১৯৫৭ সালে শিল্পশিক্ষার বিপুল আগ্রহ নিয়ে কলাভবনে এসেছিলেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, ‘...কলাভবনে শিল্পশিক্ষায় এত আয়োজনের আড়ম্বর ছিলই না। কলাভবনে ছবি আঁকা শেখার আরম্ভের অনুভব ছিল প্রকৃতি পাঠের মতো। অনেক বেশি বলা ছিল না। আজকের শিল্পশিক্ষার যেসব বাঁধন তার কিছুই ছিল না’। শান্তিনিকেতনের আশ্রম তাঁর যেন বড় আপন। মনে হয়নি বাইরে কোথাও এসেছেন। কলাভবনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নন্দলাল বসুর সুযোগ্য ছাত্র। আজীবন পাথেয় করে নিয়েছিলেন নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর প্রমুখের শিল্পশিক্ষার প্রতিটি নির্দেশ। কলাভবন গড়ে ওঠে ১৯১৯ সালে। রবীন্দ্রনাথের কলাভবন তৈরির উদ্দেশ্যই ছিল শিল্পের প্রসারতা ও শিল্পসহায়ক একটা পরিবেশ তৈরি করা। তিনি চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের শিল্পকলা সমগ্র দেশে এক নিজস্ব শৈলীতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক। রামানন্দ মনে করেছেন কলাভবন গড়ে উঠেছিল এক ভিন্ন অনুভব ভিন্ন প্রেরণা ভিন্ন চেতনায়। প্রকৃতিকে ঘিরেই চিত্রচর্চার এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন কলাভবন। এখানকার শিল্পচর্চার বিষয়ের জন্য শিল্পীদের কোথাও ঘুরে বেড়াতে হয়নি।
রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৬ সালে। তাঁর চিত্রভাবনা বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টস-এর আদর্শানুসারী। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনি, হিন্দু দেব-দেবী ও প্রকৃতিকে বিষয় করেই তাঁর চিত্রসম্ভার আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করেছে। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন চিত্রকর, শিল্পশিক্ষক ও শিল্পচিন্তক।
রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘চিত্রকরের রোজনামচা’ গ্রন্থটিতে লক্ষ্য করা যায়, রোজনামচার শুরু ২৪. ১২. ২০০৮ এবং শেষ ১৬. ৩. ২০০৯ যদিও ধারাবাহিক ভাবে নয়। এই রোজনামচা প্রকৃতঅর্থে কোনো দিনলিপি নয়, প্রাত্যহিক জীবনাচারণের বর্ণনা নয়, বরং প্রাজ্ঞমনন উদ্ভাস এক চিত্ররূপ। সারা বইটিতে ছড়িয়ে আছে সহজ করে বলা জীবন ও যাপনের গূঢ়কথা, জন্মভূমি ও কলাভবনের কথা, নিজের ছবির কথা, ‘আমার ছবি আঁকার সত্য হল ওই মাঠে রাখাল ছেলেদের মতো। আমার ছবি কোনো উচ্চকোটির পর্যায়ভুক্ত নয়—আমার এ ছবি সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকার’। তিনি মিশতে চেয়েছেন অতি সাধারণ, হতদরিদ্রের সঙ্গে, ‘পথ চলতে চলতে যখন বস্তির কাছে আসি তখন আমার কাছে একটা আলাদা জগৎ খুলে যায়। ...বস্তির এই জগৎ এক আলাদা মহিমায় গড়ে ওঠা। আমরা ওদের কেবল কেবলই হতদরিদ্রের সীমানায় আটকে রেখেছি—আমার অভিজ্ঞতা আর ওদের সঙ্গে মেলামেশায় বেশ বুঝতে পারি ওদের মতো সহানুভূতির মন সাহায্যের মন আমাদের মাঝে কাজ করে না’। রোজনামচা-য় তিনি কলম ধরার প্রেক্ষিতের কথাও বলেছেন, ‘লেখা কেবল একজনকে লেখক বা কবি গড়ে তোলে না— লেখা ভেতরে জমা থাকা অনুভবকে সবার করে দেওয়ার এক পানসি’। তাঁর গভীর জীবনবোধের উল্লেখ আমাদের প্রাণিত করে, যে বোধ মানুষকে মানুষের মতো বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী মন্ত্র, ‘চাওয়া যে যত কমাতে পারে, সে-ই সবচেয়ে প্রশান্তির মাঝে, সুখের মাঝে বাস করতে পারে। অল্পে সন্তুষ্ট হওয়ারও সাধনা দরকার’, তারপরেই লিখছেন, ‘ত্যাগের দীক্ষা না নিতে পারলে পদে পদে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা। ত্যাগ হল নিজেকে সঠিক রাখার এক বিশেষ সঞ্চয়’। তাই তিনি অনায়াসে লিখতে পারেন, ‘আমায় আর প্রলোভন দেখিয়ো না। আমায় আমার আজন্ম অভ্যেসের সঙ্গে যুক্ত থাকতে দাও। আমার পট যেটুকু দিয়েছে দিচ্ছে তার বেশি লালচের ভেতর টেনো না। ...আমি যেমনই হই— আমায় আমার মতো থাকতে দাও। প্রলোভন দেখিয়ো না’। ‘যা ভালো নয়-যা অসুন্দর তাকে নিজের মত করে সুন্দর করে নেওয়ার কাজ চিত্রকর তোমার। তুমি কি জানো তোমার পরিচয় তোমার কাজে আর বিনয় ব্যবহারে’— এ তো কোনো উপদেশ নয়, আদেশ নয়, বরং ভালোবাসার এক স্নিগ্ধ উচ্চারণ।
তিনি আশ্চর্য ভঙ্গিমায় বলেছেন নিজের জন্মভূমি বীরভূমের কথা, ‘আমি বীরভূমের ছেলে— বীরভূমের শীত আর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা তাল খেজুরের সারির এক আলাদা মাত্রা। ... শীত প্রতিদিন আরম্ভ করে তার ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন সকাল নিয়ে তবু তাকে ধোঁয়াশা লাগে না—এক অসাধারণ অসামান্য প্রকৃতির সৌন্দর্য বলেই মানুষের এত আদর শীতকে নিয়ে’। তিনি একথাও জানিয়েছেন ‘এখনও আমার মন-হৃদয় আর দৃষ্টি থেকে পল্লীর জীবন, ছবি, সংস্কৃতি কোনোটাই ফিকে হয়ে যায়নি— আমার সবটাই গ্রামের জীবন দিয়ে ঘেরা’। রোজনামচার শেষপৃষ্ঠায় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠসময়ের কথাটি বোধহয় তিনি লিখেছেন, ‘সবচেয়ে আমার ভালো লাগে ছেলেবয়েসে জামালপুরের রেল কলোনি। আর স্মৃতির ছবিতে কেবলই ফুটে ওঠে প্রথম শান্তিনিকেতন আশ্রমের ছবি— যেদিন আশ্রমে প্রবেশ করলুম। তার থেকেও এক গ্রীষ্মের দুপুরে মাস্টারমশাইকে দর্শন। সে এক অনুভূতি’।
‘চিত্রকরের রোজনামচা’ শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুভবের এক চিত্রল চালচিত্র। যে চালচিত্রে কোনো অসূয়া নেই, অহংকার নেই, আছে জীবনকে সহজ করে বোঝার এক উজ্জ্বল সরণি। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় ১৪০টি অসামান্য ড্রয়িং বইটির অন্যতম সম্পদ। শিল্পীকৃত প্রচ্ছদটিও অনন্যসাধারণ। বলা যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা।