বাসে উঠেই সমরবাবু টের পেলেন আজ বেশ ভিড়। অফিস টাইম পার হয়ে গেছে, এই সময় বাসে এত ভিড় হবে ভাবেননি। পুরনো দিনের মতো কনুই দিয়ে ঠেলে, নিজেকে সাইড করে, কিছুটা ধাক্কাধাক্কি করে, নিজের বুকেও কয়েকটা ধাক্কা খেয়ে সিনিয়র সিটিজেনের নির্দিষ্ট সিটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন একটি অল্পবয়সী মেয়ে বসে আছে সেই সিটে। বেশ মিষ্টি দেখতে, মায়াময় চোখ দুটো চেয়ে আছে জানলার বাইরে। বহু বছর আগে যেভাবে লহমা বসে থাকতো জানলার দিকে তাকিয়ে। যদিও তিনি জানতেন যে তাকে দেখেই ঘাড় ঘুরিয়ে বসে থাকত লহমা। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন তিনি। সময়ের সঙ্গে অত পিছনে গিয়ে বর্তমানে ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগলো তাঁর। আর সেই দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়েই পিছন থেকে তাঁকে জোরে ধাক্কা মেরে গাঁট্টাগোট্টা এক ভদ্রলোক সামনে এসে মেয়েটিকে বললেন, ‘সিট ছাড়তে হবে, আমি সিনিয়র সিটিজেন।’
মেয়েটি সলজ্জ হেসে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আর ভদ্রলোক নিজেকে আলুর বস্তার মত ফেলে দিলেন সিটের উপরে। আর বসেই চোখ বুজে ফেলে নানা রকম মুখভঙ্গি করতে লাগলেন। যেন কোমর-সহ তাঁর সর্বাঙ্গে ব্যথা। ভদ্রলোক যে কোন এঙ্গেলে সিনিয়র সিটিজেন, সেটা বোঝা গেল না। সমরবাবুকে দেখতে এনার থেকে অনেকটাই বয়স্ক, কিন্তু আগে এসেও নিজের বসার কথা বলতে পারলেন না বলে সিটটা মিস করলেন। কি আর করা এভাবেই গড়িমসি করে জীবনে অনেক কিছু মিস করেছেন আর কষ্ট পেয়েছেন তিনি। ভিড়ে ধাক্কা খেয়ে তাঁর বুকের পাঁজরেও বেশ ব্যথা করছে। রাগও হচ্ছে বেশ। এভাবেই টনটনে পাঁজর নিয়ে কিছুক্ষণ পরে আবার ভিড় ঠেলে রুবির মোড়ে নেমে পড়লেন তিনি।
বছর দুয়েক হল অবসর গ্রহণ করে কর্মস্থল থেকে নিজের শহরে ফিরেছেন সমরবাবু। ফ্ল্যাটটা এখানে আগেই নেওয়া ছিল। ইন্টিরিয়ারের কাজ করিয়ে সেখানেই ঢুকে পড়েছিলেন সস্ত্রীক। ছেলেমেয়েরা এখন যার যার নিজের কর্মস্থলে থিতু।
ভেবেছিলেন অবসরের পর নিজের মতো করে সময় কাটাবেন। কিন্তু হাট, বাজার, ডাক্তার, বদ্যি, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, ইনকাম ট্যাক্স এত্তসব করতে করতেই দেখলেন সময় হাতের আঁজলা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও অসংখ্য প্রমোশনাল ফোন তো নিত্যদিনের ব্যাপার। সময় নষ্ট, আর বিরক্তির উদ্রেকও হয়। এর মধ্যে আবার সাইবার ফ্রডের পাল্লায় পড়ে দু-এক বার কিছু টাকাপয়সাও খুইয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে একেবারে ‘ত্রাহি মাম’ অবস্থা। বেড়াতে গিয়েছিলেন কয়েক জায়গায়। কিছুটা হাঁফ ছাড়ার সময় পেলেও একেবারে নিজের মতো প্রতিটি পল যাপন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এরই মধ্যে একদিন বাৎসরিক মেডিকেল চেক আপ করাবার পর ডাক্তার বললেন ‘সমরবাবু, আপনার রিপোর্ট দেখে কিছু খটকা লাগছে। হৃদযন্ত্রের আরও কিছু ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে।’ নিজের ইচ্ছে না থাকলেও বাড়ির চাপে করালেন নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। আজ সমস্ত রিপোর্ট পাওয়া যাবে। নিজেই বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
বিজ্ঞাপনটা সোশাল মিডিয়ায় আগেই দেখেছিলেন - ‘অন্য জীবন’ – ‘যারা জীবনের দৌড়ে ক্লান্ত, অথচ নিজের মত করে আনন্দে বাঁচতে চান, তারা চলে আসুন ‘অন্য জীবনে’র স্বাদ পেতে- ইত্যাদি ইত্যাদি।’ হসপিটালে না গিয়ে একেবারে উল্টো দিকের বাসেই উঠে পড়লেন তিনি।
রুবি থেকে বাসে ঘটকপুকুর, সেখান থেকে ভ্যানে ঘন্টাখানেক, তারপর হেঁটে প্রায় আধাঘন্টার পথ পার করে এই বাড়িটার হদিশ পেলেন তিনি। বিজ্ঞাপনের পথনির্দেশ অনুযায়ী বাড়িটাতে পৌঁছতে অসুবিধা হয়নি বিশেষ। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে ঢুকে পড়লেন বহু পুরোনো এই বিশাল বাড়িটাতে।
গেট দিয়ে ঢুকে একটা বড় বড় ঘাসওয়ালা মাঠ পেরিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইট বের করা বাড়িটা। একসময়ের জমিদার বাড়ি বলেই মনে হল। ঠাটবাট মনে হয় যথেষ্টই ছিল। রেজিস্ট্রেশনের মেয়েটি বেশ সুন্দরী। একটা খিলানওয়ালা বারান্দার এক কোণে একটা সেগুন কাঠের টেবিল নিয়ে বসে রয়েছে সে। বুঝলেন বিজ্ঞাপন দেখে বহু নারী-পুরুষ এসেছে এখানে। দেখে মনে হচ্ছে তারা বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। ভিতরের আলোতে পুরুষদের সৌম্যদর্শন ও মহিলাদের সকলকেই বেশ লাবণ্যময়ী মনে হচ্ছে।
একজন লাবণ্যময়ী মিষ্টি স্বরে বললেন ‘আপনারা সবাই লাইনে দাঁড়ান। তাহলে মিঠুর রেজিস্ট্রেশনের সুবিধা হবে।’ সমরবাবু বুঝতে পারলেন না যে ইনি নাম লেখাতে এসেছেন নাকি ব্যবস্থাপনায় আছেন। লাইনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই অবশ্য সমরবাবুর টার্ন এসে গেল। মিঠুর মিষ্টি হাসি দেখতে দেখতে নাম ঠিকানা লিখে ও সইসাবুদ করে রেজিস্ট্রেশন কিট পাওয়া গেল। কিট বলতে দু-সেট পায়জামা পাঞ্জাবি, একটা হাতে বোনা গামছা, আর একটা হাতপাখা। বলা হল, পরে আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া হবে।
একটা বড় হলঘরে সবাই বসার পরে শুনলেন যে এখানে একজন বক্তব্য রাখবেন। ঘরে ফ্যান নেই। আলোর ব্যবস্থাও আছে কিনা বোঝা গেল না। ঘর খোলামেলা বলে এই বসন্ত শেষেও বিশেষ গরম লাগছিল না। এরমধ্যে একজন ভীষণ সপ্রতিভ বয়স্ক মানুষ সামনে এলেন। পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল--তিনি ‘সুপ্রতিম বোস।’ কোনো বড় কোম্পানির সিইও ছিলেন একসময়। সবকিছু পিছনে ফেলে এখন তিনি ‘অন্য জীবনে’র ধারক ও বাহক। উনি নিজের বক্তৃতায় বললেন ‘জীবনের তিন ভাগের দুই ভাগ আমরা সকলেই যাপন করেছি সফল ভাবে। প্রথম ভাগে শিক্ষার্জন সমাপ্ত করে, দ্বিতীয় ভাগে কর্মজীবন সাঙ্গ করে এবার শুরু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় ভাগ। সেটা হল নিজের মতো করে নিজের শর্তে বাঁচা। প্রকৃতির থেকে এতদিন নেওয়ার পরে এবার তার কিছু ঋণ শোধ করা। এখানে মোবাইল, ল্যাপটপ সবই দূরে থাকবে। কোন ওষুধপত্রও আপনাদের কাছে থাকবে না। এখানে হবে শুধু নিজের মত বেড়ানো, আনন্দ করা আর নিজের সঙ্গে খেলা। আনন্দম, আনন্দম।’
পরদিন ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে বাড়িটার পিছনে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল সমরবাবুর। এত সুন্দর একটা আম বাগান এখানে আছে বোঝেননি কাল। গাছে গাছে মুকুল এসেছে। ছোটবেলায় বসিরহাটে মামাবাড়ির আম বাগানের কথা মনে পড়ল। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে, পাখি ডাকছে, সূর্য উঠছে, চারিদিকে আলো হচ্ছে। পুরো শিশুপাঠ্যের ছবির মত। বহুদিন এরকম সকাল দেখেননি। কী পাখি ডাকছে চিনতে পারলেন না। কাল সুপ্রতিমবাবু বলেছিলেন, ‘আসল জীবন তখনই শুরু হয়, যখন মানুষ বোঝে যে জীবনের বেশিরভাগ সময় ইতিমধ্যেই চলে গেছে। আয়ুর সীমানা কেউ জানে না। তাই তখন শুরু হয় জীবনকে চেটেপুটে খাওয়ার দিন।’
পিছনে কার পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দেখলেন কালকের সেই লাবণ্যময়ী, পায়ে খড়ম ও ঘরোয়াভাবে শাড়ি পরে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। খোলা চুল পিঠের উপর ছড়ানো, হাতে ফুলে-ভরা সাজি। উনি বললেন, ‘এই যে বেরিয়ে পড়েছেন দেখছি, ওপাশে একটা সুন্দর ফুলের বাগান আছে দেখে আসতে পারেন।’
একটু বেশিই লাবণ্য যেন ঝরে পড়ছে আজ ওঁর শরীর থেকে। ভদ্রমহিলা কথা বলার সময় সুন্দর ভ্রুভঙ্গি করেন। একটা লাইন হঠাৎই হৃদয়ে বুড়বুড়ি কাটতে লাগল। ‘ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে।’ অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি নিয়ে লাইনটা মনে মনে বলতে বলতে ফুলের বাগানের দিকে চললেন তিনি। এই বাগানের পিছনে একটা বড় ঝোপের আড়ালে একটা ছোট্ট টিনের চালাঘর দেখে সেদিকেই আকর্ষিত হলেন। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। হালকা করাঘাত করতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন কালকের বাসের সেই গাঁট্টাগোট্টা মানুষটা। ইনিও এখানে এসেছেন? বেশ অবাক লাগল।
এখানকার পায়জামা-পাঞ্জাবিতে বেশ মানিয়েছে ওকে। উনিও এখানে সমরবাবুকে দেখেই বললেন, ‘আপনাকে কাল বাসে ধাক্কা দেওয়াতে খুবই দুঃখিত দাদা। কিছু মনে করবেন না।।’ সমরবাবু বুঝলেন এখানকার পরিবেশই মানুষকে এমন নমনীয় করে তোলে। মুখে বললেন, ‘না না এ তো ‘অন্য জীবন’, এখানে অতীতের কথা ভুলতে হয়।’
মাথার উপরে সূর্যটা আকাশের প্রায় সিকিভাগ এগিয়েছে। বেশ গরম। কিছুক্ষণ হেঁটে তিনি আমবাগান পিছনে রেখে চলে এলেন এক ধু-ধু প্রান্তরে। এখানকার দিক নির্দেশে দেখেছেন, এটাকে বলে ‘তেপান্তরের মাঠ।’ এই মাঠের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চলে এলেন। দূরে একলা বটগাছের নিচে একটা চায়ের দোকান। জনা দুই হাটুরে মানুষ সেই দোকানে বসে চা খাচ্ছে। তাকে দেখে দোকানদার পিছনের ঝুপড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। চা খেলেন সমরবাবু। অপূর্ব স্বাদ। কোথায় লাগে তাঁর এতদিনের মকাইবাড়ি। হাওয়া দিচ্ছে একটু একটু, ক্লান্তি মুছে গেল।
‘বাবু এখানে একটা সুন্দর দীঘি আছে পশ্চিম দিকে। দেখতে যেতে পারেন,’ কথায় কথায় চা-ওয়ালা জানালো, ‘অনেক পাখি আসে।’ চা শেষ করে ফিরবেন বলে ভাবছিলেন সমরবাবু, কী মনে হওয়াতে দীঘির উদ্দেশ্যে চলতে লাগলেন। পথে হঠাৎ নজরে পড়ল একটা ছোট্ট নীল পাখি মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। একটু জল খাওয়াতে পারলে নিশ্চয়ই বেঁচে যাবে। ওর মা হয়তো ঠোঁটে করে বাচ্চা নিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, তখন ঠোঁট থেকে পড়ে গেছে। মা আর খুঁজে পাচ্ছে না তাকে। আশপাশে কোথাও জলের চিহ্ন নেই, পিছনের চায়ের দোকানও আর দেখা যাচ্ছে না। পাখিটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দীঘির দিকেই চললেন তিনি। কতদূর এসেছেন কে জানে, দীঘিই বা কতদূর? পরম মমতায় পাখিটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে এগিয়ে চললেন তিনি। আগে কখনো পাখি মুঠোয় ধরেছেন কিনা মনে করতে পারলেন না। পাখিটার চাহনি কি অদ্ভুত ময়াময়। ওর মোলায়েম পালকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেই চোখ বুজে ফেললেন আবেশে।
বুঝতে পারলেন, এই আকাশ বাতাস পশুপাখি এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে ধরছে তাঁকে। এদের এতদিন সেভাবে দেখা হয় নি। ভাবেননি এদের কথা। মাথার উপরে সূর্য এখন অপর প্রান্তে ঢলে পড়েছে। ক্ষিদে কিছুটা পেয়েছে বটে কিন্তু কোনরকম ক্লান্তি শরীরে বোধ করছেন না। পাখিটাকে নিয়ে এগিয়ে চলতে লাগলেন তিনি।
সন্ধ্যা হয়েছে। ‘অন্য জীবনে’র বাড়িটার উঠোনে তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বলছে। একজন ব্যক্তিত্বময়ী নারী হ্যারিকেনের আলোতে বারান্দায় বসে সুর করে রামায়ণ পাঠ করছেন - ‘সুন্দরকাণ্ড।’ তার নাকের উপর গোল সোনালী চশমা আঁটা। বৃহৎ কৃত্তিবাসী রামায়ণ সামনে একটা কাঠের স্ট্যান্ডে বসানো। আধো অন্ধকারে অনেকেই বসে আছেন বিরাট একটা ফরাসের উপর। পয়ার ছন্দে অদ্ভুত এক ভক্তির ভাব ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। রামায়ণ পাঠ শুনে মনটা বেশ দ্রব হয়ে গেল সমরবাবুর।
প্রথমদিন জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখার কথা ছিল। সেটাই করলেন সবাই যার যার মত। এর পরে হয়ত কাজ দেওয়া হবে তাদের। একটু রাত করে সুপ্রতিমবাবু এলেন। প্রথম দিন কেমন কাটলো জিজ্ঞেস করলেন সবাইকে।
সবাই যে যার প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করলেন। কেউ বললেন পাহাড়ে গেছেন, কেউ বললেন বাগানের মধ্যে ঘুরেছেন। তিনি বললেন তাঁর তেপান্তরের মাঠের ঘটনা। সুপ্রতিমবাবু বললেন, ‘আশপাশে নিজের নিজের জায়গাগুলো মোটামুটি চিনে নিয়েছেন তো আপনারা? যদি কিছু বাকি থাকে তাও চিনে যাবেন। প্রত্যেকের জায়গা ও পরিবেশ কিন্তু আলাদা আলাদা। অবশ্য কখনো কখনো দেখাও হতে পারে আপনাদের মধ্যে।’
‘এখানে কোন কাজ তো দেওয়া হল না এখনও?’ সমরবাবু প্রশ্ন করলেন।
‘কাজ তো আপনি করছেন। এই যে আজ একটা ছোট পাখিকে জল খাইয়ে বাঁচালেন। সেটা তো একটা বিরাট কাজ। শুধু আপনি নন, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে সবাই নিজের অজান্তেই অনেক কাজ করছেন। এর ফলে মনে একটা অনির্বচনীয় আনন্দের ভাব বজায় থাকবে। কী করলেন সেটা বড় কথা নয়, আনন্দটাই আসল। কোন কিছু থেকে আনন্দগ্রহণ করাও শেখার এবং অভ্যাসের ব্যাপার।’
একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘যা যা করছি, তা তো এখানকার পরিবেশের ভিতরে করছি। নিজেদের পরিবেশে ফিরে গিয়ে কি এই ধরনের কাজ করতে পারব বা করার সুযোগ পাবো?’
‘সুযোগ অবশ্যই পাবেন, তবে করতে পারবেন কিনা সেটা নির্ভর করছে আপনাদের নিজেদের উপরে। হয়তো পারবেন, কারণ যেটা এখানে করা হচ্ছে সেটা অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। মানসিকতার বদল হচ্ছে। খেয়াল রাখবেন, আপনারা এতদিন পৃথিবী থেকে প্রকৃতি থেকে শুধু নিয়েছেন, আর এবার ফেরতও দিচ্ছেন। এই ফেরত দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে তার স্বাদ গ্রহণ করতে পারছেন আপনারা। একবার এই আনন্দে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সেটা বারবার পেতে চাইবেন। কাজেই প্রকৃতির ঋণ শোধ করুন আর আনন্দ নিন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভিতরে লুকোনো ‘আনন্দ-ভ্রমর’ খুঁজুন।’
‘নিজের মধ্যে লুকোনো আনন্দ-ভ্রমর খোঁজা মানে?’ এক নারীকন্ঠ ভেসে এল।
‘হ্যাঁ, সেটাই তো নিজের সঙ্গে খেলা। এই হবে আপনাদের মূল কাজ।’
‘আনন্দ ভোমরা কী? একটু বুঝিয়ে বললে ভালো হয়--’ এবার অন্য এক নারীকণ্ঠ।
‘আপনাদের এমন এক আনন্দ খুঁজতে হবে, যা পেলে ভ্রমরের মত গুঞ্জন উঠবে বুকের ভিতরে। যদি ভিতরে সেই গুঞ্জন শুনতে পান তবে জানবেন বুকের মধ্যে বন্দী হয়েছে সেই ভ্রমর। আর আপনারা হয়ে গেছেন ‘অন্য জীবনের’ পাকাপাকি বাসিন্দা।’
‘কোথায় খুঁজব এই আনন্দ-ভ্রমর?’ এবার সেই গাঁট্টাগোট্টা মানুষটি পিছন থেকে প্রশ্ন করলেন।
‘সেটা তো নিশ্চয়ই করে কেউ বলতে পারবে না। সেটাই খেলা। তবে সে আশেপাশেই আছে কোথাও। কোথায় খুঁজতে হবে তার কিছু সঙ্কেত বা ক্লু অবশ্য আপনারা পাবেন।’
‘সঙ্কেত কোথায় থাকবে?’ পিছন থেকে আবার প্রশ্ন এল।
‘সঙ্কেত বা ক্লু অবশ্যই থাকবে এই চারপাশের ছড়ানো জীবনের মধ্যে। হয়তো নিজের ভাবনায় আসবে, বা কারো কথার মধ্যে পাবেন। হয়তো বা কোথাও লেখা থাকবে। এমনও হতে পারে যে ইতিমধ্যেই অনেকে পেয়ে গেছেন সেই সঙ্কেত। সারাদিনের কথা ভেবে দেখুন ভালো করে।
‘তবে চিন্তা করবেন না। সঙ্কেত বারবারই আসবে আপনাদের সামনে। তাকে চিনে নিতে হবে।’ এতটা বলে উঠে দাঁড়ালেন সুপ্রতিমবাবু। যাবার আগে বললেন,
‘আর একটা কথা, এখানে কিন্তু আপনারা একেবারে স্বাধীন। নিজেরা যেখানে খুশি যাবেন, যখন খুশি বেরোবেন, যখন খুশি ফিরবেন, যা খুশি খাবেন। হারিয়ে যাওয়ার কোন ভয় নেই। সব ব্যবস্থা আছে চারদিকে। আনন্দম আনন্দম।’
রাতে বিছানায় শুয়ে সারাদিনে কী কী ঘটল, মনে মনে ভাবতে লাগলেন সমরবাবু। কোথাও কি কোন সঙ্কেত পেয়েছিলেন তিনি? আমবাগান, চায়ের দোকান, দীঘি, পাখি কিছুই বাদ গেল না। বার বারই মনে পড়তে লাগল, ফুলের সাজি হাতে স্নিগ্ধ সেই নারীর কথা। আজ আর দেখা হয় নি তাঁর সঙ্গে। হঠাৎ সেই পঙ্ক্তি মনের মধ্যে ফিরে এল, ‘ভ্রুপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে’।
সূর্য পাটে নামবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তেপান্তরে সেই চায়ের দোকানটা দেখা যাচ্ছে। আজ সকালেও চা খেতে এসেছিলেন এখানে। সকালে দেখেছিলেন দোকানের পিছনের ঝুপড়িতে চাওয়ালা লোকটির ছোট মেয়েটি জ্বরে কাতরাচ্ছে। দেখতে হবে সে কেমন আছে। পা চালিয়ে গিয়ে দেখলেন দোকানে কোন লোক নেই।। পিছনের ঘরে দোকানদার তার মেয়েকে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। জ্বর অনেক। তার নিজের কাছে কোন ওষুধ নেই। অন্য জীবনে নাকি ওষুধ লাগে না।
অন্ধকার হয়ে গেলে তাঁর পক্ষে এত দূর থেকে ফিরে যাওয়াও বেশ মুশকিল হবে। কিন্তু সেই রিস্ক নিয়েও মেয়েটিকে দেখতে এসেছেন তিনি। একটি একেবারে অচেনা মানুষের জন্য এতটা উৎকণ্ঠিত হলেন কী করে? নিজের পরিবারের কারো জন্য এত উৎকণ্ঠা ছিল কি তাঁর? মেয়েটির গায়ে হাত দিয়ে দেখলেন গা পুড়ে যাচ্ছে। দু-তিন জন হাটুরে মানুষ বাড়ি ফেরার পথে চায়ের দোকানে এসেছে চা ইত্যাদি খেতে।
দোকানিকে সমরবাবু বললেন, ‘দোকানে ভিড় হচ্ছে। আপনি যান, নিশ্চিন্তে দোকান সামলান, মেয়েটিকে আমি দেখছি।’ কাপড়টাকে জলে ভিজিয়ে ভিজিয়ে মেয়েটির কপালে জলপট্টি দিতে লাগলেন তিনি। যদিও জানেন তাঁর কিছু করার ক্ষমতা নেই, তবু তিনি বারবার মেয়েটির কপালে হাত দিয়ে তার জ্বরের তাপ শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন মায়ের মতো পরম মমতায়। ঘণ্টাখানেক পর মেয়েটির জ্বরটা মনে হল নামছে। ওষুধ ছাড়া শুধু সেবা দিয়ে যে অসুখ সারানো যায়, কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি।
রাতে দোকান থেকে বের হবার সময় চন্দনের গন্ধ পেয়ে দোকানিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ধূপের গন্ধটি বড় সুন্দর। এখানে কি কোথাও চন্দনের বন আছে?’
‘এখানে চন্দন আর কোথায় থাকবে?’-- লোকটি কিছুটা অবাক হল, ‘তবে শুনেছি একসময় নাকি কিছু গাছ ছিল এদিকেই কোথাও।’
আকাশে তারারা ঝিকমিক করছে। আপন মনে পথ চলতে লাগলেন তিনি। তারা-ভরা রাতে মাঠের মধ্যে হাঁটতে খারাপ লাগছিল না। মাঝে কোথাও জঙ্গল, কোথাও জলাশয় পার হচ্ছেন। একটা জঙ্গলের রাস্তা ধরে চলছেন, হঠাৎ দেখলেন দূরে একটা গ্রামের দিক থেকে কতগুলো মশাল এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে গ্রামের লোকজন চিৎকার করে কোন কিছুর পিছনে ধাওয়া করেছে। একটু পরেই দৃষ্টিগোচর হল কয়েকজন মানুষ মালকোঁচা মারা ধুতি পরে, খালি গায়ে একটা ভারী বাক্স নিয়ে দ্রুত জঙ্গলের দিকে এগিয়ে আসছে। চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে তাদের তেলমাখা শরীর। মানুষগুলো আর একটু কাছে এলে দেখলেন তাদের হাতে রয়েছে দা, ছুরি, বল্লম ও বড় বড় লাঠি। বুঝলেন এরা ডাকাতি করে পালাচ্ছে আর গ্রামের মানুষ এদের পিছনেই ধাওয়া করেছে।
বেশ ভয় পেলেন সমরবাবু। এরা তাঁকে দেখতে পেলে সর্বনাশ হবে। কালক্ষেপ না করে জঙ্গলে একটি ঝোপের আড়াল নিলেন তিনি। তাঁর কাছাকাছি এসে লোকগুলো সামনের ছোট জলাশয়ের সামনে দাঁড়ালো। একজনের গলা শোনা গেল - ‘হারান তোরা দাঁড়া। এখানেই রেখে যাব বাক্সটা। এটা নিয়ে আর দৌড়ানো যাচ্ছে না। ধরা পড়ে যাব। এখানে লুকিয়ে রাখলে কেউ এটার খোঁজ পাবে না। পরে আমরা এসে নিয়ে যাব।’
‘ঠিক বলেছ সর্দার। এটাই লুকিয়ে রাখার ভালো জায়গা।’ হারাণ এক কথায় রাজি।
সমরবাবু দেখলেন সেই সাত আট জন মানুষ বড় বাক্সটা জলাশয়ের জলের নিচে রেখে উঠে এল। একজন জলাশয়ের পাড়ে একটা গাছের গায়ে ছুরি দিয়ে চিহ্ন এঁকে চারদিক ভালভাবে দেখে নিল, তারপর সবাই মিলে অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল। ওদিকে ডাকাতগুলোকে ধাওয়া করতে আসা গ্রামের লোকজনের শোরগোল আর পাওয়া গেল না। বোধহয় ডাকাত খুঁজতে তারা অন্যদিকে চলে গেছে।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে সমরবাবু ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। কোথাও কোন জনমানুষের চিহ্ন চোখে পড়ল না। শুধু চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে জঙ্গল ও জলাশয়। ডাকাতরা জলে ডুবিয়ে কী রেখে গেল সেটা জানার অদম্য কৌতূহল হলো তাঁর। ওরা ফিরে আসে কিনা দেখার জন্য আরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কেউ না আসায় সন্তর্পণে তিনি জলে নামলেন। তাঁর জানা আছে এরা কোথায় রেখে গেছে বাক্সটা। কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়েও গেলেন সেটা। অমানুষিক পরিশ্রম করে পাড়ে তুললেন ভারী বাক্সটা। ডালা খুলে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল তাঁর; দেখলেন বাক্সে রয়েছে প্লাস্টিক প্যাকেটে মোড়া গোছা গোছা টাকার বান্ডিল আর বিপুল পরিমাণ হীরে, জহরত, সোনাদানা। এবারে আর ভয় করছিল না তাঁর। মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, আগে তাঁকে জানতে হবে এই সম্পদ কাদের। তারপর ফেরত দিতে হবে তাদের সারা জীবনের সঞ্চয় এই ডাকাতির ধন। কত পরিবার বেঁচে যাবে এতে। তবে এ বাক্স তাঁর একার পক্ষে কোথাও নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাক্সটি কোনরকমে টেনে নিয়ে পাশের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখলেন তিনি, যাতে ডাকাতরা এসে এই বাক্স আর খুঁজে না পায়। ডাকাতির ধন উদ্ধার করে একটা অনির্বচনীয় আনন্দ বুকে নিয়ে ফিরে চললেন তিনি।
সকাল থেকেই দিনটা মেঘলা। ধামা করে একটু নারকোল মুড়ি খেয়ে বেরিয়ে পড়লেন সমরবাবু। কোন দিক দিয়ে এলেন কে জানে, কিছুটা হাঁটার পরেই দেখলেন, সেই দীঘির পাড়ে এসে পড়েছেন তিনি।। জল টল টল করছে। মনটা জুড়িয়ে গেল। ওপারে একটা গ্রাম দেখে দীঘি পার হয়ে গ্রামে ঢুকলেন তিনি। গ্রামটি বর্ধিষ্ণু। একজন মানুষ কামারশালায় বসে একটা লোহার লাঙলের ফলা বানাচ্ছে। কিছুক্ষণ তার কাজ দেখলেন। পরিশ্রমের ফলে সর্বাঙ্গে তাঁর ঘাম ঝরে পড়ছে। পিছনের একটা বাড়ির ভিতর থেকে এক মহিলাকে বেরিয়ে আসতে দেখে সে বলল, ‘মাসিমা আপনার দা-টায় ধার দিতে একটু সময় লাগবে।’
‘ঠিক আছে চরণ, এখনই দরকার নেই, আমি ওবেলায় নেব।’
‘হ্যাঁ মাসিমা। এই লাঙ্গলটার জন্য একজনের চাষ আটকে আছে। আপনি বিকেলেই নেবেন।’ কাজে মন দিল লোকটি।
‘ওকি, সমরদা না? এখানে কোথায় এসেছ?’
হঠাৎ নিজের নাম শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলেন মহিলাকে। একটু সময় নিয়ে দেখে চিনতে পারলেন তাকে। ‘আরে আপনি, মানে তুমি তো মানসী, এখানে কী করছো?’
‘আমি তো এখানেই থাকি, এদের স্কুলে পড়াই।’
মেঘলা মেয়ে মানসীর ঠোঁটের পাশের ছায়া-ঘেরা ছোট্ট তিলটা আজও ওর স্নিগ্ধতা বাড়িয়ে চলেছে। ‘এখানে আর কে কে থাকেন?’
‘না না, আর কেউ না, আমি একাই থাকি।’
‘কেন তোমার স্বামী? বিয়ে তো করেছিলে শুনেছিলাম।’
‘হ্যাঁ, বিয়ে একটা দিয়েছিল বাড়ি থেকে, কিন্তু বছর খানেক পরেই সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে সে চলে গেছে আকাশের ওপারে।’
‘সে-ও’ কথাটা মনে খচ করে লাগল। সে-ও কথাটা কি তার স্বামী ছাড়া আরও কাউকে বোঝাচ্ছে। সমরবাবু নিজেই কি সেই মানুষ?
মানসীরা থাকত তাদের পাশের বাড়িতেই। দু-ক্লাস নীচে পড়লেও বন্ধুর মত মিশত তারা। একটু বড় হতেই সমরবাবু বুঝতে পারতেন মানসী তার সান্নিধ্য পছন্দ করছে। কারণে অকারণে, নানা অছিলায় তাঁদের বাড়িতে এসে পড়ত সে। মানসী ভাল মেয়ে। সবাই খুব পছন্দ করত তাকে। তাই হয়ত তাদের অবাধ মেলামেশায় কোন আপত্তি করেনি কেউ। সমরবাবু ও মানসী দুজনেই দুজনকে হাবেভাবে জানিয়েছিলেন তাদের একে অপরকে ভালো লাগার কথা। পরে সমরবাবু নিজেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেন নি।
কলেজের উজ্জ্বল মেয়ে লহমাকে দেখে কিছুটা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল তাঁর। মনে করেছিলেন যে লহমা মানসীর চেয়ে তাঁর বেশি মানানসই সঙ্গী হতে পারবে। তাঁর জীবনের পথের সঙ্গী। মানসীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পরে সে-পাড়াও ছেড়েছিলেন তাঁরা। তিনি ছেড়ে যাওয়াতে মানসী নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছিল। যদিও তিনি তখন লহমাকে নিয়ে মশগুল। কিন্তু সেখানেও হয়তো ফাঁক ছিল। সেভাবে কখনও দানা বাঁধলো না তাদের সম্পর্কটা। মাঝে মাঝে মনে হতো উজ্জ্বল রোদ্দুরের থেকে হয়তো কোন মেঘের ছায়াই ভালো ছিল তাঁর। ওদিকে লহমাও কিছুদিন পর আরও ভালো এক সঙ্গী পেয়ে তাঁকে ছেড়েছিল। তারপর আর মানসীকে কোথাও খুঁজে পান নি তিনি।
‘এসো না আমার বাড়িতে আজ, দুপুরের দক্ষিণ হস্তের কাজটি সম্পন্ন করে যাও। আয়োজন অবশ্য সামান্যই।’ মানসী তাঁর কোন আপত্তি শুনল না। খাওয়ার পর দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়ে ভাবছিলেন এমন বড়ি দিয়ে শুক্তো বহুদিন খাওয়া হয়নি। মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মৃদু হাওয়ায় চোখ বুজে আসছে। এত আনন্দ কি জীবনে কখনো পেয়েছেন? যে জীবন ফড়িংয়ের, দোয়েলের, মানুষের সঙ্গে সত্যি কি তার দেখা হয়?
সন্ধ্যেবেলা বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মানসী বলল, ‘সমরদা তোমার একটা জিনিস এতকাল আমার কাছে রেখেছিলাম। আজ মনে হচ্ছে সেই জিনিস আর আমার কাছে রাখার দরকার নেই। সেটা ফেরত দেওয়াই ভালো।’
‘কী জিনিস? কাকে ফেরত দেবে?’
‘তোমার একসময়ের খুব প্রিয় জিনিস। তোমার জীবনের সঙ্গে জড়ানো। দাঁড়াও নিয়ে আসছি।’ ঘরের কোণে কুলুঙ্গীর থেকে সে বের করে আনল সুন্দর কারুকাজ করা চন্দনকাঠের একটা ছোট্ট কৌটো। সমরবাবু ঢাকনা খুলে হাতের তালুতে কৌটো উপুড় করতেই বেরিয়ে এল কাঁচের একটা বড় রয়েল গুলি। অন্যান্য গুলির থেকে অনেকটাই বড়। প্রায় টেনিস বলের সাইজ।
পাড়াতে তখন খুব গুলি খেলতেন তিনি। খুব নেশা ছিল তাঁর। অনেক কাঁচের গুলি জিতেছিলেন তিনি। একটা টিনের কৌটোতে সেই গুলিগুলো রাখতেন। বাবা পছন্দ করতেন না। প্রায়ই বকাঝকা করতেন, চড়চাপড়ও দিতেন। কিন্তু গুলি খেলা বন্ধ হয়নি তাঁর। এমনকি পরীক্ষা কাছে এলেও লুকিয়ে গুলি খেলতেন তিনি।
তখন ক্লাস নাইন বা টেনে। সেই সময় এক পরীক্ষার দিনে গুলি খেলাতে বাবা রেগে সব গুলি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ঘরের বাইরে। ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল তাঁর প্রিয় জিনিস ফেলে দেওয়াতে। পরে অবশ্য উঠোনে কিছু গুলি খুঁজে পেয়েছিলেন সমরবাবু। কিন্তু এই রয়েল গুলিটাকে আর কখনোই পাননি তিনি। এরপর রয়েল গুলিটা চিরস্থায়ী বাসা বেধেছিল তাঁর মনের মধ্যে।
‘কোথায় পেলে এটা? কত খুঁজেছি আমি।’
‘আমাদের উঠোনেই খুঁজে পেয়েছিলাম এটা। তোমাদের পাশেই তো থাকতাম। আমাদের দু বাড়ির তো একটাই উঠোন ছিল, মনে নেই তোমার? খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম তোমার স্মৃতি হিসেবে। পরে ভেবেছিলাম একদিন সময়মতো ফেরত দেব।’ মানসী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ‘কিন্তু সেই সময় আর আসেনি। না আমার জীবনে, না তোমার। অনেক দূরে চলে গিয়েছিলে তুমি। কিন্তু এই গুলিটা থেকে গেছিল তোমার স্মৃতি হিসেবে। মাঝে মাঝে বের করে দেখতাম আর তোমার সান্নিধ্য পেতাম।’
‘সত্যি কী অদ্ভুত?’
‘হ্যাঁ, অনেকদিন রয়েছে এটা আমার সঙ্গে, কখনো কাছছাড়া করিনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এটা আর দরকার নেই আমার। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেওয়াই ভালো। আর বোধহয় তোমাকে ফিরিয়ে দেবার সময় পাবো না।’
আবেগ কম্পিত কাঁপা হাতে সমরবাবু গ্রহণ করলেন সেই কৌটোশুদ্ধ গুলিটা।
আর থাকতে না পেরে, অনেক দিনের না বলা একটা কথা বলেই ফেললেন সমরবাবু, ‘আজ আমাকে একটা কথা বলতে দাও মানসী, আমি অন্যায় করেছিলাম তোমাকে ছেড়ে গিয়ে। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।’ বেশ হাল্কা লাগল মনটা।
চাঁদের আলোয় বেরিয়ে পড়লেন তিনি তেপান্তরের মাঠের রাস্তায়। ভাবতে লাগলেন, আজ আবার চন্দন কাঠের অনুষঙ্গ ফিরে এল রয়েল গুলির কৌটোর সঙ্গে। কোথাও কি আছে চন্দন বন?
অনেকটা যাবার পর মনে হল একটা লোক পিছু নিয়েছে তাঁর।
চলতে চলতেই আরো এক জন এসে জুটলো পিছনের লোকটার সঙ্গে, তারপর আরো একজন। এমনি করে প্রায় জনা পাঁচেক মানুষ চাঁদের আলোতে তেপান্তরের মাঠে তাঁর পিছু নিল। তিনি বুঝতে পারলেন না কেন পিছু নিয়েছে এরা? হঠাৎ শুনলেন একজন আরেকজন মানুষকে বলছে -
‘হারাণ তুই ঠিক দেখেছিস তো এই লোকটাই পুকুর থেকে বাক্সটা তুলেছিল?’
‘হ্যাঁ কর্তা এই সেই লোক। বাক্সসুদ্ধু জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছিল। তারপর সেখানে গিয়ে ওকে আর খুঁজে পাইনি।’
‘তবু আরো তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কাছে গিয়ে চাঁদের আলোতে ভালো করে দেখে নে লোকটাকে। তারপরে ওকে দেখাচ্ছি মজা।’
লোকগুলো তাড়াতাড়ি হাঁটছে দেখে তিনি নিজের গতি বাড়িয়ে দিলেন। এভাবে একসময় দৌড়াতে শুরু করলেন সমরবাবু। আজ ধরা পড়লে সম্পদ তো যাবেই এরাও আর বাঁচিয়ে রাখবে না তাকে। এবারে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন তিনি। পিছনে দৌড়াচ্ছে পাঁচ জন তাগড়াই ডাকাত। সামনে একটা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। ওখানে লুকোতে পারলে হয়তো এই যাত্রা বেঁচে যাবেন তিনি। কিন্তু পারবেন কি? পিছনের লোকজনের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমে কমে আসছে। শুনতে পেলেন একজন বলছে, ‘নিতাই দেখিস লোকটা যেন চন্দন বনে ঢুকে না যায়।’
ওহ্, এই তাহলে সেই চন্দন বন। প্রথম দিনের সেই সঙ্কেত। এখানেই কি আছে তাঁর আনন্দ ভ্রমর? এই বনে ঢুকলে নিশ্চয়ই বেঁচে যাবেন তিনি। কিন্তু কীভাবে? মৃত্যু তো পিছনে ধেয়ে আসছে তাঁর। না, আর বোধহয় পারলেন না । জঙ্গলে ঢোকার ঠিক আগে একটা আগাছায় পা আটকে ছিটকে পড়লেন তিনি। পাঁচজন লোক তাদের হাতের দা লাঠি বল্লম ইত্যাদি উঁচিয়ে ঘিরে দাঁড়ালো তাকে। একজন তাঁর হাতটা ধরল কোপ মারার জন্য। আরেকজন ছুরিটা গলার কাছে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘বল কোথায় লুকিয়েছিস আমাদের বাক্স?’
বার বার জিজ্ঞেস করাতেও তাঁর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোলো না। আজই তাঁর শেষ দিন। এরা একটা একটা করে কাটবে তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তারপর শেষ কোপটা মারবে বুকের মধ্যে। ব্যাস, বেরিয়ে যাবে তাঁর প্রাণ ভোমরা। মুঠোর মধ্যে চন্দন কাঠের রয়েল গুলির কৌটোটা ধরে চোখ বুজলেন তিনি।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল সমরবাবুর। আশপাশটা চোখের ফোকাসে স্থির হতে তিনি বুঝলেন একটা হাসপাতালের বেড-এ তিনি শুয়ে আছেন আর
গাঁট্টাগোট্টা সেই ভদ্রলোকটি তাঁর উপর ঝুঁকে তাকে দেখছেন। লোকটিকে একটা মৃদু হাসি উপহার দিয়ে সমরবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে আপনি এখানে কী করছেন? আর আমিই বা কোথায়?’ তিনি কথা বলতেই চারপাশে যেন একটা আনন্দের বাতাবরণ তৈরি হয়ে গেল। একজনকে লোকটি বললেন, ‘এইতো সমরবাবুর জ্ঞান ফিরেছে।’ ওপাশ থেকে এক নারী কণ্ঠ জিজ্ঞেস করল-
‘আর কোন বিপদ নেই তো ডাক্তারবাবু?’
‘প্রাথমিক বিপদ কেটেছে। তবে খুব সাবধানে থাকতে হবে। স্যার এসে সবকিছু বলবেন।’
চারপাশের মানুষজনের মধ্যে একজন মহিলাকে কেমন চেনা চেনা লাগলো। তাঁর চোখে চোখ পড়াতে উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখন কেমন বোধ করছ গো?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আর কিছুদিন যাক। উনি আরও সুস্থ হন। একটু অবজারভেশনেও রাখতে হবে কয়েকদিন। তারপর আপনার হাজবেন্ডকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ভাল করে সেবাশুশ্রূষা করুন।’ সমরবাবু বুঝলেন যে মহিলা তাঁর স্ত্রী।
দ্বিতীয়বার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি এখন কোথায় একটু বলবেন? আপনিই বা এখানে কেন?’ গাঁট্টাগোট্টা বললেন, ‘আমি তো এখানকার ডাক্তার, গত কয়েকদিন আগে সকালে আপনি এসেছিলেন মেডিকেল রিপোর্ট নিতে। তখনই আপনার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়। এই কদিন জ্ঞান ছিল না আপনার। ভাগ্যিস হাসপাতালেই ঘটেছিল ঘটনাটা। সঙ্গে সঙ্গে সবরকম চিকিৎসা চালু হওয়াতে এযাত্রা রক্ষে পান আপনি। অন্য কোথাও এটা হলে আপনার যে কী হত বলা মুশকিল।’
‘ও, তাই নাকি? আমার তো কিছুই মনে নেই। আশ্চর্য!’
‘কিন্তু আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
‘হ্যাঁ, আপনি তো সেদিন আমাকে বিরাট ধাক্কা দিয়েছিলেন।’
‘ও হ্যাঁ। ওটা তো আপনার হৃদযন্ত্র চালু করার চেষ্টা করছিলাম আমরা।’ একটু যেন লজ্জা পেলেন গাঁট্টাগোট্টা মানুষটি।
এই কদিন জ্ঞান ছিল না তাঁর? তাহলে এত কাণ্ড হলো কী করে? এতদিন কোথায় গিয়েছিলেন তিনি, সেই তেপান্তরের মাঠ, সেই সন্ধ্যের রামায়ণ পাঠ, চন্দনবন, মানসী? এত মায়াময় ছিল ওই দিনগুলো? একটা অন্য জীবন যেন। এখনই এখানে ফেরার কথা ছিল কি? ওখানে সময় কি শেষ হয়ে গেছে তাঁর ‘অন্য জীবনে’র? পেয়েছেন কি তাঁর আনন্দভ্রমর? মনে মনে ঠিক করলেন, এখান থেকে ছাড়া পেয়ে আবার যেতে হবে সেই বাড়িটাতে। কোথায় যেন ছিল সেটা? রুবি থেকে বাসন্তী হাইওয়ে হয়ে ঘটকপুকুর। ভ্যান নিয়ে মাঠের রাস্তায় আরো ঘন্টাখানেক-- নিশ্চয়ই মনে পড়বে তাঁর।
‘আপনার তো খুব বাড়াবাড়ি রকমের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল পর পর দুবার। ডক্টর বাসু আপনাকে দিন-রাত এক করে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুললেন। ডাক্তারবাবু আজই হয়ত রিলিজ করে দেবেন আপনাকে। উনি এই শহরের সবচেয়ে বড় হার্ট স্পেশালিস্ট।’
প্রেশার মেপে, ব্রেকফাস্ট খাইয়ে বেডটা একটু উঁচু করে তাঁকে বসিয়ে দিয়ে নার্স জানাল, ‘এখনই এসে পড়বেন ডাক্তারবাবু।’ হঠাৎ তাঁর নজর পড়ল ডান দিকের সাইড টেবিলে। দু-একটা রিপোর্ট আর ওষুধপত্রের সঙ্গে কী রাখা আছে ওটা? তাঁর স্বপ্নের রয়েল গুলিটা না? কর্তব্যরত নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন ‘এই বড় গুলিটা এখানে কেন?’ নার্স টেবিলে রাখা স্বচ্ছ গোলকটা হাতে নিয়ে বলল, ‘হার্ট অ্যাটাকের পরে আপনার ডান দিকের হাতটা পক্ষাঘাতে প্রায় অচল হয়ে গিয়েছিল। ওই হাত সচল করার জন্য ফিজিওথেরাপি করা হচ্ছে। কিন্তু আঙ্গুলগুলোতে এখনও শক্তি ফেরেনি। তার জন্য এই স্থিতিস্থাপক বলটা আনা হয়েছে। আপনি ওটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে যত জোরে পারবেন বারবার চাপ দেবেন। এইভাবে আপনার আঙ্গুলগুলো সচল হবে। ধীরে ধীরে পূর্ণ শক্তি ফিরে আসবে আপনার ডান হাতে। এই বড় গুলির মতো বলটি হবে আপনার এখনকার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আপনার শরীরে এখন অন্য কোন অসুবিধা নেই।’
আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দুজন ডাক্তারের সঙ্গে ঢুকলেন অত্যন্ত সপ্রতিভ, সৌম্যদর্শন একজন মানুষ। নার্স নিচু স্বরে বলল, ‘ডাক্তার বাসু এসেছেন।’
‘কি, কেমন আছেন সমরবাবু, সব ঠিক আছে তো?’ সৌম্যদর্শন মানুষটি জিজ্ঞেস করলেন।
‘একদম ঠিক ডাক্তারবাবু, খুব ভাল আছি।’
‘হ্যাঁ সমরবাবু, আমার হিসেবে আপনি এখন সমরেও যেতে পারেন। আপনার হৃদয় একেবারে নতুন হয়ে গেছে। যেখানে খুশি যেতে পারেন, যা খুশি করতে পারেন, যা মন চায় খেতে পারেন। অবশ্য প্রথম কিছুদিনের জন্য খাওয়াদাওয়ায় একটু রেস্ট্রিকশন থাকবে। মনে করবেন নতুন জীবন পেয়েছেন। আনন্দ করুন। নতুন ভাবে উপভোগ করুন জীবনকে। আজই বাড়ি যাবেন আপনি। এবার থেকে শুধু ‘আনন্দম আনন্দম’ এই আপনার মন্ত্র।’
ডাক্তারবাবু তাকে দেখে চলে যাবার পর মনে হল এই কথাগুলো যেন আগেও কোথাও শুনেছেন। নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন ‘ডাক্তারবাবু তো দারুণ। কথাতেই আমাকে অর্ধেক চাঙ্গা করে দিয়ে গেলেন। পুরো নাম কি ওনার?’
‘ওনার নাম ডাক্তার সুপ্রতিম বাসু।’
নামটা শুনেই একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন সমরবাবু। চোখের সামনে রয়েল গুলি, সুপ্রতিম বাবু, সবই মজুদ। তিনি কি তাহলে এখন ‘অন্য জীবনে’র পাকাপাকি বাসিন্দা? হৃদয়ের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছেন তিনি। তবে কি পেয়ে গেছেন তাঁর আনন্দ ভ্রমর? খুশিতে চোখের কোণে জল চিক চিক করে উঠল। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘আনন্দম আনন্দম।’