আজ বলব তোতার কথা। ও এখন ক্লাস সিক্সে। মুখ তো নয়, নন স্টপ কথার রেল ইঞ্জিন। সুইচ ভেতরেই, এক্কেবারে স্বয়ংক্রিয়।
দু বছর আগের কথা। শ্রাবণ মাসের বেনারস ট্রিপে একটা ফাঁকা গলিতে আমি আর তোতা হারিয়ে যাই। তখন সন্ধ্যে ঘুমিয়েছে, এদিকে লোডশেডিং। মোবাইল-ও হোটেলে ফেলে এসেছি। সর্বনাশ! চোখের পাতায় একটা ফোঁটা জল। টপ করে! বৃষ্টি গলা সাধবে সাধবে করছে। প্রথমে পোল্কা ডট। কম কম। সাথে মন ভোলানো হাওয়ার দুলুনি। ব্যাস, প্রিল্যুডে এটুকুই। তারপর শুরু ওয়ার্ম আপ এক্সারসাইজ। ন্যাচারাল মিউজিক্যালিটি। স্পিডি ফিংগারিং। এতটাই ফাস্ট মুভমেন্ট, চোখ কিছুই রেকর্ড করতে পারল না। কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম নিজেদের ভিজে যেতে। ওদিকে তোতার মুখ ছুটছে। ওয়ান্ডারল্যান্ড এর পথে! কতগুলো লোহার রডকে দেখিয়ে, "ভেবো না কুট্টি, এই লোহার রডটা আমি চেপ্পে ধরব, আসবে। ঠিক আসবে একটা ষাঁড়। ম্যাগনেট জ্যাকেট পরে। তুমি কিন্তু আমাকে চেপ্পে ধরে থাকবে। ওই ষাঁড়টাই আমাদের পিঠে করে হোটেলে পৌঁছে দেবে। ঠিইইইক।" ঠিক তখনই গলির মুখের একটা বাড়িতে আলো জ্বলল। পথটা দেখা গেল। আমরাও হাঁটুজল ডিঙিয়ে কোনো মতে ফিরে এলাম। তোতা সাথে থাকলে ভয় আপনা আপনিই কেটে যায়। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে ঘুরঘুর করার মজাই আলাদা!
আরেকবার কি হয়েছে। তোতার স্কুলের ঘটনা। টিফিন পিরিয়ড সবেমাত্র শেষ। সবাই অশান্ত। যা হয় আর কি! ফিজিকাল এডুকেশনের স্যার এসে বললেন, গাছতলায় বেদির নীচে ধ্যান করতে বসতে। সবাই চোখ বুজে ছিল। কেবল তোতা চোখ বুজে বিড়বিড় করছিল। স্যারের চোখে পড়তে ওকে ডাকলেন, "কেমন লাগছে? কি দেখছো? কথা বলছ কেন?" ওর উত্তর, "আকাশের মেঝেতে গাছের পাতার কালো কালো আলপনা। হয়েই যাচ্ছে! হয়েই যাচ্ছে! যেই চোখ বুজলাম অমনি পুরো অন্ধকার, কেবল হলুদ -নীল- সাদা- লাল গুল্টি গুল্টি আলো পাক খাচ্ছে!" স্যার চোখ পাকালেন। তোতা আবার শুরু করল, "স্যার আমি তো বড়ো হইনি। ওগুলো কি বেবি গ্যালাক্সি? তারপর জানেন, কালো কালো মনস্টার এসে সব আলো গিলে নিল?" স্যার মুচকি হেসে ওর পিঠ চাপড়ালেন।
এই কথা বলার জন্য কত বার যে ও শাস্তি পেয়েছে। বিচিত্র শাস্তি।
গত বছরই তো একদিন সেকেন্ড পিরিয়ডে পুরো সেকশান 'বি' ইতিহাস ক্লাসে শাস্তি পেয়েছে। কেন? একটা দলগত পরীক্ষা করার জন্য - খালি টিফিন বক্স ফ্যানের ব্লেডে রেখে ফ্যান চালিয়ে দিলে কি হয় তার শব্দতীব্রদ্রুম মাপছিল। বেঞ্চের তলায় শুয়ে। কি শাস্তি? দেওয়ালে নাক সিঁটিয়ে দাঁড়ানো। তোতা দেওয়ালে ঠোঁট সিঁটিয়েই কথার রেলপথ খুঁজে পেয়েছে। কথার রেলগাড়ি ছুটছে, ভিজে যাচ্ছে রেললাইন, চুনের দেওয়াল গড়িয়ে জল এঁকেবেঁকে নামছে। ও থামছে না। ইতিহাসের স্যার সেটা দেখে ভারি চটে গেলেন। ওকে স্টাফ রুমে নিয়ে গিয়ে অংকের স্যারের কাছে পেশ করলেন। তোতার মুখ চলছেই। অংকের স্যার নতুন শাস্তি দিলেন, তোতাকে সারা দিন কথা বলতে হবে, জিরোনো চলবে না। তোতা এতে বৃত্তি পেয়েই পাশ করেছে! শুনলাম, এ বছর নতুন ক্লাসে উঠতে অংকের স্যার ওকে একটা বই উপহার দিয়েছেন।
কদিন হল তোতা কথা বলে না। কারো সাথেই না। কেবল মুচকি হাসে। খাতায় কি সব লেখে, আঁকে।
সেদিন ওদের বাড়ি যখন আমি ঢুকছি, ঠিক তখন জয় গজগজ করতে করতে বেরিয়ে আসছে, পিছু নিয়েছে তন্ময়।
জয়, ওর থেকে একটু বড়ো। খুব চটে আছে, আমাকে দেখেই নালিশ শুরু -"যাও কুট্টি দেখো গিয়ে, আমাদের তোতা উপনন্দ হবে। সারাদিন পুঁথি লিখছে। বললাম, চল আইস্ক্রিম খাওয়াব। উত্তর? তাও মাথা নেড়ে - না।"
আমি তোতার ঘরে ঢুকে কাঁধে হাত রাখতেই, ও তাকালো, এক গাল হাসি। নিজেই বলল, "জয় বোকা, বোঝে না। আমি ওদের সাথে কথা বললে সুশ্রীর বিশ্রী লাগে, ও কাঁদে। সুশ্রী আর জয় বেস্ট ফ্রেন্ড যে!" তারপর আমার হাতে তুলে দিল স্যারের দেওয়া বই। খোলা পাতার বাঁদিকের ছড়ায় পয়েন্ট করল - কবি শঙখ ঘোষের "বড়ো হচ্ছি"। আবার নিজের খাতায় মুখ ফিরিয়ে পেন ছোটালো। বুঝলাম, তোতার ব্রেন তালেই আছে, চিন্তা ভাবনারা মোড় নিয়েছে সূক্ষ্ম স্তরে। নিউরনরা সবাই এক একটা Soccer Player. ওর খাতার অক্ষরে অক্ষরে আমি পেলাম ভবিষ্যত Pantheon এর Atomic Structure.