'অন্তিম অরণ্যে' র পটভূমি একটি ছোট্ট পাহাড়ি শহর যেখানে লোকেরা আসে জীবনের শেষ অধ্যায়ে। কাহিনীর নায়ক এসেছে তার অনেক আগেই।কাগজের বিজ্ঞাপন মারফত মিস্টার ও মিসেস মেহরার কাছে চাকরি নিয়েছে। নিরঞ্জন বাবু, অ্যানা, ডক্টর সিং, মুতলিধর, তিয়া প্রমুখ আরও অনেক পার্শ্বচরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে । প্রত্যেকেই তার নিজস্ব চরিত্র খুঁজছে, প্রত্যেকের বুকের ভিতর শূন্যতা, খেদ ও ব্যর্থ ইচ্ছা। প্রত্যেকের জীবনই অতীতের টুকরো টুকরো স্মৃতি দিয়ে জোড়া। সবার উপরে আছেন মিসেস দিভা মেহরা-- যিনি মারা গিয়েও সবার স্মৃতির মধ্যে বেঁচে আছেন। লেখক নির্মল ভার্মা তাঁর অননুকরণীয় লেখনীতে প্রতিটি চরিত্র নিপুণভাবে সৃষ্টি করেছেন। তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন হিমালয়ের পাদদেশে একটি ছোট্ট পাহাড়ি শহরের শান্ত, প্রাকৃতিক পরিবেশ।
নির্মল ভার্মা (এপ্রিল ১৯২৯–অক্টোবর ২০০৫) একজন অগ্রণী হিন্দী সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও অনলস সাহিত্যকর্মী। তিনি হিন্দী সাহিত্যের ‘নঈ কহানি’ (১৯৫৯) আন্দোলনের পথিকৃৎ। শ্রী ভার্মা ১৯৯৯ সালে জ্ঞানপীঠ, ২০০২ সালে পদ্মভূষণ ও ২০০৫ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। ।
এই উপন্যাসটির বাংলায় প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতির জন্য আমি লেখকের স্ত্রী শ্রীমতী গগন ভার্মার কাছে কৃতজ্ঞ।
আমাদের কারুর কাছে এত সময় নেই যে আমাদের জীবনের সেরা নাটকগুলো আবার ভোগ করি, এই আমাদের নিয়তি। এ-ই আমাদের বুড়ো করে, ব্যস, এ-ই, আর কিছু নয়। আমাদের বলিরেখা ও লোলচর্ম মনে পড়িয়ে দেয় সেই প্রচণ্ড উন্মত্ততা, বাসনা ও অন্তর্দৃষ্টি , যা একসময় আমাদের কাছে এসেছিল কিন্তু আমরা তখন বাড়ি ছিলাম না।
ওয়াল্টার বেঞ্জামিন -- প্রুস্তের প্রসঙ্গে
১ / ১
তিনি আসছিলেন। আমি দূর থেকে ওঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু ঠাহর করতে পারছিলাম না তিনি একা না আর কারুর সঙ্গে। তিনি ঢালুর এমন এক কোণে দাঁড়িয়ে যে সেখান থেকে আর কাউকে ঠিক দেখা যায় না। আমি সে চেষ্টা ছেড়ে দিলাম। তিনি এখন গাছপালার শেষ ঝাড়ের দিকে, সেখানে সবুজ ছাউনির উপর অস্তিম সূর্যের হলুদ আলোর আস্তরণ ছড়িয়ে আছে। তার উপর পাখিদের খেলা আর তারও উপর আকাশ, তারা, হাওয়া... ব্যস, আর কিছু না।
আমি অনেক দূর থেকেই দেখছিলাম... তিনি এখন ঝোপের বাইরে পাকদণ্ডীর একেবারে সীমানায় হাঁটছিলেন। তাঁর এক হাতে একটি ছড়ি আর অন্য হাতে টর্চ। তৃতীয় হাত থাকলে হয়তো সেটা নিজের কাঁধেই রাখতেন ... আর নিজের সাহায্যেই নীচে নেমে আসতেন। কারুর এত সাহস নেই যে তাঁকে সাহায্য করে। তিনি কারুর উপর নির্ভর করেন না। কোনো দৈনন্দিন কাজের জন্য তো নয়ই। ওঁকে দেখে আমার হোটেলের বন্ধ দরজাটা মনে আসে, যেখানে লটকানো আছে 'প্লীজ ডোন্ট ডিস্টার্ব!' এসব তিনি-ই করতে পারে যিনি জানেন বাইরে অনেকে তার জন্য বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছে। কখন দরজা খুলবে, কখন তার দেখা পাবে। যে মানুষ সত্যিই একলা, তার দরজায় এরকম সাইন লাগানো থাকে না। আর থাকে যদি তো তাতে লেখা থাকবে 'কাম ওয়ান। কাম অল।'
দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও ভিতরে না এসে উনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? টর্চ নিভিয়ে উনি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিছু শুনতে পাচ্ছেন কি? আমি এত দূর থেকে শুনতে পাবো না। এভাবে নিজের ঘরের সামনে চোরের মতো দরজায় আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে থাকাটা কি ভালো দেখায়? এই বয়সে মানুষ কি এতই সন্দেহবাজ হয়ে যায় যে নিজের দেয়ালকেও বিশ্বাস করতে পারে না?
কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল...না, ভুল করছি। তিনি কিছু শুনছেন না, শুধু দেখছেন। এক পা পিছিয়ে নিজের ঘরটাকেই দেখছেন, যেমন লোকে একটু পিছিয়ে পেইনটিং দেখে। পিছনে পাহাড়ের ফ্রেমে তাঁর কটেজটা ভিতরের আলোয় ঝলমল করছিল। অন্ধকারটা শুধু তিনি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানেই। তাঁর ঝুঁকে পড়া পিঠ, দুলতে থাকা ছড়ি, আর নেভানো টর্চ... চোরের মতো --তিনি নন -- আমিই তাঁকে দেখছিলাম।
কখনো কখনো আমার মনে হয়, আমার অতীত, আমার বিগত জীবন, যতই যাতনাময় হোক না কেন, আমাকে শান্তি দেয়। যতই উল্টোপাল্টা হোক না কেন, আমার তাকে সাবলীল মনে হয়। জীবনের সব অভিজ্ঞতা যেন ধারাবাহিকভাবে এক মসৃণ সুতোয় বাঁধা, সব দেনাপাওনা এখানেই জমা। এই সুতো ছিঁড়লে সবকিছু ধুলোয় মিলিয়ে যাবে। ফোটো অ্যালবামে যেমন দুটো ফোটোর মাঝখানে একটু খালি জায়গা থাকে, সেটা ভরে দেবার 'আমি' তো কবেই অদৃশ্য হয়ে গেছি। আমি এখন একটা নেগেটিভ, দিনের আলোয় এক প্রেতচ্ছায়া। চাইলে বন্ধ দেরাজ খুলে বের করে দেখতে পারেন। বার করারও দরকার নেই ... একটা দেখার পর পরের ছবিটা নিজে নিজেই বেরিয়ে আসে, তাদের সম্পর্কটা না থাকলেও।
যেমন, সেই বিকেলে আমি তাঁকে নিজের কটেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম... তখনি আমার একটা অন্য দৃশ্য মনে পড়লো। এক নীরব, শান্ত ল্যান্ডস্কেপ। দুটো উঁচু টিলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে একটি শবাধার, যার ভিতর তাঁর স্ত্রী। তিনি নীচে খোলা কবরের গহ্বরের পাশে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। পিছনে তাঁদের মেয়ে, চোখে রুমাল ঢেকে; কাঁদছে কি? কি জানি! আমি তাঁদের চোখ বা মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না ... কারণ, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে শুধু তাঁদের উঁচানো হাত আর হাওয়ায় নড়তে থাকা রুমালটাই দেখতে পাচ্ছিলাম।
হঠাৎ আমি তার হাসি শুনতে পেলাম... শুভ্র, উজ্জ্বল দাঁতে পাহাড়ি ঝর্নার কুলকুল শব্দ... তার হাসি, যেটা এখন বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাসিটা ঠিক বাচ্চাদের কানামাছি খেলার হাসি, এক কোণে লুকিয়ে, অন্যদের ধোঁকা দেওয়ার হাসি। আমি এগিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রাখলাম, 'চলুন, সে তো এখন চিরতরে লুকিয়ে পড়েছে।'
আমি যখন প্রথম তাঁর কাছে আসি আমার অবাক লেগেছিল দেখে যে তিনি বসেন যে ঘরে সেখানে ছাড়া বাতি জ্বালানো থাকে অন্য সব ঘরে। একবার, আমায় নোট দেবার সময় তিনি মাঝখানে থেমে গেছিলেন। আমি ভাবলাম হয়তো কিছু মনে করছেন। আমি কলম হাতে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। হঠাৎ তিনি ছড়ি দিয়ে দেয়ালে ঝোলানো ঘণ্টির দড়িটা টানলেন। ঘণ্টিটা শুধু মুরলীধরের কোয়ার্টারেই বাজতো। তাই, মুরলীধর এলে মনে হতো ঘণ্টি শুনে নয়, ওকে দড়ি ধরেই যেন টেনে আনা হয়েছে।
সে ভিতরে আসতো না। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দিত। একটা পুতুলের মতো ওর মাথাটা নড়ত; বাকি শরীরটা বাইরে অন্ধকারে ঢাকা। 'পিছনের ঘরের আলোটা জ্বালাওনি?' সে জিগ্যেস করলো। 'জী?' ও তাকিয়ে আছে। "কি? ভুলে গেছ আজ?' 'জী না।' ও মাথা নাড়ল, ‘বাল্ব ফিউজ হয়ে গেছে। কাল আনব।'
তিনি আর কিছু বললেন না। কোন কিছু পছন্দ না হলে তিনি চুপ করে যেতেন। একটু পরে আমার দিকে তাকিয়ে শুধালেন, 'কি বলছিলাম যেন?' আমি নোটবুক থেকে শেষ লেখাটা না পড়ে হেসে বললাম, 'আপনি তো এঘরে, যেখানে বাতি জ্বলছে। আপনার অন্য ঘরের বাতি নিয়ে চিন্তা কেন?'
তাঁর মুখে একটা অদ্ভুত নিরাশার ছায়া পড়লো। এখানে বাড়ি, ঘর, কটেজ সব একটু দূরে দূরে ছড়ানো। তিনি এসব পেরিয়ে আমার কাছে আসতে চাইতেন না। এটা শুধু বয়সের জন্য নয়। অন্য কিছু একটা বাধা ছিল, যে কারণে আমাকেই সব পেরিয়ে তাঁর কাছে আসতে হতো। তাঁর সেটাই পছন্দ ছিল। তিনি চাইতেন না যে আমি সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকি। বা কেউই তাঁর সঙ্গে থাকে। তারা আশপাশে থাকুক, কিন্তু সঙ্গে ঘেঁষে না থাকলেই ভালো। এই নিয়ম সবার উপর জারি ছিল। তাঁর মেয়ে, অতিথি, চাকরবাকর--সবাই।
হয়তো এইজন্যই তাঁর কটেজটা ছোট হওয়া সত্ত্বেও অনেক দূর ছড়ানো মনে হতো... একটা পাহাড়ি দুর্গের মতো ... যা শত্রুর চোখ এড়িয়ে যায় আর মিত্রও সহজে খুঁজে পায় না। দুই ধারে চীর গাছের সারি। তার মাঝে হলুদ রঙের ছাতটা গাছেরই অংশ বলে মনে হতো। উপরে সড়ক থেকে শুধু ঘাসের উপর হেলে পড়া মুরলীধরের কোয়ার্টারটাই দেখা যেতো। পাকদণ্ডীর একটু উপরে একটা শেড। আগে হয়তো সেটা কোনো চৌকিদার বা সেন্ট্রির ছিল। এখন একটা কুঠুরি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমি সেই কুঠুরিতে থাকতাম। একটা ছোট্ট কিচেন, একটা বাথরুম, শোয়ার ঘর, আর একটা বারান্দা। এই বারান্দাটাই আমাকে প্রথমে আকর্ষণ করেছিলো। এখানে বসে নীচের উপত্যকা, আর উপরের জঙ্গল, দুই-ই দেখা যায়। রাত্তিরে শহরের আলোগুলোর ঝকমকি আকাশে তারার মতই দেখাতো। কোনটা প্রাকৃতিক আর কোনটা নয় চেনা যেত না...।
'চলি?' আমি বলতাম।
'জী,' সে মাথা দোলাত, আমার মনে হয় অন্ধকারে একটু হাসতও।
'সব ঠিকঠাক?' আমি শুধোতাম।
'জী, সব ঠিক। ব্যস, শুধু আপনারই অপেক্ষা।' সে এইরকম কিছু একটা বলত যেন এইমাত্র থিয়েটারের স্টেজ তৈরি করে এল, এখন আমারই আসার অপেক্ষা।
আমি চশমা আর ফাউনটেন পেন ব্যাগে ভরে মাফলারটা গলায় জড়াতাম। টেবিলের ড্রয়ার থেকে ব্রান্ডির বোতলটা বার করে বিনা গেলাসেই একটা লম্বা চুমুক দিয়ে তার সামনে দাঁড়াবার সাহসটা জুটিয়ে নিই, তারপর রবারের সাদা জুতোটা পায়ে গলিয়ে বাইরে বেরুতাম।
আমি বাইরে আসতেই মুরলীধর অ্যাবাউট টার্ন করে নিত আর আমরা সবাই ওর পিছনে লাইন করে পাকদণ্ডী ধরে মার্চ শুরু করতাম। আগে আগে লন্ঠন হাতে মুরলীধর, তার পিছনে আমি, আমার পিছনে কালো-কুচ্ছিত কুকুর কালী, আর সবশেষে বংশীধর। আর তারও পিছনে অর্ধেক চাঁদের টুকরো, যা আমাদের চলার সঙ্গে সঙ্গে চলে আর আমরা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালে সেও থেমে যায়, যেন দেখতে চায় আমরা এরপর কি করবো।
মুরলীধর সরাসরি দরজাটা খোলে না। একটুক্ষণ চুপ করে কান খাড়া করে দাঁড়ায়, যেন ভিতরের কোন অজ্ঞাত সিগনালের প্রতীক্ষায়। ওই সময় ওকে মনে হতো কোন পাহাড়ি দলের সর্দার, মাথায় সাত পাক পাগড়ি যার লেজটা সাপের মতো গলা থেকে ঝুলছে, মুখের উপর হাত, যেন কিছু শুধু শুনছেই না, বলছেও চুপিচুপি। কোন গোপন খবর, যা শুধু কালীই শুনতে পায় আর চারদিকে পাগলের মতো চক্কর মেরে ভেউ ভেউ শুরু করে দেয়। বংশীধরও গুটগুট করে কখনো বাপের দিকে তাকায়, কখনো কালী, কখনো বা আমার দিকে...
ঠিক তখুনি দরজাটা আচমকা খুলে যায়...অবাক মুরলীধর পিছনে পড়তে পড়তে সামলে নেয়। লন্ঠন উঁচিয়ে দেখে... তিনি চৌকাঠে দাঁড়িয়ে... আর দেখছেন ...মুরলীধরকে, যে সিঁড়ির নীচে মুখ বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে—কালীকে, যে ঘন ঘন লেজ দোলাচ্ছে—বংশীধরকে, যে অন্ধকারে নিজেকে আরও অদৃশ্য করার চেষ্টা করছে আর আমাকে, যে বিনা আড়ালে, মুখে ব্র্যান্ডির গন্ধ নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। ...
তিনি খট করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
অমনি বাইরের দুনিয়াটা পিছনে সরে গেল...আর আমার মনে হল তিনি আলোয় দাঁড়িয়ে আর আমি অন্ধকারে, কোনো সঙ্কেতের অপেক্ষায়, একটা কাঁচা অ্যাকটরের মতো, যে ইঙ্গিত না পেয়ে বোকা মুখে স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকে।
তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলেন। আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। আমি রোজকার মতো আমার চেয়ারে বসলাম। শুনতে শুরু করলাম। গাছের পাতায় হাওয়ার শব্দ কীরকম নিস্তব্ধতা ভেঙে ভিতরে আসছিল, থেমে যাচ্ছিল আর আমিও শোনা বন্ধ করে দিলাম। তাঁর গলা থেকে একটা শব্দ... যেন ঠিক হাসবার বা কাশবার সময় ...জল দেবো? আমি তাঁর দিকে তাকালাম।
তিনি চোখ বুজে বসেছিলেন। আমি উঠে জাগ থেকে গেলাসে জল ভরে ওঁর সামনে টেবিলে রেখে দিলাম। তিনি মাথা নেড়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিলেন শুধু। আমার দিকে তাকালেন না। নিচু হয়ে টেবিলের দেরাজ খুলে একটা চৌকো নোটবুক বার করলেন। নোটবুক ঠিক নয়, রেজিস্টারের মতো, তবে অতটা মোটা নয়, পাতলা... উপরটা মোটা খাকি কাগজে বাঁধাই করা। একটা কোণ একটু দোমড়ানো। তিনি বইটা দু-তিন বার খুলে জোর করে বন্ধ করে ফুঁ দিয়ে উপরের ধুলোটা উড়িয়ে দিলেন।
"কাল তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে, আমার মনে ছিলো না... এখন দেখো, এটা এখানেই আছে, আমি পেন্সিলের দাগ দিয়ে রেখেছিলাম।"
আমি ঠিক ধরেছি! ওটা নোটবুক নয়, একটা অ্যাটলাস। আমি মাঝখানে খুলতেই আফ্রিকার ম্যাপ চোখে পড়লো। পরের পাতাতেও আফ্রিকা--তবে শুধু পাহাড়, নদী ও জঙ্গল। তৃতীয় পাতা খুলতে তাঁর গলা শুনলাম, "ওখানে দেখো, যেখানে আমি মার্ক দিয়ে রেখেছি।" দেখলাম একটা লম্বা কাগজের টুকরো আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়ার অনেক পিছনে, খুলতেই চোখ আটকে গেল... পরিচিত দেশের থেকেও বড়ো আর পরিপূর্ণ মনে হল... বার্মা থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত ছড়ানো, লাল, সাদা, হলুদ রঙে রঙিন … আরব সাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে বিস্তৃত উজ্জ্বল, সোনার বরণ... ব্রিটিশ ইন্ডিয়া! প্রাচীন ভারতের থেকেও পুরনো মনে হচ্ছিলো। আমি কিছু না ভেবেই বইটা উলটে প্রথম পাতায় নামটা দেখলাম... ওয়র্ল্ড অ্যাটলাস, ১৯৩৫, ম্যাকমিলান পাবলিশার্স।
১৯৩৫! কাল রাতে এখানেই তো আটকে গিয়েছিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার, তাঁর অতীতের সব তারিখ মন থাকে... দিন, মাস, বছর, সবকিছু, কিন্তু শহরের নাম মনে থাকে না। অতীতের এমন কোনও কোণ নেই যেখান থেকে তাঁর স্মৃতির চিমটে কোন ঘটনা টেনে বার করতে পারে না, কিন্তু জায়গা, শহর, গ্রাম এইসবে যেন কোনরকম কাদা ছিল যাতে পা দিলেই ফসকে যেতো। এটা হয়তো তাঁর অফিসরী জীবনে ক্রমাগত শহর থেকে শহরে যাতায়াতের ফল। চলন্ত ট্রেন থেকে বাইরের ল্যান্ডস্কেপ তো মনে থাকে কিন্তু মাঝে দাঁড়ানো স্টেশনের নাম নয়। আমার চোখে পড়লো একটা কোটেশন, যা আমিই কোথাও টুকে রেখেছিলাম--
“Space doesn’t live in pure time, where we are now. But the objects of space... trees, houses, weather, sky, even the color of the earth... do have time, because they are supported by memory, which is a temporal fact...”
পড়তে পড়তে আমি থেমে গেলাম।
"জিন্দ?"
"জিন্দল," তিনি বললেন, "ম্যাপে এল-টা দেখা যাচ্ছে না। সাগরে ডুবে গেছে।"
আমি এই শহরের নাম আগে কখনো শুনিনি। ম্যাপেও এই প্রথম দেখলাম। সত্যি সত্যি সমুদ্রের তীরে আধ ডোবা দেখাচ্ছে।
আমি ভালো করে দেখলাম... সমুদ্রের লাইনের নীচে নামটা শহরের পিছনে ঢাকা পড়েছে। ওঁকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল।
"আপনি এখানে অনেকদিন ছিলেন বুঝি?"
"যদি বন্যা না আসতো তো আরও অনেকদিন থাকতাম। যে সার্কিট হাউসে ছিলাম তা অর্ধেকেরও বেশি ডুবে গেছিলো... ওই সমুদ্রেই, তুমি ম্যাপে যেটা দেখছ।"
"ওইখানেই বুঝি জিন্দলের 'এল'টা ডুবে গেছিলো?"
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন।
"আজ কি করছিলে?" যেদিন তিনি ভালো মেজাজে থাকতেন মনে করতেন আমার দিনটাও ভালো কেটেছে। আমাদের দিনে অনেকবার দেখা হতো কিন্তু এরকম ব্যক্তিগত প্রশ্ন তিনি রাতের জন্যই রেখে দিতেন যখন আমি তাঁর কটেজে আসতাম।
"কাল যেটা লিখেছিলে সেটা আরেকবার পড়ো তো?"
আমি আমার দিল্লী থেকে আনা নোটবুকটা খুললাম। আমরা কেউই ভাবিনি যে একটি রাজস্থানী বইয়ের পাতায় তাঁর অতীতের জমাখরচের হিসেব লেখা হবে। তাঁরও ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু আমার খবর জানার পর থেকেই আমার উপর তাঁর বেশ একটা সহানুভূতি হয়েছিলো। বলতেন, তোমার যদি ভালো লাগে তো... যতদিন এখানে আছো তুমি যা খুশি করতে পারো, তবে আমার সামনে নয়...
আর এইভাবেই বইগুলো জমা হতে লাগল, একটার পর একটা। জার্নাল নয়, ডায়েরি নয়, এক রকম রেফারেন্স বই... শুধু তারিখ, শহরের নাম, জার্নি, ডাকবাংলো, নদী, নালা, মনসুনের মাস, বন্যার দিন... কিছু স্মৃতির মানচিত্র, হলুদ কাগজে ছড়ানো শরণার্থী শহর, যেগুলো আমি জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা আশ্রয়ের ছবি আঁকতাম যেখানে তাঁর জীবনটা কেটেছে। যখন কিছু বলতে বলতে তিনি থেমে যেতেন, ভুলে যেতেন বা খেই হারিয়ে ফেলতেন, আমি তাঁকে মনে করিয়ে আবার প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনতাম, ঠিক যেন হাত ধরে অন্ধ লোককে রাস্তা পার করে দেয়া।
না, এটা ভুল। আমি পরে জানতে পেরেছিলাম... তিনি অন্ধ ছিলেন না, দেখতে পেতেন সব কিছুই, শুধু এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় পৌঁছতে তাঁর সময় লাগত। যখন তিনি কোনো খাদের সামনে ইতস্তত করতেন, আমিও পেন্সিল হাতে অপেক্ষা করতাম। আমি ভাবতাম তিনি হয়তো কিছু মনে করবার চেষ্টা করছেন কিন্তু আসলে তিনি কোনও ঘটনা ভুলে যাবার চেষ্টা করতেন। মনে করা আর ভুলে যাওয়ার মাঝখানের খাদটা এড়াবার চেষ্টায় আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, "কি সাহেব, কোথায় থেমেছিলাম যেন?"
"বন্যার সময়।" আমি উত্তর দিতাম।
"বন্যা! হ্যাঁ ... মনে পড়েছে। ছোট্ট নদী কিন্তু জল কতো! ভাগ্যি ভালো সঙ্গে আমার স্ত্রী ছিলো না। নইলে সে তো সব জায়গায় আমার সঙ্গে সঙ্গে যেতো। সেই সময় যদি আমার সঙ্গে আসতো তো আমাকেই ওর পেট কেটে তিয়াকে প্রসব করাতে হতো।" সে হাসছিল। "তুমি তো বিটিয়াকে দেখেছ... সেই সময় সে পেটে। আমি ছিলাম দোতলায়, সেখানে জল তখনো পৌঁছয়নি। তিন দিন আমি ঘরে আটকা। খাবার, জল--কিচ্ছু নেই। কিন্তু আমার সে সবের চিন্তা ছিলো না। তুমি জীবনটাই যদি না শুরু করে থাকো তো মৃত্যু কোন সমস্যাই নয়। যেখান থেকে তুমি এসেছ, মনে হয় কতো সহজেই আবার সেখানে পৌঁছতে পারো। তুমি নিশ্চয়ই দেখেছো কতো সহজে যুবকরা আত্মহত্যা করে, বয়স্করা কিন্তু কখনোই পারে না। তারা জীবনে এতই অভ্যস্ত যে বেরিয়ে আসাটা তাদের পক্ষে দুষ্কর। তবে, মরার থেকেও ভয়ের কথা যদি তুমি কখনোই না মরো, চিরদিন বেঁচে থাকো! কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার, না?"
"তখন কি কাজ করতেন?" আমি তাঁকে ঠিক রাস্তায় আনার চেষ্টা করি।
"ফাইল।"
"কিসের ফাইল?"
“তুমি ধারণাও করতে পারবে না সরকারি অফিসারদের এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে কতো ফাইল আর ফর্মের দরকার পড়ে। ফাইল আর ফর্ম!" সে নিজের কথায় নিজেই হাসতে থাকলো। "এইজন্যই যেসব দুর্ঘটনা সাধারণ লোকের কাছে বিপত্তি, আমাদের কাছে তাই বরের মতো। ভূমিকম্প, বন্যা, মহামারি...এসব ছাড়া আমাদের কাজ অসমাপ্ত থেকে যাবে। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না সেই তিন দিন আমি সমস্ত ফাইল শেষ করে ফেলেছিলাম। ডুবন্ত লোকেরা যেমন খড়কুটোও আঁকড়ে ধরে, আমরা সেরকম ফাইলের ফিতে আঁকড়ে সাত সমুদ্র পার হয়ে যাই। চতুর্থ দিনে আমি জানলা দিয়ে দেখলাম বানের জল অনেকটা নেমে গেছে। মেঘ কেটে সূর্য উঠেছে, রেলগাড়ির বগিগুলো ধোয়া, পরিষ্কার; যেন একটা সাপ জল থেকে উঠে রোদ পোয়াচ্ছে। ডাকবাংলোর চৌকিদার তো আমায় জ্যান্ত দেখে ভীষণ অবাক। জানো তার হাতে কি ছিল? একটা টেলিগ্রাম--যা তিন দিন আগে পৌঁছেছিল! ভাবোতো, যখন বিটিয়া এই পৃথিবীতে এলো, আমি পৃথিবীর শেষ কিনারায় বসে... বন্যার গল্প কোত্থেকে শুরু করলাম?"
আমি নোটবুক খুলে ভাবলাম অন্য কিছু মনে করিয়ে ওঁকে ডাকবাংলো আর বন্যার জলাভূমি থেকে সরিয়ে আনব, কিন্তু তিনি নিজেই আমায় থামিয়ে দিলেন, "পরে হবে। আজ এই পর্যন্তই।"
কিছুক্ষণ আমরা চুপ করে বসে রইলাম। তারপর আমি বল্লাম, "আজ আসি তাহলে?"
"ঠিক আছে। না... দাঁড়াও। মুরলীধর আসবে এক্ষুনি।"
"দরকার নেই।" আমি বললাম, "আমি টর্চ এনেছি সঙ্গে।"
তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আমার দিকে তাকালেন, "তোমার এখানে একলা লাগে না তো?"
"আপনার কি মনে হয়?"
তিনি আবার চুপ করে রইলেন। আমি তাঁর পিঠে হাত রেখে মৃদু চাপ দিলাম। তিনি একটুও নড়লেন না। আমি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলাম।
বাড়ি ফেরার আগে আমি একটু বেড়াবো ঠিক করলাম। পরিষ্কার আকাশ, মিষ্টি হাওয়া। আকাশে এত তারা, এত উজ্জ্বল যে মনে হয় হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়। গাছেদের মাথায় আবছা কুয়াশা। শান্ত, নিশ্চল, নিস্তব্ধ। তাদের নীচে চলতে চলতে আমি নিজেই ভুলে যাই আমি কে, কেন এখানে, ঘর ছেড়ে এতদূর কি করতে এসেছি? বুকভরে শ্বাস টেনে শরীরটা হালকা মনে হয়, মনে আশা জাগে। কি আশা আর কিসের জন্য... সেসব বুঝি না। মনটা খালি থাকলে সেখানে অনেক কিছুই ঢুকে পড়ে।
পাকদণ্ডী দিয়ে চলতে চলতে আমি থেমে গেলাম। পিছনে ঘুরে দেখি। অন্ধকারে তাঁর কটেজটা আলো-ঝকমকে বাক্সের মতো। কেউ যেন ভুলে জঙ্গলে ফেলে গেছে। প্রত্যেকটি কামরায় বাতি জ্বলছে, ঠিক তিন বছর আগের মতো... যখন আমি এখানে প্রথম এসেছিলাম। একটুও বদলায়নি। সেই সবুজ কাঠের জানলাগুলি, ব্যাডমিন্টন খেলার লন, পাথরের বেঞ্চ... সবকিছু আগের মতই, শুধু সে আর নেই... সে, যে আমাকে এখানে ডেকেছিল... সেজন্যই কি সে কবরে যাওয়ার সময় হাসছিল, যেন আমাকে বলছিল, দেখো, তোমায় ডেকে এনে আমিই পালাচ্ছি কেমন! হয়তো তার ভয় ছিল আমি একলা পাহাড়ে বোর হয়ে যাবো। বোর হওয়ার প্রশ্নই ছিলো না। দিন কখন শুরু হতো, কখন রাত এসে পড়তো আমার খেয়ালই থাকতো না। সকালে যখন মুরলীধরের ছেলে চা নিয়ে হাজির হলে বুঝতাম দিন শুরু হল, আর সন্ধ্যায় যখন মুরলীধর স্বয়ং লন্ঠন হাতে আসতো তখন এমন মনে হত না যে আরেকটা নতুন দিন শুরু হল, মনে হতো পুরনো দিনেরই একটা নতুন চ্যাপ্টার। দিন একটাই, আমিই কখনো একে উপর থেকে কখনো নীচ থেকে দেখছিলাম।
যখন কেউ বলে 'একদিন থেকে আরেকদিন,' তারা হয়তো বলতে চায় একই দিন-- কিন্তু চলন্ত। ছোটবেলায় এক গরমের ছুটিতে আমি কিছুদিন একটি ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশনে কাটিয়েছিলাম। আমার কাকা ছিল স্টেশনমাস্টার। আমি দেখতাম পুরনো বগিগুলো পাশের ছোট লাইনে সরিয়ে রাখা হতো। রেলগাড়িরা আসতো আর ওদের ছেড়ে ঝকঝক করে বেরিয়ে যেতো। ঐসব খালি কামরায় আমরা লুকোচুরি খেলতাম। কখনো কখনো দুএকটা মজার জিনিশও পেয়ে যেতাম, কারুর মাফলার, সিটের নীচে কোনো মেয়ের স্যান্ডেল... একবার তো আমি কোনো মুসাফিরের ছেঁড়া পুরনো নোটবুক পর্যন্ত পেয়েছিলাম, ভিতরে একটা পাঁচ টাকার নোট! কিন্তু সবথেকে আজব জিনিশ রেলের ওই বগিটাই--সেটা সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতো, কোথাও যেত না। পরে ওই বিজ্ঞাপনটা না পড়লে আমার জীবনটাও আজ ওই পাহাড়ি ব্রাঞ্চলাইনের বগির মতই পড়ে থাকতো। কখনো কখনো একটা ছোট্ট জিনিশ জীবনের ধারা একেবারে বদলে দেয়...
আমি দিল্লী স্টেশনে বিজ্ঞাপনটা দেখেছিলাম। তার টুকরো হয়তো এখনো আমার কাগজপত্রের মধ্যে পড়ে আছে। আমার লেখাটা ঠিক স্মরণে নেই। কিন্তু মনে আছে ওই ছোট্ট বিজ্ঞাপনটা আমার মনে কেমন কৌতূহল জাগিয়েছিল।
প্রথমত, বিজ্ঞাপনটি দিয়েছিলেন এক মহিলা, চাইছিলেন একজন শিক্ষিত যুবক, যে তাঁর রিটায়ার্ড স্বামীর সঙ্গে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সঙ্গ দেবে আর ছোটখাটো ফাইফরমাশ খাটবে। কি রকম কাজ সেটা বিজ্ঞাপনে লেখা ছিলো না। এর পরিবর্তে আবেদনকারীর ফ্রি থাকাখাওয়ার বন্দোবস্ত।
কৌতূহলের আরেক কারণ-- উত্তর দেবার জন্য বাড়ির ঠিকানা না দিয়ে বাহাদুরগঞ্জের এক পোস্ট অফিসের নম্বর দেওয়া ছিল। পরে আমি জিগ্যেস করায় সে স্বভাবমাফিক খিলখিল করে হেসে বলেছিল, "আপনি কি ভাবছেন? যদি আমি আগেই মেহরা-সাবকে বলে দিতাম তো আপনাকে তিনি এখানে থাকতে দিতেন? আমি তো তাঁকে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে রাখতে চেয়েছিলাম।"
অন্ধকারে? আমি তার কথা জানি না, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে বলতে পারি যে যেদিন আমি বিজ্ঞাপনটা পড়লাম সেদিনই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। আমি তখন যাকে বলে 'ক্রাইসিস অফ মিডল এজ'-এ ভুগছি। আমি ওটা কাটাবার চেষ্টা করছিলাম। এখন ভাবলে হাসি পায়। কেউ কি কখনো নিজের চামড়া বা মনের মালিন্য থেকে বেরুতে পারে? যেখানেই যাও, ও দুটো সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে। কিন্তু একটা কথা এখন বুঝি, এখানে আসার মানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া নয়, শুধু নিজেরই জায়গায় নিজেকে দ্বিতীয়বার পাওয়ার প্রচেষ্টা।
আমি জানি না এ বিষয়ে আমি কতোটা সফল হতে পেরেছি। কিন্তু কুটিরের বান্দায় বসে দেবদারু গাছের উপর বৃষ্টির ছাঁট দেখার সময়ে মনে হয় এই পাহাড়ের শান্তিতে আমার সেই 'মিডল এজ'-এর সন্তাপটা খানিকটা ধুয়ে গেছে... শান্তি মানে একটা নিরুত্তাপ অস্তিত্ব, যেখানে হঠাৎ খুশির দমকা হাওয়া ওঠে না, আর কোনো বিপদের আশঙ্কাও নেই।
কাজ অবশ্য খুব বেশি নয়। সপ্তাহে দু' বার মেহরা-সাহেবের কটেজে যাই, তিনি যা বলেন, ভাবেন বা মনে করেন, সব খাতায় লিখে রাখি। খালি দিনে ওইসব নোট কাটছাঁট করে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখি, যাতে অন্য কারুর পড়ায় অসুবিধা না হয়। তা এরকম জায়গায় তৃতীয় লোক আর কেই বা আছে? শুধু তাঁর মেয়েটি, সে কখনো সখনো উইক-এন্ড কাটাতে আসে। তাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম তার মার মৃত্যুর সময়, তার খোলা কবরের সামনে।
তখনি তার কবর থেকে আমি হাসির শব্দ শুনেছিলাম।
যেন সে বলছিল, 'দেখো তো, তোমাকে এখানে ডেকে আমি নিজেই পালিয়ে যাচ্ছি।'
সে কি সত্যিই পালিয়ে গেছে? আমি খালি ঘরের বাইরে হাওয়ার শব্দ শুনি। মনে হয় ঘরের ভিতরে বাইরে কোনো আত্মার পদধ্বনি...না আত্মা নয়, সে তো স্বয়ংসম্পূর্ণ, এত প্রাণবন্ত তার শরীর...
সে মেহরা-সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী, বয়সে অনেক ছোট। প্রথমে তো আমি তাঁকে মহরা-সাহেবের মেয়েই ভেবেছিলাম। জানতাম না সে নিজেই ইতিমধ্যে একটি মেয়ের মা। যেদিন এসেছিলাম, সে বাইরে ব্যাডমিন্টন খেলছিল। সঙ্গে আরও একজন মহিলা। মেহরা-সাহেব বাইরে বসেছিলেন, সামনে টেবিলে জলের জাগ আর কাঁচের গেলাস। কুলি লাগেজ নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। বারো ঘণ্টা বাস জার্নির পর ঘাম-ধুলোমাখা আমার চোখে পাহাড়ি কটেজের এই দৃশ্যটা ঠিক সিনেমার মতই দেখাচ্ছিল।
সে এক পলক আমার দিকে তাকালো, তারপর কুলিটার দিকে, আবার আমার দিকে... তারপর একটু জিজ্ঞাসার সুরে বলল, "তুমিই কি সেই স্টেটসম্যান-এর চাকুরিপ্রার্থী … ?"
সে মুখের কথাটা শেষ করলো না, তার আগেই মেহরা-সাহেব তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, মুখে মুচকি হাসি। হাসির মধ্য দিয়েই তিনি আমার পরিচয়টা বুঝে নিলেন। আমার হাত ধরে ব্যাডমিন্টন কোর্টের পাশে এনে বসিয়ে দিলেন। সেখানে এক বিদেশী মহিলা তখনও র্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে। বেঁটে, কিন্তু শক্তসমর্থ চেহারা, কটা চুল, আর মেক আপ করা বড়ো বড়ো নীল চোখ... "এঁর নাম অ্যানা। কিন্তু খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি এঁর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবে না।"
আমি খেলার শেষ পর্যন্ত কোর্টের ধারে বসে রইলাম। মিসেস মেহরা একদিকে, আর ওপাশে মিস্টার মেহরা ও বিদেশী মহিলাটি। কোর্টের পিছনে গাছের তেরছা লাইন অস্তিম সূর্যের আলোয় মাখামাখি হয়ে পাহাড়ের উপরে আকাশ পর্যন্ত চলে গেছে।
সন্ধ্যার গোধূলির আলো মিলিয়ে যাচ্ছে, আকাশে দু-একটা তারা, ওদের শাটল-ককের খট খট শব্দ কখনো এদিকে, কখনো ওদিকে। মিসেস মেহরা একলা খেলেও জিতে গেছিলো। এসে আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। তখন তারার আলোয় তার সুন্দর, রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে কে বলবে যে দু বছর পরেই আমাকে তার কবরের সামনে দাঁড়াতে হবে।