উনি তো বলে তরিকে ভর্তি করে নিলেন কিন্তু সে দুদিন স্কুলে গিয়ে আর যেতে চায় না। সকালে উঠেই কান্নাকাটি জুড়ে দেয় স্কুলে যাব না বলে। মা-বাবা ওকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে হয়রান কিন্তু তরির কান্না থামে না। মা-বাবা তো মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন। এদিকে বাবার নতুন চাকরিতেও কাজের চাপ, সেই নিয়েও হিমশিম। সব মিলিয়ে তাদের রাতের ঘুম উড়ে যাওয়ার অবস্থা।
তরি শুনল বাবা মাকে বলছেন, “এখানে আসাটা ঠিক হল কিনা এখন সেটাই বুঝতে পারছি না। মেয়েটা স্কুলে যেতে চাইছে না। আগে তো স্কুলে যেতে কত ভালোবাসত।”
মা বললেন, “হ্যাঁ, ওকে যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি করা হয়ছিল তখনও স্কুলে যেতে এত কাঁদেনি, কী যে হবে।”
পরদিন তরিকে একরকম জোর করেই স্কুলে পাঠানো হল। তবে সে যখন স্কুল থেকে ফিরল তখন তার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলেন মা। স্কুল থেকে ফিরে নিজের প্রিয় খাবার ম্যাগি খেতে খেতে তরি বলল, “জানো মা, আমি না স্কুলে একজন বন্ধু পেয়েছি!”
মা তো শুনে খুব খুশি হয়ে বললেন, “ওমা তাই নাকি? বাহ, সেটা তো খুব ভালো খবর। তা বন্ধুর নাম কি?”
“ওর নাম ঋত। সেই ছেলেটাও কলকাতা থেকে এসেছে তাই হিন্দি বলতে পারে না। আমরা দুজনে মিলে খুব গল্প করেছি আজ। ঋত নাকি খেলাধুলোয় খুব ভালো। কলকাতায় বাবাইদাদার মতন ফুটবল আর ক্রিকেট কোচিং ক্লাস করত। এখানে সেই রকম কিছু আছে কিনা ওর মা-বাবা খোঁজ করছেন।”
মা মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। যাক বাবা মেয়েটা একটা অন্তত বন্ধু পেয়েছে স্কুলে।
পরদিন সকালে উঠে তরি আর স্কুলে যাব না বলে কাঁদল না। বরং খুশি মনেই স্কুলে গেল। স্কুল থেকে ফিরে মাকে বলল, “জানো মা, আজ না স্কুলে একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। ঋত যে পুল কার করে স্কুলে যায় তাতে আমাদের ক্লাসের একটা খুব দুষ্টু ছেলেও যায়। সে আজ সকালে গাড়িতে ঋতকে বলেছে, ‘গতকাল তো হিন্দি টিচার তোকে খুব বকুনি দিয়েছিল তুই রিডিং পড়তে পারিসনি বলে তা আজতে তুই মিসকে হিন্দিতে বলিস মিস আপনাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে, একদম চুহার মতন!’ ঋত চুহা কী জিগ্যেস করতে ছেলেটা বলেছে চুহা মানে ‘খুব সুন্দর, খুব ভালো’ এই সব। ঋত ছেলেটাকে বিশ্বাস করে হিন্দি ক্লাসে টিচারকে সেটাই বলেছে সবার সামনে। তাই শুনে ক্লাসে সব ছেলেমেয়েরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আর টিচার রেগে মেগে ঋতকে বকতে শুরু করলেন। ঋতটা কী বোকা না মা? চুহা মানে যে হিন্দিতে ইঁদুর তাই জানে না!”
মা শুনে ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আহা রে! সে জানবেই বা কী করে? সে তো হিন্দি জানে না। সে ভালো মনে ওই পুল কারের ছেলেটাকে বিশ্বাস করেছিল। সেই ছেলেটা খুব দুষ্টু তো!”
তরি মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, খুব দুষ্টু।”
এর পরের দুটো দিন শনিবার আর রবিবার ছিল তাই সেই দিন দুটো তরির বেশ মজা করেই কাটল। ওর মন ভালো করার জন্যে রবিবার দিন মা-বাবা ওকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেলেন।
সোমবার দিন স্কুল থেকে ফিরে তরি বলল, “জানো মা, ঋতও রবিবার দিন চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল! কিন্তু ও আমাদের দেখতে পায়নি আর আমিও ওকে দেখতে পাইনি।”
মা বললেন, “ও আচ্ছা তাই নাকি। অবশ্য যা ভিড় ছিল তাতে আমরাই হারিয়ে যাচ্ছিলাম আর অন্য কাউকে দেখতে পাওয়া তো খুব মুশকিল ছিল।”
“ঋত আজকে ক্লাসে বাঁদরটা আর রয়াল বেঙ্গল টাইগারটা কী করছিল সেই সব অভিনয় করে দেখাচ্ছিল। সেই সব দেখে সবাই খুব হাসছিল। ও আজকে অঙ্কের ক্লাসে সারপ্রাইজ টেস্ট নেওয়া হল। আমার সব অঙ্কই ঠিক হয়েছে। মিস আমাকে ভেরি গুড বলেছেন। ঋত অবশ্য অঙ্ক পারে না ভালো তাই অনেক অঙ্ক ভুল করেছে। আমি ওকে বলেছি অঙ্ক শিখিয়ে দেব।”
মা বললেন, “হ্যাঁ, সেটা খুব ভালো হবে।”
“আর জানো মা আঁকার ক্লাসে মিস বোর্ডে আঁকতে আঁকতে বলছিলেন কী আঁকছি বলো তো! আর ঋত অমনি উঠে দাঁড়িয়ে দুম করে বলে ফেলল ‘ওটা তো টিকিটিকি!’ মিস টিকটিকিই আঁকছিলেন কিন্তু হিন্দিতে তো টিকিটিকিকে ছিপকিলি বলে তাই টিকটিকি শুনে ক্লাসের সকলে আবার হো হো করে হাসি জুড়ে দিয়েছিল। তবে আঁকার টিচার মিস সেনগুপ্ত তো বাঙালি তাই উনি বুঝতে পেরে অন্য সবাইকে হাসার জন্যে বকলেন। বললেন টিকটিকি যা, ছিপিকিলিও তাই আবার লিজার্ডও তাই, ওতে হাসার কিছু নেই,” বলে তরি ড্রয়িং খাতাটা বার করে মাকে দেখিয়ে বলল, “এই দেখো আমি কী সুন্দর ছিপকিলি এঁকেছি! মিস এ+ দিয়েছেন। ঋতর টিকিটিকিটাকে অবশ্য কিছুটা সাপের মতন দেখতে লাগছিল।”
এই ভাবেই চলতে লাগল। ক্রমে তরি হিন্দি শিখতে লাগল। নিচের তলার ফ্ল্যাটের সুধা আন্টি ওকে বাড়িতে এসে হিন্দি পড়াতে শুরু করলেন। তরি স্কুল থেকে ফিরে মাঝে মাঝে এখনও ঋতর কথা বলে বটে কিন্তু অনেক কম। অন্য আরো অনেক বন্ধু হয়ে গেছে ওর, তাদের কথাই বেশি বলে।
মাস কয়েক পরে তরির জন্মদিনে ওদের বাড়িতে তরির বন্ধুদের ডাকতে চাইছিলেন মা। তরিকে সেটা বলতে সে একটু ভেবে বলল, “সুহানি তো অনেক দূরে থাকে। জানি না ও আসতে পারবে কিনা। আমি ওকে বলব। বাবা-মা কে জিগ্যেস করে জানাবে। সঞ্জনা আর রঞ্জনা তো যমজ। ওরা বেশি দূরে থাকে না। ওরা মনে হয় আসতে পারবে আর মৈথিলি তো আমার সঙ্গে একই পুল কারে যায়, পাশেই থাকে।”
মা বললেন, “হ্যাঁ, কার পুলের যারা তারা তো পাড়ার সব, তাদের তো ডাকাই যায়। তাদের সবাইকে বলে দেব ক্ষণ। ও হ্যাঁ, মনে করে ঋতকে ডেকো কিন্তু। ও কোথায় থাকে? আশা করি আসতে পারবে।”
তরি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “ঋত? ঋত তো আর আমাদের ক্লাসে আসে না মা। ওকে বলতে পারব না।”
“সেকি! আসে না মানে? অন্য স্কুলে চলে গেছে?”
তরি বলল, “জানি না। আর দেখি না ওকে।”
মার আর চাপ না দিয়ে বললেন, “ও আচ্ছা ঠিক আছে। আমি দেখি অন্যদের ডাকার ব্যবস্থা করি।”
তরির জন্মদিনের আগে বাবার অফিসের শেখর কাকুকদের বাড়িতে একটা গেট টুগেদারে তরিদের আঁকার টিচার পূর্বা সেনগুপ্তর সঙ্গে দেখা হল ওদের। তিনি নিজেই এসে আলাপ করলেন মা-বাবার সঙ্গে, তরির আঁকার প্রশংসা করলেন। মার সঙ্গেই তাঁর কথা হচ্ছিল বেশি কারণ বাবা শেখরকাকুর সঙ্গে কথা বলছিলেন আর তরি অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলায় মেতেছিল।
মা মিস সেনগুপ্তকে বললেন, “এখন তো তরির স্কুলে যেতে খুব ভালো লাগে, অনেক বন্ধুও হয়ে গেছে কিন্তু প্রথম প্রথম আমরা ভয়ানক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কিছুতেই স্কুলে যেতে চাইত না তরি। তারপর ঋত বলে একটা বাঙালি ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হল।”
মিস সেনগুপ্ত অবাক হয়ে বললেন, “ঋত? কে ঋত?”
“তরিদের ক্লাসে ঋত বলে একটা ছেলে ছিল না? ও হ্যাঁ, যে আপনি বোর্ডে টিকটিকি আঁকছেন দেখে বাংলায় বলে ফেলেছিল?’
মিস সেনগুপ্তর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, “আপনি কিছু একটা ভুল করছেন মনে হয়। তরিই তো আমার বোর্ডের আঁকা দেখে টিকিটিকি বলে চিৎকার করে ফেলেছিল। তাতে ক্লাসে অন্য বাচ্চারা হেসেছিল বলে আমি তাদের বকেছিলাম। সেই জন্যেই ঘটনাটা আমার পরিষ্কার মনে আছে। আর ঋত নামে ওই ক্লাসে কোন বাঙালি ছেলে ছিল বলে তো আমার মনে পড়ছে না।”
মা আর কিছু বললেন না। চুপ করে গেলেন। তাঁর মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল।
বাড়ি ফিরে তরিকে বললেন, “তরি, মিস সেনগুপ্ত তো বললেন তোমাদের ক্লাসে ঋত নামে কোন ছেলেই ছিল না! তাহলে তুমি কার কথা বলতে?”
তরি ফিক করে হেসে বলল, “ছিল নাই তো! ঋত তো আমার মন গড়া বন্ধু। তখন তো সুহানি, সঞ্জনা, রঞ্জনা কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি তাই নিজের তৈরি বন্ধুর সঙ্গেই কথা বলতাম মনে মনে। আমি যা যা গন্ডগোল করে ফেলতাম, বা আমার সঙ্গে ক্লাসের দুষ্টুরা যা যা দুষ্টুমি করত সব ঋতর নাম করে এসে তোমাদের বলতাম। আমি করেছি বা আমাকে দেখে হেসেছে ক্লাসের সবাই সেটা শুনলে তোমরা ভয় পেতে তো সেই জন্যে। যখন ঋতকে দরকার হত তখন ও ছিল আর এখন অন্য অনেক বন্ধু হয়ে গেছে তাই ওকে আর লাগে না।”
তরি ঘুমিয়ে পড়ার পর মা টাবিলে ফেলে রাখা বইগুলো তুলে রাখতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলেন একটা খাতার পিছনে তরি লিখেছে ‘তরি – রিত’! তার মানে নিজের নামটাকে উলটে তরি ওকে বানিয়েছিল। আসলে সে ছিল রিত, ঋত নয়। রিতর সব কিছুই উলটো ছিল, সে ছিল ছেলে, অঙ্ক পারত না, আঁকতে পারত না। গন্ডগোলগুলো ছাড়া সে ছিল তরির একেবারে বিপরীত, আর অনেকটা তার মামাতো দাদা বাবাইয়ের মতন! মেয়ের কান্ডকারখানা তার বাবাকে বলতে গিয়ে হেসে ফেললেন তরির মা।