সারা ডিপার্টমেন্টে থমথমে স্তব্ধতা। আজও সেই একই ধরনের বিপর্যয়। সকাল ন'টায় অফিসে ঢুকে জিমের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল মুশফিককে দেখে। কানে ব্লুটুথ ডিভাইস, কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বসে আছে মুশফিক। আঙুলগুলি কিবোর্ডের উপর নিশ্চল।
—গুড মর্নিং মুশফিক। এভরিথিং ওকে?
কোন উত্তর এলো না মুশফিকের কাছ থেকে।
—হে ম্যান, হোয়াটস্ রং? জিম গলা চড়ালো। কোন উত্তর নেই! জিম এগিয়ে গিয়ে মুশফিককে একটু ধাক্কা দিল। মুশফিকের নিশ্চল দেহটি ডানদিকে হেলে গেল।
—মু শ ফি ক!!
আকাশভেদী চিৎকার করলো জিম। পাশের ঘর থেকে প্রদীপ, মানালি ছুটে এলো, তারপর ইন্দ্র। জিম থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ক্যান এনিবডি কল ৯১১? মুশফিকের চোখ খোলা। নাক থেকে সরু এক রক্তের ধারা গড়িয়ে এসেছে। কম্পিউটার স্ক্রিনে এ আই-এর কোডগুলির প্রতিটি অক্ষর মুখ ভ্যাঙচাচ্ছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে লাল নীল আলো জ্বালিয়ে পার্কিং লটে অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল। পেছনে পুলিশের গাড়ি। চার জন স্ট্রেচার ঘাড়ে করে ঢুকলো। একজন মুশফিকের নাড়ি টিপলো আর একজন স্টেথো দিয়ে পরীক্ষা করলো।
—সরি গাইজ! হি ইজ নো মোর!
ততক্ষণে সারা ফ্লোরের কর্মচারীরা ঘরের সামনে ভিড় করেছে। কারুর মুখে টুঁ শব্দটি নেই। গত এক মাসে মুশফিককে নিয়ে এআই উইংয়ে এরকম দুর্ঘটনা এই নিয়ে চারটি তবে এই প্রথম কেউ মারা গেল। এর আগে টিমোথি, পাপন আর চ্যাডও ঠিক একইভাবে কোড লিখতে লিখতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্রত্যেকেরই বয়স তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। ঝকঝকে চেহারা, অটুট স্বাস্থ্য। প্রতিটি অসুস্থতার কারণই ডাক্তার বলেছেন স্ট্রোক! বাকি তিনজন কেউই এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি। ওদের মধ্যে চ্যাড এখনো বিপদসীমার বাইরে নয়। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। আর আজ তো মুশফিকের হঠাৎই হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেছে চেয়ারে বসে কোড লিখতে লিখতে।
সিলিকন ভ্যালির এই সফটওয়্যার কোম্পানিটির নাম ইনফিনিটি। এখানে এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে চর্চা হয়। নানা রকমের কোড লেখে এই তরুণ তুর্কির দল। আন্তর্জাতিক এই টিমটিতে বেশ কিছু ভারতীয়, চৈনিক এবং ইউরোপীয় ছেলেমেয়ে আছে। সদাগরী প্রতিষ্ঠান, কাজের চাপ আছে। নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে বায়না আসে বিভিন্ন রকমের সফটওয়্যারের জন্য। প্রতিটি সফটওয়্যারেরই মূল উদ্দেশ্য হলো কী করে রক্তমাংসের মানুষের গতানুগতিক করণীয় কাজকর্মগুলি ঝড়ের গতিতে যন্ত্রের সাহায্যে তরান্বিত করা যায়। কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বলতে হবে (আসলে বসে লিখতে হবে), বাবা এআই, তুমি রাম, শ্যাম, যদুকে কড়া করে লিখে দাও তো, অফিসে যেন দেরি করে না আসে! বলামাত্র যন্ত্রদানব লিখতে শুরু করবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রাম, শ্যাম, যদুর কাছে বোমকে দেওয়া ইমেল চলে যাবে ম্যানেজারের দস্তখত সমেত। ম্যানেজারকে নিজে কিছুই লিখতে হবে না। এই কারণে বেশ কিছু কোম্পানি আর বেশি ম্যানেজার নিয়োগ করছে না। কারণ ম্যানেজারের কাজ যন্ত্রদানব দিব্যি করে দিতে পারছে। অনেক ব্যাঙ্কের থেকে বায়না আসছে অফিসের হিসেবপত্র খুদে দানবকে দিয়ে করিয়ে নেওয়ার জন্য। সব আমানতকারীদের অ্যাকাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব এখন থেকে যন্ত্র দানবের। বেশ কিছু ব্যাঙ্ক কর্মীর এখন আর কোনো প্রয়োজন হবে না। এই তো কদিন আগে একটি কলেজ থেকে অভিনব এক বায়না এল। কৃত্রিম অধ্যাপক তৈরি করার জন্য। কলেজের প্রিন্সিপাল ইনফিনিটিকে যা যা বিষয় পড়াতে হবে তার একটি সিলেবাস পাঠিয়ে দিলেন। তার সঙ্গে বর্তমান অধ্যাপকদের লেকচার নোটগুলি, যেগুলি কলেজের ইলেকট্রনিক ব্ল্যাকবোর্ডে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। প্রিন্সিপালের নাম আর্থার উইলিয়ামসন। এঁর কাছ থেকে ইনফিনিটির কর্ণধার, জন বেক একটি ইমেল পেলেন।
— আপনাকে আমাদের অধ্যাপকদের সব নোটস পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি একটি যন্ত্র দানব তৈরি করুন যে এই নোটগুলি বুঝে নিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারবে। জন একটু বিমূঢ় হয়ে প্রশ্ন করল, "কিন্তু এই লেকচার নোটগুলি তো আপনার কলেজের অধ্যাপকদের বুদ্ধির ফসল! ওঁদের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি। এগুলি ব্যবহার করা কি ঠিক হবে?” আর্থার চটপট জবাব দিলেন, "না, না! এই অধ্যাপকদের আমরা ভাড়া করেছি। আমাদের ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে আমাদের ছাত্রদের ভাড়াটে মাস্টাররা যা পড়াচ্ছেন, তার ওপর তাঁদের কোনো অধিকার নেই। এগুলি আইনত আমাদের কলেজের সম্পদ।" জনের মনে হল এই যুক্তিটির মধ্যে যথার্থতা আছে। তাও কোম্পানির আইনজ্ঞের সঙ্গে একটু পরামর্শ করে জন এই অর্ডারটি নিয়ে নিলেন। এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞ শুরু হলো।
একমাসের মধ্যে ইনফিনিটিতে কৃত্রিম অধ্যাপক তৈরি হলো। ফ্রন্টিয়ার কলেজের প্রিন্সিপাল তো ভারি খুশি। এর দু এক মাসের মধ্যে কৃত্রিম অধ্যাপক তৈরির বেশ কয়েকটি অর্ডার এলো আরো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে। ভারতের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ও এর শরিক। এর মাস খানেকের মধ্যেই প্রথম বিপর্যয়টি হল। যে টিমটি এই কাজটি শুরু করেছিল তাদের দলনেতা চ্যাডের একটি মারাত্মক স্ট্রোক হলো সর্বপ্রথম। চ্যাড খুব সকাল সকাল অফিসে আসে। সেই সময় অফিসে কেউ এসে পৌঁছোয় না। সেদিন ছিল সোমবার। সকাল সাড়ে আটটায় চ্যাডের স্ট্রোক হয়। ন’টা নাগাদ জিম এসে প্রথম দেখে যে চ্যাড চেয়ারে বসে আছে কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে, কানে ব্লুটুথ ডিভাইস লাগানো। নাক থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। ওই অবস্থায় দেখতে পাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে চ্যাডকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সে কোমায় চলে যায়। আজও সে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এরপর একসপ্তাহের মধ্যে পাপন ও টিমোথিও একই ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো। এখনো পর্যন্ত ভালোভাবে কথা বলতে পারছে না।
ইনফিনিটির এই উইংটিতে সাত জন কাজ করে। তাদের মধ্যে তিনজনের এরকম রহস্যজনক অস্বাভাবিক অসুস্থতা ও আজকের এই মৃত্যুর ঘটনার পর সারা স্যান হোসেতে শোরগোল পড়ে গেল। টিভিতে প্রতিদিন জল্পনা কল্পনা এরকম অসুস্থতা ও তার জেরে এই মৃত্যু কি স্বাভাবিক? তিনজনেই কম্পিউটারে কোড লিখতে লিখতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। মেডিকেল রিপোর্ট দেখাচ্ছে তিনজনেরই ধমনীতে এয়ার এম্বোলিজম তৈরি হয়ে ফুসফুস ফেটে গেছে। ইনফিনিটির দপ্তরে প্রতিদিন সাংবাদিকদের আর পুলিশের ঘন ঘন যাতায়াত। সিলিকন ভ্যালিতে মানুষের জীবনে কোনো বৈচিত্র্য নেই। প্রতিদিনই শুধু কাজ আর কাজ! এই ঘটনার পর পথে ঘাটে শপিংমলে এই নিয়েই গল্প। লোকজন কিছু একটা নিয়ে আড্ডা দেবার সুযোগ পেল।
শিলিগুড়ি থেকে উত্তরের দিকে এক শান্ত প্রত্যন্ত শহরে শঙ্খচিল ইউনিভার্সিটি। ক্যাম্পাস থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গ দেখা যায়। প্রতিদিন বৈশম্পায়ন যখন ক্লাসে পড়াতে যায় মহানুভব হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে একবার বলে, আমি একদিন তোমার কাছে ঠিক চলে যাব। কখনো হিমালয়ের চূড়ার খাঁজগুলি দেখলে ওর মনে হয় পীনোন্নত নারীর অঙ্গসৌষ্ঠব। কখনো মনে হয় জটাজুটধারী মহাদেব বা নৃত্যরত নটরাজ। এদের মধ্যে কে বেশি সুন্দর? কে তাকে বেশি আকৃষ্ট করে এখনো জানে না বৈশম্পায়ন। তারপর ক্লাসে গিয়ে অ্যালগরিদম আর কম্বিনেটোরিয়াল অঙ্ক ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে শুরু করে। ব্ল্যাকবোর্ডে সমীকরণগুলির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করে আত্মমগ্ন ভাবে। শেখার কোনো আগ্রহ নেই ছাত্রছাত্রীদের। প্রতিদিন ক্লাসের পরে ছেলেমেয়েদের শুধু একটিই প্রশ্ন, স্যার, এগুলি কি পরীক্ষার জন্য ইম্পরট্যান্ট? কিছু সাজেশন দিন না মিডটার্মে কী ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে!
বৈশম্পায়ন চৌধুরী হার্ভার্ড থেকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পিএইচডি করে উত্তরবঙ্গের এই ঘুমন্ত শহরটিতে পড়াচ্ছে আজ দশ বছর হলো। তার আগে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে কিছুদিন অধ্যাপনা করেছে। ইচ্ছে করলেই বৈশম্পায়ন অনেক উঁচু সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারত। বেশ কয়েকটি অফারও ছিল কিন্তু গতানুগতিকভাবে জীবন কাটানো বৈশম্পায়নের ধাতে নেই। শঙ্খচিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর স্কুলের এক বন্ধু বাংলার অধ্যাপক। একদিন ওর কাছে ব্যাঙ্গালোর থেকে বেড়াতে এসে বৈশম্পায়ন কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রেমে পড়ে গেল। পরদিন ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে দেখা করে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, ওদের বিজ্ঞানের কোনো বিভাগে পড়ানোর লোকের দরকার কিনা। ভাইস চ্যান্সেলর সুদীপ্ত চ্যাটার্জি বৈশম্পায়নের সি ভি দেখে প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি আমাদের এই ইউনিভার্সটিতে পড়াতে চাইছেন আপনার এই সি ভি নিয়ে? আপনি কি মানসিকভাবে সুস্থ? বৈশম্পায়ন স্থির চোখে সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে বলে, সুদীপ্তবাবু, আমি শুধু জানতে চাইছি আপনি আমাকে একটি অধ্যাপনার চাকরি দিতে ইন্টারেস্টেড কিনা। সুদীপ্ত এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, আমাদের এই ছোট ইউনিভার্সিটিতে আইটির ফেসিলিটি খুব ভালো না। আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বেসরকারি। আমরা কিছু সরকারি অনুদান পাই কিন্তু টাকার বেশির ভাগ আসে একজন শিল্পপতির কাছ থেকে। তাঁর নাম অসীম সিংহানিয়া। আমাকে দুদিন সময় দিন, আমি একটু বোর্ড অফ ট্রাস্টিসের সঙ্গে কথা বলি। ঠিক দু'দিন বাদে সুদীপ্ত চ্যাটার্জী বৈশম্পায়নকে ফোন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কবে কাজে জয়েন করতে চান? আমাদের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে আপনাকে আমরা একজন চেয়ার প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত করতে চাই। উই আর রিয়েলি লাকি টু হ্যাভ ইউ! বৈশম্পায়নবাবু, আমরা চাই আপনি আমাদের এই ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগটিকে নতুন করে গড়ে তুলুন, ভালো ভালো ফ্যাকাল্টি হায়ার করুন। টাকা পয়সার জন্য চিন্তা করবেন না।
তারপর দশ বছর তো দেখতে দেখতে কেটে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে ঘরকন্না করে। বৈশম্পায়ন বিশেষ কিছু করে উঠতে পারল না ডিপার্টমেন্টের উন্নতির জন্য। ভালো লোকজন এই প্রত্যন্ত জায়গায় আসতে চায় না। বৈশম্পায়ন গবেষণাটি কিন্তু চালিয়ে গেল। এই খুদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকটি ভারী ভারী প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করল। কয়েকটি ভালো পিএইচডি ছাত্র ওর তত্ত্বাবধানে পিএইচডি করে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। তাদের কারো কারো সঙ্গে বৈশম্পায়নের এখনও যোগাযোগ আছে। তবে মানালির সঙ্গে যোগাযোগ তার মধ্যে সবথেকে বেশি।
স্যান হোসে আর ভারতের সময় ব্যবধান সাড়ে বারো ঘন্টা। প্রতি সপ্তাহের শনিবার ঠিক বেলা দুটোয় বৈশম্পায়নের ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে আলো জ্বলে ওঠে। স্যান হোসেতে তখন রাত্রি দেড়টা।
— বৈশম্পায়নদা, কী করছেন? কেমন আছেন?
— ভালো মানালি! তোর কী খবর? এতো রাতে জেগে আছিস!
— ঘুম আসছে না! ভালো লাগে না বৈশম্পায়নদা!
— কেন, কী হলো?
— কিছু না! সবকিছু কীরকম ঘেঁটে গেল!
— কী হয়েছে বলবি?
— আপনার কথা শুনে এই চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করলাম, চলেও এলাম। তবে যেরকম হবে ভেবেছিলাম তা তো হলো না!
— একটু খুলে বলবি?
— এই ইনফিনিটি কোম্পানি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নানারকম চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট দেবে। যেখানে মাথা খাটিয়ে কিছু করতে পারব। এখন তো সব থোড়বড়িখাড়া কাজ ছাড়া কিছুই করি না!
— কী কাজ করিস প্রতিদিন?
— কিছুই না বৈশম্পায়নদা! নানা রকম সফটওয়্যার লেখার বরাত আসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। এইসব করার জন্য কোনো পিএইচ.ডি ব্রেনের প্রয়োজন নেই। অত্যন্ত সাধারণ কাজ!
বৈশম্পায়ন ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করলো, তোর সব কলিগই কি এরকম বোরিং কাজ করছে?
— না না বৈশম্পায়নদা! আমাদের কোম্পানির একটি এআই সেল আছে। সেখানে ছয়জনের একটি টিম অনেক ইন্টারেস্টিং কাজ করে। আমাকে বলেছিল বস ওই টিমে জয়েন করতে। আমি না বলে দিয়েছি!
— সে কী! কেন?
— ওদের কাজে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে ঠিক। তবে আমার মনে হয়েছে ওই কাজগুলি থেকে যে প্রোডাক্ট তৈরি হবে তা সমাজের পক্ষে অকল্যাণকর।
— কী রকম!
— সব গতানুগতিক কাজ এআই-ই করে দেবে। অনেক মানুষ বেকার হয়ে যাবে। এখনই যাচ্ছে!
— তাহলে কী করবি?
ফোনের ওপারে চুপচাপ কিছুক্ষণ।
— বৈশম্পায়নদা, আপনাকে একটি কথা বলা দরকার।
— কী?
— শঙ্খচিল ইউনিভার্সিটি থেকে একটি অর্ডার এসেছে ইনফিনিটিতে। এআই প্রফেসর তৈরি করার জন্য। আর কয়েক মাসের মধ্যেই এই প্রজেক্টটি শেষ হবে। শঙ্খচিলের অনেক প্রফেসর ছাঁটাই হয়ে যাবেন। আপনি কিছু জানেন না?
স্তম্ভিত হয়ে গেল বৈশম্পায়ন।
— মানালি এখন আমি রাখি! পরে কথা হবে।
বৈশম্পায়ন গভীরভাবে চিন্তা করলো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো বড় একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে, তার বিন্দুবিসর্গ সে জানে না। প্রথমে বিষন্নতা এলো। তারপর রাগ!
পরদিন সুদীপ্ত চ্যাটার্জির সঙ্গে এমার্জেন্সি মিটিঙের জন্য অনুরোধ পাঠালো। সুদীপ্ত ছুঁচলো চোখে তাকিয়ে বৈশম্পায়নকে জিজ্ঞেস করল, এই খবরটি আপনি কোত্থেকে জানলেন?
— আমার প্রচুর বন্ধুবান্ধব আছে। খবর পেতে দেরি হয় না।
— বৈশম্পায়নবাবু, আপনি কিন্তু একটু ওভাররিয়্যাক্ট করছেন, সুদীপ্ত এবার একটু অসহিষ্ণু গলায় বললো।
— নট অ্যাট অল! আপনি এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে কি করে নিলেন? আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চেয়ারড প্রফেসর!
— বৈশম্পায়নবাবু, এই ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলোচনার আমি কোন প্রয়োজন অনুভব করিনি! এটি বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের সিদ্ধান্ত। তাদের উপর তো কোন কথা চলে না! শুনুন বৈশম্পায়নবাবু, আপনি পণ্ডিত লোক। আপনাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন। সুতরাং আপনার চাকরি নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।
— আর আমার কলিগদের চাকরি?
— দেখুন বৈশম্পায়নবাবু, আওয়ার ইউনিভার্সিটি ইজ অন দ্যা মুভ। ছোট ছোট ডিপার্টমেন্ট, যেমন বাংলা, ইতিহাস, ইংরেজি এগুলি আমরা ডাউনসাইজ করবো। এইসব কোর্সগুলি অনলাইনে চলে যাবে। একটি এআই ফার্মকে আমরা নিয়োগ করেছি। তারা তিন মাসের মধ্যে পুরো প্রোগ্রামটি অনলাইন করে দেবে। আপনি এসব মানডেন ব্যাপার নিয়ে কেন সময় নষ্ট করছেন? যান, দুটি আর্টিকেল নেচারে ছাপান! আমাদের ইউনিভার্সিটির মান আরো বাড়বে!
— মানালি, তুই আমাকে একটি ব্যাপারে সাহায্য করতে পারিস?
মানালি মনে মনে ভাবে আপনাকে তো কোনোদিনই আমার কিছুই অদেয় ছিল না বৈশম্পায়নদা! মুখে বলে, বলুন বৈশম্পায়নদা!
— তোদের এআই উইঙে যারা শঙ্খচিলের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে তাদের নাম আর হোয়্যার অ্যাবাউটস আমাকে পাঠাতে পারিস?
— কেন, কী করবেন বৈশম্পায়নদা?
— আই ওয়ান্ট টু স্টল দেয়ার শঙ্খচিল প্রজেক্ট!
— কীভাবে করবেন?
— সেটি আমাকে ভাবতে দে।
— ঠিক আছে! এটি কিন্তু ক্লাসিফাইড অ্যান্ড কনফিডেন্সিয়াল ইনফরমেশন। আমি তবুও করবো।
— তুই আরো একটি ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারবি?
— কী?
— তোদের কোম্পানিতে যে নেটওয়ার্ক আছে তার একটি ফায়ারওয়াল সিকিউরিটি আছে। সেটি কিছুদিনের জন্য ডিঅ্যাক্টিভেট করতে পারবি?
— কী বলছেন বৈশম্পায়নদা! ওরা জানতে পারলে তো আমি বড় বিপদে পড়ে যাবো!
— মানালি, বিপদে তুই এমনিতেই পড়বি! কিছুদিনের মধ্যে তোর ওই গতানুগতিক কাজের জন্য এআই তৈরি হবে। তোকে ওদের এমনিতেও আর কোনো প্রয়োজন হবে না। মানালি চুপ করে যায়।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার এই ছোট শহরটি সন্ধ্যে সাতটার পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। মানালি সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যখন তার এই দু বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকে, কোনো কিছুই করতে আর ভালো লাগে না। সামান্য কিছু রান্নাবান্না করে টিভির সামনে তাকিয়ে বসে থাকে। ইজরায়েল গাজা ইউক্রেনের রক্তারক্তি শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে যায় মানালি। এরই মধ্যেই স্থানীয় খবর আসে ছেলে মাকে খুন করেছে বা কোনো সেভেন ইলেভেন স্টোরে ডাকাতি হয়েছে। সারা পৃথিবী ধ্বংসযজ্ঞে মেতেছে। তার নিজের জীবনের গতিও যেন কীভাবে হারিয়ে গেছে! তার মধ্যে ডিপার্টমেন্টে গত দু সপ্তাহ ধরে এই দুর্ঘটনা! তিন তিনজন কলিগ হাসপাতালে আর দুদিন আগে মুশফিকের এই ভয়ানক মৃত্যু! চ্যাড এখনো কোমায়। পাপন আর টিম একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছে কিন্তু দুজনেই এখনো আইসিইউ তে। যতদূর ও জানে তিনজনেরই ভয়ানক ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। পাপন আর টিম এখনো ভালোভাবে কথাবার্তা বলতে পারছে না। এগুলি কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এই তিনটি ঘটনার মধ্যে কি কোন যোগসূত্র আছে? তিনজনেই এআই সেলে কাজ করতো আর তিনজনেই কোড লিখতে লিখতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাত আটটায় মানালির ফোন বাজলো। সহকর্মী রাজদীপের ফোন। মানালির বাড়ি থেকে দশ মাইল দূরে থাকে আর এক শহরে। রাজদীপ কলকাতা থেকে একটি এআই ডিগ্রি করে গত তিন মাস ইনফিনিটিতে চাকরি করছে।
— কী করছিস মানালি?
— কিছু না! বল কী খবর?
— মানালি, তোর সঙ্গে একটু কথা আছে। হাতে সময় আছে?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল!
— মানালি, আমার খুব ভয় করছে! আমার মনে হয় আমাদের কম্পিউটারে কোনো ভয়ানক ভাইরাস ঢুকেছে! যা সব ঘটছে তা কোনো হ্যাকারের কাজ। আমরা কেউই নিরাপদ নই।
মানালি চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বসা গলায় জিজ্ঞেস করল, এও কি সম্ভব? কোনো কম্পিউটার ভাইরাস কি মানুষ খুন করতে পারে?
— কে জানে মানালি! এক বছর আগে তুই কখনো ভেবেছিলিস তুই যা চাইছিস চ্যাটজিপিটি ঠিক সেইরকম লিখে দেবে? তোর কোড লিখে দেবে? আমার খুব ভয় করছে রে! আমিও তো একই উইঙে কাজ করি। হয়তো এরপরে আমি...!
— কী যা তা বলছিস! আচ্ছা এখন রাখি।
রাত এখন একটা। মানালির চোখে ঘুম নেই। প্রচুর এলোমেলো চিন্তায় মনটা ভার হয়ে আছে। বৈশম্পায়নদা ওদের এআই সেলের কর্মীদের ইমেল অ্যাড্রেস চেয়েছিলেন। তারপর ওর অনুরোধে মানালি কোম্পানির ফায়ার ওয়াল সিকিউরিটি কম্প্রোমাইজ করেছে। তা হলে কি এই ঘটনাগুলির সঙ্গে ওঁর কোনো যোগ আছে! কী হচ্ছে এসব!
হোয়াটসঅ্যাপে বৈশম্পায়নের নম্বর টিপলো মানালি।
— কী রে মানালি! এখনো জেগে আছিস?
— বৈশম্পায়নদা, আমার ভয় করছে!
— কেন রে?
— তুমিই কি এসব করছ?
— কী বলছিস?
— গতকাল আমার এক সহকর্মী ভয়ানক স্ট্রোক হয়ে মারা গেছে কোড লিখতে লিখতে। গত সপ্তাহে আরো তিনজন কর্মী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে কোড লিখতে লিখতে! তিনজনেরই অসুস্থতা একই ধরনের। এসব কী হচ্ছে বৈশম্পায়নদা?
ফোনের ওপারে স্তব্ধতা।
— আছো বৈশম্পায়নদা?
— আছি।
— কিছু বলো!
— মানালি, আমি কাউকে মারতে চাইনি। আমি শুধু তাদের এ আই এর কোড লেখা বন্ধ করতে চেয়েছিলাম।
—কী বলছো বৈশম্পায়নদা! তুমি!!!
— মানালি, তুই আমাকে বিশ্বাস কর আমি সত্যিই কাউকে মারতে চাইনি। যেদিন শুনলাম আমাদের ভিসির কাছ থেকে যে ইনফিনিটি আমার কলিগদের চাকরি খতম করে দেবার জন্য কোড লিখতে শুরু করেছে, আমার মাথায় আগুন জ্বলে গিয়েছিল। আমাদের ভিসিকে অনেক অনুরোধ করলাম এ ব্যাপারটি বিবেচনা করে দেখতে। সুদীপ্ত আমার কোনো কথাই শুনলো না।
— বৈশম্পায়নদা, এ তুমি কী করেছো? আমি তো ভাবলাম তুমি এআই সেলে ভাইরাস ঢুকিয়ে ওদের কোডগুলিকে নষ্ট করে দেবে। কিন্তু এতো খুন!
— আমি তো তাই করবো ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তারপর ভেবে দেখলাম ওদের কোড ডিলিট করে কিছুই করা যাবে না। ওরা নিশ্চয়ই এসব কোডের ব্যাকআপ করে রেখেছে। আমি তাই ঠিক করলাম এই কোড নির্মাতাগুলিকে ডিজেবল করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
মানালি বজ্রাহত হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে বলল, বৈশম্পায়নদা, আমার কাছে আর কোন পথ খোলা নেই। আর দু’দিন বাদে কোম্পানি বাইরে থেকে এক্সপার্ট আনছে এ ব্যাপারে সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য। ওরা জানতে পারবে আমিই ফায়ারওয়াল খুলে দিয়েছি। আমাকে এখনই পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে। সব কথা কনফেস করতে হবে! তোমার নামও। বৈশম্পায়ন জানলো না কথা বলতে বলতে মানালির গাল বেয়ে দরদর করে দু চোখের ধারা নেমেছে। সে কি দুঃখে, রাগে না বিশ্বাসভঙ্গের নিরুপায় অভিমানে, সে নিজেই জানে না!
সে যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারে না তার ভালোবাসার মানুষটি এমন সুনিপুণ মৃত্যু রচনা করতে পারে। আচ্ছা, একটুও মায়া হলো না বৈশম্পায়নদার? তার জন্য! আজ সে সত্যি বোঝে, বৈশম্পায়নের হাতে সে এক অস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়! কিন্তু কই, তবু তার নিজের মোহ ভঙ্গ হয় না কেন!
বৈশম্পায়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর বলে, আই অ্যাম সরি মানালি। তোকে এরকম বিপদে ফেলার জন্য। হ্যাঁ, তুই গিয়ে সব বল। আমার কথা বলিস। আমি সত্যিই মানুষ খুন করতে চাইনি, এটুকু বিশ্বাস কর!
কম্পিউটারের কোড হলো রাশি রাশি এক আর শূন্যের সমন্বয়। সেই এক আর শূন্য তরঙ্গগুলিকে সাজিয়ে কোড নির্মাতা যা করতে চাইছেন তাই করেন। এই বিদ্যাতে কম্বিনেটোরিয়াল গণিতের পারদর্শিতা প্রয়োজন। বৈশম্পায়ন গত পনেরো বছর এই নিয়ে গবেষণা করছে। ইদানিং সে চিন্তা ভাবনা করছে কম্পিউটার কোড থেকে কিভাবে শব্দ সৃষ্টি করা যায়। সেই শব্দ সুমধুর সংগীত হতে পারে আবার মারক ধ্বনিও হতে পারে। কোনো একটি শব্দ তরঙ্গ যদি সাত মিলিহার্টজ-এর নিচে চলে যায় সেটি ব্লুটুথ ব্যবহার করে ইয়ারফোনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে সঞ্চালন করলে মানুষের চিন্তাশক্তি ব্যাহত হতে পারে, ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে। এয়ার এম্বলিজম হয়ে ফুসফুস ফেটে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে এই ধরনের শব্দ তরঙ্গ তৈরি করতে অনেক বিদ্যুতের প্রয়োজন। ওঁর পদার্থবিদ এক বন্ধুর কাছে শুনেছিল টেসলা কয়েল দিয়ে এই বিদ্যুৎ তৈরি করা সম্ভব। এসব বিষয় নিয়ে বৈশম্পায়ন বহুদিন চিন্তা করছে। যুদ্ধবাজ দেশগুলি বৈশম্পায়নের এই গবেষণার খবর পেলে কোটি কোটি টাকায় বৈশম্পায়নকে কিনে ফেলবে। এই গবেষণা বৈশম্পায়নের নেশা। এর থেকে টাকা করার কথা তার মাথাতেও আসে না। শুধু ভাবতে ভাবতে চার পাশে অন্ধকার নেমে এলে তার শাণিত চোখ দুটি ঝকঝক করে!
যেসব কোম্পানি কৃত্রিম বুদ্ধির চর্চা করছে তাদের ওপর বৈশম্পায়নের খুব রাগ। এআই-এর দৌরাত্ম্যে রাশি রাশি চাকরি ধ্বংস হচ্ছে, সাধারণ মানুষের রুজি রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যারা এই কোডগুলি লিখছে তারা কি কৃত্রিম বুদ্ধির এই কুফলগুলির কথা ভাবছে? ব্রিটেনে কিছুদিন আগে একটি শহরে এ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক অধিবেশন হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিদানবকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অদূর ভবিষ্যতে এই দানব ভয়াবহ আকৃতি নিতে পারে। গোটা একটি দেশকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। যারা কৃত্রিম বুদ্ধির কোড লিখছেন তাদের এসব ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই। যত কোড লিখবে তত টাকা। কোড নির্মাতাদের মধ্যে এক ধরনের ঔদ্ধত্যও আছে যা বৈশম্পায়ন বরদাস্ত করতে পারে না। ওর আইআইটির বন্ধু যোগেন হাজরা, ব্যাঙ্গালোরে এই ধরনের একজন ভাড়াটে ইঞ্জিনিয়ার। কথা প্রসঙ্গে বলল একদিন, আরে বস্, ওসব থিওরি টিওরি কপচে আর অঙ্ক কষে কিছু হবে না। পড়ে আছো তো উত্তরবঙ্গের কোন খাজা ইউনিভার্সিটিতে, তোমার মত ব্রেনের হোয়াট আ ওয়েস্ট!
এখন এই যন্ত্রদানব উত্তরবঙ্গের এই ঘুমন্ত শহরটিতেও ঢুকে পড়ছে। একটা কিছু করা দরকার! কিন্তু মানুষ খুন করতে বৈশম্পায়ন চায়নি। সে চেয়েছিল এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্যদের একটু শাস্তি দিতে। এখনো চোখ বুজলে নটরাজের মতন বাবানদার চোয়াল শক্ত করা মুখটি দেখতে পায় বৈশম্পায়ন। সত্তরের দশকে দিনবদলের স্বপ্ন দেখতো বাবানদা। শিলিগুড়ির কাছেই একটি গ্রামে সংগঠনের কাজে অনেকদিন কাটিয়েছিল। তারপর কোথায় হারিয়ে গেল কেউ জানে না। বন্ধুরা বলতো পুলিশের সঙ্গে কমব্যাটে মারা গেছে। এই শিলিগুড়ি বৈশম্পায়নকে টানে। তাইতো সে এখানে রয়ে গেলো। বাবানদার আপোষহীন সত্তাই বৈশম্পায়নকে উদ্বুদ্ধ করলো এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবদের শাস্তি দিতে।
যন্ত্রদানবের সঙ্গে এই যুদ্ধের জন্য ওর একজন বিশ্বস্ত সহকারীর দরকার ছিল। মানালি ওর ভীষণ প্রিয় ছাত্রী। যখন মানালি ওর কাছে পিএইচডি করছে, দু'জনের সম্পর্ক ছিল গুরু শিষ্যের, তখনই বৈশম্পায়ন বুঝেছিল মানালির মনের কথা। কিন্তু বৈশম্পায়ন এত দিনেও বুঝে উঠতে পারল না নিজেকে, তার নিজস্ব যৌনসত্তাকে। ঘুমের মধ্যে কতবার বাবানদার রক্তমাখা মুখের দুঃস্বপ্ন দেখে সে জেগে উঠেছে। ঘামে গা ভিজে গেছে। মানালির প্রতি বৈশম্পায়নের রোমান্টিক কোনো আকর্ষণ নেই। কিন্তু সে কথা কি খোলাখুলি ওকে বলা যায়? ভারি ভালো মেয়ে মানালি! তাই তো বৈশম্পায়ন তড়িঘড়ি মানালিকে বিদেশে পাঠাবার বন্দোবস্ত করলো।
মানালির ফোন কেটে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে সে। এক গভীর অপরাধবোধে বৈশম্পায়নের মন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। মেয়েটি তো ওকে ভালোই বেসেছিল! ওর এই নিজের তৈরি যুদ্ধে মানালিকে স্বার্থপরের মত কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। কিন্তু এ ছাড়া তো ওর কাছে আর কোনো পথও খোলা ছিল না।
ব্যাকপ্যাক নিয়ে এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটে বৈশম্পায়ন। হিমেল বাতাস ওর শরীরের প্রতিটি কোষে আঘাত করছে। অন্ধকারে বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়েছে সে। সারা শরীরে প্রচুর ক্ষত আর রক্তক্ষরণ। তাও নিজেকে শাস্তি দিতে এই কঠিন পথ চলতে হবে তাকে। এ তার প্রায়শ্চিত্ত! হে হিমালয়, আমি তোমাকে বলেছিলাম একদিন তোমার কাছে আমি ঠিক চলে যাব। কেউ আমাকে আর খুঁজে পাবে না। আজই তো সেই দিন!
সকাল হয়ে আসছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার শৃঙ্গে সূর্যের ঝিলিমিলি। এতক্ষণে হয়তো ইন্টারপোলের পুলিশ বাহিনী তার ইউনিভার্সিটির ফ্ল্যাটে ঢুকে তল্লাশি করছে।