশ টাকায় যে ইয়ার টপ কিনেছি (হারালে তো ভয় নেই আবার হবে) এখন না হয় মূল্য বৃদ্ধিতে তা তিরিশে দাঁড়িয়েছে, তাতে মনে হ’ল কারো বিশেষ অভিযোগ নেই। গুরজারি অবন্তীর মত এম্পোরিয়মে যা আটশো হাজারে বিকোচ্ছে, প্রায় সে রকম নেকলেস বালা আপনি পাচ্ছেন দেড়শো দুশোয়। ক্ষতি কি, গলায় হাতে পরে বেরোলে তো কোথাও ফুটপাতের ট্যাগ থাকবে না। --ইতি উতি দেখতে দেখতেই নজর কাড়ল হোয়াইট মেটালের এক সেট চোকার আর কানের দুল, (তাতে রং বিরঙ্গি পাথর না টিনের ওপর রং করা বলতে পারব না) মাত্র দেড়শো টাকা—কিনি কি কিনি না ভাবছি, --হুস করে কন্যা পকেট মানি দিয়ে ব্যাগস্থ করলে তাকে, (ফাইভ জি মানুষ তো)--আর আমি কপারের ছাঁচে মা দুর্গার মুখ দেওয়া লকেট সমেত লাল সোনালি পুঁথির লম্বা মালা নিলাম আমার অষ্টমীর লাল সাটিন পাড় সাদা শাড়ির সাথে ম্যাচ করে। যাই হোক নিজেদের সাজের যোগাড় তো হ’ল, সাথে সাথে কেনা হয়ে গেল পাপোশ, তোয়ালে, কাপড় শুকোবার ক্লিপ, পুজোভিত্তিক গোপালের জরির ঘাগরা, গণেশের ধুতি চাদর, মা লক্ষ্মীর মুকুট চাঁদমালা। যখন ভাবছি অনেক হল আর নয় চোখে পড়ল আকাশরঙা স্টোলটা—সাদা কামিজের সাথে বেশ যাবে, যেন পেঁজা মেঘের ফাঁকে এক টুকরো শারদ আকাশ। নিয়েই নিলাম, মাত্র একশো কুড়ি তো। আরও কমালে হ’তো? নাহ! দোকানির হাসি মুখ যে শুকোতো।
হাতিবাগানের প্রতিটি কোনা অলিগলি থেকে যেন প্রাণ উপচে পড়ছে। বিশ্বকর্মা পুজো তো পুজোর লাইনে সবার আগে তাই ফড়েপুকুরের ঘুড়ির দোকানে ভিড় জমতে সুরু হয়েছে। কিছুদিন আগের কেনা ঘুড়ি লাটাই আমাদেরও রয়েছে, হয়তো মনের অজান্তে চোখের রঙিনে ছেয়ে রং জায়গা করে নিচ্ছে তাই আর আলমারির মাথা থেকে তাদের পাড়া হয় না। সে যাক, মনে যখন পড়েছে ধুলো ঝেড়ে আকাশে উড়িয়ে দিতেই বা কতক্ষণ।
ভাত খেয়ে বেরোলেও কেনা কাটা করলে মনে বেশ একটা ফুর্তি ফুর্তি ভাব আসে, আমার তো আসেই। চা খাওয়ার সময় সাড়ে ছটা হলেও চারটে বাজতেই মন উশখুশ করে চোখ ইতিউতি চায় চা আর তার সাথে টায়ের জন্য। সে ব্যবস্থাও আছে। ট্রাম লাইন-এর জন্য খানিক রাস্তা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গ্যাছে ফুলুরির ঠ্যালা। কালো বড় কড়াইতে ভাজা হচ্ছে খুদেখুদে মুচমুচে ডালের বড়া, সাহস থাকলে মেরে দেওয়া যায় কটা, পাশেই তো কেটলি হাতে ঘুরছে লেবু চা ওয়ালা।
এই প্রাণবন্ত উচ্ছলতায় তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন হাতিবাগান। তাতে মন আমাদেরই খারাপ হয়, খোদ হাতিবাগানের কোনো মাথাব্যাথা নেই।
হাতিবাগান বলতে সবাই সিনেমা পাড়া বুঝত, কিন্তু আগে যে সব সিনেমা হল গুলো রমরমিয়ে চলত যেমন দর্পণা, শ্রী, রূপবাণী, উত্তরা, রাধা, টকি শো হাউস, যেখানে আমরা ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন রেনি ডে হিসাবে ক্লাস কাটা করে ‘আনন্দ’, ‘হাতি মেরা সাথি’র মত জমাটি সিনেমা দেখেছি; সেসব হল যেন আজ রুগ্ন হাতির দল, - চলছে হয়ত ঠিকই, অনেক দিন যাইও না, তবে ভিতরের অবস্থা বাইরের চেহারা দেখেই খানিক আন্দাজ করা যায় যেমন বাড়ির সুমুখ দেখলে ভিতরের বাসিন্দাদের দৈনন্দিনের আঁচ পাওয়া যায় বেশির ভাগ সময়। নেট দেখছিলাম, চোখে পড়ল শপিং মলের গ্রাসে শতাব্দী প্রাচীন মিত্রা সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেল। ‘ঐতিহ্য নাকি ঐতিহ্য নয়’ এর টানাপোড়েনে উত্তরা সিনেমা হল।
এছাড়া হাতিবাগান বললেই মনে আসে স্টার, রঙ্গনার মত অভিজাত থিয়েটার হলের কথা। এসপ্ল্যানেডের মেট্রো সিনেমা হলের মত এখানে ঢুকলেও মনে হত কোনও মন্দিরে এলাম কি? স্কুল থেকেই ব্লক বুকিং করা হোতো মেট্রোতে, স্কুল ড্রেস পরে বেনহুর দেখা আর আরেকটু বয়সে, ধরা যাক বাইশ তেইশে, স্টারে নান্দীকারের ‘তিন পয়সার পালা’ সম্মোহিত করত। বিস্ময়ে দেখতাম রিভলভিং স্টেজের কারিকুরি। ওখানেই দেখেছি ‘নটী বিনোদিনী’ যার নামে এই হল করার কথা ছিল, যা শেষ মুহূর্তে পালটে হয়েছিল ‘স্টার’। এবার দেখলাম ঠিক পাশেই ‘নটী বিনোদিনী মেমো রিয়াল আর্ট গ্যালারি’।
আজও ‘স্টার’ আছে তবে সিনেমা হল হিসাবে। বিগতদিনের আমরা (যদিও নিজেকে বিগত বলতে রাগ হয় বইকি) প্রশ্ন করি ‘সবই কি আধুনিকতার মোড়কে চাপা পড়ে যাবে?’ কিন্তু যাকে নিয়ে চিন্তা তার হেলদোল নেই নেচে কুঁদেই সে অস্থির।
কিছু লিখতে বসলেই লোভ হয় কিছু ইতিহাস আউড়ে নিই, যেমন হাতিবাগানকে হাতিবাগান বলা হয় কেন, কিন্তু সেতো শোনা কথা, এ লেখায় তা টানবো না, এতো আমার দেখা একান্ত আপনার হাতিবাগান।