ভূতবাজারের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই সবাই। শোনো নি! অমন সুন্দর একটা জায়গা! ঘন, খু- উ-উ-ব ঘন জঙ্গল, যেখানে বড়ো বড়ো গাছের ডালপালা ভেদ করে সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছায় না, তেমন একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অনেক দূর গেলে দেখবে, হঠাৎ করে একটা ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠের ঠিক মধ্যিখানে একটা জলা। জলা ঘিরে সারি সারি শ্যাওড়া গাছ। জলার নরম ঠান্ডা কাদায় পা ডোবালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়; তীব্র মেছো গন্ধে পেট আনচান করে ক্ষিদে পায়। তার ওপর ফুরফুরে হাওয়ায় শ্যাওড়া গাছের পাতা নড়ে ওঠার ঝিরিঝিরি শব্দ - আহা! মনোরম এই মৎস্যগন্ধী জলার ধারেই ফি অমাবস্যার রাতে বসে ভূতবাজার।
ভূতেদের জীবনে প্রয়োজনীয় যাবতীয় পণ্যসামগ্রী মেলে ভূতবাজারে। জলার টাটকা মাছ: জলার মরা আধপচা মাছ; এমনকি তাতেও যদি কারুর না পোষায়, তাহলে হারান জেলের নিজের হাতে শুকোনো শুঁটকি মাছ; দু মাইল দূর থেকে বাতাস ম ম করে সেই শুঁটকির গন্ধে। হারান জেলে দেখতেও বেশ জম্পেশ, করোটি দেখেই বোঝা যায় হারানের জীবিত অবস্থায় মা যত্ন করে সর্ষের বালিশে শোয়াতো তাকে। পরস্পরের গা টেপাটিপি করে অল্পবয়সী পেত্নীর দল ভিড় জমায় তরুণ সুদর্শন এই মেছো ভূতের দোকানে।
একটু এগিয়ে ভূতবাজারের বস্ত্রবিপণী; শিশিরের মত পাতলা ফিনফিনে শাড়ি; কুয়াশার মতো মায়াবী ওড়না; মেমসাহেবদের লেস দেওয়া দুধসাদা গাউন! সাহেবি ওয়েডিং গাউন দেশী পেত্নীদেরও খুব পছন্দের। শাঁকচুন্নিদের জন্য সরু, মোটা, নানান কারুকাজের শাঁখা। আর পেত্নীদের উল্টো পাতা চরণকমলে পরার মত রিনিঝিনি নূপুর, রংবেরংয়ের বাহারি চটি, টকটকে আলতা!
ব্রহ্মদৈত্যদের অবশ্য এত জামাকাপড়ের বাহুল্য পোষায় না। তেনারা একটু এগিয়ে কমল শাকচুন্নির কাছ থেকে কেনেন মোটা কাপড়ের সাদা ধুতি। একসাথে ন খানা নিলে দশমটা ফ্রী। বামুন ঠাকুরদের দক্ষিণা।
ছোকরা প্রেতদের জামার স্টাইল নিয়ে বাছাবাছি নেই। তাদের ধুতি পিরান, কুর্তা পাজামা, শার্ট প্যান্ট সবই চলে। সাদা হলেই হলো। সাদা না হলে নিজেদের ঠিক ভূতভূত মনে হয় না।
সময় থেমে থাকে ভূতবাজারে। সভ্যতার পালাবদল ঘটে, জঙ্গলের গভীরে আধুনিক জগতের হাওয়া ঢোকে না সেভাবে। শ্যাওড়া বাগানের ঝিমুনি মেরে থাকা প্রাচীন প্যাঁচা-পেঁচি দম্পতির মতোই বড়ো ঢিমে তালে চলে ভূতবাজারের জীবন প্রবাহ। ভূতেদের হাতে অঢেল সময়, তাই কোনো বিষয়েই কোনো তাড়া নেই কারুর।
সেদিন, থুড়ি, সেই রাতেও ধীর লয়ে শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল হাটবার। ভিজে চুলে কচুরিপানার ফুল গুঁজে বিকিকিনি সারছিল শাকচুন্নির দল। জগন্নাথ পটো মাটির পাত্রে রং গুলে মন দিয়ে আঁকছিল পশুপাখি, আলপনা, ঠাকুর দেবতার ছবি। কমল শাকচুন্নি গুনগুন সুর ভাঁজতে ভাঁজতে চরকায় সুতো কাটছিল নিজের মনে; স্বদেশী আমলে চরকা চালাতে চালাতে পুলিশের লাঠির ঘায়ে মরেছিল কমলমণি, তার পর থেকে চরকাসুদ্ধু এসে উঠেছে ভূতবাজারে। ষোড়শী সুন্দরী ঘাড়বেঁকা পেত্নী মণিমালার সঙ্গে মরা আমগাছের মগডালে বসে রসিয়ে প্রেমালাপ করছিল তরুণ প্রেত ঘাড়বেঁকা রাজচন্দ্র। প্রেমিকযুগল দুজনেই গলায়-দড়ে কিনা, কাজেই দুজনেরই ঘাড় একটু বেঁকা। আর সবচেয়ে লম্বা শ্যাওড়া গাছের উপর থেকে এ পাড়ার বহুদিনের পুরোনো পেত্নী মুলোদন্তী আতস কাঁচ জাতীয় কিছু চোখে লাগিয়ে মাছপোড়া খেতে খেতে রাজচন্দ্র আর মণিমালার প্রেমপর্ব দেখার চেষ্টা করছিল।
পিঠে হঠাৎ একটা ঝাপটা লাগায় চমকে উঠলো মুলোদন্তী। ট্যারা এসে বসেছে তার গা ঘেঁষে। সস্নেহে ওর মুখে এককুচি মাছ তুলে দিল মুলোদন্তী। ট্যারা শুধু ভূতবাজারের বা শ্যাওড়া বাগানেরই নয়, ট্যারা এই সমস্ত জঙ্গলের প্রাচীনতম প্রাণী। সম্ভবত জীবিত মৃত সব মিলিয়ে জগৎসংসারে টেরাড্যাকটিল কুলের একমাত্র প্রতিনিধি। মুলোদন্তীর পোষা পাখি ট্যারা। ওকে "রাধে কেষ্ট" বলতে শিখিয়েছে মুলোদন্তী।
মাঠের একপাশে মাদুর পেতে বসে হরিচরণ বাউল একতারা বাজিয়ে খোনা গলায় গান ধরেছিল, "মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা…" কন্ধকাটার দলটা বাদে ধন্য ধন্য করছিল সবাই।
হঠাৎই রাতের এই নিঝুম স্তব্ধতা ভেঙে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর ঠাকুর। বেঁচে থাকতে প্যালিওন্টোলজিস্ট বা জীবাশ্মবিদ ছিলেন প্রফেসর। গবেষণার কাজে জঙ্গলে এসে প্রথমে কম্পাস এবং তার পর পথ হারিয়ে সসেমিরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি, হঠাৎ চোখে পড়লো ট্যারা। হলোসিন যুগে টেরাড্যাকটিল দেখবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে ট্যারাকে তাড়া করতে করতে তিনি দড়াম করে আছাড় খেলেন জলার পাড়ে। আর এই অঞ্চলের ভূত মাত্রেই জানে, জলার এক অংশের কাদা একেবারে চোরাবালির বাপ। সেই মরণ আছাড় খাওয়া ইস্তক এই জলার পারেই থেকে গেছেন প্রফেসর ঠাকুর।
প্রফেসর-এর চিৎকারে সবাই ঘুরে তাকায়। সাত পুরোনো দাবানলে পুড়ে যাওয়া একটা গাছের টঙে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে আঙুল দেখাচ্ছেন প্রফেসর। সত্যি তো, ওটা কি বস্তু!!
আকাশ থেকে কোনাকুনি ভাবে নেমে আসছে একটা বড়ো আগুনের গোলা!
"এবার আমরা মরব। সত্যিই মরব। এ এক মহা উল্কা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। একদিন পৃথিবী থেকে ডাইনোসর এবং অজস্র প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল এমনই উল্কাপাত। এবার আমাদের পালা।"
শেয়াল শকুন কিছুই নেই আশপাশে, তবু নিঃশব্দ নিশুত রাত্তিরে অধ্যাপকের কণ্ঠস্বর বড়ো অমঙ্গলজনক শোনালো ব্রহ্মদৈত্যদের কানে।
"আঃ, অধ্যাপক, তোমার ঐ বিজ্ঞান আওড়ানো বন্ধ করো দিকিনি।" অগ্নি গোলোকের দিকে একবার তাচ্ছিল্য ভরে তাকিয়ে মন্তব্য করেন প্রবীণ ব্রহ্মদৈত্য মুখুজ্যে জ্যাঠা। "ভূতেদের আবার মরা বাঁচা কিসের!"
"আর ওই প্রাগৈতিহাসিক না কি বললে, ওটা মোটেই ঠিক কথা নয়। প্রাচীন জীবজন্তুরা সবাই যে নিশ্চিহ্ন হয় নি, সেটা তুমি ভালই জানো।" ট্যারার ডানায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলে মুলোদন্তী।
আগুনে জিনিসটা জঙ্গলেই কোথাও একটা এসে পড়ে। জোর শব্দ হয়। কানে হাত দেয় ভূতবাজারের বেশিরভাগ জনতা। কানে হাত দিতে না পারলেও মাটির কেঁপে ওঠাটা বোধহয় কন্ধকাটারাও টের পায়।
আগুনটা জ্বলতে দেখা যায় বেশ কিছুক্ষণ। বনে ছড়িয়ে যায় না অবশ্য। একপশলা বৃষ্টিতে নিভে যায় একটু একটু করে। ভূতবাজারে অংশগ্রহণকারীরা সবাই একটু অস্বস্তি বোধ করে। কেউ জলার ধার ছেড়ে নড়ে না।
এমন সময় হুড়মুড় করে উপস্থিত হয় বেঘো কার্তিক। কার্তিক এককালে ছিল দুঃসাহসী শিকারী, কোনো পশুপ্রাণীকে ভয় পেত না, একবার একা দু-দুটো কুমিরকে ঘায়েল করে নদী থেকে উঠে পালিয়েছিল। অথচ সেই কার্তিককেই একদিন সুখী বাঘিনী প্রায় আস্ত গিলে ফেলল। কিন্তু বাঘের পেটে যাওয়ার আগে ভোজালি দিয়ে তাকে এমন ঘায়েল করেছিল কার্তিক, যে সুখী বাঘিনীও দুদিন পর ভূতবাজারে এসে ভিড়ে যায়। মরণে সব শোধবোধ; কার্তিক আর প্রাণীহত্যার পক্ষপাতী নয়। সুখী বাঘিনীও এখন কার্তিকের পোষ মেনে গেছে। হুলো বেড়ালের মত গুটিশুটি মেরে কার্তিকের পায়ের কাছে বসে থাকে। কার্তিক ওর পিঠে চড়ে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। সুখলতা বা সুখী নামটাও কার্তিকের দেওয়া। এই সুখী বাঘিনীর পিঠে চড়েই ভূতবাজারের ময়দানে প্রবেশ বেঘো কার্তিকের। আকাশ থেকে আগুন ঝরানো বস্তুটার সংবাদ নিয়ে।
"কি বুঝলি, বেঘো?" গায়ের সাদা চাদরখানা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে প্রশ্ন করেন ব্রহ্মদৈত্য মধুসূদন তর্কালঙ্কার।
"ভয়ঙ্কর ব্যাপার, মধু জ্যাঠা। একটা বিশাল বড়ো আকাশযান ভেঙে পড়েছে। পেটে অনেক অনেক মানুষ। তারা এখানে এসেই ভিড়বে মনে হয়। খুব অদ্ভুত সব লোকজন।"
"অদ্ভুত লোক?" ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেন অধ্যাপক ঠাকুর। "তাহলে বোধ হয় মানুষ নয়। এলিয়েন। অন্য গ্রহের প্রাণী।"
"না না, ওসব নয়। এরা মানুষ। তবে হাবে ভাবে আমাদের চেয়ে আলাদা। সবাই কেমন যেন ঝগড়াটে, সবাই যেন খুব তাড়ায় আছে, একটা ষণ্ডামার্কা লোক গজগজ করছিল পরের গাড়ি ধরতে পারবে না বলে। এক সুন্দরী মহিলাকে ঘেরাও করে জিজ্ঞেস করছিল কয়েকজন, 'নন ভেজ চেয়েছিলাম, ভেজ দিলে কেন? ভেজ খাওয়ার জন্য পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেছি?'"
বেঘো কার্তিকের পর্যবেক্ষণ একেবারে নির্ভুল। গভীর জঙ্গলে এয়ারবাস ক্র্যাশ করে চারশোর অধিক মানুষের প্রাণ হারানোর খবরটা সভ্য দুনিয়ার প্রায় সব সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল। আর গভীর জঙ্গলে গিয়ে উদ্ধারকার্য চালানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনায় মুখর হয়েছিল বেশ কিছু টিভি চ্যানেল। মোদ্দা কথা, এই দুর্ঘটনায় নিহত চারশোর অধিক আত্মার শান্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ হয় নি।
ভূতবাজারের এই অতি প্রাচীন কালের বুদবুদটার মধ্যে হঠাৎ করে এসে ঢুকে পড়ল একদল আধুনিক ভূত। তারা যে আর মানুষ নয়, এই প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগল তাদের। মানুষ থেকে ভৌতিভবনের একটা পদ্ধতি আছে। সেটা সুখের নয়। হঠাৎ করে নশ্বর জগতের টান কাটিয়ে ওঠা বেশ কঠিন কাজ। ভূতেদের শরীর নেই। কাজেই ক্ষিদে তেষ্টা ক্লান্তি ঘুম জাতীয় কিছু থাকার কথা নয়। তবু অশরীরী জিভ খোঁজে পরিচিত বস্তুর স্বাদ, সদ্য ছেড়ে আসা ইহজীবনটাকে নিয়ে, অপূর্ণ উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখার লোভে একটা ঘুমের ভাবও আসে। তারপর আস্তে আস্তে বোধোদয় হয়, আর পাওয়ার কিছু নেই। ছোটদের ক্ষেত্রে মেনে নেওয়াটা অনেক বেশি কষ্টের। ক্ষুদেরা প্রথম প্রথম আইপ্যাড খোঁজে, পিজা কুকি চাউমিন খেতে চায়, বাড়িতে ফেলে আসা খেলনা, পোস্টারের বিরহে কাতর হয়। আস্তে আস্তে বোঝে, তাদের সামনে এখন অনন্ত জীবন। এই বয়সটাও চিরকালের, বেড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। বড়ো হয়ে ডাক্তার উকিল রকস্টার কার্টুনিস্ট হওয়া আর সম্ভব নয়। ক্যালেন্ডার দেখে জন্মদিন পালন করে মোমবাতিতে ফুঁ দিলেও বয়সটা থেকে যাবে একই জায়গায়। অথচ এই বয়সের ভালো-লাগা জিনিসগুলো প্রায় সবই নাগালের বাইরে। তারা মা বাবাদের জড়িয়ে কান্নাকাটি করে কদিন। তারপর একটু একটু করে সয়ে যায়।
বড়দের সর্ব সমক্ষে কাঁদবার উপায় নেই। নিজেদের আচমকা ভূত হয়ে যাওয়ার দুঃখ ভুলে ক্ষুদেদের সান্ত্বনা দিতেই চলে যায় প্রথম কদিন। তারপর সব সামলে সুমলে তারা বেরোয় চারদিক ঘুরে দেখতে। ভূতবাজারের বোধ হয় একটা আলাদা চৌম্বকক্ষেত্র আছে যা অশরীরীদের টানে। প্লেন ক্র্যাশ হওয়া ভূতের দল জায়গাটা ঠিক খুঁজে পেয়ে যায়। এখানেই বসত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রথম প্রথম প্রাচীন ভূতেরা শুধু সব দেখে যায় দূর থেকে। যেচে গিয়ে কেউ আলাপ করে না। ভূতসমাজের হোতা হিসেবে প্রবীণ কজন ব্রহ্মদৈত্য আর মামদো মৌলভী মিলে ঠিক করেন, এদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে না মেশাই সমীচীন। হাবভাব দেখে মনে হয় না বয়স্কদের এরা তেমন মান্যগণ্য করে। বরঞ্চ সবকিছুতেই একটু অশ্রদ্ধার ভাব। কার্তিকের দেখা ষণ্ডা লোকটাকে এতদিনে সবাই চিনে ফেলেছে, সে মাঝে মাঝেই গাঁকগাঁক করে চেঁচায়, ফ্লাইট সময়মত না পৌঁছনোয় তার পরের প্লেন ধরা হলো না, অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে গেল। আরে হতভাগা, টাকা দিয়ে আর করবিটা কি? কিন্ত ষণ্ডা সেটা বোঝে না, সময়ে অসময়ে হাহাকার করতে থাকে। মুখুজ্যে জ্যাঠা পুরোনো ভূতেদের সবাইকে বলে দেন, এই আগন্তুকদের থেকে দূরে থাকতে। আর আধুনিক ভূতেদেরও বেশ কদিন লাগে প্রাচীনদের অস্তিত্ব টের পেতে। টের পাওয়ার পর তাদেরও একটু ইতস্তত হয় গিয়ে আলাপ করতে। তবে ক্ষুদেরাই প্রথম উদ্যোগ নেয়।
জলার ধারে শামুক গুগলি কুড়িয়ে শাড়ির কোঁচড়ে পুরছিল পুতুলরানী, তার সঙ্গে ভাব জমায় এগারো বছরের সৌরদীপ।
"তোর নাম কি রে? বয়স কত? কোন ক্লাসে পড়িস?"
"আমি পুতুলরানী। মরেছিলাম এগারো বছরে। তবে সে অনেককাল আগের কথা।"
"কোন ইস্কুলে, কোন ক্লাসে পড়িস বলবি না?"
"পড়ি না। মেয়ে বউরা আবার ইস্কুলে যায় না কি?"
"সব যায়। লেখাপড়া না করলে ফিউচার অন্ধকার। তুই মেয়ে না বউ?"
"বাঃ! শাঁখা সিঁদুর দেখছ না? আমি বউ; ন বছরে বে হয়। তবে বরের মুখ বা নাম কিছুই মনে নেই।"
"হুঁ, এসব বাচ্চাবয়সের বিয়ে আজকাল বেআইনি। তুই খেলাধুলো করিস? লেগো খেলবি? আমার একসেট আছে।"
সারাদিন পুতুলরানীর সঙ্গে লেগো খেলে মায়ের কাছে ফেরে সৌরদীপ। মাকে বলে নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপের কথা। তার মা ঠোঁট উল্টে বলে "যত্তসব গেঁয়ো ভূত!"
"বাঃ, কি মজা! পুতুলরানী গেঁয়ো ভূত আর আমি শহুরে ভূত। ঠিক টাউন মাউস অ্যান্ড কান্ট্রি মাউস-এর মত।"
মেলিসা টমসনকে বড়ো মনে ধরে হরিচরণ বাউলের। সে ফর্সা ফুটফুটে মেমসাহেব বলে নয়। মনে ধরে, কেননা সেও একটা বাজনা বাজায়। গান গায়। একতারার চেয়ে অনেক জটিল, তবু তারযন্ত্র বলে কথা! অন্য ভাষায় অন্য রকম গান গায় মেলিসা। গানবাজনা শোনার লোভে লুকিয়ে লুকিয়ে মেলিসার পিছু পিছু ঘোরে হরিচরণ। মেলিসা বাকি পেত্নীদের মত জলার মাঠে শ্যাওড়া গাছের ডালে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে থাকে না। সে তার বাজনা নিয়ে শিস দিতে দিতে জঙ্গলের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। আজ মেলিসার পরনে হাতকাটা হলুদ জামা, নীল পেন্টুলুন। নব্য ভূতেরা তাদের মত এত জামার রং নিয়ে বাছবিচার করে না বোধহয়। সাদা রংয়ের প্রতি আলাদা কোনো আনুগত্য নেই। কিংবা এদের আসার পর একদিনও সাদা জামার পসরা সাজিয়ে ভূতের হাট বসে নি বলেই বোধ হয়... মুখুজ্যে জ্যাঠা-ই বলেছেন, কদিন এদের ভাবগতিক ঠিকভাবে বুঝে নেওয়া যাক, ততদিন বরং বন্ধ থাকুক ভূতবাজার। হঠাৎ করে এরা যদি প্রাচীন ভুতেদের সঙ্গে দাঙ্গা বাধায় তাহলে সমস্যা... আপনমনে পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে মেলিসার পিছন পিছন অনেকদূর এসে পড়েছিল হরিচরণ, হঠাৎ, ঝোপঝাড়ের ওপাশে একী দৃশ্য! হরিচরণ বাউল এর অশরীরী সত্ত্বার হৃদয় থাকার কথা নয়, তবু অকস্মাৎ বেড়ে যায় হৃৎস্পন্দন। অন্তত হরিচরণের তাই মনে হয়। বনের ভিতর একটা টলটলে পুকুরের পাশে তার বাজনা নামিয়ে রেখে জলে সাঁতার দিতে নেমেছে মেলিসা। হলুদ জামা, নীল পেন্টুলুন পড়ে রয়েছে পুকুরপাড়ে। হরিচরণের হাঁ চট করে বন্ধ হয় না! একতারা গড়িয়ে পড়ে যায় তার হাত থেকে। আর গড়াতে গড়াতে গিয়ে ঠেকে মেলিসার বাদ্যযন্ত্রের পাশে! কি করবে এখন হরিচরণ? একতারা ফেলে উল্টোদিকে দৌড় দেবে? নাহ, তা হয় না। চোখ বুজে হরিনাম জপতে জপতে পুকুরধারে নেমে আসে হরিচরণ। কি লজ্জা, একতারার শব্দে মেলিসাও মাঝপুকুর থেকে সাঁতরে চলে আসে পাড়ে। হরিচরণের একতারাটা তুলে নেয় সে। দু বার পিড়িং পিড়িং আওয়াজ করে। হরেকৃষ্ণ, মেমসাহেবের হাতে যেন যন্তরখানা ভেঙে না যায়, হরিচরণ বাউল কোনোদিন কাছছাড়া করে নি তার একতারাকে।
মেলিসা হাসিমুখে তাকায় তার দিকে। ইঙ্গিতে বোঝায়, সে গানবাজনা শুনতে চায়। বিকিনি পরা অবস্থাতে বেশ স্বচ্ছন্দ ভাবেই বসে পড়ে পুকুরপাড়ে গান শুনতে।
কপালের কাল্পনিক ঘাম মুছে একতারা বাজিয়ে গান ধরে হরিচরণ, "মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা/ ও তুই বেছে বেছে করলি জামাই/ সে যে চিরকালের ল্যাংটা!" ধুর, এত সব গান থাকতে এই গানটাই যে কেন মনে পড়ল এই সময়ে!
মেলিসার অবশ্য কোনো তাপ উত্তাপ নেই! সে হাসিমুখে তাল দিতে দিতে গান শোনে। মেমগুলো বড্ড নির্লজ্জ, পরপুরুষের সামনে এই পোশাকে! হরিচরণ লজ্জায় নিজের চোখ বন্ধ করে গাইতে থাকে "কটি তটে বাঘাম্বর, নির্গুণ বেটা গাঁজায় দেয় দম/ তার হাতে ত্রিশূল মাথায় জটা ঠিক ভিখারীর ঢংটা/ মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা।"
কিছুক্ষণ পর মেলিসা নিজের বাজনাটা তুলে নেয়। হরিচরণের সঙ্গে সেও সুরটা ধরে ফেলে। "গড়িয়ে সোনার পুতলী/ বুড়ো বরে বিয়া দিলি/ মেনকা গেলি ভুলে দেখে সাদা রংটা/ মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা!" নাহ, ভুল হয়ে গেল, অন্য কোনো গান নির্বাচন করা উচিত ছিল আজ। ভাগ্যিস মেমটা বাংলা বোঝে না! মেলিসার বাজনাটা কিন্তু বেশ! তালে তালে মাথা নাড়তে নাড়তে সুরটাও দারুণ বাজাচ্ছে সে! কপালে রসকলি কেটে বোষ্টমী সাজালে দিব্যি মানিয়ে যাবে। হঠাৎ করে একটা অন্যরকম ভালোলাগা বোধ হয় হরিচরণের, মেলিসাকে আর অতটা নির্লজ্জ মনে হয় না তার।
কদিন ধরেই একটা বেশ রংচঙে টিয়াপাখির আবির্ভাব ঘটেছে শ্যাওড়াবাগানে। জলার পারের এই জায়গাটার এমন মহিমা, চট করে জীবিত পশুপাখি এর ধারে কাছে ঘেঁষে না। কয়েকটা ডাকাবুকো দাঁড়কাক মাঝেমধ্যে এসে পড়লেও অন্ধকার হওয়ার আগে পালিয়ে যায়। কাজেই এই ন্যাজঝোলা লাল নীল টিয়াপাখি হয় মহা সাহসী নয় কাঠবোকা, কিংবা ট্যারা আর ওই ঝিম মারা প্যাঁচা দম্পতির মত সেও মরদেহের মায়া কাটিয়েছে। মুলোদন্তীর বড়ো ইচ্ছে এটাকে পোষ মানাবে। ছোটবেলায় তার বাড়িতে একটা পোষা টিয়াপাখি ছিল, সেটার অবশ্য সবুজ রঙ, লাল ঠোঁট আর আয়তনে অনেক ছোট। তুলনামূলক ভাবে এই পাখিটা অনেক বড়। একে "রাধেকৃষ্ণ" শেখালে নিশ্চয়ই চট করে শিখে যাবে।
"আয় রে আয় টিয়ে, নায়ে ভরা দিয়ে", সুর করে বলতে বলতে পাখিটাকে অনুসরণ করে মুলোদন্তী।
"ও কিন্ত মোটেই টিয়া পাখি নয়। ও স্কারলেট ম্যাকাও।" অচেনা গলার আওয়াজে চমকে ওঠে মুলোদন্তী। পিছনে ফিরে চোখ জুড়িয়ে যায়। ডাগর ডাগর চোখ, নরম দৃষ্টি, তিলফুলের মত নাক, পাতলা ঠোঁটের কোণে ছোট্ট তিলটা পর্যন্ত অবিকল এক রকম! মেয়েটার মুখটা একদম তার বাল্যসখী ইন্দুমতীর মত। তবে ইন্দুমতীর ছিল কোমর-ছাপানো চুল, এই মেয়ের চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা।
"আমার পোষা পাখি। নাম রেইনবো। একটু রেয়ার ব্রিড। আমার কলেজ লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড। ওকে ফেলে আসতে মন চাইছিল না তাই দেশে ফেরার আগে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্লেনে করে নিয়ে আসার পারমিশন জোগাড় করেছিলাম। এখন মনে হয়, যদি আর কাউকে দিয়ে দিতাম, রেইনবো আজ বেঁচে থাকত।"
মেয়েটা আরো বকবক করতে থাকে। মুলোদন্তী মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে তার দিকে। দুজন মানুষের মুখে এত মিলও হয়? আহা প্রাণসখী ইন্দু! এতদিন পরে ফিরে এল তার কাছে? কুশ্রী মেয়ের বিয়ে না হওয়ায় বাড়ির সবাই তাকে দুষত, গ্রামের লোকেরা তাচ্ছিল্য করত, একমাত্র স্নিগ্ধ সুন্দর ইন্দুমতীই ছিল তার একান্ত আপন! সবার কথাবার্তায় যখন তার বুকে শেল বিধত, ইন্দু, শুধু ইন্দুই পরম আদরে সোহাগে আগলে রাখত তাকে! ইন্দুর বিয়ে করে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেই তো... থাক সে কথা!
"এই দ্যাখো, আমার নামটাই তো বলা হয় নি এতক্ষণ। আমি রিয়া। তোমার নাম কি?"
নাম প্রকাশ করতে একটু লজ্জা পায় মুলোদন্তী । তবু বলে। ঝর্নার মত কুলকুল করে হেসে ওঠে ইন্দুমতী…রিয়া।
"যাঃ এরকম কারুর নাম হয় না কি! মা-বাবা কখনো মেয়ের এমন নাম রাখে?"
"মা নাম রেখেছিল মাধুরী। একটু বড়ো হতেই সবাই বুঝে গেল এমন নাম আমায় মানায় না। তখন থেকে গাঁয়ের লোক ডাকত মুলোদন্তী। মা মরেছিল দু বছর বয়সে, বাপ নিরুদ্দেশ, কাকা-কাকী যতদিন পারল দেখল, সতেরো বছর বয়সের পরও যখন বিয়ে হলো না, তখন বাড়িতে গঞ্জনার ঠেলায় টেঁকা দায় হলো। আমার সখী ইন্দুমতীই শুধু ভালোবাসত আমায়। চুল বেঁধে ফুল গুঁজে দিত, নিজের হাতে ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াত, লুকিয়ে লুকিয়ে আচার, নাড়ু, তিলকুট নিয়ে আসত নিজেদের ভাঁড়ার থেকে। সে ছাড়া কেউ মাধুরী বলে ডাকত না আমায়, সবাই ডাকত, মুলো ও ও ও!" পুরোনো অভিমানে একবার চোখ মুছে নেয় মুলোদন্তী।
রিয়া জড়িয়ে ধরে তাকে। "তোমার যুগে মেয়েদের জীবন খুব কষ্টের হতো, তাই না? আমি কিন্তু তোমাকে মাধুরী বলেই ডাকব এখন থেকে। এই সেরেছে, আমরা প্রাণ খুলে গল্প করছি, রেইনবো ওদিকে কোথায় পালিয়েছে কে জানে! আমি একটু খুঁজে আসি, তুমি সঙ্গে আসবে, মাধুরী?"
কত যুগ পরে সেই এক মায়াভরা দৃষ্টি, সেই এক মধু ঝরানো গলার আওয়াজ! "আসব রে ইন্দু, আসব!" মনে মনে বলে মুলোদন্তী। "এবার আর তোকে হারিয়ে যেতে দেব না।"
কন্ধকাটাদের দলটা নিজেদের মতই থাকে জঙ্গলে। সবাই সর্বদা একসঙ্গে, জোট বেঁধে। প্রাচীনকালে এরা ছিল সব দুঁদে ডাকাত, বনেবাদাড়ে লুকিয়ে থাকত, আর কাউকে জঙ্গল পার হতে দেখলেই হা রে রে রে বলে তেড়ে যেত। তাদের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত আশে পাশের গ্রামের মানুষ। তবে সুদিন কারুর চিরকাল থাকে না। একদিন রাজার সৈন্যরা এদের খুঁজে পেতে ধরে নিয়ে গেল, রাজার আদেশে সবার গর্দান নেওয়া হল। তারপর থেকে এরা একসঙ্গেই থাকে; বাকি ভূতেদের সঙ্গে সেরকম গলায় গলায় ভাব না থাকলেও কারুর সঙ্গে ঝামেলা করে না। তবু তাদের সম্পর্ক একটা ভয় ভয় ভাব রয়েছে মৃত্যুভয়হীন প্রেতাত্মাদের মনে। বহুদিন আগে নাকি মামদো মৌলভী দেখেছিলেন এদেরকে মাঝারি মাপের একটা নৌকো উল্টে সব নৌযাত্রীদের মুন্ডু উপড়ে নিতে, সব কটা উপড়ানো মুন্ডু পরস্পরের ধড়ে লাগিয়ে দেখেছিল কন্ধকাটারা। কোনোটাই 'ফিট' হয় নি। তবে এই ঘটনার পর পুরো ভূতসমাজ এদের বেশ সমীহ করে চলে, কেউ ভুলেও এদের ঘাঁটায় না। বেঘো কার্তিকের মত বীরপুরুষও নয়। সবাই ইচ্ছে করেই একটু দূরে থাকে এদের থেকে, এমনকি এত যুগ হয়ে গেল, এদের নামগুলো পর্যন্ত জানে না কেউ। সেটা অবশ্য অবাক হওয়ার মতো কিছু না। কারণ "নাম কি?" প্রশ্নটা কন্ধকাটাদের কেউ কানে শুনতে পায় না, মুখ ফুটে জবাবও দিতে পারে না। মুন্ডু না থাকা বড়ো বালাই।
নতুন ভূতেরা কেউ অবশ্য কন্ধকাটাদের নেপথ্য কাহিনী জানে না। ফার্স্ট ক্লাসের এয়ার হোস্টেস পরমা সুন্দরী রোমিলা, গীতি আর আফরিন মিলে একদিন গিয়ে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে এদের সঙ্গে। কন্ধকাটাদের বলে, তাদের "ফিজিক" নাকি এই ভূতবাজারের সেরা, নিয়মিত জিম-এ গিয়েও নাকি এমন ঈর্ষণীয় সিক্স প্যাক বানানো যায় না। অগত্যা এনারা যদি তাঁদের ডায়েট এবং এক্সারসাইজ সম্পর্কে কিছু টিপস দেন…কন্ধকাটারা এয়ার হোস্টেসদের কথা বুঝতে পারে না। কান না থাকলে বোঝার কথাও নয়। রোমিলার সপ্রশংস দৃষ্টি তাদের চোখে পড়ে না, সে তাদের সুঠাম বাইসেপে হাত রাখলে তারা ছিটকে যায়। রূপসীত্রয়ী বুঝতে পারে না গোলমালটা ঠিক কোথায়। যেখানে বেঁচে থাকা অবস্থায় তাদের কমপ্লিমেন্ট দেওয়ার জন্যে ছেলেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত সেখানে তাদের যেচে দেওয়া কমপ্লিমেন্টে এই নওজোয়ান ছেলেগুলোর এত অরুচি কেন?
মধুসূদন তর্কালঙ্কার ওদের আড়ালে ডেকে সাবধান করে দেন। "মা জননীগণ, এদের একটু এড়িয়ে চলাই মঙ্গল। এরা বেঁচে থাকতে মানুষ মারত, মরেও মানুষের মুন্ডুপাত করেছে, সেটা একজনের নিজের চোখে দেখা। নেহাত ভূতেদের আবার মারা সম্ভব নয়, কাজেই…"
সংলাপটা কানে যায় যোশী দম্পতির। এঁরা দুজন শুধু বহু ভাষাবিদই নন, মন্দাকিনী যোশী রীতিমত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বিশেষজ্ঞ। বেঁচে থাকতে বহু মূক বধির মানুষকে ভাষা জুগিয়েছেন, ইন্টারপ্রেটার-এর কাজও করেছেন তাদের জন্যে। তাঁদের রীতিমত মায়া হয় কন্ধকাটাদের ওপর। আহা রে, এক কালে সব ছিল অথচ আজ এরা চোখে দেখতে পায় না, কানে শুনতে পায় না, মুখে কিছু বলতে পারে না। যতই খুনে ডাকাত হোক না কেন, মনে মনে এরা নিশ্চয়ই খুব অসহায়! অবশ্য মুন্ডু ছাড়া মানুষের শরীরে কোনো কিছুই কাজ করার কথা নয়, কিছু শেখালেও মগজে পৌঁছনো সম্ভব নয়, তবে ভূতেদের এনাটমি যে মানুষের থেকে আলাদা এটা গত কয়েক দিনে বেশ বুঝে গেছেন অজিত আর মন্দাকিনী। প্রেতজীবনে প্রবেশ করে অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছিলেন দুজন, হঠাৎ করে যেন একটা লক্ষ্য খুঁজে পেলেন। কন্ধকাটাদের জন্য একটা পাঠশালা খুলে বসলেন তাঁরা। আর কি অদ্ভুত ব্যাপার, যাদেরকে এত যুগ ধরে সবাই মনে করতো সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত, তারা নির্দ্বিধায় এসে যোগ দিল পাঠশালায়। রোজ নিয়ম করে লেখাপড়া, হোমওয়ার্ক করতে লাগল মন দিয়ে।
বিমান দুর্ঘটনার পর কেটে গেছে এক বছর। জলার ধারে ভূতবাজার আবার ফিরে এসেছে স্বমহিমায়। কিছুটা চরিত্র বদল হয়েছে বাজারের, প্রাচীন নবীন দেশী বিদেশী মিলিয়ে ক্রেতা বিক্রেতাদের ভিড়টাও অনেক বেশি। মেছো হারানের নতুন সঙ্গী জাপানের ছেলে মুরামাৎসু কেঞ্জি; হারানের সঙ্গে মাছ ভাগাভাগি করে সে সুশি, সাশিমি বানায়। ভাষা না বুঝলেও মাছের রকমফের দুজনেই ভালো বোঝে, হারানেরও বিশ্বাস যার নামে মুড়া এবং মৎস্য দুই-ই আছে, তার বানানো মাছের পদ কখনো বিস্বাদ হতে পারে না।
বীরেশ কন্ধকাটার হাত ধরে মুখোশওয়ালার সামনে বসে পড়ে রোমিলা। যোশীদের ইস্কুলের সৌজন্যে আজকাল কন্ধকাটাদের নামগুলো অন্তত জানে ভূতবাজারের বাসিন্দারা। বীরেশকে একটা হেলমেট পরিয়েছে রোমিলা। এর সঙ্গে একটা ভালো রকম মুখোশ এঁটে দিলেই দিব্যি মানুষের মত লাগবে। পটো জগন্নাথকে অনেক বলে কয়ে বেশ একটা হৃত্বিক রোশন মার্কা মুখ আঁকিয়েছে রোমিলা। জামালের মুখোশের দোকানে বসে ভালো করে বুঝিয়ে দেয় সে, হুবহু ওরকম মুখের একটা মুখোশ তার চাই। বীরেশের কন্ধকাটা নাম ঘোচানোর জন্য; শত রেগে গেলেও যেন মুখটা হাসি হাসি দেখায়, তার জন্য।
হরিচরণ বাউল আবার মাঠের কোণে মাদুর পেতে গানের আসর জমিয়ে বসেছে। এবার তার পরনে জিন্স, হাতে জ্যাজ গিটার। তার পাশে বসে একতারা ধরেছে শাড়ি-পরা মালঞ্চ বোষ্টমী। বাউল আর জ্যাজ গানের ফিউশন। মেলিসা থেকে তার নাম বদলে হয়েছে মালঞ্চ। বাকি পেত্নী-শাঁকচুন্নিরা তাকে শাড়ি পরা শিখিয়েছে হাতে ধরে। হাততালিতে ছয়লাপ চার দিক। কে জানত প্রাচীন ভূতেরা ফিউশন-এর এতবড়ো রসগ্রাহী?
আনন্দের আমেজ আবার ফিরে এসেছে ভূতবাজারে। নতুন কাস্টমারদের চাহিদা মেটাতে সাদা সুতির জামাকাপড়ের সঙ্গে রঙিন টি-শার্ট, জিন্স, সিনথেটিক জিনিসপত্র যোগ হয়েছে দোকানে দোকানে। তবে কমলমণি এত পরিবর্তনের মধ্যেও তার চরকা আর খদ্দর ধরে রেখেছে। নতুন এক স্যাঙাত জুটেছে তার… প্লেনের সেই ষণ্ডামার্কা লোকটা। কমল শাকচুন্নির "চরকা থেরাপি"-র ফলে সে এখন একদম অন্য মানুষ। জানা গেছে তার নাম ভরত সিং, সে এখন একটুও চিৎকার চেঁচামেচি করে না, বরঞ্চ খুব ধৈর্য ধরে সুতো কাটে। হালফ্যাশনের জামাকাপড় যতই লোকের, থুড়ি ভূতের পছন্দ হোক না কেন, কমল শাকচুন্নির ধুতি চাদরের কাটতি কমে নি এতটুকু। কমবেই বা কেন? প্লেন-এর বেশ কিছু যাত্রী, মায় সিনিয়র পাইলট শার্দূল মিশ্র পর্যন্ত যোগ দিয়েছেন ব্রহ্মদৈত্যদের দলে, সুতরাং ধুতি চাদরের চাহিদা বেড়েছে বৈকি।
আরও একটা নতুন দোকান যোগ হয়েছে হাটে, আগে যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না ভূতবাজারে। ভূতুড়ে ইস্কুলের কথা মাথায় রেখে বই খাতা পেন্সিল-এর একটা দোকান বসিয়েছে মোহন কন্ধকাটা; সৌরদীপ আর পুতুলরানীও হাত লাগিয়েছে তার সঙ্গে। আজকাল প্লেন দুর্ঘটনার শিকার সব ছোট ছেলেমেয়েরাও যোশীদের স্কুলে পড়ে, পুরোনো অল্পবয়সী পেত্নীরাও কেউ কেউ ক্লাসে আসে। বহুযুগব্যাপী নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্তি অবশেষে! প্রফেসর ঠাকুর প্রিন্সিপাল হিসেবে বহাল হয়েছেন। বেশ রমরমিয়ে চলছে ইস্কুল, সুতরাং মোহনের খাতাবইয়ের দোকানও ভালোই চলছে তার সঙ্গে।
নতুন আর পুরোনোরা একেবারে গলায় গলায় না হলেও একটা সৌহার্দ্যের জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে অবশেষে।
হাটবারে সবার মনই ফুরফুরে, শুধু মুখভার করে পায়চারি করে চলেছেন মুখুজ্যে জ্যাঠা। মাসকাবারি ধুতি চাদরটাও কেনা হয় নি আজ। ভূতবাজারে হঠাৎ করে যেন বিয়ের হিড়িক লেগেছে! তাদের ছোট ব্রহ্মদৈত্য পরিবারে পেশাদার যজমান কেউ নেই, অগত্যা দায়িত্বটা তাঁকেই পালন করতে হবে। এতদিন গেল, মন্ত্রটন্ত্রগুলোও ঠিকমত মনে পড়ছে না।
সম্ভাব্য দম্পতিরা সবাই আহ্লাদে এত গদগদ অবস্থায় রয়েছে যে বিয়ের সময় অল্পস্বল্প মন্ত্রপাঠের ভুলচুক হয়তো এরা বুঝতেও পারবে না। সেটা নিয়ে তাঁর তেমন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু মুলোদন্তী আজ তাঁর সমস্ত প্রচলিত ধ্যানধারণার ভিত এমন নাড়িয়ে দিয়ে গেছে যে ধাক্কাটা তিনি ঠিক হজম করে উঠতে পারছেন না। মুলো মেয়েটা মন্দ নয়, এক কালে অনেক শোকতাপ সয়েছে, ওর সম্পর্কে একটু সহানুভূতি জন্মে গেছিল মুখুজ্যে জ্যাঠার। কিন্তু তার আজকের প্রস্তাব টা…এমন বিয়েতে কি মন্ত্র ই বা পড়বেন তিনি! এ বড়ো বাড়াবাড়ি রকমের ধর্মসংকট।
মুলো তড়িঘড়ি এসে দুটো থলি নামিয়ে রাখে মুখুজ্যে জ্যাঠার সামনে। গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করে। "আপনার ফর্দ মিলিয়ে বিয়ের হোমের সব কিছু নিয়ে এসেছি জ্যাঠা। এখন দিনক্ষণ সব আপনার হাতে…"
"আর কথা বাড়াস নি, মুলো, তুই এ অঞ্চলের সব চেয়ে পুরোনো, তোকে আমরা সবাই ভালোবাসি, তাই বলে তুই আমাদের দিয়ে এ ভাবে ধর্মনাশ করাচ্ছিস, পরলোকে কি ভাবে মুখ দেখাবো বল তো?"
"এত যুগ ইহলোকে থেকে এখনও পরলোকের মোহ কাটাতে পারলে না, দাদু?" এক ঝলক রোদের মত উজ্জ্বল হাসি নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে রিয়া। "এই দ্যাখো কেমন সুন্দর একখানা বেনারসি শাড়ি কিনেছি, তুমি বিয়েটা না দিলে তো সব মাঠে মারা যাবে গো! আর মরার এতদিন পরেও যখন পরলোকে পৌঁছতে পারো নি, যখন পরলোক বলে আদৌ কিছু আছে কিনা জানো না, তখন নাহয় ইহলোকের বাসিন্দাগুলোকেই সুখী করে দাও। আমরা প্রাণ ভরে ধন্য ধন্য করব।"
আদুরে ভাবে মুখুজ্যে জ্যাঠার গলা জড়িয়ে ধরে রিয়া।
"তুই ঠিক জানিস? এ সব এখন আইনত গ্রাহ্য?" গলা খাঁকরি দিয়ে প্রশ্ন করেন ব্রহ্মদৈত্য।
"একদম লিগাল। সেলিব্রিটিদের মধ্যে তো আকছার হয়।"
"তবে আর কি! পরশু বিকেল পাঁচটায় লগ্ন আছে, তখন তৈরি হয়ে নিস। আর মুলোর জন্যও একটা ভালো শাড়ি কিনে নিস, বিয়ে বলে কথা!"
"একদম! আর হ্যাঁ, ওর নাম মুলোদন্তী নয়, মাধুরী। মন্ত্র পড়ার সময় আর যাই গুপি দাও না কেন, নামটা যেন ঠিকঠাক বোলো।"
ট্যারা আর রেইনবো একযোগে বলে ওঠে, "রাধেকেষ্ট"!