কোন কোন সময় এই সব আইন তাদের অপব্যবহারকে প্রায় ডেকে নিয়ে আসে। বাদবাকি সময় এতটা খারাপ না হলেও মূল অধিকারটি নানা মারপ্যাঁচে মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়।
১৯(১)(ক) সংখ্যক ধারাতে বলা হয়েছে যে সকল নাগরিকের বাক্স্বাধীনতায় অধিকার থাকবে (“All citizens shall have the right to freedom to speech and espression”)।
(লক্ষ্য করুন- অনুচ্ছেদটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টিতে, আপত্তিজনকভাবে, যাঁরা নাওরিক নন তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এরই পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন বলছে যে বাক্স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে এমন কোন আইনই কংগ্রেস পাশ অরতে পারবে না। (“Congress shall not make my law…..abridging the freedom of speech”)। এই আইন মার্কিন নাগরিকদের বাক্স্বাধীনতা রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ছাত্রদের মতো অ-নাগরিকদেরও একই অধিকার দিয়ে থাকে)। আমাদের দেশের সরকার ১৯(১)(ক) সংখ্যক অনুচ্ছেদটিতে (আরো নানান মৌলিক অধিকারজ্ঞাপক অনুচ্ছেদের মতোই) অল্প অল্প করে অনেক কিছুই পরে যোগ করেছেন যার মধ্যে সর্বাধুনিকটি হল “ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা” (the sovereignty and integrity of India”) বাক্যবন্ধটি। ওই একই ধারার দু নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে:
“[(2)] Nothing in sub-clause (a) of clause (1) shall affect the operation of any existing law, or prevent the State from making any law, in so far as such law imposes reasonable restrictions on the exercise of the right conferred by the said sub-clause in the interests of [the sovereignty and the integrity of India] the security of the State, friendly relations will foreign States, public order, decency or morality, or in relation to contempt of court, defamation or incitement to an offence]”. অর্থাৎ যেকোন আইনকে যদি কোনভাবে দেখানো যায় যে তা বেশ কিছু সমস্যার সমাধানে আপাতভাবে “সহায়ক”, তাহলেই তার বাক্স্বাধীনতার উপর আরোপ হতে কোন অসুবিধা নেই। মানহানি আর আদালতের অবমাননা (“Defamation and Contempt of Court”) যে বাক্স্বাধীনতার আওতায় পড়ে না- এটা সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু লক্ষ্য করুন friendly relations with foreign States” বাক্যবন্ধটিতে কি সুচতুরভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে, তিব্বতীদের উপর চীনের অত্যাচারের বা বৃটিশদের কোহিনূর হাতছাড়া না করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে বাক্স্বাধীনতার আওতার বাইরে ঠেলে দিতে। এই ধরনের প্রতিবাদকে দমন করার অধিকার সরকারের থাকা উচিৎ কি না- তা নিয়ে কিন্তু কখনো কোন কথাই ওঠে নি। নিজেদের অধিকারের মুঠিকে আরো শক্ত করতে পরের পর নানা সরকার এই ধরনের খামখেয়ালী বাধা চাপিয়েছেন বাক্স্বাধীনতার উপর।
ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা সংক্রান্ত প্রকরণটি আরও আপত্তিজনক: এর যথেচ্ছ অপব্যবহার ঘটেছে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশকে (অতি সাম্প্রতিককালে বাতিল হওয়া TADAর সাহায্যে) অপরাধের আওতায় আনতে। টাডা (সন্ত্রাসবাদী ও সংহতিনাশক (নিবারক) আইন)র প্রয়োগের ফলে এমন অদ্ভূত পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়েছিল যেখানে ভারতেরই একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মতামত শুধুমাত্র পুনরুক্তি করার কারণে কারোর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারত। ১৯৫২ সালের ২৬ শে জুন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন: কাশ্মীরের জনগন যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন গণভোটে জানান “আমরা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে চাই না’, আমরা তা মেনে নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ”। যেহেতু ভারতের জনমত এখন কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত রাখার পক্ষে, তাই নেহেরুর এই উক্তি টাডার আওতায় আসা ‘ভারতের অখন্ডতা’ সংক্রান্ত প্রকরণটির সঙ্গে খাপ খাবে না। অতএব আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সরকারিভাবে করা এই মন্তব্য যদি কেউ জনস্মক্ষে উদ্ধৃতও করেন, তাহলেও তাঁকে বন্দী করে সাজা দেওয়া যেতে পারে। নেহেরু নিজেই হয়ত বন্দী হতেন যদি টাডা বহাল থাকাকালীন তিনি বেঁচে থাকতেন এবং নিজের মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করতেন।
এরকম যখন পরিস্থিতি, তখন যেকোনো বিচারবোধসম্পন্ন মানুষ এই ভেবে চিন্তিত হতে পারেন যে মৌলিক অধিকারগুলির সীমাবদ্ধকরণ হয়ত একটু বেশীই মাত্রা ছড়িয়ে গেছে। উদাহরণ অবশ্য একটা না, আরো অনেক আছে। যেমন ধরুন ২২ নম্বর অনুচ্ছেদটির কথা। যথেচ্ছ বনী করা ও আটকে রাখার হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার কথা এই অনুচ্ছেদটিতে উল্লিখিত অধিকারটির। ২২(১) ও ২২(২) ধারাতে বলা হচ্ছে যে কোন ব্যক্তিকে বন্দী করলে তাঁকে তার কারণ জানানো অবশ্যকর্তব্য। আরো বলা হয়েছে যে সেই ব্যক্তির একজন আইনজীবির সাহঅ্যা নেওয়ার অধিকার থাকবে এবং তাঁকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। কিন্তু এরপরেই ২২(৩) ধারায় বলা হচ্ছে: “Nothing in clauses (1)and (2) shall apply….(b)to any person who is arrested or detained under any law providing for preventive detention”। (২২) তম ধারাটির শুরুতে যে অধকার দেওয়া হল, (৩) নম্বর অনুচ্ছেদে তা ফিরিয়ে নেওয়া হল। এই (৩) নম্বর অনুচ্ছেদটির সাহায্যে সরকার “preventive detention” এর আওতায় এমন আইন আনতে পারেন যা কার্যত (১) এবং (২) নম্বর অনুচ্ছেদে প্রদত্ত অধিকারকে নিষ্ক্রিয় করে দেবে। সরকারের খেয়াল হলেই যদি আইন করে অধিকার ফিরিয়ে নিতে পারেন, তাহলে সেই অধিকারের কি মূল্য থাকে? এরকম বহু আইন সরকার করেওছেন, যেমন “জাতীয় নিরাপত্তা আইন (National Securities Act), যা আগে মিসা নামে জরুরী অবস্থার সময় কুখ্যাত হয়েছিল, “সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতাজ্ঞাপক আইন” (Armed Forces (Special Powers) Act,), জম্মু ও কাশ্মীর জননিরাপত্তা আইন (Jammu and Kashmir Public Safety Act) ইত্যাদি। “সন্ত্রাসবাদী ও সংহতিনাশক (নিবারক) আইন” (Terrorist and Disruptive Activities (Prevention) Act) বা টাডা মাত্র কদিন আগে সরকার ফিরিয়ে নিয়েছেন।
অধিকার বজায় রাখার একমাত্র উপায় হল সদ্য সতর্ক থাকা। ভারতীয়রা যদি তাঁদের চোখের সামনে নিজেদের অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া না দেখতে চান তাহলে তাঁদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এখানেই একটি দ্বিমুখী সমস্যা আছে। প্রথমত, এই অধিকারগুলির পরিমার্জনার কুফলগুলি বেশীমাত্রায় দেখা যায় এমন সব জায়গায় (যেমন উত্তরপূর্ব ভারতে AFSPA’র মাধ্যমে সরকার এমন আইন করেছেন যাতে গুলি করে হত্যার মতো অপরাধ করেও বিচার’এর হাত এড়িয়ে দিনের পর দিন বহাল তবিয়তে থাকা যায়) যার সম্বন্ধে অধিকাংশ লোকজনের উৎসাহ খুব একটা নেই। তাই এইসব জায়গায় মৌলিক অধিকারের সীমাবদ্ধকরণ ঘটলে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ প্রায় হয়ই না, বা হলেও সাড়া মেলেনা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দিক থেকে। অন্য সমস্যাটি এই যে আমাদের সংবিধান অত্যন্ত জটিল বলে বেশীরভাগ সীমাবদ্ধকরণগুলি হয় কেউ খেয়ালই করেন বা বা খেয়াল করলেও অল্পই আলোচনা করা সুযোগ থাকে তা নিয়ে।
এই অবস্থার প্রতিকারের জন্যে আমাদের প্রয়োজন “অধিকার বিধেয়ক” বা “Bill of Rights”-এর মতো একটি সর্বজনস্বীকৃত দলিল যাতে সংকলিত থাকবে আমাদের অপরিবর্ত্তনীয় মৌলিক অধিকারগুলি। স্বেচ্ছাচারী সরকাএর ক্ষমতার প্রসারকে ঠেকাতে বিচ্ছিন্ন ও কোণঠাসা মানবাধিকার সংগঠনগুলির থেকে এরকম একটি দলিল ব্যবহার করলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।
একদিকে ক্ষমতালোভী সরকার আর অনযদিকে নির্বিকার জনসাধারণ- আইনের মারপ্যাঁচের সাহায্যে এই দুইয়ের মোকাবিলা করা ও জেতা প্রায় অসম্ভব। অধিকার বিধেয়ক তৈরীর মূল উদ্দেশ্য তাই হবে রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি সুদৃঢ় ভিত তৈরী করা। আমেরিকার প্রথম থেকে দশম অ্যামেন্ড্মেন্ট্ (আমেরিকার Bill of Rights যা দিয়ে গঠিত) আজ আর শুধুই মামুলি সাংবিধানিক আইন নয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই কোন সরকার তার পরিবর্ত্তন করতে পারেন না। এই আইনগুলি আজ আমেরিকায় ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীক হয়ে গিয়েছে। তার পরিমার্জনা কোন সরকারের সাধ্যের অতীত।
গত পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে যেকোন ভারতীয় অধিকার বিধেয়ক-এর অন্তর্গত হতে পারে এরকম তিনটি প্রস্তাব নিচে আলোচনা করা হল।
১) সরকার সংকলিত অধিকারগুলির কোনটিই পরিবর্ত্তন করতে বা এই অধিকার ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনি অভিযোগ আনলে তাতে বাধা সৃষ্টি করতে পারবেন না।
(এর দ্বারা, সরকারের সশস্ত্র বাহিনীকে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যথেচ্ছ মারণাস্ত্রে ব্যবহার করার অধিকার দেওয়ার রীতি বন্ধ হবে। AFSPA’এর ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ওই আইন বহাল হলে, সশস্ত্র বাহিনীর কারোর বিরুদ্ধে কোনরকম আইনি অভিযোগ আনা যাবেনা যতক্ষণ না কেন্দ্রীয় সরকার তার অধিকার দিচ্ছেন। অর্থাৎ মানবাধিকারের চরম অবমাননা হলেও (যেমন এই কদিন আগেই সশস্ত্র বাহিনীর হাতে এক যুবতীর মৃত্যু ও তার একবছরের শিশুর গুরুতরভাবে আহত হওয়ার মতো ঘটনা) তার আইনি বিচার হবে কি না তা কেন্দ্রীয় সরকারের মর্জির উপর নির্ভরশীল। আইনি বিচারের উপর এরকম বাধা সৃষ্টি করলে মানুষের যেকোন অধিকারই মূল্যহীন হয়ে পড়ে, তাই এই ধরণের রায় মানবিকতা-বিরুদ্ধ।
২) শুধুমাত্র সঙ্গত কারণের ক্ষেত্রেই তল্লাসী, আটক ও গ্রেপ্তার করা যাবে এবং তা সম্পূর্ণভাবে আইন মোতাবেক করতে হবে। ৪৮ ঘন্টার অধিক আটক চলবে না, ৩০ দিনের অধিক বিনা বিচারে গ্রেপ্তার করে রাখা যাবে না এবং গ্রেপ্তার করা যাবে শুধুমাত্র জুডিশিয়াল ওয়ারান্ট্ থাকলে।
(অন্যান্য জুলুমের প্রতিকার ছাড়াও, এরকম একটি অধিকারের মাধ্যমে, বিভিন্ন ভারতীয় বন্দিশালায় ঔপনিবেশিক শাসকের চরম আপত্তিজনক “preventive detention” আইনের কারণে আটক যে সব বন্দী, যাঁদের অনেকেরই বিরুদ্ধে আইনি অভিযোগের কোন সম্ভাবনাই নেই, তাঁদের অবস্থার প্রতিকার করা যাবে।)
৩) কোন ব্যক্তিকে অত্যাচার করা বা তার উপর কোন রকম অমানুবিক ও অবমাননাকারী আচরণ করা চলবে না; বন্দীর বিরুদ্ধে এমন কোন স্বীকারোক্তি আনা যাবে না যা বন্দীর আইনজীবি ও একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অগোচরে করা হয়েছে।
(অপরাধশূন্যতার অর্থাপত্তি বা “presumption of innocence” এর মতো একটি সর্বজনস্বীকৃত অধিকার ভারতীয় সংবিধানে পুরোপুরি স্বীকৃত নয়। টাডার মতো আইনের ক্ষেত্রে (যেখানে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার ভার বন্দীর নিজের উপর) এই অধিকারকে পুরোপুরিই নাকচ করা হয়েছে। এছাড়াও, পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তির আইনি ব্যবহারের অধিকার টাডাতে দেওয়া হয়েছিল। এক কথায় বলা চলে অত্যাচারের মাধ্যমে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করার বা কোর্টে জাল স্বীকারোক্তি পেশ করার জন্যে পুলিশকে নিমন্ত্রণপত্র ধরানোর সমান ছিল এই আইন।)
এই তিনটি বিষয় ছাড়াও বাক্স্বাধীনতা ও ধর্ম সংক্রান্ত স্বাধীনতার বিষয়গুলি একটি সম্পূর্ণ অধিকার বিধেয়কে থাকা উচিৎ। পঞ্চাশ বছরের ভারতীয় গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমাদের হাতে, আমরা ওয়াকিবহাল আমাদের বিচারব্যবস্থার বিশেষ গলদগুলির সম্বন্ধে- আসুন তবে আমরা আর একবার ফিরে তাকাই আমাদের মৌলিক অধিকারগুলির দিকে। সেগুলিকে পরিবর্ত্তন হওয়ার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাই। এমন ভাবে সেগুলিকে আবার পুন:প্রতিষ্ঠিত করি যাতে কোন সরকার, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও, জনসাধারণের উত্তাল প্রতিরোধের কথা স্মরণ করে কোনদিন সেগুলি পরিবর্ত্তন করার সাহস না পান।