সে অনেককাল আগের কথা। তখন হুগলীর বাউলপাড়ায় সদ্য সদ্য ইলেক্ট্রিসিটি এসেছে। তবে শুধু বাবুলোকদের ঘরেই। আর রাস্তাঘাটের মোড়ে মোড়ে ইলেকট্রিক পোস্টে আলো। সন্ধ্যে হলেই শুনশান। এরকম এক জ্যৈষ্ঠের সন্ধ্যেতে বাউলপাড়ার বড়কালীর মোড়ে খেতিবাবুর বাগানের পাঁচিলের ধারে দুটো ছোকরার ফিসফিস শোনা গেল।
‘এই ভোম্বল! এ নে! জালটা ধর!’
‘দে। তুই ওঠ্ এবার পাঁচিলে।’
‘এই না না! তুই একাই জাল ফেলে গোটা কতক মাছ ধরে পাইলে আয় ভাই।’
‘কেন? একা হবেনেকো?’
‘আরে খৈনিকা আমায় চিনে ফেলবে। বাবা ওর কাছে কাজ করে।’
‘এই! আয়! আমি একা মরবুনি...!’
‘আস্তে আস্তে!...তুই লাফ্ দে ওপারে। তারপর যাচ্ছি।’
ওপারে লাফ দিতে গিয়ে জনৈক ভোম্বল এক আছাড় খেলো।
‘উই মা! ওফ!’
আওয়াজ শুনেই খেতিবাবু হেরিকেন হাতে বেরিয়ে এলেন।
‘অ্যই অ্যই! কে র্য! আবার এয়েছিস চুরি করতে! থাম! থাম!’
ততক্ষণে দুজনে চম্পট দিয়েছে।
ক্ষিতিমান মুখার্জীকে গ্রামের সবাই খেতি মুখুজ্জে বলেই চেনে। তাই পাড়ার চ্যাং ফচকে ছেলেদের কাছে খৈনিকা নামটাই ইদানিং বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। আসলে ওনার কারখানায় তৈরী 'ক্ষিতি' ব্রান্ডের খৈনির আগে বেশ সুনাম ছিল। তবে এখন তো আর ছেলেপুলেরা সেরকম খৈনি খায় না, তাই ব্যবসাটা একটু পড়ে গিয়েছে। তাতে আদতে কিছু এসে যায় না যদিও। বাংলার এক একটা জমিদার বংশ ইংরেজ আমলে জুলুম করে যা কামিয়েছে তা ভাঙিয়ে খেতি মুখুজ্জের এখনো চার-পাঁচ পুরুষ চলে যেত। বাউলপাড়াতে যদিও আর মুখুজ্জে বাড়ির কেউ থাকে না। বেশিরভাগই কলকাতায়। শুধু প্রতি বছর, রীতি মেনে, পৌষপাব্বনের দিন সবাই এসে জড়ো হয়। ওই কারখানা, গা ছমছমে ফাঁকা পুরোনো আমলের বানানো এক বাড়ি, এবং লাগোয়া এক বিরাট বাগান আগলে খেতিবাবু পড়ে আছেন এই গ্রামেই। কম বয়সেই বিয়ে, কিন্তু বিয়ের দু’বছরের মাথায় বউ ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন ছেলেমেয়ে হওয়ার আগেই। আর বিয়ে করেননি। বহুকাল থেকেই পাড়ার তুতুন মাসি রোজ এসে ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে একবেলা রান্না করে দিয়ে যান। খেতিবাবু পাড়ার চায়ের দোকানে প্রায় নিয়ম করে নিজের উচ্চ বংশের অতিমাত্রিক ইতিহাস তুলে ধরেন, আর তারপর কোনো না কোনো খদ্দেরের কাছ থেকে বিড়ি ধার করেন আর দোকানদারকে বলেন চায়ের দাম খাতায় লিখে রাখতে। দোকানদার অবশ্যি বামুন সেবা করছেন এইটুকু সান্ত্বনা নিয়ে চায়ের কাপের হিসেব রাখা ছেড়েই দিয়েছেন।
তা খেতিবাবুর বাগানের মধ্যে বারোটি নারকেল গাছ, চারটে আম গাছ, ছয় সাতেক জাম গাছ, আর মেহগনি, শাল গাছ একটা করে আছে। আর তিনটে পুকুরে মাছ চাষ করান। ওনার বাড়ি থেকে বাগান একটু তফাতে। বাগানের চারপাশে ইয়া বড়ো পাঁচিল থাকলেও ছোটখাটো চুরি লেগেই থাকে। সন্ধ্যে হলেই বাগানে উৎপাত। চুরি হয় বলতে মাছ, আর ছেলেপুলেরা মাঝে মধ্যেই একটু পাঁচিল টপকে ফলমূল নিয়ে পালায় আর কি। তবে খেতিবাবুর আরেক মাথাব্যথা হলো পাঁচিলের ধারে হওয়া দুটো কাঁঠাল গাছকে নিয়ে। বড় সাধের এই গাছদুটি। বছর সাতেক আগে মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরের কাছ থেকে চল্লিশ টাকা দিয়ে দুটি কাঁঠাল কিনেছিলেন। আহা! সে স্বাদ যেন ওনার মুখে এখনো লেগে। এরকম মিষ্টি কাঁঠাল কপাল করে জোটে। সবকটা দানা মাটিতে যত্ন করে পুঁতেছিলেন। সেই সবের থেকে এই দুটো গাছ হয়েছে। লোকে বললে এটা নাকি বারোমাসি কাঁঠাল। দুটো গাছই বেঁকে পাঁচিলের গা বেয়ে নেমে গেছে। যেন সে কোনো বদ্ধ সীমানায় থাকতে চায় না। একটু হাত বাড়ালেই একটা মোটা ডালের নাগাল পাওয়া যায়। যখন কচি কাঁঠাল ধরে, খেতিবাবুর মায়াপুরের পাকা কাঁঠালের সেই স্বাদ মনে পড়ে। খেতিবাবু প্রতিদিন দেখে আসেন কাঁঠাল কালকের থেকে আজকে কতটা বাড়ল, কতটা পাক ধরল। মাঝে মধ্যে দুটো ডাল বেয়ে কাঁঠালগুলোকে হাত বুলিয়ে পরম স্নেহে আদর করেন। তারপর একদিন দেখেন যে কাঁঠাল উধাও। তাই খেতিবাবুর নজরদারি শুরু হলো। কিন্তু তাতে সুবিধে করতে পারছেন না। ফল ধরছে কিন্তু ঘরে ঢুকছে না। তা ছাড়া মাছ চুরিরও একটা বিহিত করতে পারছেন না। ইতিমধ্যে একদিন বিকালে দোকান থেকে চা খেয়ে ফেরার সময় দেখেন যে দুটো স্কুলের ছেলে ওই গাছে ওঠার চেষ্টা করছে। দৌড়ে গিয়ে ধরার আগেই সাইকেলে করে কাঁঠাল নিয়ে হাপিশ।
‘ইস্! এটটুনির জন্যে বেটারা ফসকে গেল!’
এর এক-দেড় সপ্তাহ পরে একদিন চায়ের দোকানে বসে খেতিবাবু গালগল্প সাঁটাচ্ছেন, এইসময় দুটো স্কুলের ছেলে চায়ের দোকানে এল।
‘কাকু শেঠের লালসুতো বাঁধা বিড়ি এক প্যাকেট দাওতো!’
শুনে খেতিবাবু বললেন,
‘আই! আই! তোরা কিসে পড়িস রে?’
‘সেভেন।’
‘বাপের কষ্টের টাকায় বিড়ি খাচ্ছিস! ছ্যাঃ!’
‘কেন তোমার বাপের টাকায় কিনছি নাকি?’
ছেলেগুলো দাঁত বের করে সাইকেলে চড়ে বসল। ছেলেটার পাকা মুখে আলতো বজ্জাতে হাসি দেখে কি কারণে যেন খেতিবাবুর খুব অস্বস্তি হলো। মনে হলো যেন ছেলেটি তার জন্মজন্মান্তর ধরে হাড়পিত্তি জ্বালাচ্ছে। কিন্তু কোথায় দেখেছেন ঠাওর করতে পারছেন না।
‘আই! আই! তোকে...তোদেরকে কোথায় যেন দেখছি মনে হয়!’
এক হিমেল স্ফুলিঙ্গ যেন শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। আরে, এটাই তো সেই আগের দিনের ফস্কে যাওয়া কাঁঠাল চোর!
‘দাঁড়া! থাম! তুই আমার পাঁচিলে উঠেছিলি না পরশু? থাম! দাঁড়া! দাঁড়া বলছি! নইলে...নইলে...'
তারা আর দাঁড়ায়!
এর পর বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। আবার ওই বারোমাসি কাঁঠাল গাছে কাঁঠালে পাক ধরেছে আর সাথে খেতিবাবুর চিন্তাতেও। একদিন রাত দুটো নাগাদ খেতিবাবুর এক নম্বর পেল। ধুতির কাছাটা বেঁধে আর পৈতে কানে জড়িয়ে খালি গায়ে বের হলেন বাগান বাড়ির কোণের দিকে। অদ্যিকালের অভ্যাস। তাছাড়া শৌচালয় ভর্তি হলেও পয়সা দিয়ে পরিষ্কার করতে হয় কি না। টর্চও নিলেন না। খামোকা চাঁদনি রাতে আলোর ব্যাটারি পোড়াবেন কেন? যাই হোক। শান্তিতেই কাজ সেরে ফেরার আগে একবার তুলসীতলার শিব ঠাকুরের ছোট্ট মন্দিরের দিকে দুহাত জোড় করে ‘জয় জয় শিবশম্ভু!’ বললেন। তখনই পাঁচিলের দিক থেকে বিকট আওয়াজ!
‘ওরে বাবারে! বাঁচাও! ভূত!! খেয়ে ফেল্লে রে!’
খেতিবাবুও প্রথমে হকচকিয়ে গেলেন। তারপর সাহস করে কাঁঠাল ডালে পা দিয়ে উঠে পাঁচিলের ওপরের পরিস্থিতি দেখতে চাইলেন। দুটো ছেলে উদাম্ ছুটছে। এটুকুই আবছায়া বোঝা গেল আর কি।
‘কিছু দেখল নাকি এরা!!’
খেতিবাবু তার পৈতে হাতে চেপে ধরে ‘রাম রাম রাম….হনুমান জি আমার পুত…না না... ভূত আমার পুত! আমার ঝি! ধুত্যের!" এই সব বিড়বিড় করতে করতে ছুটে ঘরে ঢুকে শিকল টেনে দিলেন। তারপর ঘরের সমস্ত আলো জ্বেলে গরমের মধ্যেও নিজে বিছানার চাদরের নীচে ঢুকে পড়লেন যাতে ভূত এলে না দেখতে পায়। পৈতে ধরে ‘রাম রাম রাম রাম’ জপতে জপতে ঘুমিয়ে পড়লেন। তবে সকালে উঠে খুব আফসোস। ইস্! ভূত আবার আছে নাকি! কারেন্টের বিল বাস্তব। বোকামির জন্য কম করে পাঁচ টাকা গেল বোধ হয়। নিমপাতার দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পাঁচিলের চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করলেন। বেটারা এত রাতে এসেছিলো কি ধান্ধায়? চুরি নয় তো! বুক ধড়াস্ করে উঠল! চারদিক তাড়াতাড়ি দেখে নিলেন।
কিন্তু খেতিবাবুর বাগানে ভূত দেখার ব্যাপারটা কিভাবে যেন চাউর হয়ে গেল। সেই ঘটনার দিন তিনেক বাদে তুতুন মাসি সকালে সাবধান করে দিলেন খেতিবাবুকে। বাগানে নাকি এক বেম্ভদৈতির আগমন হয়েছে। সে নাকি নিশীথ রাতে খালি গায়ে ধুতি পরে শিব পুজো করে। খেতিবাবুর কাছে ব্যাপারটা এবার স্পষ্ট। ব্যাটারা তাহলে তাকেই দেখে ভূত ভেবেছে। ইতিমধ্যে, গ্রামে নাকি কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে যে মালতির মা নাকি খেতিবাবুর বাগানে ভরদুপুরে ব্রহ্মদৈত্যিকে গাছে চড়তে দেখেছে। তুকতাক জানা গ্রামের একমাত্র বিপুল বুড়ো ব্রহ্মদৈত্য-প্রতিরোধক মাদুলি বিক্রিও শুরু করেছে। তার তিন ধরনের প্যাকেজ--১৫ টাকা, ২৫ টাকা এবং ৫০ টাকা। ১৫ টাকার মাদুলিতে তিন মাস পর্যন্ত রক্ষে পাওয়া যাবে আর তারপর নতুন মাদুলি লাগবে। ২৫ টাকার মাদুলির লাইফ-টাইম ভ্যালিডিটি। আর ৫০এর মাদুলিতে ব্রহ্মদত্যি প্রসন্ন হবে এবং ধন-কড়ি পাইয়েও দিতে পারেন। বিপুল বুড়োর মতে ব্রহ্মদত্যি আদলে খুব ধার্মিক ভূত। শিবভক্ত ব্রাহ্মণ মরলেই ব্রহ্মদত্যি হয়তো, তাই। তাই সে এখনো গভীর রাতে নিজে শিবের পূজা-অর্চনা করে। তবে তার নিয়ম নিষ্ঠা খুব ভয়ঙ্কর। সে যেখানে থাকে সেই জায়গা যদি কেউ ইয়ে টিয়ে করে অপবিত্র কেউ করেছে তাহলে তার আর রক্ষে নেই। সেদিন রাতেই তার ঘাড় মটকায়! আবার প্রসন্ন হলে টাকাপয়সা বকশিসও নাকি পাইয়ে দেয়। ব্রহ্মদত্যি সব গাছে থাকে না। এই খেতিবাবুর বাগানে সে বোধ হয় মিষ্টি আম বা কাঁঠালের গাছে বাসা বেঁধেছে।
পাড়ার লোকজন কয়েকদিনের মধ্যে এসে হাজির। তারা দাবি করে বাগানে শিবস্বস্ত্যেন করে অশরীরী বিতাড়ন করতে হবে। খেতিবাবু মুচকি হেসে বলেন,
'বুঝলে ভাই! এ বেম্ভদৈত্য নিঘ্ঘাত আমার আগের-পুরুষের কেউ। তাড়াই কোন মুখে বলো দিকি। যদি পাপ হয়?’
খেতিবাবু যুক্তি দেন যে একান্ত ওনার বা সেই অশরীরীর অনিষ্ট না করতে এলে সে কারো অপকার করবে না। সে নিয়মনিষ্ঠাবান শিবভক্ত ভূত।
এর পর খেতিবাবু একটু ভেবে বললেন, ‘তবে সে আবার পাপ বেনিয়মও দেখতে পারে না শুনিচি। বাগানে ফলমূল চুরি করতে যারা আসে তাদেরই একটু বিপদ আর কি।’
খেতিবাবু এবার পল্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ রে পল্টু, তোর দোকানে যে ছেলেটা ছাঁচের মূর্তি বানায় সে দেওয়াল টাওয়ালেও আঁকা আঁকি করে না রে?'
'হ্যাঁ। মাধব।'
'ওকে কাল দেওয়াল আঁকার রংটং দিয়ে পাঠিয়ে দিস তো। লোকজনকে এট্টু সাবধান করে দিতে হবে বইকি।’
'হ্যাঁ। মানে…দাম...'
'কি? একটুকুন রং দিতে এত ভাবতে হয়? কিপ্টামোও একখান্ পাপ জানিস? আর পাড়ার লোকেদের বাঁচাতে চাস কি না বল?’
পরের দিন মাধবকে আচ্ছা করে ইন্সট্রাকশন্ দিয়ে বাগানের পাঁচিলে ছবি আঁকালেন। একটা পৈতে-পরা গোপাল ভাঁড় গোছের লোক তার ঠোঁটের কোণের দুটো রাক্ষুসে দাঁতের মাঝে স্মিত হাসি নিয়ে একটা হাফ প্যান্ট পরা কাঁধে ব্যাগ নেওয়া হাড় গিলগিলে ছেলের ঘাড় পরম আনন্দে মটকাচ্ছে। সঙ্গে লেখা 'সাবধান! এইখানে শ্রী শ্রী বেহ্মদৈত্যি ঠাকুরমশায়ের আবাস।'
ব্যাস! এর পর থেকে কেউ আর পাঁচিলের কাছেই যায় না। মাছ চুরি সামলানোর বালাই নেই আর। দুটো কাঁঠাল গাছে একসাথে সাত সাতটা কাঁঠালে পাক ধরল। কিছুদিন পর তারমধ্যে থেকে সবচেয়ে সুদর্শন কাঁঠাল পেড়ে পরম যত্নে শৈল্পিক সত্ত্বায় ছাড়ালেন। লালচে হলুদ রং খেতিবাবুর মন উদ্ভাসিত করল। সেই মায়াপুরের স্বাদ মনে পড়ল। একবার ইসকনের রাধা-কৃষ্ণকে স্মরণ করে একটি মুখে পুরলেন।
‘এ্য এ্য! ইস! কি টক্! ধ্যুত্যেরি!’