।। ১ ।।
ঠিক যেরকম কোনো বিস্ময়বিমূঢ় প্রাক-সভ্য মানুষ সমুদ্র থেকে ভেসে আসা অজানা বস্তুকে হাতে তুলে নিয়েছিল; অথবা সমুদ্রতীরের বালি খুঁড়ে বের করেছিল তাকে; অথবা আকাশ থেকে পড়েছিল সেই অজ্ঞাত সামগ্রী? তার আকারে দুর্বোধ্য বক্রতা, প্রথম চোখে পড়ায় অনুজ্জ্বল, তারপর বিকীর্ণ আলোকে ঝলমলে। মানুষটি সেই বস্তুটিকে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উল্টে-পাল্টে দ্যাখে, আবিষ্কার করতে চায় জিনিশটি তার কোন কাজে লাগবে, তার জ্ঞানবুদ্ধির অন্তর্গত কোনো দৈনন্দিন কাজে বস্তুটিকে ব্যবহার করা যাবে কিনা, কখনও একথা স্বপ্নেও না ভেবে যে তার কোন উচ্চতর উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
আমরাও ঠিক একই রকম, হাতে নিয়েছি শিল্পকলাকে; দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ভাবি যে আমরা তার প্রভু, নির্ভয়ে তার দিকনির্দেশ করি, তাকে নতুন করে সাজাই, নানান সংস্কার করি তার, ভালো দামে বিক্রি করে দিই তাকে, উপহার হিসেবে পাঠাই তাকে উপর অলাদের কাছে; এক মুহূর্তে তাকে ব্যবহার করি উপভোগের জন্যে- জনপ্রিয় সঙ্গীতে অথবা নাইট ক্লাবে, আবার অন্য মুহূর্তে অস্ত্র তুলে নিই হাতের কাছে যা পাই- বোতলের ছিপি অথবা খেঁটে লাঠি- রাজনৈতিক কারণে অথবা সংকীর্ণমনা সামাজিক প্রয়োজনে। সত্যি কথা বলতে কী, শিল্পকে কলুষিত করা আমাদের সাধ্যে নেই, তার স্থির লক্ষ্য থেকে তাকে নড়ানোও আমাদের পক্ষে মুশকিল, তবে প্রত্যকে বারই এবং আমাদের প্রচেষ্টার ফলে সে তার গোপন, অন্তর্গত আলোকের খানিকটা অংশ উপহার দেয় আমাদের।
কিন্তু কবে আমাদের পুরোপুরি বোধগম্য হবে সেই পুণ্য আলোক? কোন মানুষ সাহস করে বলতে পারেন তিনি শিল্পের প্রকৃত সংজ্ঞা দিতে এবং তার প্রতিটি পলের সম্যক বর্ণনা করতে সক্ষম? হয়ত বহুকাল পূর্বে কোন মনীষী শিল্পকে হৃদয়ঙ্গম করে আমাদের জানিয়েছিলেন তাঁর অপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা, কিন্তু আমরা বেশিদিন তাতে সন্তুষ্ট থাকি নি; আমরা তাঁর কথা শুনেছি এবং অগ্রাহ্য করেছি, সঙ্গে সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি তাড়াহুড়ো করে- যেমন নতুন কিছু সামগ্রী দেখলে আমরা পুরানো অথচ সেরা সামগ্রীর সঙ্গে তাকে বদল করে নিই। পরে তার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে আমাদের মনেও পড়ে না সেই অলোকসামান্য বস্তুটি আমাদের মালিকানায় ছিল।
একজন শিল্পী নিজেকে বিচার করেন এক স্বাধীন, পবিত্র, আধ্যাত্মিক জগতের স্রষ্টা হিসেবে। সেই জগতকে গড়ে তুলে, সেখানে বস্তি স্থাপন করে, তার দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে দ্বিধা করেন না তিনি; কিন্তু জগতের ভারেই তিনি আবার চাপা পড়ে যান, কারণ রক্ত মাংসের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় সেই অমানুষিক বোঝা বহন। ঠিক যেরকম মানুষ নিজেকে সকল অস্তিত্বের কেন্দ্রস্থল বলে ঘোষণা করলেও এখনও অব্দি গড়ে তুলে উঠতে পারেনি কোনো ভারসাম্যময়, লোকোত্তর প্রক্রিয়া। এবং যে কোন রকম দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হলেই তার দোষারোপের ভাগী হয় দুনিয়ার যত প্রাচীন অসঙ্গতি, আধুনিক বিদীর্ণ আত্মার সমূহ জটিলতা অথবা পাবলিকের নির্বুদ্ধিতা।
আরেকজন শিল্পী, উচ্চতম শক্তির কথা চিন্তা করে, আজীবন ঈশ্বরের স্বর্গের নীচে দাঁড়িয়ে বিনীত শিক্ষানবিশের মত কাজ করে গেলেন সানন্দে; কিন্তু তার ফলে যা কিছু লিখিত অথবা অংকিত হ’ল, সেই সব শিল্পকর্ম যাঁরা আত্মস্থ করবেন তাঁদের জোরালো দাবি থেকে যাবে স্রষ্টার কাছে। কিন্তু তার পরিবর্তে কোন সন্দেহই থাকবে না শিল্পকর্মটির মূল সূত্র কোথায়- যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সেখানে নয়, যিনি তাকে পরিচালনা করেন সেখানেও না। এবং শিল্পীকেও বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকতে হবে পৃথিবীর সুসামঞ্জস্য এবং তাতে মানব সমাজের অবদানের সৌন্দর্য এবং কর্দম - উভয় বিষয়েই এবং তার নিখুঁত বর্ণনা করতে হবে তাঁর সহোদরদের সামনে। এই দায়িত্ব তাঁর চিরকালের- দুর্ভাগ্যের সময়, এমনকী অস্তিত্বের চরম গভীর অতলেও- বিপর্যয়ে, কারাগারে, অসুস্থতায়- এই দৃঢ়, অবিচল সুসঙ্গত মনোভাব যেন কখনও তাঁকে ত্যাগ না করে।
শিল্পের যতরকম অপ্রকৃতিস্থতা, চোখ-ঝলসানো পরিবর্তন, অনিশ্চয়তার আবিষ্কার এবং মানবজীবন চুরমার করে দেওয়া প্রভাব সত্ত্বেও তার মধ্যে রয়ে গেছে অফুরন্ত যাদু- যাকে শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি, তাঁর শৈল্পিক চিন্তাভাবনা অথবা তাঁর অনুপযুক্ত আঙুলের কর্মবিস্তারে ফুরিয়ে ফেলা চাই।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এমন আদি মানবসমাজের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন যখন শিল্প বলে কোন কিছু ছিল না। সেই মানব সভ্যতার প্রথম প্রহরের ঝুঁঝকিবেলায় আমরা সর্বশক্তিমানের হাত থেকে শিল্পকে পেয়েছিলাম, কিন্তু অনুধাবন করতে সমর্থ হই নি তার মর্ম। এবং প্রশ্ন তুলতেও দেরি করে ফেলেছি- কোন উপলক্ষ্যে এই উপহার দিয়েছ আমাদের? কী করব আমরা সেই সামগ্রী নিয়ে?
যাঁরা ভবিষ্যৎবাণী করেন- শিল্প একদিন না একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার কোন মূল্য থাকবে না আর, তাঁদের ধারণা এখনও ভুল এবং ভবিষ্যতেও ভুল প্রতিপন্ন হবে- শিল্প চিরস্থায়ী। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, যখন আমরা নিজেরা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়াব, তখনও কী সম্যকভাবে উপলব্ধি করব শিল্পের গুণাবলীকে অথবা তার সব সম্ভাবনাকে?
সব কিছুর নাম দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক বিষয়ই আমাদের নিয়ে যায় ভাষার সীমানার বাইরে। শিল্পের প্রভাবে, এক বরফজমা, অন্ধকারাচ্ছন্ন সত্তাও উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করে। শিল্পের মাধ্যমে আমাদের জীবনে আসে, যদিও নিষ্প্রভ এবং ক্ষণিকের জন্যে, পরমের অব্যক্ত উন্মোচন, যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার দ্বারা যা অসম্ভব।
রূপকথার সেই রঙিন কাচ চোখে লাগিয়ে- তাকিয়ে দেখি এবং দেখতে পাই- না, নিজেকে নয়, ধরা ছোঁয়ার বাইরে সেই তাকে, যেখানে কোন মানুষ যেতে পারে না, কোন মানুষ ওড়ে না। কেবল আত্মাই কাতর আর্তনাদ করে ওঠে …
।। ২।।
একদিন দস্তইয়েভস্কি বেমক্কা মন্তব্য করলেন, “সুন্দরই ধ্বংস থেকে রক্ষা করবে পৃথিবীকে”। এ কেমন এক ছিরিছাঁদহীন কথা? অনেকদিন ধরেই আমি ভেবেছি এই কথাগুলি নিয়ে। কী করে এটা সম্ভব? পৃথিবীর এই রক্তলোলুপ ইতিহাসে সুন্দর কখন কাকে কোন বিপদ থেকে রক্ষা করেছে? হ্যাঁ, মহত্বমণ্ডিত করা সম্ভব, নৈতিক উন্নতিসাধনও- কিন্তু ধ্বংসের থেকে রক্ষা?
সুন্দরের অস্তিত্বেই এক বিশেষ বৈচিত্র্য রয়েছে, সে বৈচিত্র্য সুন্দরের অবস্থানে; অর্থাৎ প্রকৃত শিল্পসৃষ্টির প্রভাব এতটাই প্রত্যয়সাধ্য যে তাকে খণ্ডন করা অসম্ভব, এমনকী সম্পূর্ণ বিপরীত শক্তিরও তার কাছে আত্মসমর্পণ অবশ্যম্ভাবী। যা একাধারে ভুল এবং মিথ্যে, তার উপরে ভিত্তি করে রমণীয় ও মোলায়েম একটি রাজনৈতিক বক্তৃতা, মাথাগরম-করা প্রবন্ধ, সমাজ সংস্কারক কার্যকলাপ অথবা দার্শনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। যা কিছু গুপ্ত, যা কিছু বিকৃত, তা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পায় না।
এর পরে তার সম্পূর্ণ বিরোধী এক বক্তৃতা, প্রবন্ধ, কার্যকলাপ বা বিপরীত দার্শনিক ব্যবস্থায় শত্রুপক্ষকে সংঘবদ্ধ করা সম্ভব- এটাও রমণীয় এবং মোলায়েম এবং তাকেও কার্যকরী করে তোলা যায়। সেই জন্যে এমন সব বস্তুকে বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস করলে ক্ষতি নেই।
কিন্তু হৃদয়কে যা স্পর্শ করে না, হাজার পুনরাবৃত্তিতেও তা ব্যর্থ হবেই।
মহান শিল্পকর্মের মধ্যেই নিহিত রয়েছে তার প্রমাণ- যে কোনো তত্ত্ব ফাঁদলে বা তাকে টেনে টেনে বাড়ালেও ভুল থেকে যাবে তার প্রতিমায়, তাকে দেখাবে অসুস্থ এবং ম্লান- কারুর মনে ভক্তিরও উদ্রেক করবে না। কিন্তু প্রকৃত শিল্পকর্ম সত্যকে হাতে তুলে নেয় মুঠো মুঠো করে এবং চোখের সামনে তাকে উপস্থিত করে জীবন্ত, আমাদের শক্ত পাকে জড়ায় এবং সম্ভ্রমের উদ্রেক করে- কোনদিন, এমনকী দূর ভবিষ্যতেও কারুর পক্ষে সম্ভব হবে না তাকে উপেক্ষা করা।
অর্থাৎ সত্য, সুন্দর ও মহতের যে অতিপ্রাচীন ত্রিবেণীসঙ্গম, তা কেবল একটা শূন্য, ম্লান, ফরমুলা নয়- যেমন আমরা ভেবেছিলাম যৌবনের জড়বাদী আত্মবিশ্বাসে?
এই তিন বৃক্ষের চূড়া যদি আকাশে মিলিত হয়, যেমন পণ্ডিতেরা বর্ণনা করেছেন, তারপর যদি সত্য ও মহতের কর্কশ ও প্রত্যক্ষ কাণ্ডদুটিকে যদি কেটে ফেলা বা ধ্বংস করা হয়, কিন্তু তাহ’লেও বোধহয় সুন্দরের উদ্ভট, অনির্দেশ্য, অপ্রত্যাশিত ডালপালাগুলি আপন মনে বেড়ে চলবে এবং একা একাই শূন্যের অমোঘ উচ্চতায় উঠবে এবং তিনটি বৃক্ষের প্রত্যাশাকেই পূর্ণ করবে।
এক্ষেত্রে দস্তয়েভস্কির মন্তব্য, “সুন্দরই ধ্বংস থেকে রক্ষা করবে পৃথিবীকে” কোন অসতর্ক বাগবিস্তার নয়; তাহ’লে কি সেটা ভবিষ্যদ্বাণী? কেন না তিনি তো দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন অদেখাকে- স্বপ্নসম্ভব উদ্ভাসনের অধিকারী তিনি।
তাহ’লে শিল্প ও সাহিত্যের পক্ষে কি জগতকে সাহা্য্য করা সম্ভব?
অনেক বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার পরে আমি যা সামান্য অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেছি- আজকে সুধীজনের সামনে সেই কথাই বলার চেষ্টা করব।
।। ৩ ।।
যে মঞ্চে উঠে নোবেল বক্তৃতা পাঠ করা হবে তা পৃথিবীর সমস্ত লেখকদের থেকে বিশাল দূরত্বে এবং জীবনের বিরলতম ঘটনা; এই মঞ্চে ওঠার জন্যে আমি এখানকার কাজ-চালানোর মত তিন-চারটে ধাপ নয়, কয়েক শো, এমন কী কয়েক হাজার ধাপ পার হয়েছি; দুর্গম, পিচ্ছিল, বরফ-জমা ধাপ সে সব- অন্ধকারে এবং প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়- যেখানে আমার ভবিতব্য ছিল বেঁচে থাকা- যেখানে অন্যেরা, হয়ত: আমার চেয়েও প্রতিভাধর এবং শারীরিকভাবে শক্তিশালী- মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই আমার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে গুলাগ দ্বীপপুঞ্জে ভাঙাচোরা, ভগ্নাংশের মতন অসংখ্য দ্বীপ-ছায়াময় এবং অবিশ্বাসের মাইল ফলকে ভরা সেই স্থান; অনেকের সঙ্গে আমি নিজে কথা বলিনি, অনেকের কথা অন্যের মুখে শুনেছি, আবার অন্য অনেকের কথা কেবল কল্পনা করেছি। সেই অতল গহ্বরের পতনের আগেই যারা নাম করেছিলেন সাহিত্য জগতে- তাঁদের কথা অন্তত: লকে জানে; কিন্তু আরো অনেকে হারিয়ে গেছেন নামহীন, যাদের নাম কোনদিন জনসমক্ষে উচ্চারিত হয়নি। এবং প্রায় কেউই সেখান থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হয়নি। একটা পুরো জাতির সাহিত্য বিলীন হয়েছে সেখানে- কোনো সমাধি ছাড়াই তাকে পাঠানো হয়েছে বিস্মৃতির অন্তরালে; অনেক সময়েই তাঁরা নগ্ন, পরনের ট্যানাটুকুও নেই- কেবল পায়ের আঙুলে শক্ত করে বাঁধা তাঁদের ক্রমিক সংখ্যা। রুশ সাহিত্য এক মুহূর্তের জন্যেও থেমে থাকে নি, যদিও বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে বন্ধ্যা, নিষ্ফলা জমি। যেখানে গড়ে উঠতে পারতো এক শান্তিময় অরণ্য, সেখানে সব গাছপালা নির্বিবাদে কেটে ফেলার পর বেঁচে রয়েছে দু-তিনটি, যারা রক্ষা পেয়েছে অলৌকিকভাবে।
আজ যে আমি এখানে দাঁড়িয়ে সেই সব শহীদদের ছায়ায়, যাঁদের এখানে আসার উপযুক্ত প্রতিভা ছিল আমার আগে তাঁদের সামনে মাথা নত করে; কোন অলৌকিক প্রেরণাতে আমি তাঁদের না বলা কথাগুলো সবাইকে বলতে সমর্থ হব?
এই দায়িত্ব আমাদের কাঁধে রয়েছে বহুকাল থেকে এবং আমরা তার মর্ম বুঝি। ভ্লাদিমির সলোভিয়েভ এর ভাষায়:
“পায়ে শিকল পরা থাকলেও
ঈশ্বর আমাদের জন্যে যে বৃত্ত আঁকতে লেগেছেন
আমাদের দায়িত্ব তাকে সম্পূর্ণ করা”।
প্রায়শই শ্রমশিবিরের যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতে, বন্দীদের দু:খময় মিছিলে, যখন তুষারের নিরানন্দ আবছায়া ভেদ করে লন্ঠনের সারি- তখন ক্লান্ত সন্ধ্যায় আমাদের মনের গোপন কথাগুলো উথলে ওঠে বুকের কন্দরে- যদি পুরো পৃথিবীতে একটি মানুষও শুনতে সমর্থ হয় আমাদের সমবেত কন্ঠস্বর, চেঁচিয়ে উঠে বলতে ইচ্ছে করে আমাদের কাহিনী। তারপরেই সবকিছু জলের মত পরিষ্কার। আমাদের সেই সফল প্রতিনিধি সকলের দূত হয়ে জগতকে কী কথা শোনাবে এবং তার কী প্রতিক্রিয়া হবে বাইরের পৃথিবীতে। আমাদের দিগন্তে দেখি বস্তু জগত এবং আধ্যাত্মিক আন্দোলনকে একসঙ্গে মিশে যেতে; আমাদের না-দেখা জগতের ভার সাম্যহীনতাও তার চোখে পড়ে না। এই সমস্ত চিন্তাভাবনা বই পড়ে আসে নি এবং যুক্তিসঙ্গতি মেনে চলার জন্যে তাদের জোর করে টেনে আনাও হয় নি। তাদের সৃষ্টি মানবের কথোপকথনে-যে সব মানুষ আজ সবাই মৃত; তাদের সৃষ্টি জেল-খানায় অথবা জঙ্গলের দাউ দাউ আগুনে- সেই জীবন সংগ্রামে তাদের অগ্নিপরীক্ষা, সেই অস্তিত্ব থেকে তাদের বেড়ে ওঠা।
আমাদের কাঁধের উপরে বাইরের পরিবেশের দুর্বহ চাপ একটুখানি কমলে আমার এবং আমাদের দিগন্ত খানিকটাও প্রসারিত হ’লে- আমরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে হলেও দূরের পৃথিবীকে দেখতে শুরু করি। এবং অপার বিস্ময়ে লক্ষ করি যে বাইরের পৃথিবীকে যেমন প্রত্যাশা করেছিলাম, তেমনটি একেবারেই নয়; তাদের জীবনযাত্রা এবং তাদের দিগদর্শন সম্বন্ধে যা বলা হয়েছিল সব মিথ্যে; এই পৃথিবী কর্দমাক্ত জলাজমি দেখে বলে ওঠে না, “কী সুন্দর দিঘি! অথবা গলার কংক্রিটের বেড়ি দেখে, “কী চমৎকার নেকলেস ওটা”! তার বদলে সেই বিশ্বে তারা শোকে ডুকরে কাঁদে অথচ হালকা আনন্দের কোন বাজনা শুনলেই নাচতে শুরু করে তার সঙ্গে।
কী করে এটা সম্ভব হ’ল? কেন এই আকুল ব্যবধান? আমরা কী বুঝতে ভুল করেছি পৃথিবীকে? না কী পৃথিবী আমাদের প্রতি নিস্পৃহ? অথবা ভাষার তফাৎ এর জন্যে দায়ী? কেন মানুষ একে অন্যের উচ্চারিত বাক্যসমূহ শুনতে পায় না? শব্দেরা কেন জলস্রোতের মতন বইতে পারে না- স্বাদহীন, গন্ধহীন, বর্ণহীন। এবং কোন পদচিহ্ন অথবা নিদর্শন ছাড়াই।
এই সব বুঝতে আমার সময় লেগেছে এবং আমার সম্ভাব্য ভাষণের গঠন, বিষয় বস্তু এবং স্বরের তীক্ষ্ণতা বদলেছে ক্রমাগত। এই সেই ভাষণ সঙ্গে নিয়েই আমি আজ উপস্থিত আপনাদের সামনে।
কনকনে ঠান্ডায় বন্দীশিবিরে বসে যে ফন্দী এঁটেছিলাম, তাঁর থেকে এটা অনেক অংশেই আলাদা।
।। ৪।।
সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এমনভাবে গড়ে উঠেছে মানবজীবন, যে পৃথিবীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী, যদি না থাকে সম্মোহন করে ভুল বোঝানো হয়ে থাকে, তার অনুপ্রেরণা এবং মূল্যবোধের মানদণ্ড, তার কর্মকুশলতা এবং উদ্দেশ্য- সবই তার নিজস্ব এবং যৌথ জীবন অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি। প্রাচীন রুশ প্রবাদ বলে, “দাদার কথা বিশ্বাস কোর না, সব কিছু নিজের বাঁকা চোখে দ্যাখো”। এবং চারপাশের পৃথিবীকে এবং মানব সমাজের চালচলন সম্যক বোঝার জন্যে নিজের অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভর করা জরুরি। এবং দীর্ঘকাল ধরে আমাদের পৃথিবী যখন আবৃত ছহিল রহস্যে এবং অরণ্যে, যখন কোনো রকম যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, যখনও পৃথিবীটা পরিণত হয় নি এক আলোড়িত প্রাণ-চঞ্চল দলাপাকানো পিন্ডে- মানুষ, নিজস্ব অভিজ্ঞতায় ভিত্তি করে দুর্ঘটনাহীনভাবে শাসন করেছে তাদের সীমাবদ্ধ এলাকা, তাদের সমাজ, তাদের জনসমষ্টি এবং শেষ পর্যন্ত তাদের জাতীয় এলাকা। তখন একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল একটা মূল্যবোধের মানদণ্ডকে উপলব্ধি করা এবং এবং আপন করে নেওয়া; কোনটা স্বাভাবিক এবং কোনটা অবিশ্বাস্য, তার তফাৎ করতে শেখা; কোনটা নৃশংস, নির্মম আর কোনটা অশোভনতার সীমানা লঙ্ঘন করে; কোনটা সততার পরিচয় আর কোনটা প্রবঞ্চনা। যদিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মধ্যে আলাশ পাতাল ফারাক, তাদের সামাজিক মূল্যবোধও নাটকীয়ভাবে পৃথক, তাদের ওজন ও দূরত্বের মাপকাঠির মধ্যেও তুমুল গরমিল- কিন্তু এইসব পার্থক্য চোখে পড়েছে কেবল বিরল পরিব্রাজকের, তাঁদের রোজনামচায় বিস্মিত বিভ্রমে তা লেখা রয়েছে; কিন্তু মানবসমাজে কোন বিপদ এসে উপস্থিত হয়নি সেইসব অমিলের সূত্রে। এবং মানব সমাজ বলতে সত্যি সত্যি কিছু ছিলও না তখন।
কিন্তু গত কয়েক দশকে, প্রায় হঠাৎই এবং অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে, সৃষ্টি হতে চলেছে এক অখণ্ড মানব সমাজের- আশাব্যঞ্জক এবং সেই সঙ্গে বিপদসংকুল ঘটনা- ফলে কোনো এক অংশের আলোড়ন অথবা প্রজ্জ্বলন প্রায় মুহূর্তের ছড়িয়ে পড়ে অন্য অংশে এবং বেশির ভাগ সময়েই তাকে প্রতিরোধ করার কোন ব্যবস্থা থাকে না। মানব সমাজ এক হয়েছে সত্যিই- কিন্তু না কোন প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর মতন এবং না কোন দেশ বা জাতির মতন- বহু বছরের ভাগ করে নেওয়া কোন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নয়, এক দৃষ্টি দিয়ে জগতকে দেখার সূত্রে- যদিও সেটা বক্র দৃষ্টি হতে পারে- নয়, কোন সর্বজনীন ভাষার সাহায্যে নয়; কিন্তু সব রকমের বাধার প্রাচূর ভেঙে এবং আন্তর্জাতিক বেতার সম্প্রচার এবং ছাপাখানার বই এর মাধ্যমে। ঘটনার বাঁধভাঙা স্রোত আমাদের সামনে এসে উপস্থিত- এক দেড় মিনিটের মধ্যেই সারা পৃথিবীর কানে পৌঁছে যাবে তার ঢেউ এর শব্দ। কিন্তু কোন মাপকাঠিতে মূল্যায়ন হবে এই সমস্ত ঘটনার- হবে সেই অঞ্চলের আইন কানুন ও মূল্যবোধের মানদণ্ডে; এবং তাকে শব্দ তরঙ্গ বা সংবাদপত্রের প্রবন্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দেওয়া অসম্ভব এবং অনুচিত। কেন না এই সব মাপকাঠি সেই দেশের এবং সমাজের বিশেষ আবহে বহু শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে- এক পলকে তার পরিবর্তন সম্ভব নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মানুষ তাদের বহুকষ্টে এবং সযত্নে গড়ে তোলা দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে ঘটনা সমূহের বিচার করে- তাদের সেই বিচার একগুঁয়ে এবং অনমনীয়- সেই বিচারের ভিত্তি তাদের নিজস্ব মানদণ্ড এবং কখনই অন্য কিছু নয়।
এবং এইরকম মানদন্ডের সংখ্যা যে প্রচুর, তা নয়- হয়ত হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি; একটি নিজের মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্যটি বহুদূরের ঘটনাবলীর জন্যে; একটি প্রবীণ সমাজের জন্যে, অন্যটি তরুণতর সমাজের জন্যে; একটি সফল মানুষের জন্যে, অন্যটি ব্যর্থ মানুষের জন্যে। মূল্যবোধের এই তীব্র মতান্তর চীৎকার করে জানান দেয় নিজেকে; তা একই সঙ্গে আমাদের বিস্মিত ও আচ্ছন্ন করে এবং আঘাত না পেতে ব্যাকুল আমরা, যেন অপ্রকৃতিস্থতা থেকে অথবা চিত্তবিভ্রম থেকে সিদ্ধান্ত নিই অন্য মূল্যবোধের মুখোমুখি না হওয়ার এবং তার ফলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সারা পৃথিবীর বিচার করতে বসে যাই নিজের মূল্যবোধের তুলাদন্ডে। সেই একই কারণে আমরা ঘরের কাছে ঘটা বিপর্যয়কে যতটা গভীর, যতটা যন্ত্রণাদায়ক, যতটা অসহ্য বলে বিবেচনা করি, অনেক দূরত্বের কোন বিপর্যয় তার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে গভীর, যন্ত্রণাদায়ক এবং অসহ্য হলেও তাকে অগ্রাহ্য করতে দ্বিধা থাকে না। যা কিছু রয়েছে অনেক দূরত্বে, যা আমাদের চৌকাঠে এসে হানা দেয় না তার কাতরানি, তার অব্যক্ত ক্রন্দন, তার নষ্ট হওয়া জীবনগুলিকে নিয়ে- যদিও তার শিকার হয়ে যায় নিযুত বা কোটি মানুষ- আমরা তাকে সহ্য করে নিই এবং খানিকটা ক্ষমার চোখেও দেখি।
পৃথিবীর এক অংশে- খুব বেশিদিন আগে নয়, রোম সাম্রাজ্যের আমলে খ্রীষ্টধর্মীদের উপরে যেমন অত্যাচার চলত, তার থেকে কোন অংশে কম নয়- ঠিক একই রকম অনাচার হাজার হাজার খ্রীষ্টধর্মী নীরবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের জন্যে। অন্য গোলার্ধে এক বদ্ধ পাগল নেতা (এবং সন্দেহ নেই যে তিনি কোনভাবেই একা নন) সমুদ্র পার হয়ে ধেয়ে এলেন ধর্মের হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করবার জন্যে- এক ঝটকায় ধর্মগুরুর বুকে বিঁধিয়ে দিলেন তাঁর ইস্পাতের তরবারি! এ কথা খুবই সত্যি যে তিনি নিজের মূল্যবোধের মাপকাঠিতেই বিচার করেছিলেন প্রতিটি সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎকে। দূর দেশ থেকে দেখলে যে অঞ্চলকে মনে হয় সতেজ এবং ঈর্ষণীয় স্বাধীনতার রাজ্য- কাছে গিয়ে অন্য মাপকাঠি দিয়ে বিচার করলে সেই অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের উপরেই রাগে অগ্নিশর্মা হবার সম্ভাবনা। যে পরিমাণ রুজি রোজগারে পৃথিবীর এক অংশ স্বচ্ছন্দে সংসার চালানো যায়, অন্য কোথাও সেই রোজগারকেই মনে তুমুল শোষণ এবং ধর্মঘট ছাড়া উপায় থাকবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রেও এই একই মাপকাঠি কাজ করে; নিজের পাড়ায় এক পথ দুর্ঘটনাকে দূরের দেশের তুমুল বন্যায় দু লক্ষ মানুষের মৃত্যুর চেয়ে বেশি দু:সহ বলে বোধ হয়। ব্যক্তিগত মান-অপমানের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন মাপকাঠি বর্তমান- কারুর কারুর বঙ্গোত্মক হাসি বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীই তুমুল উপমানদায়ক; অন্য কারুর ক্ষেত্রে বেধড়ক মারধোরকেও দুর্ভাগ্যজনক রসিকতা বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে। শঠতা এবং শাস্তির ক্ষেত্রেও এই একই মাপকাথির প্রয়োগ; কোন দেশে একজন মানুষকে এক মাসের জন্য গ্রেফতার, মফস্বলে নির্বাসন অথবা ভালো খাবার দাবার সমেত নির্জন, বিচ্ছিন্ন সেলে অন্তরীণ করলেও জনসাধারণ ভাবেন কী অকথ্য অত্যাচার ক্রুদ্ধ সমালোচনা চলে সংবাদপত্রে। আবার অন্য কোন দেশে কথায় কথায় পঁচিশ বছরের নির্মম কারাবাস- সংযোগ বিচ্ছিন জেলখানায় যেখানে বরফজমা দেওয়াল এবং বন্দীর পরণে কেবল ছিন্ন অন্তর্বাস, সুস্থ মানুষকে জোর করে বন্দী রাখা হয় পাগলা গারদে; এবং অসংখ্য মানুষ কোন কারণ ছাড়াই যে দেশ থেকে পালাতে সচেষ্ট হয় এবং গুলি খায় সীমান্তরক্ষীর- অথচ সবাই ভাবে এসব দৈনন্দিন ঘটনা, ভ্রুক্ষেপও করে না কেউ। দূর দূরান্তের যেসব বিচিত্র, অচেনা দেশ সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই, যে সব দেশের খবরাখবর আমরা নিয়মিত পাই না, দুয়েকজন সাংবাদিকের তুচ্ছ, বস্তাপচা অনুমান ছাড়া- সে সব দেশের বিষয়ে আমাদের মনে বিন্দুমাত্র অশান্তি নেই।
মানবমনের এই দ্বিচারিতার নিন্দা করে কোন লাভ নেই- কারণ বহু দূরের মানুষেরর দু:খ দুর্দশার বিষয়ে এই চক্ষুস্থির করার মত অনুপলব্ধি- মানবের স্বাভাবিক ব্যবহারের অঙ্গ। কিন্তু পুরো মানবজাতিকে একত্র করে চিন্তা করলে পরস্পরের প্রতি এই অচিন্ত্যনীয় দুর্বোধ্য আচার সন্নিকট ও মারমুখী ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে পারে মানবজাতিকে। এক পৃথিবী, এক মানবজাতি এরকম ছয়, চার এমনকী দুটি বিভিন্ন মূল্যবোধের মাপকাঠি নিয়ে টিকতে পারবে না বেশিদিন- আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হব অসমান উত্থান পতনে এবং অসামঞ্জস্য আন্দোলনে।
যে মানুষের বুকে দুটি হৃদয়, সে এই পৃথিবীর জন্যে নয়, এবং তাঁর সঙ্গে এই পৃথিবীতে পাশাপাশি বাস করাও অসম্ভব।
।। ৫ ।।
কিন্তু এই বিভিন্ন মাপকাঠির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেন কে, এবং কিভাবে? মানবজাতির জন্যে কে নির্মাণ করবেন এক ও অদ্বিতীয় ভাষা যা ভাল ও মন্দের ক্ষেত্রে অথবা সহনীয় এবং অসহনীয় পরিস্থিতিতে সমান ভাবে প্রযোজ্য হবে? মানব জাতির কাছে কে সরল ভাষায় উপস্থাপন করবেন কোন পরিস্থিতি দুর্বহ এবং অসহ্য আর কোন পরিস্থিতিতে ত্বকের অগভীর কাটা ছেঁড়ার বেশি কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই? কে মানবজাতির ধিক্কারকে সঠিক পথে চালনা করবেন বহুদূরের হলেও স্তম্ভিত করা ভয়াবহ ঘটনার দিকে এবং নিকটের অনেক কম ভয়াল পরিস্থিতির দিকে নয়? কে সফল হবেন মানুষের সীমিত অভিজ্ঞতা পার হয়ে বাকী পৃথিবীর ঘটনাবলীকে তার চিন্তনে বোধগম্য করে তুলতে?
কে সমর্থ হবেন মানব নামক অন্ধবিশ্বাসী এবং একগুঁয়ে জীবকে বহুদূরের মানুষের আনন্দ ও বিষাদের সঙ্গী করে তুলতে এবং তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার সীমানা পেরিয়ে এক নবীন মাত্রার বোধগম্যতায় পৌঁছে দিতে (যদিও তার মধ্যে প্রতারণার সম্ভাবনা বিদ্যমান)। প্রচার, নিয়মের বন্ধন অথবা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ- সবই তার কাছে নিষ্ফল। কিন্তু সৌভাগ্যবশত আরও একটি উপায় রয়েছে হাতের কাছে। তার নাম শিল্প! তার নাম সাহিত্য!
আলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারে তারা- সাধারণত: মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়, অন্যের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা স্পর্শ করতে পারে না তার জীবনকে- শিল্প মানুষের এই হানিকর বিচিত্র স্বভাবকে অতিক্রম করতে সক্ষম। তুলনামূলক ভাবে মানুষ অল্প সময়ই কাটায় এই পৃথিবীতে- কেবলমাত্র শিল্পই পারে তারা অপরিচিত ও জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতাকে- তার সব বোঝা, সমস্ত রঙ এবং জীবন রস সমেত- নতুন শরীর দিয়ে গড়ে তুলতে এক নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবে- যাকে আমরা আপন বলে গ্রহণ করতে পারি এবং নিজেকে মিলিয়ে দিতে পারি তার সঙ্গে। এবং কেবল তাই নয়, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি; বিভিন্ন দেশ এবং বিভিন্ন মহাদেশ কয়েক শতাব্দী পার করে হলেও পুনরাবৃত্তি করে চলে একে অন্যের ভুল কর্মের। প্রথম দর্শনে মনে হবে এটা কী করে সম্ভব! কিন্তু তাই হয়ে চলে; যে তত্ত্ব বা কর্মপদ্ধতিতে কোন জাতির অভিজ্ঞতা রয়েছে, যারা সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছে, তাকে কাজে লাগিয়েছে এবং পরে ত্রুটিমুক্ত বলে বাতিল করেছে কয়েক যুগ পরে, কয়েক যোজন দূরে অন্য জাতি নতুন করে আবিষ্কার করে তাকে। অর্থাৎ, আবার বলতে চাই, যে অভিজ্ঞতা আমাদের নিজের জীবনে কখনও আসেনি, কেবলমাত্র শিল্প অথবা সাহিত্যের মাধ্যমেই তাকে একান্ত নিজের বলে অনুভব করা সম্ভব। তাদের রয়েছে এক অনির্বচনীয় ক্ষমতা: ভাষা, লোকাচার এবং সামাজিক রীতিনীতির বাধা পেরিয়ে তারা এক দেশের জীবন-অভিজ্ঞতাকে দূরের কোন অচেনা দেশে সাবলীলভাবে পৌঁছে দিতে সক্ষম। কোন অনভিজ্ঞ দেশের মানুষের সামনে তারা এনে দিতে পারে অন্য দেশের দশকজোড়া জাতিয়তাবাদী নির্মম পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা, যাতে সেই নতুন দেশটি একই অনাবশ্যক, পরিহার্য, ভ্রমতাড়িত, বিধ্বংসী পথে না যায় এবং তার ফলে মানব ইতিহাসের উদ্দেশ্যহীন পুনরাবৃত্তিকে রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়।
আজকের নোবেল বক্তৃতায় আমি শিল্পের এই উত্তম এবং মহান গুণটিকে তুলে ধরতে চাই সুধীজনের সামনে।
এ ছাড়া সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও ঘনীভূত অভিজ্ঞতা প্রেরণ করে আর একটি অমূল্য বার্তা- প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এই সাহিত্য পরিণত হয় দেশ ও জাতির জীবন্ত স্মৃতিতে। এইভাবে সাহিত্য বাঁচিয়ে রাখে দেশের ফুরিয়ে যাওয়া ইতিহাসের ম্লান দীপশিখাকে এবং নতুন ইন্ধন জোগায় তাতে; তাকে রক্ষা করে দৈহিক বিকৃতি এবং অপবাদের হাত থেকে। তার ফলে সাহিত্য বাঁচায় একটি দেশের ভাষাকে এবং সেই সঙ্গে জাতির আত্মাকেও।
[ইদানিং একটা নতুন ফ্যাশন লক্ষ করছি- বিভিন্ন দেশ ও জাতিকে সমান বলে প্রচার করার- যেন আধুনিক সভ্যতার গলনপাত্রে (melting pot) বিভিন্ন জাতি তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে মিলেমিশে এক হয়ে যাবে। আমি এই মনোভাবের সঙ্গে এক মত নই এর তার আলোচনার বিভিন্ন দিক নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। এখানে একটি কথাই বলে রাখা ভাল- যদি বিভিন্ন জাতি তাদের অস্তিত্ব হারায়, তার ফলে দরিদ্র হয়ে পড়বেই মানব সমাজ- ঠিক যেমন যদি সব মানুষ হয়ে দাঁড়ায় একে অন্যের প্রতিফলন- একই মুখ, একই ব্যক্তিত্ব। দেশ ও জাতি মানবসমাজের সম্পদ তার সামূহিক ব্যক্তিত্ব; ঈশ্বরের করুণায় লাভ করা তাদের নিজস্ব গাত্রবর্ণ এবং নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।]
যে দেশে সাহিত্যিক নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলপূর্বক, সত্যিই দুর্ভাগা সে দেশ। কারণ তা কেবল “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা”র চরম লঙ্ঘনই নয়, তা হ’ল জাতির হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দেওয়ার সামিল এবং তার স্মৃতির খানিকটা অংশ কেটে বাদ দেবার। দেশ ভুলে যায় তার নিজস্ব ঐতিহ্যের কথা, নষ্ট হয় তার অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক ঐক্য এবং একই ভাষায় কথাবার্তা চালিয়ে গেলেও ক্ষমতা থাকে না একে অন্যকে বোঝার। এক নীরব প্রজন্ম বৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দিকে এগোয় কিন্তু সুযোগ পায় না নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলার- হয় একে অন্যের কাছে অথবা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। যখন আখমাতোভা অথবা জামিয়াতিনের মতন মহান লেখকেরা যখন আজীবন নীরব থাকতে বাধ্য হন, শুনতে পান না আপন কন্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি- এই জ্যান্ত কবরে সমাহিত হওয়া কেবল তাঁদের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, তা পুরো দেশের দুর্ভাগ্য, শুধু তাই নয় তা দেশের পক্ষে বিপজ্জনকও।
।। ৬ ।।
বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন কালে তপ্ত, ক্রুদ্ধ এবং পরিশীলিত তর্কবিতর্কের উদ্রেক হয়েছে যে শিল্প এবং শিল্পী নিজের মতন করে স্বাধীনভাবে কাজ করে যাবেন অথবা সমাজের প্রতি তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সর্বদা সতর্ক থেকে কাজ করবেন যদিও পক্ষপাতশূন্যভাবে। আমার মধ্যে এরকম কোন দোটানা নেই, তবে আমার যুক্তিতর্ক আমি এই সভায় পেশ করব না। এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যটি হ’ল আলব্যের কামুর সুবিখ্যাত নোবেল বক্তৃতা এবং আমি তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হতে পেরে আনন্দিত। সত্যিসত্যিই গত কয়েক দশকের রুশ সাহিত্য আত্মসিদ্ধির রহস্যচেতনায় মগ্ন না হবার, নিরর্থক চিন্তাভাবনায় ডানা না ঝাপটানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আমিও একথা স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র লজ্জিত নেই যে আমি সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়েছি সেই ঐতিহ্যের অনুসরণে। রুশ সাহিত্য বহুকাল ধরে এই ধারণায় বিশ্বাস করে যে লেখক তাঁর সমাজের উপকারে অনেক কিছু করতে পারেন এবং সেটা তাঁর একান্ত কর্তব্য।
শিল্পীর বিশেষ অধিকার রয়েছে বাইরের পৃথিবীর সমস্ত ঘটনাকে অগ্রাহ্য করেও নিজের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতিকে প্রকাশ করা- আমরা যেন তাতে কোনভাবেই বাধা না দিই। শিল্পীর কাছে আমরা কিছু দাবী করব না, কিন্তু তিরস্কার অথবা মিনতি করব, উৎসাহ দেব অথবা লোভ দেখাব যাতে তিনি চারপাশের বাস্তবতাকে শিল্পের সামগ্রী করেন। কারণ তাঁর শিল্পপ্রতিভার কেবল একটা ছোট অংশই সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর পরিশীলনে, বাকীটা জন্ম থেকেই আঁকা হয়ে রয়েছে তাঁর কপালে। এই উপহার পাওয়া প্রতিভার ফলে দায়িত্বও এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। ধরে নেওয়া যাক যে শিল্পী স্বয়ং সম্পূর্ণ- কারুর কাছে তাঁর কোন ঋণ নেই; কিন্তু তাহ’লেও তিনি যদি নিজের গড়ে তোলা জগতে অথবা অহংপ্রসূত খামখেয়ালের পরিসরে বিরাজ করতে চান- তার ফলে তিনি বাস্তব জগতকে সঁপে দেবেন ভাড়াটে দস্যুদের হাতে, যারা হয় উন্মাদ, নয় মূল্যহীন।
আমাদের বিংশ শতাব্দীর পূর্বের অন্য সব শতাব্দীর তুলনায় বেশি নির্মম এবং তার প্রথম পঞ্চাশ বছরের বীভৎসতা মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি এখনও। আমাদের পৃথিবীতে এখনও জমজমাট গুহাবাসী মানবের মানসিকতা- লোভ, ঈর্ষা, অসংযম এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ- যদিও তাদের নতুন নামকরণ ঘটেছে- শ্রেণী সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, জনগণের সংগ্রাম বা শ্রমিক ইউনিয়নের লড়াই। যে কোন রকম বোঝাপড়াকে অস্বীকার করার আদিম অভিপ্রায় এখন পরিণত হয়েছে নীতিগত তত্ত্বে এবং সনাতন সদগুণের পরিচয় হিসেবে। তার দাবী- নিরর্থক গৃহযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বলিদান; আমাদের আত্মার সামনে তার সরব প্রচার- শুভবুদ্ধি অথবা ন্যায়বিচার বলে কোন অপরিবর্তনীয় ও সর্বজনীন ধারণা নেই, তারা সকলেই অনিত্য এবং পরিবর্তনশীল। সেই কারণে নতুন নিয়ম- পার্টির জন্যে যা লাভজনক, তাই তোমার কর্তব্য। যে কোন পেশাদার গোষ্ঠী যখন দেখতে পায় সমাজের সম্পদের একটা অংশ নিজেদের জন্যে ভেঙে বের করে নেওয়া সম্ভব- যদিও তা অনুপার্জিত এবং প্রয়োজনতিরিক্ত, তারা তখনই সেটা ভেঙে নেবে- পরোয়া করবে না যদি তার ফলে পুরো সমাজটাই টুকরো টুকরো হয়ে ধসে পড়ে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, পশ্চিমী সমাজের আন্দোলনের এখন যা প্রসার, তাতে এমন একটা সময় খুব নিকটে চলে এসেছে যখন সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখাই অসম্ভব হয়ে উঠবে। হিংসা এখন উদ্ধত ও জয়ীর ভঙ্গীতে দর্পে দাপিয়ে বেড়ায় পৃথিবীর বুকে- শত শত বছরের আইন শৃঙ্খলার বেঁধে দেওয়া সীমানা নির্বিবাদে পেরোতে লজ্জাবোধ করে না। তারা ভাবেও না হিংসাত্মক কর্মের অসফলতা ও বন্ধ্যাত্ব ইতিহাসের খাতায় বার বার প্রমাণিত হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, পৃথিবীতে সফলতা লাভ করে শক্তির বেহায়া বহি:প্রকাশ নয়, করে তার উল্লাসিত ন্যায্যতা। পৃথিবী এখন এই উন্মত্ত অন্ধবিশ্বাসে ভরে উঠেছে শক্তি প্রয়োগ করে সব কিছুই করা সম্ভব, ন্যায়বিচার দিয়ে কিছুই না। দস্তয়েভস্কির “শয়তানেরা”- যা ছিল গতশতকের প্রাদেশিক দু:স্বপ্নের ফ্যানটাসি মাত্র এখন তারা আমাদের চোখের সামনে বুকে হেঁটে ঘুরে বেড়ায়; যে সব দেশে পা দেবার কথাও তারা কল্পনা করত না আগে, সাম্প্রতিককালে তারা সেখানে ঢুকে ছিনতাই, জবরদস্তি হরণ, বোমা বিস্ফোরণ এবং অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে সভ্যতাকে তীব্র ঝাঁকুনি দিতে অথবা ধ্বংস করতে উদ্যত! এবং তাদের সফল হবার সম্ভাবনাও প্রচুর। তরুণ সমাজ, যে বয়েসে তাদের অর্থহীন যৌনতা ছাড়া জীবনের অন্য কোন অভিজ্ঞতা নেই, বহু বছরের ব্যক্তিগত দু:খদুর্যোগ অথবা ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির অভিজ্ঞতা যাদের গড়ে ওঠেনি। তারা মহানন্দে ঊনবিংশ শতকের বিকৃতরুচি ভুলভ্রান্তিগুলির পুনরাবৃত্তি করতে উদ্যত এই ভেবে যে তারা সম্পূর্ণ নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চলেছে। তারা চিনদেশের লাল রক্ষীদের ঘৃণ্য অধ:পতনগুলিকে প্রগতির উদাহরণ হিসেবে মুক্তকন্ঠে অভিনন্দন জানায়। অগভীর বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে তারা বুঝতে পারে না মানব সমাজের প্রাচীন মূল্যবোধের সারমর্ম, অনভিজ্ঞ হৃদয়ের নানান আত্মবিশ্বাসে হাঁক পাড়ে তারা- এসো আমরা মেরে তাড়াই ওই নৃশংস, লোভী অত্যাচারীদের সরকারকে; তারপর নতুনেরা (অর্থাৎ আমরা!) রাইফেল আর গ্রেনেড দূরে সরিয়ে রেখে সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা করব। এটা কখনই সম্ভব হবে না!.... কিন্তু আমরা যারা অনেক বছর বেঁচে রয়েছি এবং পৃথিবীটাকে ভালমত বুঝি- আমরা এই তরুণদের বিরোধীতা করতে সক্ষম- কিন্তু ভয়ে এগোতে পারি না, অনেকে এমনকী এই তরুণদের পদলেহন করতে উদ্যত, যাতে “রক্ষণশীল” এর বদনাম গায়ে না লাগে। এই হল ঊনবিংশ শতাব্দীর রাশিয়ার আর এক চমকপদ অঘটন- দস্তয়েভস্কি যার প্রসঙ্গে বলেছেন “প্রগতিশীল হাতুড়েদের দাসত্ব”।
মিউনিখের প্রেতাত্মা কিন্তু কোনমতেই দূর অতীতের উদাহরণ না; এমনকী তাকে সংক্ষিপ্ত, বিছিন্ন ঘটনাও বলা যাবে না। বলতে দ্বিধা নেই যে পুরো বিংশ শতাব্দী জুড়ে মিউনিখের প্রেতাত্মা বিদ্যমান। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যে নগ্ন, বন্য বর্বরতার পুনরুজ্জীবন ঘটে চলেছে, তার বিরুদ্ধে ভীরু সভ্য জগতের হাতে কোন ধারালো অস্ত্র নেই, নতিস্বীকার এবং হাসি মুখে মেনে নেওয়া ছাড়া। মিউনিখের প্রেতাত্মা আমাদের দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে সফল মানুষদের ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতা- যে কোন মূল্যে সমৃদ্ধি অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় এবং আর্থিক উন্নতিকে মানবের পার্থিব অস্তিত্বের প্রধান লক্ষ্য ধরে অশুভকে মেনে নেওয়া। এই সব লোকেরা- এবং বর্তমানের পৃথিবীতেও তাদের সংখ্যা কম নয়- নিষ্ক্রিয়তা এবং পশ্চাদপসরণের পথ বেছে নেয়- তাদের অভ্যস্ত জীবনকে অতিরিক্ত কিছুদিন টেনে নিয়ে যাবার জন্যে তারপরই পেরিয়ে যাওয়া যাবে দু:খকষ্টের সীমানা; আজকে অন্যায় মেনে নাও- দেখবে আগামীকাল সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতই। (কিন্তু কখনই ঠিক হয় না! ভীরুতার মূল্যে অশুভের জয়; যদি ত্যাগস্বীকারের জন্যে বুকের পাটা থাকে, তখনই সাহসের মাধ্যমে বিজয়ের ফসল ঘরে তোলা যাবে।)
বোঝার উপরে শাকের আঁটির মতন আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয়ের আরও কারণ এই সদা-সংকুচিত আন্তরিকতাহীন জগতে মানুষ ধর্মের মাধ্যমে মিলিত হতে সক্ষম নয়; জ্ঞান এবং সহানুভূতি অণু-পরমাণুগুলি পৃথিবীর এক অর্থ থেকে লাফ দিয়ে অন্য অর্ধে যেতে অপারগ। সম্মুখে সমূহ বিপদ- পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে তথ্যের আদান প্রদান বলপূর্বক বন্ধ করা হচ্ছে। সমসাময়িক বিজ্ঞান ভাল করেই জানে- সত্যকে জোর করে চেপে রাখার ফল- প্রথমে বিশৃঙ্খলা এবং পরে সম্পূর্ণ ধ্বংস। তথ্যের স্বাধীন আদান প্রদান ছাড়া আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া এবং চুক্তিস্বাক্ষরের আশা অলীক; কন্ঠরুদ্ধ সমাজে কোনো চুক্তিকে যথেচ্ছভাবে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া বা তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করাও অবাস্তব নয়- যেন কোনোদিন সেই চুক্তির অস্তিত্বই ছিলনা। (অরওয়েল এই কথাটা বেশ ভালই উপলব্ধি করেছিলেন) কন্ঠরুদ্ধ সমাজে, মনে হবে যেন, পৃথিবীর অধিবাসীরা বসবাস করেন না, মঙ্গলগ্রহ থেকে আসা অভিযাত্রীদলের বাস সেখানে; মানুষ পৃথিবীর অন্য অংশের অধিবাসীদের বুদ্ধিবৃত্তির বিষয় কিছুই জানে না, কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে, পুণ্য বিশ্বাসে ভর করে তাদের পদদলিত করতে বিবেকে বাধে না, কারণ তারা নিজেদের ভাবে “মুক্তিদাতা” বলে।
শতাব্দীর এক-চতুর্থাংশ আগে অনেক আশায় ভর করে জন্ম হয়েছিল রাষ্ট্রসংঘের।
কিন্তু হায়, নীতিভ্রষ্ট জগতে সেই নবীন সংস্থাটিও হয়ে দাঁড়িয়েছে নীতিভ্রষ্ট। সংস্থাটি রাষ্ট্রসংঘ নয়, সম্মিলিত সরকারগুলির সমষ্ঠি, যেখানে সব সরকারই সমান- স্বাধীন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার, বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া সরকার, অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা সরকার। সংখ্যাগরিষ্ঠের অর্থপ্রিয় পক্ষপাতে রাষ্ট্রসংঘ কিছু দেশের স্বাধীনতাকে সযত্নে রক্ষা করে, কিন্তু অন্যদের স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে। এক আজ্ঞাবহ ভোটের ফলশ্রুতি হিসেবে তারা কোন ব্যক্তিগত আবেদনের সরেজমিনে তদন্ত করতে সক্ষম নয়- সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষের কাতরানি, চিৎকার সকরুণ মিনতিতেও এই মহান সংস্থার কোন হেলদোল নেই- অতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামান না। গত পঁচিশ বছরে রাষ্ট্রসংঘের সেরা দলিল হল “মানবাধিকারের সনদ”- কিন্তু প্রতিটি সদস্য দেশকে সেই সনদ মেনে চলার ব্যাপারে বাধ্য করতে রাষ্ট্রসংঘ এতটুকু অঙ্গুলি হেলনেও আগ্রহী নয়। পৃথিবীর দীনহীন মানুষদের তাদের অনির্বাচিত সরকারের আদেশ মানতে বাধ্য করে রাষ্ট্রসংঘ তাদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে দায়ী।
একথা মনে হতেই পারে যে সমসাময়িক জগতের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নির্ভরশীল বিজ্ঞানীদের উপরে; তাঁদের হাতেই মানবজাতির প্রাযুক্তিক উন্নতিসাধন। যদি রাজনীতিবিদদের বদলে বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক শুভবুদ্ধির উপরে নির্ভর করে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অভিমুখ, তার চেয়ে সুখবর কিছু নেই। কয়েকটি ক্ষুদ্র উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় মানুষ মানুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করলে পৃথিবীতে অসাধ্যসাধন সম্ভব। কিন্তু না, বিজ্ঞানীদের মধ্যেও কোন সক্রিয় প্রয়াস দেখি না মানবজাতিকে সঠিক, স্বাধীন পথে চালিত করায়। তাঁরা পুরো একটা বিজ্ঞান কংগ্রেস জুড়ে সমালোচনা করেন অন্যের দু:খ-দুর্দশার- কিন্তু নিজেরা বাস করেন বিজ্ঞানীদের জন্যে নির্দ্দিষ্ট নিরাপদ এলাকার সীমানার মধ্যে। সেই একই মিউনিখের প্রেতাত্মা তাঁদের মাথার উপরে ওড়ে দুর্বল, ভীরু ডানা মেলে।
অতএব এই নির্মম, গতিময়, বিভাজিত জগতে অন্তত: দশ রকম ধ্বংস প্রক্রিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লেখকদের অবস্থান ও ভূমিকা কী? হাজার হোক, আমরা মহাশূন্যে রকেট উৎক্ষেপনে হাত লাগাই না, এমনকী অগতির গতি ঠেলাগাড়িও ঠেলি না দুহাতে এবং যারা কেবল পার্থিব শক্তিকেই সমীহ করে, তারা আমাদের পাত্তাও দেয় না। আমাদের পক্ষে তাহ’লে কী কয়েক পা পিছিয়ে যাওয়া, শুভবুদ্ধির একনিষ্ঠতায় বিশ্বাস হারানো এবং সত্যের অবিচলতায় সন্দেহ প্রকাশ করাই স্বাভাবিক? তার ফলে পৃথিবীর মানুষকে জানাবো আমাদের তিক্ত, নিষ্পৃহ, নিরাসক্ত পর্যবেক্ষণ- মানুষ এখন আশাতীতভাবে অসৎ, সম্পূর্ণ হয়েছে তাদের অধ:পতন এবং আমাদের মতন রমণীয় ও পরিশীলিত মানবের পক্ষ তাদের সমাজে বাস করা ভীষণ কষ্টকর।
কিন্তু এই যুদ্ধে না নেমে আমাদের উপায় নেই। একবার যাঁরা “শব্দ” নামক অস্ত্রটি হাতে তুলে নিয়েছেন, আর নিস্তার নেই তাঁদের; একজন লেখক কেবলমাত্র তাঁর সতীর্থ এবং সমসাময়িক মানুষজনের নিরাসক্ত বিচারকই নন, তিনি তাঁর দেশের মাটিতে ঘটা এবং দেশের মানুষের কৃত সমস্ত অন্যায়কর্মের দায়ভাগী। তাঁর পিতৃভূমির ট্যাংকবাহিনী যদি কোন দূর দেশের রাজধানীর কালো পিচের রাস্তা রক্তস্রোতে ভরিয়ে দিয়ে থাকে, সেই শুকনো রক্তের বাদামি ছোপ লেখকের গালেও প্রকাশিত হবে সারা জীবন। এবং কোন নিয়তিনির্দ্দিষ্ট নিশীথে তিনি যদি তাঁর ঘুমন্ত ও বিশ্বাসভাজন বন্ধুকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে থাকেন, তবে লেখকের হাতেও দগদগ করবে সেই দড়ির ফাঁসের ক্ষত। এবং তাঁর তরুণ সতীর্থ নাগরিকেরা যদি সৎকর্মের চেয়ে ভ্রষ্টাচারকেই উত্তম বলে ঘোষণা করেন, নিষিদ্ধ ভেষজের নিয়মিত ব্যবহারে রত হন অথবা অর্থের দাবীতে বলপূর্বক বন্দী করেন অসহায় মানুষকে তাদের অপকর্মের দুর্গন্ধ মিশে যাবে লেখকের শ্বাসবায়ুর সঙ্গেও।
এর পরেও কী কারুর বুকের পাটা থাকবে বলার যে বর্তমান পৃথিবীর পূতিগন্ধময় ক্ষতগুলির জন্যে আমরা দায়ী নই?
।। ৭ ।।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি এখন আশাবাদী এই সচেতনতা দেখে যে পৃথিবীর সাহিত্য সমূহকে এখন একটি বিশাল সজীব হৃৎপিণ্ড হিসেবে ভাবা হচ্ছে, যার স্পন্দনে জগতের বিভিন্ন মানুষজনের উদ্বেগ ও সমস্যার প্রতিধ্বনি- যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে তার পরিবেশনা ও উপলব্ধির তফাৎ রয়েছে।
প্রতিটি দেশ ও জাতির সে প্রাচীন সাহিত্য রয়েছে, তা ছাড়াও, এমন কী সুদূর অতীতেও বিশ্বসাহিত্য নামে এক রচনা সমষ্টির অস্তিত্ব ছিল যেখানে জাতীয় সাহিত্যের উচ্চতাকে এড়িতে পারস্পরিক সাহিত্যিক প্রভাবের যোগ সূত্র স্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু সেখানে একটা সময়ের পার্থক্য ঘটতে বাধ্য- লেখক এবং পাঠকেরা অচেনা ভাষার লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে অনেক দিন কেটে যায়, অনেক সময় শতাব্দীও- ফলে পারস্পরিক প্রভাবের ছায়া পড়তে বিলম্ব ঘটে- ফলে কোন একটি দেশের জাতীয় সাহিত্যের অমোঘ উচ্চতা প্রতীয়মান হয় সমসাময়িকের বদলে তাঁদের উত্তরসূরিদের চোখে।
অথচ বর্তমানকালে এক দেশে লেখকদের সঙ্গে অন্য দেশের পাঠক ও লেখকদের পারস্পরিক আদান প্রদান বিদ্যমান যা পুরোপুরি তাৎক্ষণিক না হলেও ঘটে যায় খুব দ্রুত। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি। আমার যে সমস্ত গ্রন্থগুলি স্বদেশে প্রকাশের সুযোগ পায়নি, হায়, সেগুলি কিন্তু খুব অল্পসময়ে সহানুভূতিশীল পাঠকবৃন্দকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে, যদিও খুব তাড়াহুড়ো করে করা, অনেক সময় বাজে অনুবাদে। হাইনিরিখ ব্যোল (১৯১৭-১৯৮৫) এর মত বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক তার রিভিউ লিখেছেন। গত কয়েক বছরে আমার সাহিত্য এবং আমার স্বাধীনতা- দুটোই যখন তাসের ঘরের মতন ভেঙে পড়তে শুরু করে, যখন তারা মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম এড়িয়ে কোনোভাবে শূন্যে ঝুলে থাকতে সক্ষম হয়েছিল- হয়ত অস্তিত্বহীনতায়- সহানুভূতিশীল পাবলিকের ত্বক প্রসূত অদৃশ্য, অর্থহীন টানাপোড়েনে; তক্ষন কৃতজ্ঞতাময় উষ্ণতায় এবং আমার কাছে পুরো অপ্রত্যাশিতভাবেই আমি খবর পাই আন্তর্জাতিক লেখকসংস্থাগুলির ভ্রার্তৃসুলভ নিবিড় সমর্থনের। আমার পঞ্চাশতম জন্মদিনে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম পশ্চিমের স্বনামধন্য লেখকদের কাছ থেকে অভিনন্দন বার্তা পেয়ে। দেশের সরকার আমার উপরে অযথা চাপ দিলেই তা চোখে পড়েছে পৃথিবীর লেখকসমাজের। যে বিপজ্জনক সপ্তাহ গুলিতে আমাকে লেখকদের ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার করা হ’ল, পৃথিবীর খ্যাতনামা লেখকের তখন আমার জন্যে “প্রতিরক্ষার দেয়াল” গড়ে তুলে আমাকে আরও খতরনাক নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। নরওয়ের লেখক ও শিল্পীরা আমার জন্যে একটি খালি কামরা তৈরি করেই রেখেছিলেন, যাতে আমাকে সত্যিসত্যিই নির্বাসনে পাঠানো হলে (ভীতি প্রদর্শন চলেছিল প্রতিদিনই) আমি সেখানে গিয়ে বাস করতে পারি। এমনকী এই নোবেল পুরষ্কারের জন্যে আমার মনোনয়নের প্রস্তাব যে দেশে আমি বাস করি এবং লিখি- সে দেশ থেকে আসেনি- এসেছে ফ্রাঁসোয়া মরিয়াক (১৮৮৫-১৯৭০) ও তাঁর সহকর্মীদের পক্ষ থেকে। কিছুদিন পরে তাঁদের পুরো জাতীয় লেখক ইউনিয়ন সমর্থন প্রকাশ করে আমার জন্যে।
এইভাবে আমি উপলব্ধি ও অনুভব করি যে বিশ্বের সাহিত্য বলতে কোন নৈর্ব্যক্তিক সংকলন বোঝায় না অথবা তা সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের আবিষ্কৃত কোন তুচ্ছ সাধারণীকরণ নয়; বিশ্বসাহিত্যের রয়েছে যৌথ শরীর এবং যৌথ সত্তা- তার মধ্যে রয়েছে জীবন্ত ও মর্মস্পর্শী একটা যেটা পৃথিবীজোড়া মানবজাতির ক্রমবর্ধমান ঐক্যের প্রতিফলন। দেশগুলির সীমান্ত রক্তবর্ণ ধারণ করে এখনও, ইলেকট্রিক তারের সাহায্যে উত্তপ্ত; মেসিনগানের গোলাগুলির শব্দেও; প্রতিটি দেশের স্বরাষ্ট্র দপ্তর অবশ্যই ভাবেন যে সাহিত্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তাঁদের দপ্তরের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। সংবাদপত্রের হেডলাইনে বড় আখরে লেখা হয়, “আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারুর হস্তক্ষেপের অধিকার নেই!” কিন্তু এই জনসংকুল পৃথিবীতে আর “আভ্যন্তরীণ বিষয়” বলে কিছু নেই! মানবজাতির মুক্তির একমাত্র উপায় হ’ল প্রতিটি মানুষের পক্ষে প্রতিটি বিষয়কে আপন করে নেওয়া; পূর্বদেশের মানুষদের চিন্তা করতে পশ্চিমের মানুষদের বিষয়ে; পশ্চিমদেশের মানুষদের ও চিন্তা করতে হবে পূর্বের মানুষদের বিষয়ে। এবং সাহিত্য যেহেতু মনুষ্যজাতীয় প্রাণীর হাতে সবচেয়ে অনুভূতিপ্রবণ এবং সংবেদনশীল প্রযুক্তি তাকেই প্রথম এগিয়ে আসতে হবে মানিয়ে নিতে, মিশে যেতে এবং মানবজাতির ক্রমবর্ধমান ঐক্যের অনুভূতিকে জড়িয়ে ধরতে। তাই আমি, মনে আত্মবিশ্বাস নিজে আজকের পৃথিবীর সাহিত্যের দিকে তাকাই- আমার শত শত প্রিয় বান্ধব যাদের সঙ্গে অতীতে কোনদিন দেখা বা আলাপ হয়নি, এবং ভবিষ্যতেও হবার সম্ভাবনা কম।
বন্ধুগণ! আমাদের যদি যোগ্যতা বলে কিছু থাকে, তাহ’লে এই সাহায্যের হাত বাড়াতে হবেই। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আপনাদের পরস্পরের প্রতি যুদ্ধে রত দল, আন্দোলন, জাতি অথবা গোষ্ঠীকে বিভক্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন কারা? এক কথায়, তাঁরাই আপনাদের দেশের লেখকমণ্ডলী; মাতৃভাষায় নিজেদের প্রকাশ করেন তাঁরা- জাতিকে এবং যে ভূমিতে তাঁরা বাস করেন সেই ধরিত্রীকে একসূত্রে বেঁধে রাখে তাঁদের প্রাণশক্তি এবং জাতীয় সত্তার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ তাঁরা।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস মানবসমাজের এই সংকটজনক মুহূর্তে পৃথিবীর সাহিত্যের ক্ষমতা রয়েছে তাকে সাহায্য করার- তাকে দেখতে সাহায্য করা তার আসল রূপটিকে, বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর পক্ষপাত ও মতাদর্শকে উপেক্ষা করে। বিশ্বসাহিত্যের ক্ষমতা রয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতার নির্যাসকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছে দেবার, যাতে আমরা একই সঙ্গে বিমোহিত এক ছিন্নভিন্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাই; যাতে বিভিন্ন মূল্যবোধের মাপকাঠি একে অন্যের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে শেখে; যাতে এক জাতি অন্য জাতির ইতিহাসকে সঠিক এবং নিখুঁতভাবে আত্মস্থ করে- এমন শক্তিমত্তার সঙ্গে সেই পরিচিতি এবং যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি যেন নিজে নিজেই সে চলেছে অন্যের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এবং যাতে অন্যের সেই নির্মম ভুলগুলি নিজের সমাজেও না করে বসে। হয়ত এমন সব অপ্রীতিকর পরিবেশে আমরা শিল্পীরা এমনব এক নতুন দৃষ্টির উন্মোচন করতে পারি যাতে জড়িয়ে ধরা সম্ভব হয় সমগ্র পৃথিবীকে; যার কেন্দ্রে বসে আমরা নিকটে সব জিনিশকে পর্যবেক্ষণ করি, আর প্রান্তগুলিতে আমরা কাছে টেনে আনতে চেষ্টা করি যার অন্তর্গত বাকি পৃথিবীর ঘটনাবলী। আমরা পৃথিবীর এক অংশের সম্পর্কিত করতে পারি অন্য অংশকে তাদের নিজস্ব পরিমাণের অনুপাতে।
সত্যি সত্যিই, লেখকেরা ছাড়া আর কে এমন সুবিচার করতে সক্ষম- কেবল নিজেদের ব্যর্থ প্রশাসকদের সম্পর্কেই নয় (যদিও অনেক দেশে এটাই হতে পারে ভাল উপার্জনের জীবিকা, অলসতাহীন মানুষদের যোগ্য কর্মসংস্থান), মানুষের নিজের সম্পর্কেও- তাদের ভীরুতার অপমানে অথবা আত্মসন্তুষ্টির দুর্বলতায়? কেই বা তরুণ সমাজের হালকা- মেজাজের হালচাল অথবা তরুণ দস্যুর হাতে ঝলসানো ছুরিকার সঠিক মূল্যায়ন করতে সচেষ্ট?
অন্যেরা আমাদের বলবে: অদম্য হিংসার নির্মম আক্রমণের বিরুদ্ধে সাহিত্যের কতটুকু ক্ষমতা? কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে হিংসা একা একা বাস করে না অথবা করতে পারেও না: তাকে মিথ্যাচারের সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে হয়। তাদের দুজনের মধ্যে একান্ত গোপন, নিবিড় সম্পর্ক। হিংসার একমাত্র আশ্রয় মিথ্যাচার আবার মিথ্যাচারকে সমর্থন করে হিংসা। যদি কোন মানুষ হিংসাকে তার কর্মপদ্ধতি বলে স্বীকার করে নিয়ে থাকে, মিথ্যাচারকে মূল তত্ত্ব বলে মেনে নেওয়া ছাড়া তার কোন উপায় নেই। জন্ম হয়ে থেকেই হিংসা তার কাজ করে যায় জনসমক্ষে, এমনকী গর্বের সঙ্গেই তা করে থাকে। যখন একটু বয়েস বাড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে শক্তি বাড়ে তার, সে উপলব্ধি করে পাতলা হয়ে আসছে তাকে ঘিরে থাকা বায়ুমণ্ডল এবং সে বাধ্য হয় মিথ্যাচারের কুয়াশার আড়ালে নিজেকে ঢাকতে- কিন্তু মিথ্যেগুলোকে মিষ্টি কথা কথার রঙিন পোষাক পরায়। তবে সবসময়ই যে সে তার শিকারের গলা খোলাখুলি শক্ত করে টিপে ধরে তা নয়, সে দাবী করে অবদমিতাকে মিথ্যার নাম করে শপথ নিতে অথবা মিথ্যের দলে নিজের নাম লেখাতে।
এবং সাধারণ সাহসী মানুষের সাধারণ পদক্ষেপ হ’ল মিথ্যাচারের আশ্রয় না নেওয়া এবং মিথ্যাকে প্রশ্রয় না দেওয়া! সে যদি আসে আমার জগতে- আসুক, এমনকী চাইলে সেখানে অবাধে রাজত্বও করুক- কিন্তু আমার সাহায্য নিয়ে নয়। কিন্তু শিল্পী ও সাহিত্যিকরা তার অনেক বেশি অর্জন করতে সক্ষম তারা পারেন মিথ্যাচারকে পরাস্ত করতে! মিথ্যাচারের সঙ্গে যুদ্ধে জয় হওয়ারই কথা শিল্পের এবং শিল্প সর্বদাই জিতে যায়! খোলাখুলি, বিতর্কহীন, এবং সকলের জন্যে। মিথ্যাচারের পক্ষে পৃথিবীর অনেক কিছুরই বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব- কিন্তু শিল্পের বিরুদ্ধে কখনই নয়।
এবং মিথ্যাচারকে ছত্রভঙ্গ করা গেলে হিংসার বহি:প্রকাশ ঘটবে তার সমগ্র, কুৎসিৎ নগ্নতায়- এবং ভগ্নদশাগ্রস্ত হিংসার পতন অবশ্যম্ভাবী।
সেইজন্যেই, বন্ধুগণ, আমি প্রাণমন দিয়ে বিশ্বাস করি- পৃথিবীর এই শ্বেততপ্ত লগ্নে আমরা তার সাহায্যে লাগতে পারি। না, আমাদের হাতে অস্ত্র নেই বলে অজুহাত সাজিয়ে নয়, অথবা, অর্থহীন জীবনযাপনের কাছে আত্মসমর্পণ করেও নয়- সাহায্য করতে হবে হিংসার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে!
রুশ মানুষেরা প্রবাদবাক্য ভালবাসে এবং স্বীকার করে তাদের সত্যতা। আমাদের নির্মম জাতীয় অভিজ্ঞতাসমূহের (যার পরিমাণও যথেষ্ট) একনিষ্ঠ এবং অনেক সময় চমকপদ বর্ণনা দেয় তারা-
“সমগ্র পৃথিবীর চেয়ে একটি সত্য কথার গুরুত্ব বেশি”।
এবং এখানে, এক কষ্টকল্পিত আজগুবি জগতে, ভর এবং শক্তির সংরক্ষণনীতিকে লঙ্ঘন করে আমি চালিয়ে যাই আমার কর্মপদ্ধতি এবং আবেদন জানাই পৃথিবীর লেখকসমাজের কাছে।
টীকা-
- সলঝেনিৎসিন (১৯১৮-২০০৮) নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭০ সালে। কিন্তু পুরস্কার গ্রহণের জন্যে স্টকহোমে যেতে সমর্থ হন নি। এই লিখিত বক্তৃতাটি তাঁর পক্ষ থেকে পেশ করা হয় সুইডিশ আকাদেমির কাছে।
- ভ্লাদিমির সলোভিয়েভ- (১৮৫৩-১৯০০)- রুশ প্রতীকীবাদী কবি এবং প্রভাবশালী দার্শনিক। দস্তয়েভস্কির ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তাঁর আলিওশা কারামাজভ চরিত্রের অনুপ্রেরণা। তলস্তয়ের ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত “ক্রুৎসার সোনাটা” গ্রন্থে তাঁর দার্শনিক তত্ত্বের প্রতিধ্বনি।
- গুলাগ- GULAG একটি acronym অর্থাৎ বিভিন্ন শব্দের আদ্যক্ষর নিয়ে গঠিত সংক্ষিপ্ত নির্দেশক শব্দ- যার অর্থের বিস্তার করলে দাঁড়াবে “সংশোধনী শ্রমশিবির ও বস্তির মুখ্য প্রশাসন”। রুশ ভাষায় শব্দটির ব্যবহার বিরল।
- আখমাতোভা অথবা জামিয়াতিন- নির্যাতিত রুশ কবি আনা আখমাতোভা (১৮৮৯-১৯৬৬); স্বামী নিকোলাই গুমিলিয়ভ (১৮৮৬-১৯২১) কে প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন লেনিন; পুত্র লেভ গুমিলিয়ভ (১৯১২-১৯৯২) কে সাইবেরিয়ার গুলাগে পাঠিয়েছিলেন স্তালিন।
ইয়েভ্গেনি জামিয়াতিন (১৮৮৪-১৯৩৭)- জার এবং স্তালিন উভয়ের হাতেই নির্যাতিত রুশ কথাসাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক। গোর্কির “নীচের তলা” উপন্যাসের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি পরিচালক জঁ রেনোয়ার সঙ্গে যৌথভাবে। তাঁর “আমরা” উপন্যাসটি অনুপ্রাণিত করে জর্জ অরওয়েলকে তাঁর ভুবনখ্যাত “১৯৮৪” উপন্যাস লিখতে।
- দস্তয়েভস্কির “শয়তানেরা”- ১৮৭২ সালে প্রকাশিত উপন্যাস। কন্সস্ট্যান্স গার্নেট তার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন “নিশি-পাওয়া মানুষ” (“The Possessed”) নামে।
- মিউনিখের প্রেতাত্মা- ১৯৩৮ সালের ২৯ সেপ্তেম্বর জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের স্বাক্ষর করা শান্তিচুক্তি- নাৎসি বাহিনীর কাছে ইয়োরোপের আত্মসমর্পণের সূচনা।