• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩ | ডিসেম্বর ১৯৯৭ | গল্প
    Share
  • আমি অসুর : অশোক

    প্রথম দিন

    তাকে দেখি পাহাড়ের পাশে। পাথরের সিংহাসনের উপর। গোপনে পূজা করছে দেবতারা। মন্ত্রে মন্ত্রে করছে তার অস্ত্রগুলির শোধন। সে একটু বিস্মিত হলেও সংযত। দেবতারা যখন আমাকে দেখেনি তখন সে আমাকে দেখলো।

    রুদ্রগণ ও বসুরাও উপস্থিত ছিল। এতদিন তারা ভয়ে পালিয়ে পালিয়েই বেড়িয়েছে। এখন লুকিয়ে মিলিত হয়েছে পাথরের এই নিরালা আশ্রয়ে। অলংকার ও মূল্যবান উপঢৌকন নিয়ে এসেছে তার জন্য। চন্দন ও পুষ্প এনেছে। অকারণেই তার স্তুতিপাঠ করছে তুষ্ট করার জন্য। তার নিস্পৃহ দুচোখের দিকে তাকিয়ে আমিই শুধু বুঝলাম— এসব আয়োজন বৃথা।

    আমি কোনো শব্দ করি নি। কাউকে জানালো না সে আমার কথা। ঋকের গুঞ্জনের মধ্যে চাপা পড়েছিল আমাদের প্রচ্ছন্ন অবস্থিতি। পিছন থেকে বন্ধু সম্বর বললো— এবার? আমি ডান হাত বাড়িয়ে ওদের আটকালাম। ইঙ্গিতে বললাম ফিরে যেতে। ওরা ইতস্তত করছিল বলে আকস্মিক ক্রোধে আমার মুখ রক্তবর্ণ হয়। বন্ধু সম্বর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল— একা থাকতে চাও তুমি? আমি ঘাড় নেড়ে বললাম— হ্যাঁ।

    একাই ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। যেমন সে ছিল দেবতাদের দ্বারা পরিবৃত হয়েও নির্জন। কখনো কখনো বুজে যাচ্ছিলো তার চোখ। ক্লান্তিতে না ঔদাসীন্যে তা আমি বুঝিনি। আমার অনুচরদের ইচ্ছে ছিলো ঝাঁপিয়ে পড়ে এই সভা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আমি বারণ করেছি কেন সেটা তারা বোঝে নি।

    পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ। সম্পূর্ণ একা। যতক্ষণ না সে আমার দিকে চেয়ে সবার অলক্ষ্যে শুধু একবার হাসলো।

    প্রাসাদে

    পরে সম্বর বললো— চিন্তার কো্নো কারণ নেই। আরেকটি নিতান্ত কাঁচা ষড়যন্ত্র।

    আমি বললাম— কেন?

    সম্বর বললো— দেখলে না অস্ত্রগুলো দেখতে ভালো হলেও মোটেই ভারী নয়।

    আমি বললাম— কিন্তু নিহিত মন্ত্রশক্তি আছে।

    সম্বর বললো— তোমার মায়াজালের কাছে একপলও টিঁকবে না। খোঁজখবর নিয়ে বলছি।

    সম্বর যখন খোঁজখবর নিয়েছে তখন এই তথ্যে ভুল থাকার সম্ভাবনা খুব কম। তবু আমি ভ্রুকুঞ্চিত করে বললাম— আমার শক্তিরও একটা সীমা আছে । সেটা মনে রেখো।

    সম্বর বললো— অত কিছু লাগবে না। শুধু বশীকরণেই কাজ হবে। চাও তো আজ রাত্রেই।

    আমি তাড়াতাড়ি বললাম— না, না। অসতর্ক হয়ে পড়লে মারাত্মক ফল হতে পারে। তোমরা কিছু কোরো না। যা করার আমিই...।

    কথা শেষ হবার আগেই সম্বর হা-হা করে হাসতে হাসতে চলে গেল। রেখে গেল আমার জন্য ভয়ের বীজ। যা আমি তৎক্ষণাৎ মনের গভীরে প্রোথিত করে ফেলেছি। অল্প সময়েই আশংকার মহীরুহ হয়ে দাঁড়াবে তা জেনেও।

    কুলপুরোহিত শুক্লকে ডাকিয়ে আনলাম। তখন সন্ধ্যা হব হব। মনের মধ্যে অবিরত বেজে চলেছে কীসের গুঞ্জন। ঋকের রেশ হতে পারে। পাখীরা ফিরে আসছে কুলায়। প্রাসাদে এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি। শুক্ল প্রসন্নমুখে এসে বলবেন— এরকম শান্তি চিরায়ত হোক এই পুরীতে। আমি শুক্লের চোখে চোখ রাখতে না পেরে অলিন্দ থেকে বাইরে পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইলাম।

    শুক্ল আমার হাত দেখে বললেন— রেখাগুলি চিরকাল চলমান তোমার। দ্যাখো কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কাল পর্যন্ত ছিল অজেয়। আজ মনে হচ্ছে তুমি অমর।

    দমকা উল্লাসের ঝলক বোধ করি। —আরেকবার ভালো করে দেখুন তো, বলে হাতটা আবার এগিয়ে দিই শুক্লর দিকে। শুক্ল নেড়েচেড়ে দেখে বলেন— আশ্চর্য! কিন্তু এ বর তো পাওনি কোনোদিন।

    আমি উত্তেজনা চেপে বলি— হয়তো আবার পাল্টে যাবে। হয়তো শুধুই সাময়িক। শুক্ল নিশ্চিন্তভাবে বললেন— তা হলেও ভালো।

    সারা দুপুর আশ্বিনের রোদে ভিজেছে মাটি। আমি শুধু ভিতরে ভিতরে ভীত ও বিস্মিত হয়ে আছি। কী করে এমন মুখের মিল হয়? গত একবৎসর ধরে কাকে আমি প্রতিবারের স্বপ্নে এই রূপে দেখলাম?

    ভয় হচ্ছে সম্বর ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা গিয়ে তার অস্ত্র অভিষেকে বাধা না ঘটায়। এখনো তো চোখেমুখে জন্মলগ্নের ঘোর। জাগ্রত হয়নি কাম বা ক্রোধ। যুদ্ধের প্রবৃত্তি নেই লেশমাত্র। পাথরের সিংহাসনে নির্বীর্য দেবতাদের দ্বারা রক্ষিত।

    শুনলাম দেবতাদের সম্মিলিত ইচ্ছা থেকে সে সম্ভূত। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মুখশ্রী থেকে তেজঃপুঞ্জ নির্গত হয়ে তাকে একটি শক্তি বলয় দিয়েছে। ইচ্ছে হল একবার গিয়ে দেখে আসি কীভাবে তাকে সজ্জিত করেছে দেবতারা। কষ্টে দমন করলাম সে ইচ্ছা। অলিন্দের বাইরে সন্ধ্যায় গাঢ় অন্ধকার নেমে আসছে। বইছে এক লঘুভার হাওয়া। আমি তন্ময়ভাবে আরো গাঢ় অন্ধকারের প্রতীক্ষায় থাকি। জানি আজ রাতে আর ঘুমের চেষ্টা করাও ভুল।

    এও বুঝতে পারি যে দেবতারা তাকে দিয়েছে অপরিমিত অস্ত্র। কিন্তু দিতে পারেনি অফুরন্ত কামনা। একমাত্র যার থেকেই জন্মাতে পারে জয়ের অভিলাষ।

    এক বছর আগে

    মাত্র একবছর আগেও জয় নিয়ে কোনো ক্ষোভ ছিল না। রণক্ষেত্র ছিলো সর্বাধিক প্রিয়। শত্রুর রক্তদর্শনে ছিল প্রকৃত উল্লাস।

    ওরা বলে আমি অত্যাচারী। সত্যি কি তাই? ছদ্মবেশে নগরে নগরে কি ঘুরিনি সন্ধ্যায়— ঘুরছিলাম অমরাবতীর অন্ধকার পাড়াগুলিতে। একা ও নিরস্ত্র। সম্বর যা চিরকাল বারণ করে এসেছে। আমি শুনিনি। ঘুরতে ঘুরতে শুনতে পেলাম গানের সুর। বীণার ঝংকার। বুঝেছি কাছাকাছি কোথাও আছে বাররমণীদের প্রমোদভবন। কান পেতে শুনছিলাম। সেই কারণে অন্যমনস্ক। এই প্রমোদভবনগুলির জন্য কিছু স্বর্ণমুদ্রার আনুকূল্য করতে আরম্ভ করেছিলাম নিজের ইচ্ছেতে। জানতে লোভ হচ্ছিল— কারা গান করে?

    এমন সময় দেখি সরু পাথরের তৈরী পথটি রোধ করেছে তিন জন পুরুষ। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না তার দেব না দানব। পথের এদিক ওদিক ছুটছিল যে কজন কিশোর-কিশোরী তারা অদৃশ্য। কিছু বুঝবার আগেই অনুভব করলাম পিঠের ঊপর প্রচণ্ড প্রহার। খড়্গের গরম তীক্ষ্ণ ফলক। কাঁধের পেশীতে ঢুকে আটকে গেছে। স্রোতের মত গলার পাশ দিয়ে নামছে উষ্ণ শোনিত।

    তীব্র একটা চিৎকার এল উপরের গবাক্ষ থেকে। দ্বার বন্ধ হবার অনেকগুলি শব্দ। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসছে দেখে দ্রুত হাতের বেষ্টনে ধরে ফেলেছি পিছন থেকে আসা আততায়ীর কোমর। তাকে ঘুরিয়ে নিজের সামনে এনে তারই শরীরে ভর দিয়ে দাঁড়ালাম সামনের এগিয়ে আসা তিনটি অস্ত্রধারী পুরুষের হাত থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য। সহসা এক আশ্চর্য ঘটনা টের পেলাম। আমার পাশে, পিছন থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ।

    যে আঘাত করেছিল— তার কোমরের অসি পড়েছিল মাটিতে। তাই তুলে নিয়ে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে কেউ, আমাকে রক্ষা করবে বলে। আড়চোখে দেখলাম । আশ্চর্য। অন্য কিশোর-কিশোরীদেরই বয়সী তো সে! হয়তো বা একটু বড়। মুখশ্রী সেরকমই সুকুমার। হাত ও পায়ের গড়ন সরু। পালকের চেয়ে লঘু দেহ। দুহাতে অসিটিকে এমনভাবে ধরে সে দাঁড়িয়েছে যাতে বোঝা যায় এই অসম যুদ্ধের ফলাফল সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। আমার মাথা যথেষ্ট ঘুরছিলো। কানে দূরাগত সঙ্গীতের ধ্বনির সঙ্গে শুনছি নিজেরই ধমনীর স্পন্দন। এসবের মধ্যেও এক অপূর্ব দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। নিজের বিপদের কথা ভুলে তার জন্যই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমাকে বাঁচাবে সে?

    সামনের তিনজন উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে তখন ছুটতে শুরু করেছে আমাদের লক্ষ্য করে। আমি আহত ও নিরস্ত্র। একটি হাত প্রায় অবশ জেনে বুঝলাম যুদ্ধের উপায় নেই। সে তবু এক পা সরেনি। যেন ভয়ের লেশমাত্র নেই। শেষমুহূর্তে আমিই দুচোখ বন্ধ করে কুলগুরুর শেখানো মায়ামন্ত্র স্মরণ করলাম। যে শক্তির কাছে দৈব-অদৈব সবই পদানত হয়েছে এতকাল।

    মুহূর্তের মধ্যে ধাবমান পুরুষরা পাথরের মূর্তির মত স্থির। এ মায়াজাল এমনই যাতে সমস্ত চরাচর হয়ে যাবে অচল। স্রোতহীন। জেগে থাকবে শুধু মন্ত্রের প্রয়োগকারী। আমি এক হাতে কাঁধ চেপে দাঁড়ালাম পথের একপাশে পাথরের দেয়ালে হেলান দিয়ে। দেখি সেও একটু সামনে ঝুঁকে, নিরাসক্ত কিন্তু উৎসুক মুখে মূর্তির মত স্তব্ধ। মুক্ত অসিটি তার দুহাতের মুঠোয়। নিষ্পলক চোখদুটি আমার দিকে ফেরানো। ভালো করে দেখলাম তাকে। বিশ্বচরাচরের কাছে যা একমুহূর্ত আমার কাছে তা অনন্তকাল।

    কাছে গিয়ে কপালে আঙুল ছোঁয়াতেই চোখের পলক পড়লো তার। আমি জিজ্ঞাসা করলাম— কে তুমি? সে কোনো উত্তর দিল না।

    আমি তার হাত থেকে অসি নিয়ে চারজন আততায়ীর কপালে আমার নিজস্ব চিহ্ন এঁকে দিলাম। আমৃত্যু শাস্তির ভয়ে এদের জীবন নরকের সমান হয়ে যাবে। আবার আমি তার কাছে ফিরে এসে প্রশ্ন করলাম— কে তুমি? পুনরায় সে উত্তর দিল না। আমি গলা থেকে একটি মাত্র অলংকার খুলে তাকে দিতে চাইলাম। সে নিঃশব্দে গ্রহণ করলো। আমি আমার ইন্দ্রজালের ক্ষমতা দিয়ে তার পথের প্রতিটি প্রাণীকে মূক ও নিশ্চল করে রাখলাম— যাতে সে নিরাপদে চলে যেতে পারে। আমি তার চলমান দেহকে উদ্দেশ্য করে দূর থেকে চেঁচিয়ে বললাম— তুমি জানো আমি কে?

    যেতে যেতে সে শেষবার ফিরে তাকালো এবং মাথা নেড়ে জানালো— হ্যাঁ।

    আরোগ্য

    বেশ কিছুদিন লেগেছিল সেবার সম্পূর্ণ সুস্থ হতে। মন্ত্রীদের চিন্তিত মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে আঘাত গুরুতর। প্রাণের আশংকা ছিল কয়েকদিন।

    কিছুদিন পরে সম্বর এসে বললো— আততায়ীদের পাওয়া গেছে। তিনজন মৃত, একজন অর্ধমৃত। যে দেবতারা নিযুক্ত করেছিলো তারাই ধরা পড়ার ভয়ে এদের বধ করতে চেয়েছিল। একজন লুকিয়ে বেঁচেছে। যদিও আগুনে পুড়ে তার চোখ দুটি নষ্ট হয়েছে।

    আমি প্রাসাদের বিশ্রামকক্ষে শুয়ে একনাগাড়ে একশো চৌদ্দ দিন ধরে একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি দেখে যেতে লাগলাম। সামনে ছুটে আসা তিনটি অস্ত্রধারী মূর্তি। আমার দুহাতে পড়ে ছটফট করা একটি লোক। পাশে, ডানদিক থেকে ঝকঝকে অসি ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। স্বপ্নভঙ্গ হবার আগের কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মুখ দেখতে পাচ্ছি। নিষ্পলক দৃষ্টি। করুণ বা নিস্পৃহ নয়। কেবল উদাসীন। আমার শরীরে শীতের পাহাড়ের মতো নেমে আসছে নিদ্রা।

    সুস্থ হবার পর ইচ্ছে ছিল একাই খুঁজবো তাকে। সকলে বাধা দিল। শুক্ল নিজে এসে বললেন— দৈব যে শিক্ষা দিচ্ছে তা গ্রহণ না করা পুরুষোচিত নয়। এখন থেকে চিরকাল দেহরক্ষী নিয়ে চলবে পথে। সকলের মানসিক অশান্তির চেয়ে এই ভালো। আমি বললাম— বেশ। বাররমণীদের গৃহ থেকে কিছু অপরূপ সুর শুনেছি সেদিন। মনে গেঁথে গেছে। কে গাইছিলো, কোথায় থাকে, এসব জানতে হবে।

    খুঁজে খুঁজে গেছি অমরাবতীর প্রতিটি প্রমোদভবনে। ঘুরেছি পাড়ায় পাড়ায়। অপরাহ্নের আলোয় তরুণ-তরুণীরা আমার সন্ধানী চোখে চোখ রেখেছে। কখনো বা ভেবেছি— এই কি সে? কিন্তু নিশ্চিত হতে পারিনি।

    তাকে খুঁজে পাইনি। কিন্তু যে পথে আক্রান্ত হই সেই পথেই অনুসন্ধান শেষ হয়েছিল আমার। উপরের খোলা বাতায়ন থেকে একটি বিদেশী রমণী হাতছানি দিয়ে ডেকেছিলো। তার স্বর্ণাভ চুল আর কালো পোষাক দেখে বুঝেছিলাম সে ডাক হেলা করার নয়। সরু সোপানশ্রেণী অতিক্রম করে ভিতরের একটি চত্বরে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেখানে জলের সুগন্ধ প্রস্রবণের পাশে পাথরের বেদীতে উপবিষ্টা সেই রমণী আমাকে তার সূচের অধিক তীব্র দৃষ্টিতে বিদ্ধ করে বলেছিলো— যাকে খুঁজছো, সে তো এখানে নেই।

    আমি বিস্মিত, অবাক। বললাম— কাউকে খুঁজছি তা বুঝলে কী করে?

    তাকে দুইটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ভাগ্যগণনা করিয়েছিলাম। সেও আমার হাত নিজের দুহাতে ধরে বলেছিলো— এইভাবে খুঁজে তো পাবে না। পাবার দিন আসেনি এখনো।

    আমি বললাম— তুমি চেনো তাকে?

    সে বললো— না। কিন্তু জানি তাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে নিজেদের সাথে। তাই খুঁজে পাওয়া কঠিন।

    আমি বললাম— ওরা মানে কারা?

    স্বর্ণাভ দুই চোখে আমাকে আপদমস্তক দেখে সে রমণী বললো— যারা তোমার মৃত্যু চায় তারা।

    আমি ছিটকে সরে গিয়েছিলাম দূরে। কিন্তু কী কারণে— হয়তো বা মন্ত্রবলে— দুই পা হঠাৎ পাথরের মত চলার শক্তিরহিত। সেই রমণী উঠে এসে আমার হাত টেনে ধরেছিল। বালকের হাত ধরার মত শান্তভাবে বলেছিল— ভয় পাচ্ছো, রাজা?

    প্রকৃতপক্ষে ভয় পাইনি। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। এই রমণীর স্বচ্ছ মায়াবী দূরদৃষ্টির আলোয় নিজের নির্বুদ্ধিতা নিজেরই কাছে উন্মোচিত হওয়ায়। মনে হয়েছিল— অন্ধ, অন্ধ আমি। এতদিন মূঢ়ের মতো কাউকে বলিনি তার কথা। ভেবেছি গোপনে খুঁজে নিতে পারবো একাই। এখন বড় বিলম্ব হয়ে গেছে।

    — আমাকেই ডাকলে কেন? সংবিৎ ফিরে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্বর্ণাভ চুলের সেই রমণীকে। — রাজপথে আর কেউ এরকম অন্ধ নয়, তাই?

    উত্তরে হেসেছিল সে। তর্জনী তুলেছিল— না তা নয়। যদিও তুমি বিত্তবান, কিন্তু তাও নয়। কী কারণ জানো? এই দ্যাখো তোমার হাতের রেখায় দেখতে দেখতে পরিবর্তন হচ্ছে। জেগে উঠেছে নতুন ভাগ্যের পথ। দেখছো?

    — তার মানে কী? আমি জানতে চেয়েছিলাম।

    — তুমি অতি ভাগ্যবান। ভাগ্যবানদের ভবিষ্যৎ গণনা করতে আমি ভালোবাসি।

    অভিলাষ

    এখন সন্ধ্যা উত্তর হয়েছে। তমসায় নিমজ্জিত হয়েছে অমরাবতী। প্রাসাদ থেকে দূরে পর্বতগাত্রের উপর একটি আভা দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হতে পারে আগুন। কিন্তু তা নয়। লাল পাথরের শিলার উপর চাঁদের রশ্মি পড়েও ওই আলো বিচ্ছুরিত হয়।

    আবার ওই আভাগুলির আশ্রয় নিয়ে কেউ যদি আলোকবর্তিকা জ্বেলে রাখে— তাও কোনো অবিনিদ্র প্রহরীর দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে। আমি প্রাসাদ থেকে বেরোবার আগে মায়ামন্ত্র ব্যবহার করেছিলাম— যাতে কেউ আমাকে দেখতে না পায়।

    সম্বরের কথা মনে পড়লো। এই অস্ত্রগুলো নতুন কিন্তু পরীক্ষিত নয়। যে কাজ গোপনে করা সম্ভব হয়নি তার বিষয়ে দেবতাদের চেয়ে সম্বরের জ্ঞান অধিক হওয়া বিচিত্র কী? বরং তাই হবে আশা করা যায়। সেনাপতিরাও কেউ চিন্তিত হয়ে নেই। যদি আমাকে সে যুদ্ধে আহ্বান করে— কারো আপত্তি হবে না তাতে।

    আমি প্রাসাদ উদ্যানের পারিজাত নয়, পথের সঙ্গী হবে ভেবে মাঠের ধার থেকে বন্য পুষ্পগুচ্ছ ছিঁড়ে নিয়েছিলাম। পর্বতশ্রেণীর মাঝখানে, যেখানে পাথরের সিংহাসনে একটি জ্বলন্ত সমিধখণ্ড আলোকিত করেছে মায়ানিদ্রিত দেবতাদের, সেখানে সে একা দাঁড়িয়েছিল উত্তরের মহান শিলাগুলির দিকে মুখ করে। বন্যপুষ্পের সুগন্ধে তার তন্দ্রা কেটে যাওয়াতে সে ফিরে তাকালো। দেখলাম তাকে কাছ থেকে। এই এক বৎসরে যেন অনেকটা বয়স বেড়েছে। ততোধিক বেড়েছে রূপ। একথাও অনস্বীকার্য আমাকে সে চিনতে পারছে চেষ্টা না করেই।

    পুষ্পগুলি সে আমার হাত থেকে নিল। এমনভাবে যেন সেও অপেক্ষায় ছিল এই সময়ের। বা যেন উভয়ের অদৃষ্টে এসব পূর্বনির্দিষ্ট। আমি তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। একবছর আগে যেখানে দেখেছি তারুণ্য, এখান সেখানেই দেখছি যৌবন। তার নিরুদ্বেগ চোখের ভিতর একটি সাগ্রহ জিজ্ঞাসা। আমি অপেক্ষা করে রইলাম সেই স্বর শোনার জন্য। অবশেষে সে মৃদু গলায় বললো— কেমন আছো, রাজন?

    আমরা পর্বতবেষ্টিত উপত্যকায় মসৃণ শিলাস্তরের উপর পা ফেলে ফেলে হাঁটছিলাম। কখনো পাশাপাশি। কখনো বা সে এক পা এগিয়ে। কখনো সে উদাস, কখনো কীসের কথা ভেবে উচ্ছসিত। তার নতুন অস্ত্রগুলি আমাকে দেখাতে উৎসুক।

    — কীভাবে দেবতাদের মন্ত্রবলে এমন গভীর ঘুম পাড়ালে? সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আমায়।

    এত অল্প সময়ে তো সব বোঝানো সম্ভব নয়। আমি তার অস্ত্রগুলি পরীক্ষা করে করে ফিরিয়ে দিতে লাগলাম তাকে। — তুমি কিছু নাও, সে বললো আমাকে। — অনেক তো আছে আমার। শ্রেষ্ঠ বলেই আমাকে নির্বাচিত করেছে ওরা। কত দিয়েছে দ্যাখো।

    — তবু যথেষ্ট নয়। আমি বললাম— মায়াবলে যদি অবশ করে দিই? স্তব্ধ করে দিই সময়ের গতি?

    সে বললো— তোমার চোখের দিকে তাকাবো না। ধ্যানমগ্ন থাকবো।

    আমি দেখলাম সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমার চোখের দিকেই। যেন এখন তার বাধা নেই।

    আমি তার অস্ত্রসম্ভার, কবচ, বর্ম সব একদিকে সরিয়ে তাকেই ভালো করে দেখি। তার চোখের দৃষ্টিতে খুঁজি সেই দুর্লভ সংকেত। বোঝার চেষ্টা করি— সে কি প্রস্তুত?

    সে হঠাৎ লজ্জা পেয়ে হাসে।

    — কী দেখছো?

    অস্ত্র নয়, মন্ত্র নয়, মায়াবলও নয়। জয়ের মূলে যে শক্তি তা হল কামনার। অভিলাষের। যা দেবতারা প্রদান করতে পারে না— তাহলে তো তারা নিজেরাই--। যা নিজেকে খুঁজে বের করতে হয় নিজেরই গভীরে। বার বার তুলে আনতে হয়। সমরে ও সমরের আগে। যুযুধান দুই রথীকে সেই অভিলাষ বেঁধে রাখে আমৃত্যু সংগ্রামে।

    সে কি প্রস্তুত? তাকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে আমার বাধছিল। তাই আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

    — কাল যদি জয়ী না হতে পারি? সে কৌতুক করে বলে ওঠে। আমি দুচোখ বন্ধ করে ফেলি। হঠাৎ বুকের কাছে পাই তার নিঃশ্বাস। মুখে, ঠোঁটের নীচভাগে অনুভব করি দংশনের আঘাত। মনে হয় নিয়মিত দেখা স্বপ্নের মত তার নিষ্পলক দৃষ্টির সামনে আমার শরীরে আবার নেমে আসছে শীতের পাহাড়ের গভীর ক্লান্তি। আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই— কে তুমি? কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা করি না।

    ঊষা

    কাল মধ্যরাতে কারা এই সংকেতলিপি ফেলে গেছে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে। আমি তখন ঘরে ছিলাম না। প্রাক্‌-ঊষার শিশিরপথে পা দিয়ে শুক্ল দেখতে পেয়ে তুলে এনেছিলেন। ততক্ষণে ফিরে এসেছি আমি। সম্বর তখনই আমার কক্ষে এসে আমাকে সংবাদ দিল। যুদ্ধের বার্তা। আমার শান্ত অবিচলিত আচরণে আশ্বস্ত হয়ে সে ততোধিক দ্রুতবেগে নিষ্ক্রান্ত হল অন্য আয়োজন করতে।

    সমরের আগে দেবতারা প্রচুর সুরাপান করে থাকে। অসুরগণও তাই আরম্ভ করেছে আজকাল। আমি কেবল একদণ্ড ধ্যান করি। শুক্ল একটি শীতল মন্ত্রোদক তৈরী করে রাখেন আমার জন্য।

    ঋক্‌গুলি বেজে চলেছে কোথাও। চরাচরের স্পন্দনে স্পন্দনে। সবাই কি শুনতে পাচ্ছে তো? নাকি তা শুধু আমারই কানের জন্য?

    অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরামাহ
    মাদিত্যৈরুত সিশ্বদৈবৈ:।
    অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্মাহ
    মিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা।।

    আমি কি জানি তুমি কে? তুমি একাদশ রদ্র, অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং সকল দেবতা। তুমিই মিত্র এবং বরুণ। ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়। তুমি সোম, তুমি ত্বষ্টা। তুমি পূষ্য ও ভগ। তুমি সমস্ত যজ্ঞের ফল এবং কামনা। যজ্ঞার্হগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

    আমি এক মায়াবী রাজা। ব্রহ্মার বরে অবিজিত। ঋক্‌মন্ত্রে আমার পরিচয় উচ্চারিত হয় না। আমার হস্তরেখা ভ্রাম্যমান। আমি বান্ধব ও প্রজাবৃন্দ দ্বারা পরিবৃত ও তাদের অশেষ স্নেহের লক্ষ্য। আমি অসুর।

    পর্বতসমূহের মাঝে একটি আলোকছটা। সকলের সঙ্গে আমিও গিয়ে দেখেছি। দূর থেকেও তার উজ্জ্বলতায় সবিতৃর আভা ম্লান হয়ে গেছে। সেই প্রভূত রশ্মি বিকীরণের মধ্যে আমি তোমাকে কল্পনা করতে পারছি। তোমাকে শুনতে ও স্পর্শ করতে পারছি। যা অন্য দেবতা, অসুর ও প্রাণীসমূহের পক্ষে সম্ভব নয় আমি দেখেছি মায়াবলে। আমিই জানি। আমিই দ্রষ্টা।

    ময়া সো অনুমতি যো বিপশ্যতি
    য: প্রানিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্‌
    অমন্তবো মাং ত উপক্ষিয়ন্তি
    শ্রুধি শ্রুত শ্রুদ্ধিং তে বদামি।।

    অহং রুদ্রায় ধনুরাতনোমি
    ব্রহ্মাদিষে শরবে হন্তবা উ
    অহং জনায় সমদং কৃণোমাহং
    দ্যাবা পৃথিবী আবিবেশ।।

    অহং সুবে পিতরমন্য মূর্ধণ্‌
    মম যোনিরপনবন্ত: সমুদ্রে।
    ততো বিবিধে ভুবনানু যিস্বো—
    তামুং দ্যাং বর্ন্নণোপরস্পৃশামি।।

    তোমার শক্তিতে আহার ও দর্শন করে প্রাণীগণ, শ্বাস প্রশ্বাসাদি নির্বাহ করে এবং শ্রবণ করে। তুমিই ইচ্ছামত সর্বশ্রেষ্ঠ, ব্রহ্মা, ঋষি এবং ব্রহ্মামেধাবান করো। রুদ্রের ধনুকে তুমি জ্যাসংযুক্ত করো। স্বর্গ ও পৃথিবীতে অন্তর্যামীরূপে প্রবেশ করে তুমিই যুদ্ধদান করো। তুমিই সর্বাধারের উপর দ্যুলোককে প্রসব করেছো। তুমি মায়াময় দেহে সমগ্র দ্যুলোকে পরিব্যাপ্ত আছো।

    তুমিই ভূবাদি সমস্ত লোকে সর্বভূত সৃষ্টি করে বায়ুর মত স্বচ্ছন্দে তাদের অন্তরে ও বাইরে সর্বত্র বিচরণ করো। যদিও স্বরূপতঃ তুমি এই আকাশের অতীত ও পৃথিবীর উপরে এবং অসঙ্গ-ব্রহ্মাস্বরূপ, তবুও স্বীয় মহিমায় এই সমগ্র জগৎরূপ ধারণ করতে সক্ষম।

    বন্ধু সম্বর, কুলপুরোহিত শুক্ল, মিত্র ও সভাসদগণকে আমি আলিঙ্গন করছি। আমার নির্জন চিন্তা ও ধ্যানের সময়টি অতীত। আমি মায়াবল বিস্তার করতে আরম্ভ করেছি যাতে সমস্ত দ্যাবা পৃথিবী মূক, বধির ও দৃষ্টিহীন হয়। আমি অসুর, দেব ও মানবগণকে নিশ্চল ও চিন্তার গতিকে রুদ্ধ করেছি ইন্দ্রজালে। তাদের শ্বাস, প্রশ্বাস, শ্রবণ ও ঋষিসূক্তের মধ্যে আমি এই মন্ত্র প্রবাহিত করে দিই যাতে তা কীর্তিমান ও উপযুক্ত হবি: দ্বারা উপাসকগণের মধ্যে ধৃত ও ধারক হয়। আমি তাকে অভিলাষ, কামনা ও অবিজিত রাজনের কন্যা এবং মায়াযুদ্ধের সঙ্গীরূপে কল্পনা করে গতিমান, তেজস্বী ও সর্বগামী করি।

    সকলে যখন নির্বাক ও নিশ্চল তখনও আমি মন্ত্রগুলিতে আবিষ্ট ছিলাম। ছিলাম সমরের জন্য প্রস্তুত।

    অহমেব বাত ঈব প্রবাস্যা
    রভমানা ভুবনানি বিশ্বা।
    পরো দিবা পর এবা পৃথিবৈ:
    তাবতী মহিমা সংবভূব।।

    আমি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আমার প্রিয় যোদ্ধারূপে অবলম্বন করছি। ঊষার আলোয় ভেসে যাচ্ছে যখন সম্মুখের ভূমি। আমি মায়াবলে একটি মহিষের আকৃতি ধারণ করবো বলে বন্ধ করেছি দুচোখ।



    অলংকরণ (Artwork) : ভাস্কর সরকার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments