

ক্ষণকালের খণ্ডকথা-- দেবজ্যোতি দাশ; ‘কৃতি’ প্রকাশন, কলকাতা-৪; প্রথম প্রকাশঃ নভেম্বর ২০২১; ISBN নেই
তা হবে না-ই বা কেন?
কমবেশি প্রায় ত্রিশখানি গ্রন্থপ্রণেতা দেবজ্যোতিবাবু যে ভারতে bio-statistics চর্চার এক পুরোধা পুরুষ ছিলেন সেই ১৯৬০-এর দশক থেকে তা-ই মাত্র নয়, সাহিত্যচর্চাতেও বিশেষ অবদান ছিল ওঁর যেটা অনেকেই জানে না। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর উদ্যোগে ‘সাহিত্যসাধক চরিতমালা’ সিরিজের অন্তর্গত সাতটি জীবনীগ্রন্থেরও তিনি ছিলেন রচয়িতা। এবং, বিজ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রে বাংলাভাষায় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণারও এক পথিকৃৎ ছিলেন স্যর। সেবানিবৃত্তির পরে ১৯৯১-৯৬ দীর্ঘ পাঁচ বৎসর প্রেসিডেন্সি প্রাক্তনীদের গরিমাময় ‘অটাম এনুয়াল’ পত্রিকার এডিটর ছিলেন উনি। ওঁর ঋজু মেরুদণ্ড ও স্পষ্টবাদিতার জন্যে প্রবল জন-অপ্রিয় মানুষ ছিলেন দেবজ্যোতি, নতুবা দীর্ঘকাল প্রেসিডেন্সিতে বিভাগীয় প্রধান থাকা সত্ত্বেও ওঁকে অধ্যক্ষ করা হয়নি কেন? বঞ্চিত হয়েছেন, ওঁর ডক্টরেট করা ছিল না বলে (যদিও ওঁর অনুপ্রেরণায় ডক্টরেট করেছেন বহু ছাত্রছাত্রী)! ৯০-সংখ্যায় আমরা প্রবাদপ্রতিম বাংলাদেশী অর্থশাস্ত্রী ‘জাতীয় অধ্যাপক’ আব্দুল রজ্জাক সাহেবের কথা পড়েছিলাম নিজে ডক্টরেট না হয়েও যিনি তিনটি প্রজন্মকে গবেষণা করা শিখিয়ে গিয়েছিলেন। প্রফেসর দেবজ্যোতি দাশের (১৯৩১-২০২৩) কেসটিও অনুরূপ।
***
জন্ম নিয়েছিলেন উত্তর কলিকাতার এক বিরাট ধনী-বনেদী-ও-শিক্ষিত পরিবারে। পূর্বজদের মধ্যে ছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির গৃহচিকিৎসক ডাঃ নীলমাধব হালদার। কিন্তু অবস্থার বিপাকে ও বেশ কিছু নিকটজনের অকালমৃত্যুর কারণে দুর্বিপাকে কেটেছিল দেবজ্যোতির বাল্যকাল। আবাল্য অতি-মেধাবী ছাত্র---যার ধারা বজায় ছিল এম.এস.সি তে স্বর্ণপদক জয়ের মধ্যে। বিলেতে গবেষণার সুযোগ পেলেন। কিন্তু পারিবারিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যাওয়া হলো না। হলো না তো হলোই না। আজীবন আর ডক্টরেটই করা হয়ে উঠল না (পরে প্রশ্ন উঠেছিল, কার অধীনে করবেন উনি?)
এ’সব জীবনকাহিনীর গপ্প থাক্, সটান বইটির প্রসঙ্গে আসি। যেহেতু দেশবিভাগজনিত এক টালমাটাল সময়ের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল তাঁর কৈশোর-ও-প্রাক্যৌবনকাল, সে সময়কার কলকাতার জাজ্বল্যমান ঘটনাবলী বড় অনায়াসে এসেছে তাঁর কলমে। আবার হিন্দু স্কুল/কলেজের মতো তাঁর শিক্ষায়তনের গল্পপ্রসঙ্গে অনায়াসে চলে গিয়েছেন সেই ডিরোজিওর কালে। কর্মারম্ভ তাঁর পাটনা ভেটারেনারি কলেজে। ১৯৫০এর দশকের পাটনার গল্প পড়তে পাওয়া বেশ মনলোভা। হুগলী মহসীন কলেজে পড়িয়েছেন দীর্ঘদিন। রয়েছে সেখানকার গল্পও। বিদূষী স্ত্রী-কন্য এবং পুত্রের গল্পও এসে গেছে কিছু কিছু। একটি সময়কালের সমৃদ্ধ দলিল, তাই, এই গ্রন্থ। শুধু সেকালের শিক্ষাজগতই নয়, সেই সময়কালটিকে নির্মোহভাবে ধরে রাখায় অতি সফল বর্তমান গ্রন্থটি।
***
পৃষ্ঠপ্রচ্ছদে কোনো ব্লার্ব নেই। দ্বিতীয়টিতে যা আছে তাতে ওঁকে শারীরতত্ত্বের এক প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া নেই। উচিত ছিল। স্যর বিজ্ঞাপনবিরোধী মানুষ ছিলেন, তা বলে প্রকাশকমহাশয়ও তেমন হবেন কেন? তাহলে হবু ক্রেতা/পাঠক কী টানে গ্রন্থটির নিকটে আসবে? চিনবে কী করে এমন এক প্রবাদপ্রতিম মানুষকে?
নেহাতই ঢক্কানিনাদবিরোধী না হলে গ্রন্থটির এই নাম দেন স্যর? তাঁর এই ‘ক্ষণকাল’-এর দৈর্ঘটি নব্বুই বছরের….না, তারও বেশি…এক প্রকৃত শিক্ষকের জীবন তো আর ঐভাবে ঠিক প্রয়াণদিবসে রুদ্ধ হয়ে যায় না, তাঁরা ক্রমশ বিলীন হয়ে যেতে থাকেন মহাকালের মধ্যে।
‘A true teacher never dies. He just withers away’---প্রেসিডেন্সির প্রবাদপ্রতিম অর্থশাস্ত্রী দীপক ব্যানার্জীর যে অবিচুয়ারি লিখেছিলেন আরেক কিংবদন্তী তাপস মজুমদার---সে লাইন কয়টিই এই প্রসঙ্গে স্মরণ করলাম।
হাওয়াগাড়ি -- তরুণ গোস্বামী; তবুও প্রয়াস প্রকাশনা, প্রথম প্রকাশঃ জুন ২০২৩; ISBN: 978-93-87743-58-8
তাহলে চলছে কী করে গাড়িটা?
‘ইন্টারনাল কমবাশন এঞ্জিন’ ব্যাপারটা বুঝতে জনগণের সময় লেগেছিল সেকালে। জার্মানদেশেই প্রথম মোটরগাড়ি এলেও আমেরিকা পেছিয়ে ছিল না। অচিরেই ভারতের রাজা-মহারাজারাও পশ্চিমা ‘হাওয়াগাড়ি’-র মস্ত কদরদান হয়ে উঠলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অটোমোবাইল যখন প্রথম এলো, সেই বিস্ময় পুবে-পশ্চিমে একই রকম ছিল---কালো ভারতীয়রা যে বেশি ভ্যাবলা ছিল তাহা নহে! ১৮৯০-র দশকে রঞ্জিসিংজী যখন কেম্ব্রিজের ছাত্র (ও তখনই তুখোড় ক্রিকেটার) কিনেছিলেন এক মোটরকার! তার ‘দুরন্ত’ [40 kmph] গতিতে ভয় পেয়ে সাহেব বন্ধুবান্ধবরা প্রার্থনা করত যেন সে ভালোয় ভালোয় বাসায় ফিরে আসে।
কিন্তু শুধু গুর্জরদেশী কেন? বঙ্গদেশও সে দৌড়ে পেছিয়ে ছিল না।
১৯০৮-এ প্রখ্যাত ফরাসী কার-ম্যাগাজিন ‘লা প্রাতিক অটোমোবিল’-এ’ বেরিয়েছিল বম্বেতে সুদীর্ঘ পথ মোটরকার চালিয়ে কোচবিহারের মহারাজার রেকর্ড করার খবর! তার পরের বছরই আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য প্রবল গতিতে মোটরগাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনায় চলে গেলেন পরলোকে!
কুছ্ পরোয়া নেই!
ভারতীয় ফুটবলের এক প্রবাদপুরুষ---‘সন্তোষ ট্রফি’ দান করবার অনেক আগেই মোটরগাড়ির নেশা পেয়ে বসেছিল মহারাজা স্যর মন্মথনাথ রায়চৌধুরীকে । একটি ফ্যান্টম ও দুইটি সিলভার গোস্ট রোলসরয়েসের মালিক ছিলেন তিনি….
না, এই সকল নেট-ঘাঁটা ইতিহাস শোনাননি বর্তমান লেখক তরুণ গোস্বামী, বরঞ্চ তাঁর বেশি টান পুরনোগাড়ির পিছনের গপ্প ও ছুট্কাহিনীতে (anecdote)---এবং যেগুলি পড়তে পাওয়া সবিশেষ মনোলোভা। বাংলাভাষায় এই বিষয়ের উপরে এই মানের বই আগে হয়নি, যদিও প্রবাসী বঙ্গসন্তান গৌতম সেন মশায়ের ইঙ্গভাষায় লিখিত গাড়ির বইগুলি বড়ই সুখপাঠ।
তরুণের গল্পে অনায়াসে উঠে এসেছে উত্তমকুমারের র্যাম্বলার কার বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্লাইমাউথ! রামপুর মহারাজের কাছ থেকে পাওয়া মিনার্ভা গাড়িটি চড়ে বেগম আখতার সাহিবা গাইতে যেতেন রাজপ্রাসাদের বাৎসরিক মেহ্ফিলে, যে গাড়ি অন্য সময়ে তাঁর সম্মানার্থে গ্যারেজে তুলে রাখা থাকত, আর কেউ চড়তে পেত না। এবং এমন এমন মানুষের কথা পড়তে পাওয়া গিয়েছে এই গ্রন্থে যাঁরা ঐ উত্তম-হেমন্তের মতো বিখ্যাত মানুষ নন, তাঁদের পরিচয়ই গাড়িপ্রেমী বা রেস্টোরার হিসেবে। যেমন সঞ্জয় ঘোষ, শশী কানোরিয়া বা প্রতাপ চৌধুরী। গাড়িই এঁদের প্রাণ; রাস্তার খন্দে তা হোঁচট খেলে যাঁদের কলিজায় গিয়ে লাগে আঘাতটা। এ’হেন গাড়িপ্রেমীদের প্রতি লেখক তরুণের আবেগ ও ভালোবাসা দেখবার মতো (বা, পড়বার)। শতাধিক বছরের পুরনো কোনো গাড়িকে মেরামত করে ফের পথে চালু করিয়ে দেবার কৃতিত্ব কোনো মানুষকে বাঁচিয়ে ফেরানোর চেয়ে কম কৃতিত্বের নয়। এঁরাই ‘কার-রেস্টোরার’!!
আর রস-রসিকতা?
বৃজমোহন বিড়লার প্রয়াণ হলে স্বয়ং ভগবান নারায়ণ নাকি এগিয়ে এসে তাঁকে স্বর্গধামের ভিতরে নিয়ে যান, কারণ এম্বাসাডর কার বানিয়ে তিনি তার লক্ষ লক্ষ মালিকদের মুখ দিয়ে এতোবার ঈশ্বরের নাম জপিয়ে নিয়েছিলেন যে তেনার টার্গেট পুরে গিয়েছিল!! যা হোক্, তাঁরা তো নিরাপদে গৃহে ফিরেছিলেন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় আবার বেকার বাঙালী যুবকদের এম্বাসাডর ট্যাক্সি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহে উদ্বুদ্ধ করতেন! মারুতি আসবার আগে পর্যন্ত বিড়লাদের এম্বি-র পরেই দক্ষিণী স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড বা বম্বের প্রিমিয়ার পদ্মিনী কারের বাজার ছিল। এ’গাড়ি কীভাবে ইনোভা-জাগুয়ারকেও টেক্কা দিত---শুনিয়েছেন তরুণ এক নিবন্ধে।
কী এক এক শিরোনাম নিবন্ধগুলির!
কয়েকটি শোনাইঃ
• ‘হ্যারি পটারের গাড়ি দাপিয়ে বেড়ায় কলকাতায়’
• ‘এই গাড়ি চড়েই দেশ ছেড়ে পালান সুভাষচন্দ্র’
• ‘বিধান রায় থেকে জ্যোতি বসুর পছন্দের ফিয়াট’
• ‘ঠেলাগাড়িতে চড়া অযান্ত্রিক …অস্টিন’
ইংরেজী স্টেটসম্যান কাগজের তরুণ সাংবাদিক যে বাংলায় এমন ‘মার-কাটারি’ শিরোনাম দিতে পারেন, কে জানতো?
***
বইটি প্রোডাকশনে, রঙীন ছবিতে ও নির্ভুল ছাপাতে দশে দশ পায়। এই মানের কোনো ইংরিজি বই ডেড়া দামে বিকতো। তরতরে পাঠ ও গল্পের ভাণ্ডারে ফুলমার্কস পাওয়া ছাড়াও নানান উপযোগী তথ্যের জন্যে অতি উচ্চ আর্কাইভাল ভ্যালু হয় বইটির। অনেক গাড়িপ্রেমীই নানান উপযোগী তথ্যের জন্যে এ’ বই কিনে রাখবেন হাতের কাছে।
আবারও বলি, বাংলাভাষায় এই বিষয়ের উপরে এই মানের বই আগে আর হয়নি।
যে কোন গাড়িপ্রেমিকের পার্সোনাল লাইব্রেরিতে অনায়াস স্থান করে নেবে এই বই।
বইটির বহুল প্রচার ও কদর হওয়া দরকার।
PHOOLSUNGHI -- Pandey Kapil [translated from Bhojpuri to English by Gautam Choubey]; Penguin Random House India Pvt Ltd, Gurgaon 122002, First published 2020; ISBN 978-0-670-09519-3
ভোজ-রাজ, বা রাজা ভোজ! একাদশ শতকের মধ্যভারতীয় এক নৃপতির নাম আজও জড়িয়ে আছে প্রবাদের মধ্যে, এতে তাঁর বিরাটত্ব প্রমাণিত হয়----কেন তিনি মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে তুলনীয়! মধ্যভারতে যেমন রয়েছে ভোজপুর শহর ও ভোজেশ্বর শিবমন্দির, তেমনই ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাসের নানান নিরিখে বিহার-ইউপি-নেপাল-ঝাড়খণ্ড জুড়ে সুবিস্তীর্ণ ‘ভোজপুর’ এলাকা ভারতবর্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বটে। এখানকারই ভাষা ‘ভোজপুরী’, যাকে হিন্দির উপভাষা বলে ভ্রম করা হয়। ভোজপুরীর লিপি কিন্তু দেবনাগরীর থেকে বেশ খানিকটা পৃথক; স্বাধীনতার পর পরই নিখাদ ভোজপুরীভাষায় রামনাথ পাণ্ড্যের মতো সাহিত্যিক উপন্যাস লিখেছেন। যদিও আজকের দিনে ‘বোড়ো’ ‘মেইতেই’ ‘ডোগরি’-র মতো স্বল্পচর্চিত ভাষাও ‘সরকারী ভাষা’-র স্বীকৃতি পেয়ে গেলেও ভোজপুরীভাষা পায়নি (গায়ের কাছের ‘মৈথিলী’ তো পেয়েছে)।
***
যা হোক্, এ’হেন ভাষা-বিতর্ক তোলা তো বর্তমান গ্র.স.-টির লক্ষ্য নয়।
যে অসাধারণ ভোজপুরী উপন্যাসটি সম্বন্ধে বলতে বসেছি তাতে আসি।
লেখক ‘পাণ্ড্যে কপিল’ (১৯৩০-২০১৭ খৃ.) মহাশয় কিন্তু ব্রাহ্মণ নয়, কায়স্থবংশজাত ছিলেন, গোত্রনাম ‘সহায়’। দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে ‘ভোজপুরী সম্মেলন পত্রিকা’-র সম্পাদনা করেছেন, আবার ভোজপুরীতে ‘শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’-র অনুবাদও করেছেন (যদিও একটা বামপন্থী ঝোঁক তাঁর ছিল বরাবরই), লিখেছেন বহু উপন্যাস ও ছোটগল্প। এবং গীত ও গজল! অর্থাৎ, পাণ্ড্যে কপিলজীর জীবন-ও-কর্মধারা অনুসরণ করলেই আধুনিক ভোজপুরী সাহিত্যকে জানা হয়ে যাবে।
স্বনামধন্য অমিতাভ ঘোষের বিশ্ববিখ্যাত ‘আইবিস্ ট্রিলজি’-র ত্রিশ বছর আগেই আফিহেন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত লোকজনদের জীবনকাহিনী নিয়ে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় এই ‘ফুলসুঙ্ঘী’ [১৯৭৭] উপন্যাস লিখেছিলেন কপিলজী, সম্প্রতি যার অনবদ্য এক ইঙ্গানুবাদ করেছেন তরুণ লেখক গৌতম চৌবে-জী; যদিও অমিতাভের মতো কপিলের উপন্যাসটি সমুদ্রযাত্রা করেনি, পূর্বভারতের সীমানামধ্যেই রয়েছে।
Woodpecker (কাঠঠোকরা) পক্ষী যেমন কাঠ ঠুকরে ঠুকরে বেড়ায়, flowerpecker (ফুলসুঙ্ঘী) তেমন ফুল! খাঁচায় ভরে রাখলে সে বাঁচে না, তাকে যতই ফুলমধু খাওয়াও।
এ’ উপন্যাসের নর্তকী-নায়িকা ঢেলাবাঈকেও তেমনি রূপোর খাঁচায় ভরে রাখতে চেয়েছিল মুগ্ধভক্ত ছাপরাবাসী আফিঙের থানাদার বৃদ্ধ বাবু হালিবন্ত সহায়, বাঈয়ের প্রেমিক-কবি মহেন্দ্র মিশ্রকে বঞ্চিত করে। সেই নিয়েই উপাখ্যান, যার জল গড়িয়েছ নগর কলকেতা পর্যন্ত, ঘটনার ঘনঘটায় এসেছে ব্যাঙ্কনোট ফ্রডের ঘটনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
চমৎকার গতিময় পাঠ।
উন্নাসিক বাঙালি পাঠকের কাছে ভোজপুরী তো দারোয়ানদের ভাষা। কপিলজীর এ’ উপন্যাস পড়িনি তো আমরা, পড়লে সঠিক বোধদয় হতো। কোথায় যেন মনে হয় ‘সাহেব-বিবি-গোলাম’ পড়ছি---মিনিয়েচারে! সমাজ-ইতিহাস-প্রেম-ক্রাইম মিলেমিশে গেছে সার্থক এই ঐতিহাসিক উপন্যাসে, যার দীর্ঘ সময়কালটা ১৮৩০ থেকে ১৯২০র আশেপাশে, এবং পটভূমিকা ভোজপুর [আরা-ছাপরা-বালিয়া ]।
এ’ উপন্যাসের প্রশস্তিতে নালেঝোলে হয়েছেন বসুধা ডালমিয়ার মতো হিস্টোরিয়ান!
ভৈরবী রাগিনীতে অনবদ্য এক দাদরা গেয়েছিলেন ভোজপুরেরই ভূমিপুত্র (না, কন্যা) কিংবদন্তী গায়িকা রসুলান বাঈ (১৯০২-৭৪): ‘বিসরইয়ো ন বালাম, মোরে…….’!
রাত্রিব্যাপী এ’বইয়ের পাঠশেষে প্রাতেঃ বেজে উঠল সে গান। মনমধ্যে। চোখের জল ধরে রাখা গেল না।
হে মোর প্রেমিক, আমাকে তুমি ভুলিও না।
রসুলান বাঈয়ের মতো ‘অশিক্ষিত’ তাবায়েফকে গুরু মেনেছিলেন প্রবাদপ্রতিম সিদ্ধেশ্বরী দেবী থেকে সাবা দেওয়ানের মতো স্টিফেনিয়ান ফিল্মমেকার!
এ’ বই বাংলায় অনূদিত হওয়া উচিত।
রবীন্দ্রগানের অন্তরালে-- ডাঃ পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার; সিগনেট প্রেস [একটি আনন্দ পাবলিশার্স সংস্থা ], প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০২৩; ISBN 978-9354-250126
বাঙালী হয়ে জন্মানোর এক প্রধান যে ‘পাওয়া’, সেই রবীন্দ্রনাথকে মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ-ও-আনন্দের প্রতিভূ এই কেতাব---সহজবহ ও টেক্-স্যাভি হওয়ার নিরিখে!
যদিও কলিকাতার সল্টলেকে প্রকাণ্ড এক চক্ষু-নিরাময়ালয় চালান তবু ডাঃ পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার বাঙালীর কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে আছেন সেই সন ২০০৬ থেকেই যখন উনি Gitabitan Archive নির্মাণ করেন [ডবল ডিভিড হয়ে বেরোয়]। চটজলদি রবীন্দ্রগান সম্বন্ধে শুনে-পড়ে নেওয়ার এ’হেন ভাণ্ডার তার আগে আমরা হাতে পাইনি। ২০২৩-তে উনি উল্লেখ্য এক স্বীকৃতি পেয়েছেন যখন ওঁর ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’ [প্র. প্র. ২০১৯] পেল আনন্দ পুরষ্কার! এই প্রথম একজন অ-লেখক এই পুরষ্কার পেলেন যদিও এক সংগ্রাহক হিসেবে ওঁর কাজের গুরুত্ব দশজন লেখকের সমতূল।
তাহলে আবার এই ২০২৩এ’ উনি বর্তমান এই গ্রন্থটির নির্মাণ কেন করলেন, আর তার গুরুত্বটাই বা কী?
এর প্রধান কারণ বর্তমান বইটির ‘তন্বিত্ব’ [পড়ুন, কৃশতা], আর দ্বিতীয়ত ‘টেক্-স্যাভিত্ব’ [মানে, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনা]! আনন্দ-পুরষ্কারজয়ী ‘তথ্যভাণ্ডার’-টিতে যেখানে ১৯১২+ ১৯১ (নাট্যসঙ্গীত) = ২১০৩ টি রবীন্দ্রগানের পূর্ণাঙ্গ ভাণ্ডার সাজানো রয়েছে সেখানে বর্তমানটিতে সুনির্বাচিত দুইশতটি গানের পরিচয় দেওয়া রয়েছে গল্পাকারে, রয়েছে কুলুজী (অস্যার্থে, রচনার স্থানকাল, সুর-তাল প্রভৃতি), এবং অ-সাধারণ, হ্যাঁ, সত্যিই অসাধারণ এক সুবিধা---QR code ভাঙিয়ে তক্ষুণি গানটি শুনে নেওয়া। প্রযুক্তিগতভাবে এই উন্নতি রবীন্দ্রগানের সঙ্গে এই যে যুক্ত হলো এখানে তার তুলনা মেলা ভার! স্মার্টিফোন যেহেতু আজকের দিনে মুড়িমিছিরি হয়ে গিয়েছে তাই ট্রেনেবাসে পথ চলতে এই তন্বী কেতাব হাতে নিয়ে কোড-টি ভাঙিয়ে গানগুলি শুনে নেওয়া অপার এক প্রাপ্তি, এবং আনন্দের উৎস। হ্যাঁ, স্পটিফাই বা ইউটিউবে অবশ্যই কোনো গান শুনে নিতে পারেন, কিন্তু সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি? তার জন্যে তো এই প্রিয়গ্রন্থটির নিকট আসতেই হবে। এই বইয়ে দু’শতটি গানের চয়ন খুবই অ-নৈর্ব্যক্তিক। সেটা মেনে নিতেই হবে। কারণ আমার প্রিয় দু’শোটা গান কখনই তো আপনার প্রিয়গুলির সাথে মিলবে না।
কী বললেন? এই সংকলনের গায়ক-গায়িকাগণ ‘তেমন’ নামী নন কেউই?
আমি তো বলব সেটা এই গ্রন্থের এক মস্ত প্রাপ্তির দিক। না, দেবব্রত-হেমন্ত-ঋতু-রাজেশ্বরী এখানে নেই বটে [যাঁরা ওঁর ২০০৬ এর সংকলনটিতে ছিলেন] ‘অনামী’ যাঁরা আছেন তাঁরা অনেক নামীদের টেক্কা দিয়েছেন। কারোর নামোল্লেখ এখানে করছি না, তাতে অন্যের অমর্যাদা হবে। এখান ওখান থেকে খুলে গোটা পঞ্চাশেক গান ও আবৃত্তি শুনতে শুনতে মন ভরে উঠতে লাগল যার রেশ এখনও কাটেনি। দু’হাত তুলে সাধুবাদ জানাই, না পদস্পর্শ করি, কারণ ডাক্তারবাবু বয়ঃজ্যেষ্ঠ মানুষ যে।
শেষ পারানির কড়ি তো এইভাবেই জমিয়ে নিলেন গো!
‘নূতন’ তথ্য এ’বইয়ে কিছুই পেলাম না, হয়ত বা তার দরকারও ছিল না। তবু, কোনো কোনো গান নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি যদি দূর করে দিতেন, কিছু নব-সংযোজনা ঘটতো বইটিতে ।
চট্ করে মনে পড়ছে ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে…’ [পৃ. ২৪৬] গানটির জন্মকথা [১৯১৪ খৃ. ]। বহু বছর পরে (১৯৩২ খৃ.) মীরাদেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে পুত্র শমীন্দ্রনাথের প্রয়াণের সঙ্গে জুড়ে এই গানটির সম্বন্ধে যে বিভ্রান্তি জড়িয়ে আছে সেটা দূর করে দেওয়া যেতে পারত। যদিও ‘অন্তর মম বিকশিত কর’ গানের প্রসঙ্গে এর উল্লেখ কিছুটা রয়েছে [পৃ. ১৯৫]।
কিংবা ধরা যাক্ বিপিন পালের ফরমায়েসে বাঁধা ব্রাহ্ম-রবীন্দ্রনাথের ‘অয়ি ভুবনমনোমোহিনী’ গানটি যেটি নাকি ততটা মূর্তিপূজাশ্রয়ী হয়নি বলে কংগ্রেসী অধিবেশনে অ-মনঃপূত হয়েছিল [পৃ ১৩২]। যদিও সেই কংগ্রেস অধিবেশনেই [কলিকাতা, ১৮৯৬] যুবক রবীন্দ্রনাথ নিজসুরে বঙ্কিমের ‘বন্দেমাতরম্’ গেয়েছিলেন যেটা নিয়ে ভবিষ্যতে কী গেরো! আজও মুলায়েমের মুসলিম এম পি এ’ গান বাজলে পার্লামেন্ট থেকে বেরিয়ে যান!
এক্কেবারে বিতর্কহীন তথ্যের পুনঃপাঠ হলে নব্য পাঠক আর কী টানে আসবেন নূতন এক কেতাবের কাছে, বলুন তো?
***
বইয়ের ভূমিকাটি সুখপাঠ্য ও তথ্যবহ। শেষের ব্যক্তি পরিচিতি ও সহায়ক গ্রন্থ খুবই কাজের। এ’হেন বই রোজ রোজ লেখা হয়না, লেখা যায়না। বহু বহুদিনের পরিশ্রমের ফলশ্রুতি এমন এক গ্রন্থ যার স্থান মস্তকোপরি।
কোনো হক্ নেই , তবুও দশে বারো দিতে ইচ্ছে করে এমন এক কাজকে।