• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৪ | এপ্রিল ২০২৪ | গল্প
    Share
  • উত্তর দোল : উত্তম বিশ্বাস

    বিধুকে দোলনায় বসিয়ে দিয়ে আমি কুঞ্জের বাইরে আসছিলাম। পেছন থেকে বিধু ডাকল, “আরেকটু শুনবে স্বরূপ?”

    আমি ফিরে গিয়ে আরও জোরে দোলনাটা দুলিয়ে দিয়ে বললাম, “থেমে গেলে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ো। আমি ততক্ষণে চলে আসব।”

    “আবীর উড়ে যাচ্ছে তো!”

    “থালাটা কোলের মধ্যে নিয়ে ওড়না চাপা দাও। দেখবে আর উড়বে না!”

    এবার বিধু এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে লাগল, “নীপাকে বলবে সে যেন খোঁপায় কাঁটা না নেয়। পরমাকে বলো, ওর শাড়িটা যেন জাম-রঙা হয়। কাছারিমাঠের উল্টো দিকের বস্তিতে বিরজু থাকে। ওঁকে ডাকবে। বিরজুর মুদ্রা বিশ্বখ্যাতি পেয়েছে। এখন থেকে ও’ই সবাইকে নাচাবে। বেশি দেমাগ দেখাবে না। ওঁর কাছে নতমস্তকে অনুনয় করবে। আর হ্যাঁ, পূর্ণকে অবশ্যই এনো। ও ছাড়া কে বা এমন পিয়ানো বাজাতে পারে বলো! যদিও একজন বাঁশিওয়ালা হলে ভালো হতো। কিন্তু কোথায় পাই? আচ্ছা এটা তুমিই বাজিও।”

    “আমি পারব?”

    বিধু আমার দিকে অবোধ হরিণীর মতো ড্যাবডাব করে চেয়ে থেকে বলল, “পারবে। এবং খুব ভালো পারবে!”

    “বাঁশির জন্যে ভালো বাঁশ চাই। কে দেবে?”

    “শুনেছি সম্ভারের ঝাড়ে নাকি সামান্য হাওয়া খেলে গেলেও শনশন শব্দ হয়! ওর মাকে বলব?”

    আমি ঠোঙার বাকি আবীরটা বিধুর বাটায় ভাগে ভাগে সাজিয়ে দিয়ে টানপায়ে দীঘির পাড়ে এলাম। দীঘিটা আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে। আর ওর কোল ঘেঁষে যে ঘন বন ওটাই আমাদের আদি এবং অনন্তের কুঞ্জবীথি। জলের ওপার দিয়ে আগে আগে হেঁটে চলেছে একটি কালো কুটিল ছায়া। ঘাড় ফেরাতেই দেখলাম লীলা, আমার স্ত্রী, সংসারের একমাত্র সারথী!

    আমি কেঁচোর মতো ওর কাছে এলাম, “কী গো, বনেবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে কী খুঁজে বেড়াচ্ছ?”

    দেখলাম ওর মুখখানা ঝড়ের মেঘের মতো থমথম করছে। আমি আরও কিছুটা তরল হবার চেষ্টা করলাম, “চুপ করে আছ যে? বলো কী খুঁজে বেড়াচ্ছ?”

    “ঘরে চলো। তারপর তোমার জন্যে কী ওষুধ খুঁজছি, বলব!”

    শার্টের বোতামগুলো খুলে দিতে দিতে বললাম, খুব ঘেমে গেছি গো! এই বয়েসে এসে এত ধকল আর কি সয়?”

    লীলা আমার দিকে আর তাকাল না। দক্ষিণ দিক থেকে দমকা বাতাস ছাড়ল। গাছের তলায় জমে থাকা দীর্ঘদিনের শুকনো পাতাগুলো একদিক থেকে আরেকদিকে এমনভাবে উড়ে যেতে লাগল, মনে হল যেন লীলার ভেতরকার দীর্ঘশ্বাস মিশে গেছে তাতে! একটা দুটো কাঞ্চনের কুঁড়ি বুকের ওপর এসে টোকা মারল! মাথার ওপর দিয়ে খড়কুটো পাখির পালক উড়ে গেল। বিধুর দোলনাটা হয়ত তখনো দুলছে। কিন্তু সেদিকে আর তাকাবার সাহস হল না! যখন ঘরে এলাম ততক্ষণে দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে!

    বিধুর কথামতো আমি সেই যে আমি সম্ভারের ঝাড়ে ঢুকে গেলাম তো গেলাম! বিধুর মুখ, বিধুর হাতে আবীরের থালিটার কথা, ওর দোলনার কথা একদমই আর মনে করতে পারি না। লীলা সারাক্ষণ বকাঝকা করে। টেনেহিঁচড়ে বার করে আনে। গায়ের গন্ধ-গেঞ্জি খসিয়ে গা ধুইয়ে দেয়। এরপর গোলাপজলে বেণী ডুবিয়ে আমাকে ডাকে, “এসো শুদ্ধ হও!”

    আমি তর্জনী দিয়ে জলের বুকে ঘূর্ণি তুলি। ইচ্ছে হলে আতর মাখাই। তার পরই আধপোড়া বাঁশের ফোকরে কুহু কুহক কুরররররররররর...

    সেদিন মধ্য রাত্রি। স্বর সেধে সেধে সবে একটুখানি শুয়েছি। হঠাৎ একমুঠো আবীর উড়ে এল।

    লীলা ফোঁস করে উঠল, “দক্ষিণ দিকের জানালাটা আবার খুলে রেখেছ? বললাম না ওটা বন্ধ থাকবে!”

    আমি আরক্তিম গুম্ফশ্মশ্রু নিয়ে ওর দিকে মুখ বাড়িয়ে দিতেই সে দপ্‌ করে জ্বলে উঠল, “লুজ ক্যারেক্টার! নুড়ো জ্বেলে দেব একেবারে! দিলে তো ব্রাটার বারোটা বাজিয়ে! এসব নষ্টামো বন্ধ করো, নইলে গায়ে আগুন জ্বালিয়ে শেষ করে দেব এই শুনে রেখো!”

    “সত্যিই বলছি আমি কিছু জানি না!”

    “জানো না, তাই না? অথচ প্রতি রাতে রং মাখতে খুব ইচ্ছে করে! বাঁশির বদলে চাইলে পিচকারি পুরে দিতাম, পাশে নিয়ে শুতে পারতে!”

    “মাঝে মধ্যে রং উড়ে আসা ভালো, কী বলো? তাতে করে আর কিছু না হোক খড়ি-ওঠা শরীরটাকে একটু হলেও ভালোবাসতে সাধ জাগে!”

    আমার মুখের কথা মুখে থাকতে থাকতেই লীলা পাট কাঠির মশাল বানিয়ে তাতে আগুন দিয়ে জলের ধার বরাবর হাঁটতে শুরু করল। আমি ওর পিছু নিলাম।

    এখন খোলা আকাশের নিচে এসে লীলা গলা ফেড়ে গালাগালি দিচ্ছে, “নাঙ নাচানী, কোথায় গেলি? সামনে আয়! বেরিয়ে আয়, তোর রঙের খায়েস মিটিয়ে দেব আয়!”

    দেখলাম লীলা ঠকঠক করে কাঁপছে! বললাম, “ঘরে চলো। তুমি তো দেখছি ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছ!”

    “ছায়ার সঙ্গে মানে?”

    “তা নয় তো কী! রংটা তো তুমিই মাখালে!”

    “মিথ্যে অপবাদ দেবে না বলে দিচ্ছি! জলে ঝাঁপ দেব!”

    বলল বটে লীলা। ঝাঁপ দিল না। হাতের মশালটা জলের ওপরে ছুড়ে দিয়ে ঘরে গেল।

    লীলা চলে গেলে একটু ধাতস্থ হয়ে আমি একটা গাছের আড়ালে গিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিলাম। আর তখনই ঘাড়ের কাছেই একটা নিঃশ্বাস পড়ল। আমি সড়াৎ করে সরে গেলাম। সেও ছায়ার মতো আমার সঙ্গে সরে এল।

    “কী গো, পূর্ণকে পেলে?”

    “তুমি কে? কে তুমি?”

    বাগান থেকে বেরিয়ে এল বিধু। হাতে সেই রঙের ডালি।

    “এগুলো এখনো রাখার কী দরকার! কাউকে মাখিয়ে দিতে পারতে!”

    “কাকে মাখাব? আমার মহল্লায় তেমন মানুষ কই?”

    “বলছ কী! কেউ কি আসেনি?”

    “হ্যাঁ এসেছিল সম্ভারের মা। সে কী এক দীনহীন চেহারা! নাকমুখ ঢাকা। যেন আস্ত একটা শামুক!”

    “কোন সম্ভার?”

    “কেন তোমার বনেদী বাড়ির খুড়ি। বাঁশি বানাবে বলে যার বাঁশঝাড়টা তোমার নামে সেদিন উৎসর্গ করে গেল! ওর সমস্যা কী শুনবে? শুনলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। উনার নাকি এখন রোজ মনে হয় উনি এই রাজ্যের কেউ নন। এই যে পরিচিত হাট-বাজার, নদী পুকুরঘাট, এমনকি নিজের সংসার, সংসারের লোকজন সবকিছুই নাকি আনকোরা লাগছে! আমি বললাম বেশ তো! এত কিছু ওলোটপালোট হয়ে গেল আর এ তো অতি সামান্যই! এই কথা শোনার পর সম্ভারের মা কাঁদতে বসলেন, “যাত্রার বিনোদিনীরও পোশাক পাল্টাতে পমটার সময় দিতেন। আমি তো তাও পেলাম না মা! দিব্যি স্বামী সংসার নিয়ে মোটা ভাতে মোটা কাপড়ে চলে যাচ্ছিল। মা গো মা! কী যেন একখান যুদ্ধ হয়ে গেল! ঘুমের মধ্যেই এভাবে পথের ভিখিরি হব ভাবিনি!”

    “এমা! এভাবে কাঁদলে হয়! মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে! খাননি বুঝি?”

    “আখায় যে আগুন দেব কী দিয়ে দেব? খানিকটা রাস্তা এগোয় তো খানিক খানিক পিছিয়ে আসি। কী যে ছেমো রোগে ধরেছে!”

    “কেন পিছিয়ে আসেন কেন?”

    “সে এক লজ্জার কথা মা! জগতের কাছে মুখখানা দেখাতেই যেন কী এক কুণ্ঠা!”

    আমি আচ্ছা করে আবীর মাখিয়ে দিয়ে বললাম, “এই মুখ দেখাতে লজ্জা লাগছে তো? এই রাঙিয়ে দিলাম। আর আপনার দিকে অবজ্ঞার চোখে কেউ তাকাতে সাহস পাবে না!”

    বিধুর কথা শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে পড়লাম, “আচ্ছা এমনটা কি আদৌ সম্ভব?”

    বিধু হেসে লুটিয়ে পড়ল, “সবই সম্ভব! বন ধ্বংস করলে বনের বসবাসকারী প্রাণীরা উদ্বাস্তু হয়! তাদের আচরণেও এর ছাপ পড়ে। সম্ভারের মা হয়ত এদেরই একজন!”

    “কিন্তু উনি তো আদৌ উদ্বাস্তু নন!”

    “তোমার উৎপাতে হয়ত ওঁর উঠোনে আনকা কোনো আলো এসে পড়েছে! এতদিনকার যে আড়ালটুকু ছিল, তুমি তা ভেঙে দিয়েছ!”

    “এভাবে আমাকে দাগিয়ে দিও না বিধু!”

    “না না না মহামারি! মহামারি! মহাকালের এক অলিখিত যুদ্ধ! আর আমি সেই ভৈরব স্বরের কথাই বলতে চেয়েছি স্বরূপ!”

    বিধু যখন কথা বলছিল, খানিক খানিক ওকে লীলার মতো লাগছিল। আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়তেই বিধু বলল, “ফাঁকি দিয়ে কোথায় যাচ্ছ শুনি? রাত বেশি নেই। আজ আর নাই বা শুলে।”

    “তাহলে গল্প বলো।”

    “শুনবে উলুপির কথা?”

    আমি চোখ বন্ধ করে ওর ঊরুতে মাথা রাখলাম।

    এবার বিধু ভোরের শিশিরভেজা পাতার মতো আমার মুখের ওপর আনত হয়ে গল্প শুরু করল, “সেদিন আমাদের পাড়ার উলুপি দেখলাম কলমির দামের মধ্যে গলা সমান জলে দাঁড়িয়ে হি-হি করে হাসছে! আমি ওই পথে আবীর উড়াতে উড়াতে আপনমনে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওকে ওই অবাস্থায় দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হল! আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই উলুপি, কী রে অমন করে হাসছিস কেন? কোনও কথার উত্তর না দিয়ে সে পানকৌড়ির মতো ডুব দিল। উঠতেই আবারও জিজ্ঞেস করলাম, কী রে কী হয়েছে বল!

    “সে ওষ্ঠ উঁচিয়ে দেখাল, ‘দেখছ না গোঁফ উঠেছে তাই হাসছি!’

    “খুব পেকেছিস! গোঁফ না ছাই! হদ্দম ডুব দেবার ফল। ধুয়ে ফ্যাল!

    “উলুপি হাত তুলছে না দেখে আমি আবারও জানতে চাইলাম, হাতে ওটা কী ডুবিয়ে রেখেছিস দেখি?

    “উলুপি বালি ভর্তি একটা পেতলের ডাবর উঁচু করল!

    “আমি শিউরে উঠলাম, এ রাম! এত বালি! তলিয়ে যাসনি এটাই রক্ষে! কী করবি এসব বালাই?

    “’এসেছিলাম জল নিতে। কিন্তু যখন মনে পড়ে গোঁফ নিয়ে কলস কাঁখে করে কীভাবে যাব। তাই আজ বালি ভরলাম!’

    “কবে থেকে এমন মনে হচ্ছে তোর?

    “উলুপি লজ্জায় আনত হয়ে বলল, ‘যেদিন থেকে স্বরূপদার বাঁশি কানে আসতে লাগল...!’

    “ও আবার ডুব দিচ্ছে দেখে আমি আঁকশি দিয়ে ওড়না টেনে ডাঙায় তুললাম। তারপর আচ্ছা করে আবীর মাখিয়ে দিয়ে বললাম এইবার কলসটা কাঁখে নে। সত্যিই তোকে রাধা রাধা লাগছে রে! উলুপি নূপুর বাজিয়ে পথে জলের ছিটে দিতে দিতে হেঁটে ঘরে গেল!”

    “বাঃ! তোমার রঙের শক্তি আছে বলতে হয়!”

    “তা নয় তো কী! তুমি যে উলুপিকে উল্টো-রাধা বানিয়ে ছেড়েছ এর দায় কাকে দেবে শুনি?”

    এতক্ষণ আমি আরুণীর মতো বিধুর কোলে আড় হয়ে ছিলাম। পুব দিক ফর্সা হয়ে আসছিল। এবার আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝালাম, “বেশ! বাকি রংটুকু তাহলে এভাবে আমাকেও...!”

    “উঁহু মোটেই না! পূর্ণকে লাগবে।”

    “কোন পূর্ণ?”

    “কী গো তুমি! যে পিয়ানো বাজাত। একই কথা বারবার জিজ্ঞেস কর কেন?”

    “আমাতে কী পূর্ণতা নেই বিধু?”

    “না নেই! আমাতেও পূর্ণতা নেই। দেখ না আমাতে অনেক কলঙ্ক। এত্তো গিরিগুহা! ও যেদিন ধরা দেবে, সেদিন আমার সমস্ত সাগর কানায় কানায় উপচে উঠবে!”

    “দোল কি না খেললেই নয়?”

    “না নয়! রংটুকু বাদ দিলে জীবনের রইলই বা কী? অতএব পূর্ণকে আমার চাই!”

    “আর যদি না পাই?”

    “আড়ালে যেতাম। এবার থেকে প্রকাশ্যে ছেটাব! আবীরে আবীরে একেবারে অন্ধ করে দেব!”

    এরপর বিধু আপনমনে অনেক কথা বলে যেতে লাগলল, “পাড়ার প্রতিটা সরণির নতুন নামকরণ করতে হবে। পথের দুধারে বাহারি সব ফুলের চারা বসাতে হবে। দুঃখীর দুমড়ে যাওয়া ঘরদোরগুলো ঠ্যাকনা দিয়ে সোজা করতে হবে। প্রতিটা বাড়ির দেওয়ালে শৌখিন লতাপাতা আঁকতে হবে। যেসব পথকে মানুষ অশুভ বলে এড়িয়ে চলছে, ভয় পাচ্ছে, ওইসকল পথগুলো মোরামের বদলে রঙিন ধুলোতে ভরিয়ে দিতে হবে! মানুষের মুখের সংলাপে, তোমার বাঁশি আর সংযত সংরাগ বসিয়ে দিতে হবে! শ্মশানের কাঠকয়লাগুলো নেভাতে হবে। ঘাটগুলো স্নানের উপযুক্ত করে বাঁধাতে হবে। এত কাজ ওঁরা না এলে আমি পারব কেন!”

    ওর কপালের ওপর আলতো আভা বুলিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, আমি প্রভাত হলেই পূর্ণর খোঁজে বেরিয়ে পড়ব। আপাতত ওকে আনলেই হচ্ছে তো?”

    দুই আঙুলের ফাঁকে বিধু আমার নাকটা চেপে ধরে আবদার করল, “না বাবু! ওই যে বললাম বিরজু, রীতি, সৌম্য, সুকান্তি, আহীরা, উদ্দালক, সঞ্চারী এঁদের সব্বাইকে চাই!”

    “তোমার মাথাটা গেছে দেখছি! একেক দিন একেক জনের নাম বলছ! অথচ এঁদের সঙ্গে আদৌ আমাদের কোনো সংযোগ নেই!”

    “আজকের সমাজ-সংসারের আসল পাটীগণিতটাই আমি তোমাকে বোঝাতে পারিনি! এটা আমার ব্যর্থতা! এই মনে করো তুমি লীলার সঙ্গে আছ, অথচ লীলা তোমাকে চেনে না। এই আমি যেমন আমাকে চিনি না। ঠিক তেমনি একই গ্রামের একই পাড়ায় পাশাপাশি ঘর থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রত্যেকেই একেক জন দূর দ্বীপের বাসিন্দা!”

    “কী করবে এত লোকজন দিয়ে?”

    “পাগলামো কোরো না প্লিজ! একা মানুষ দিয়ে যেমন সংসার ধর্ম হয় না। তেমনি বসন্তের হাট বসাতে হলে ওঁদের সবাইকে দরকার। ওঁরাই তো আমার আনন্দের আদি উৎস, সুন্দরের সহজতম কুশীলব!”

    হঠাৎ ঝোপের আড়ালে একজোড়া ডাহুক ডেকে উঠল। একজনের স্বরটা ঠিক যেন আমার লীলার মতো! তবে আরেক জন? ঠিক অনুমান করতে পারলাম না! আলো ফোটার আগে আমি বিধুকে ফেলে ওখান থেকে সরে পড়লাম।

    আজকাল আমি সুযোগ পেলেই বাঁশি-হাতে বেরিয়ে যাই। সম্ভারের কাছ থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে বিরজু, পূর্ণ এঁদের খুঁজে বেড়াই। সেদিন সন্ধ্যার ঠিক একটু আগে আগে বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি দীঘির জলে মস্তক মুণ্ডন করা অনেকগুলো লোক। ঘাটের সিঁড়িতে এলোচুলে দাঁড়িয়ে আছে পরমা। হাতে আতপ চালের বাটা। ঘাট থেকে কিছুটা দূরে উবু হয়ে আগুন জ্বালছে নিপা। ওর পরনে সেই জাম-রঙা শাড়ি। আমি ভয়ে ভয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম, “এই অবেলায় আগুন কী হবে নিপা?”

    নিপা মুণ্ডিত মস্তক লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে জবাব দিল, “ওরা হাত-পা সেঁকবে!”

    “পরমা অমন পোশাকে আছে কেন? হঠাৎ কী হল ওর?”

    “জানিনে। সম্ভারের মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো গিয়ে!”

    দেখলাম বুড়ি হাটের মানুষ জড়ো করে দাওয়ার খুঁটিতে কপাল ঠুকে সবার হয়ে শোক প্রস্তাব রাখছেন! আমি কাঁচুমাচু হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কাদের জন্যে কাঁদছেন খুড়িমা?”

    “ও মা তুমি শোনোনি? সাত পৃথিবীর লোক জেনে গেল আজ আমাদের শঙ্খ...!” বলতে বলতে খুড়ির স্বর আটকে এল। হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে বসলেন। আমি ওঁর চোখেমুখে জলের ছিটে দিতে দিতে বর্তমান পৃথিবী সম্পর্কে আমি আমার অজ্ঞতা স্বীকার করে নিলাম, “কোই না তো! কোন শঙ্খ?”

    “এমা! স্বরূপ বলে কী! মিডিয়ায় ফেসবুকে এসব মৃত্যুর খবর ফ্যানা ফ্যানা হয়ে উঠেছে! আর তুমি বলছ শোনোনি?”

    উঠোনে ততক্ষণে পাত পেড়ে খেতে বসেছে অসংখ্য মানুষ। কীরে বাপু! লীলা করে কী? বাইরে বার হয় না কেন ও? অবশেষে খুড়ির হাঁকাহাঁকিতে লীলা পট্টবস্ত্র পরে বাইরে এসে দাঁড়াল। হাতে একঘটি জল। আমাকে পা ধুইয়ে দিয়ে বলল, “খেতে বসো। সূর্য ডুবে গেলে এঁদের অমঙ্গল হবে!”

    আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম, “কী হয়েছে আগে বলবে তো?”

    লীলা আরও স্নিগ্ধস্বরে বলল, “শান্তি স্বস্ত্যয়ন!”

    “এ মা! কাদের, কেন?”

    লীলা আঁচলে চোখ মুছে একটা ফর্দ বার করল, “সৌম্য, সুরভী, পূর্ণ, কান্ত, মনোহর, তপোব্রত...”

    তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে শুনে আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, “আর বিরজু? বিরজুও কি নেই?”

    “না নেই। সবাই এখন অমৃতলোকের বাসিন্দা!”

    হাপর থেকে সব হাওয়া বেরিয়ে গেলে কামারকে যেমন ধ্বস্ত দেখায়, লীলার কাণ্ডকারখানা দেখে স্বরূপের এখন তেমনই অবস্থা!

    উলুপি একটা কলার পাতার আগায় আমার জন্যে ভাত ঢেলে দিয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম উলুপির চোখের দিকে!

    “কী দেখছ অমন করে?”

    “তোকে তো উর্বশীর মতো দেখতে লাগছে রে উলুপি!”

    উলুপির কানের লতি রাঙা হয়ে এল, “সত্যি বলছ স্বরূপদা?”

    “হ্যাঁ রে সত্যি? কোথায় পেলি এত রূপ?”

    “ওই যে তোমার কুঞ্জবনে!”

    ভাতগুলোকে মুঠোর মধ্যে দলা পাকিয়ে বসেই রইলাম। উঠল না! আসন ছেড়ে বাঁশিটা নিয়ে দীঘির ধারে এলাম!

    এখন লীলা দারুণ সুখী! স্বপ্ন দেখবে বলে সক্কাল সক্কাল শুয়ে পড়ে। আমি বলি, “দেখো আমাদের ছেলে হবে। ওস্তাদজীর সঙ্গে আমার নিত্য ওঠাবসা। আমি ওকে সারেঙ্গী শেখাব!”

    আমার এসব কথায় লীলা কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। সে বলে, “আরে! আগে আসুক তো! আমি চাই সে ভালো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হোক!”

    সেদিন শেষ রাত। লীলা ঘুমোচ্ছিল। পোড়া বাঁশে সবে ফুঁ দিয়েছি! ঠিক তখনই দক্ষিণের কপাটটা ঠক ঠক করে উঠল, “ও স্বরূপ, পিয়ানো চাইতে গিয়েছিলে শুনলাম, সত্যি?”

    আমি ধড়মড়িয়ে ঠেলে উঠলাম, “কে পূর্ণ? পূর্ণ তুমি বেঁচে আছ?”

    হা-হা করে একদলা হাওয়া ঘুরে গেল। আমি ছাদে উঠে আকাশ উতলা করে হাঁক ছাড়লাম, “তুমি কোথায়? তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?”

    “কী করে দেখবে আমি যে আমাকে লুকিয়ে ফেলেছি!”

    “আর তোমার পিয়ানো? কোথায় লুকিয়ে রেখেছ তোমার পিয়ানো পূর্ণ?”

    অন্ধকারের চাদর জড়িয়ে আবছা উত্তর এল, “গঙ্গার চরে!”

    “কেন? কেন? উত্তর দাও পূর্ণ। বিধুর দিব্যি!”

    আর উত্তর এল না।

    নিচে নেমে এসে লীলাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু ঘুম আর আসে না। চোখের পাতা চেপে ধরে আমিও স্বপ্ন দেখতে চেষ্টা করলাম। আর ঠিক এইসময় বিধু এসে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। যেখানে কুঞ্জ, ওইখানে। দোলনায় দোল খেতে খেতে আদেশ করল, “এত স্ত্রৈণ কেন তুমি? পূর্ণকে নিয়ে এসো!”

    “পূর্ণকে পেতেই হবে? সম্ভারের মায়ের মতো, উলুপির মতো আরো কত এমন মানুষ আছে। এদের নিয়ে বসন্ত সাজাও!”

    “বোকা! সম্ভারের মা, উলুপি এরা দুদিন যেতে না যেতেই মুখের রং মুছে ফেলবে। মুছতে বাধ্য হবে। কেননা এটাই জগৎ সংসারের রীতি। কিন্তু আমি এমন কিছু মানুষকে রাঙাতে চাইছি, যাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে নদী তার বাঁক বদল করবার সাহস পাবে। পাখপাখালির কন্ঠে উঠে আসবে অচেনা স্বর! গাছে গাছে ফুল ফুটবে। পথের ধুলোয় থাকবে প্রসাদের গন্ধ! আমি তেমন মানুষকে নিয়ে ফাগুন ফোটাতে চাই স্বরূপ!”

    “কোথায় পাব তাঁকে?”

    “বলল শোননি? গঙ্গার দুই ধার বরাবর খুঁজবে। প্রথমে প্রয়াগ, তারপর হৃষীকেশ হরিদ্বার হয়ে সোজা...!”

    মুখের কথা মুখে থাকতে থাকতেই আমি বেরিয়ে পড়লাম। ধু-ধু বালুর চর ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কান পেতে শুনবার চেষ্টা করলাম, সেখান থেকে কোনও সংকেত আসছে কিনা। না আসছে না। আবার অন্য নিশানা নিয়ে এগিয়ে চললাম। কিন্তু নাহ! কোথাও পূর্ণকে পেলাম না।

    সেদিন আকাশে একাদশী। ভিজে বালির চর ধরে হেঁটে চলেছি। সহসা একটা উঁচু ঢিবির আড়াল থেকে কে যেন ডাকল। আমি দুহাতে বালি সরাতে লাগলাম। কিন্তু এ কী! কী কদাকার গন্ধ! সঙ্গে সঙ্গে একদল শেয়াল আমার দিকে ধেয়ে এল। আমি ঊর্ধশ্বাসে দৌড় লাগালাম! আর ঠিক এইসময় শনশন বাতাসের মধ্যে শুনতে পেলাম, “স্বরূপ, আমাকে তুললে না? আমি সারস্বত। একজন বলল, আমি অর্ঘ্যকুসুম।”

    লবণ কারখানার আড়াল থেকে একজন কেঁদে উঠল, ‘আমি লাবণ্য!’ তরঙ্গের পর তরঙ্গ জুড়ে ধ্বনিত হতে লাগল, “আমি চিরায়ত, আমি সুন্দরম! আমাদের এইভাবে পুঁতে রেখো না! তোলো তোলো তোলো!”

    ওঁদের আবেদনমতো একটা একটা করে টেনে তুলতে লাগলাম। ইস! কী দুর্গন্ধ! পাঁজরগুলো সব খুলে খুলে পড়ছে। কেউ বা চেয়ে আছে হায়েনার মতো। কারো হাতদুটো জড়িয়ে ধরতে চাইছে আমার গর্দান! কেউ বা অভিশাপ দিতে দিতে ঠেলে উঠছে, “এতবড় চক্রান্ত! তোমাদের ধর্মে সইবে না। রাতারাতি এইভাবে পুঁতে ফেললে! কী এমন অপরাধ করেছিলাম তোমাদের কাছে? বলবে?”

    “তোমরা কে? কে তোমরা?”

    “আমরা? হা-হা-হা! আমরা তোমার কুঞ্জের কর্মী গো! চিনতে পারছ না? শেষমেশ এই পরিণতি? কেন?”

    আমি এখন ওদের একটি কথারও জবাব দিতে পারি না।। বালি চাপা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে আসি।

    এখন লীলাকে কে যেন বুঝিয়েছে আমি নাকি খারাপ আত্মাদের খপ্পরে পড়েছি। সংসারে সমানে অশান্তি চলছে! আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি। শোনে না। সঙ্গীতের সামগ্রী, পোড়া বাঁশের বান্ডিল, উপাসনার বস্তু সংসার থেকে একটা একটা করে সরিয়ে ফ্যালে। আমি আহত হলে ও আনন্দ অনুভব করে। চুপি চুপি চলে আসি কুঞ্জের কাছে।

    সেখানেও গিয়ে দেখি লীলা দোলানায় দোল খাচ্ছে! কোলের ওপর সেই থালাটি!

    “তুমি লীলা না? এইখানে?”

    “তুমি কি আমাকে ভালোবাস না স্বরূপ?”

    কথাটা কেমন যেন স্বর্গের বিচারসভা থেকে ভেসে আসা আর্জির মতো শোনাল। আমি হতচকিত হয়ে বললাম, “কেন নয়? বাসি তো!”

    “তাহলে এসো। আমাকে রাঙিয়ে দাও।”

    “তুমি এই অবস্থায় কেন বাইরে এলে? মারা পড়বে তো!”

    “বরং ঘরে থাকলেই মারা যাব আমি। পেটে যে কাঁটা ঢুকিয়ে দিয়েছ সে মোটে ঘরে থাকতে চাইছে না। কান পেতে দেখো। তোমার রক্ত তো! কী বলছে শোনো!”

    আমি ওঁর উন্মুক্ত ভুবননের ওপর আদর মাখিয়ে বললাম, “এমন পাগলামো করো না লীলা!’

    “এই একই মুখ তোমাকে দেখাতে কেমন যেন কুণ্ঠা কুণ্ঠা বোধ হচ্ছে! আমাকে নতুন করে নির্মাণ করে নাও স্বরূপ! সত্যি বলছি আমি মরতে চাইনে!”

    থালাটা এগিয়ে দিতেই দেখলাম দুমড়ে মুচড়ে ওটা একেবারে পিদ্দুম হয়ে উঠেছে! রং নেই, পালিশ নেই, ঠিক যেন কাঁসারু পাড়ার কদাকার চাকতির মতো!

    “এটা তুমি কোথা থেকে আনলে?”

    “এই দোলনার ওপরেই তো ছিল। রাঙিয়ে দাও স্বরূপ! আমাকে অপরূপা করে দাও সোনা!”

    “রং নেই তো! কী দিয়ে রাঙাব?”

    লীলা কেমন যেন আলুথালু হয়ে উঠল, “আজ কোনও অজুহাতই আমি মানব না। দূরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমাকে দোল দাও!”

    লীলা গাছের শাখাপ্রশাখা ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল। ফুল থেকে অল্প পরাগ উড়ে মাটিতে মিশে গেল। কিন্তু রঙের সন্ধান দিল না কেউ। সূর্য পাটে গেল। আবীরের ডালি নিয়ে আকাশ উপুড় হল কিন্তু লীলাকে বাড়ি নিতে পারলাম না।

    এবার লীলা আগুন মুখে নিয়ে নেমে এল, “কোথায় রেখেছ রং?”

    “আমি কী জানি! হয়ত ওঁরা জানেন!”

    “ওঁরা মানে? কারা? পূর্ণ, শাশ্বত, চিরায়ত বিরজু এঁদের কথা বলছ নিশ্চয়ই?”

    “আরে তুমি এঁদের নাম জানলে কীভাবে?”

    “থালার উল্টো পিঠে লেখা আছে যে! এঁরা কোথায়?”

    “ওই যে বললাম, গঙ্গার তীরে!”

    “ডাকলে আসবে না?”

    “কী করে আসবে! তুমি তো আগেই তিল তুলসী দিয়ে রেখেছ!”

    লীলা আমার মুখ চেপে ধরল, “ধ্যেৎ! কী যে বল না! সুন্দরের সৈনিককে মেরে ফেললে চলে নাকি! তাছাড়া আর কয়েক মাস পরেই আমাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। ওঁরা যদি না জাগেন পুরো অতলে তলিয়ে যাব তো! তুমিও কি চাইবে এমন বিবর্ণ পৃথিবীতে আমাদের সন্তান হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াক? চলো ওঁদের তুলে আনি!”

    “যাওয়াই যায়। এইফাঁকে যদি দোলনাটা কেউ...?”

    “উঁহু নিলেই হল? আচ্ছা তুমি থাকো। আমিই যাচ্ছি।”

    এখন জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আকাশের মাঝখানে আরেকটা দোলনা টাঙিয়েছে বিধু! আর ওই দিকে নিরিখ রেখে দোমড়ানো থালাটা দিয়ে একের পর এক বালির ঢিবি ভেঙে দিচ্ছে লীলা...



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments