‘পুতুলখেলা’— এই বই শুধু স্মৃতিকথা নয়, বর্ধমানের পাপেট চর্চার চার দশকের ইতিহাসের দলিল। আগে দুর্গাপুজোর সময় গ্রামবাংলার পাড়ায় পাড়ায় বসত পুতুল নাচের আসর। গীতিআলেখ্যেধর্মী পুতুল নাচের মাধ্যমে ফুটে উঠত সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখের কথা। সুকুমার সেনের একটি লেখাতে পাওয়া যায়, চৈতন্যপূর্ব বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ পালাটি ছিল একটি পুতুল নাটকের পাণ্ডুলিপি। ১৯৫০-এর দশকে শৈল চক্রবর্তী পুতুলনাচের দল প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দিলেন ‘পুতুল রঙ্গম’। রঘুনাথ গোস্বামী শ্যাডো পাপেটকে এক অন্য মাত্রা দিলেন ১৯৬০-এর দশকে। এরপর ১৯৭০-এর দশকে পুতুল নাট্যচর্চার অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল বিদেশ। মস্কোর বিখ্যাত শিল্পী ওব্রাৎসবের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সুরেশ দত্ত রড পাপেটকে জনপ্রিয় করে তুললেন। ক্যালকাটা পাপেট থিয়েটারের জন্ম হল। এরপর স্বপ্না সেন প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দা পাপেটস’। ‘ডলস থিয়েটার’ তৈরি করলেন সুদীপ গুপ্ত। শুভাশিস সেনের দল হল ‘তাল-বেতাল থিয়েটার’। আশির দশকে বর্ধমানে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ‘বর্ধমান পাপেট থিয়েটার অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার’। বর্ধমান শহরের সংস্কৃতির অঙ্গনে কীভাবে এই পাপেট থিয়েটার হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য এক অধ্যায়— সেই ইতিহাসই এই গ্রন্থের পাতায় পাতায় তুলে ধরেছেন বিভিন্ন শিল্পীরা।
পুতুলনাচের ইতিহাস খুবই ঐতিহ্যময়। ইউরোপে পুতুলনাচের সবচেয়ে প্রাচীনতম ধারক জার্মানি। মধ্যযুগে ইতালিতে ‘পুলসিনেলো’ নামে আবির্ভাব ঘটে স্ট্রিং বা সুতো পাপেটের, ফ্রান্সে যার নতুন নাম হয় ‘পলসিনেল’। গ্লাভ বা দস্তানা পাপেটের জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে জন্ম নেয় ‘পাঞ্চ’। এই পাঞ্চ চরিত্রের প্রতিরূপ দেখা যায় রাশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে। জার্মানি ও সুইডেনে পাঞ্চের নাম ‘কাসপার’, হল্যান্ডে ‘ইয়ান ক্লাসেন’ এবং হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ায় ‘ভাসিলচে’। ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরে কাঠ আর তার দিয়ে পুতুল নাচানো হত। চীনে পুতুলনাচ শুরু হয় হান যুগে বা খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০ সালে ছায়া পুতুলের মাধ্যমে। জাপানে পুতুলনাচের উদ্ভব হয় পাঁচ হাজার বছর আগে ‘জোমোন’ সময়কালে। এছাড়াও কোরিয়া, ফিলিপিনস, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় পুরোনো ও আধুনিক ধারার পুতুলনাচের অস্তিত্ব এখনও বিরাজমান।
বাংলাদেশে পুতুলনাচের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের পুরোনো। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বিপিন পালের হাত ধরে প্রথম পুতুল নাচের প্রচলন শুরু। বাংলাদেশে কয়েকটি গ্রামে সাধারণত পুতুল তৈরি হতো শোলা দিয়ে। তারপর তাকে কাপড় পরিয়ে এবং রঙ মাখিয়ে সুন্দর করে সাজানো হতো। কোথাও কোথাও শুধুমাত্র বিভিন্ন রঙের কাপড় দিয়ে পুতুল তৈরি হয়। প্রথম দিকে নাচের পুতুল মাটি ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হতো। নিচের অংশ কাঠ আর ওপরের মাটির অংশে রঙ দিয়ে মানুষ, পশু, পাখির অবয়ব আঁকা হতো। নিচের অংশে কাপড়ের পোশাক ব্যবহারের প্রচলন ছিল। চুল হিসেবে ব্যবহার করা হতো পাট বা কচুরিপানার শিকড়। পরবর্তী কালে ভাঁটশোলা, ন্যাকড়া, লোহার তার দিয়ে নাচের পুতুল তৈরি করা শুরু হল। নাচের পুতুল তৈরির জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কান্দিপাড়া গ্রাম বেশ প্রসিদ্ধ। এখানেই গড়ে ওঠে কয়েকটি পুতুল নাচের দল। একসময় হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত পুতুলনাচিয়ে দল গ্রামে-গঞ্জে পুতুলনাচ পরিবেশন করত। এই দলগুলো বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশে সাধারণত তারের পুতুল ও লাঠি পুতুলের প্রচলন খুব বেশি। আমাদের দেশে মূলত চার ধরনের পুতুলনাচ দেখানো হয় — ডাং পুতুল (রড পাপেট), তারের পুতুল (স্ট্রিং পাপেট), বেণী পুতুল (গ্লাভস পাপেট) আর ছায়াপুতুল (শ্যাডো পাপেট)৷ দক্ষিণ ২৪ পরগণার জয়নগর এলাকা বিখ্যাত ডাং পুতুলের জন্য। নদীয়ার কৃষ্ণনগরে জনপ্রিয় তারের পুতুল আর পূর্ব মেদিনীপুরে বিখ্যাত বেণী পুতুল।
১৯৮৮ সালে বর্ধমান শহরের কিছু সংস্কৃতিমনস্ক শিল্পী, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী আর স্বাস্থ্যকর্মীর যৌথপ্রয়াসে তৈরি হয়েছিল ‘বর্ধমান পাপেট থিয়েটার অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার’, যার নেতৃত্বে ছিলেন বর্ধমান মেডিকেল কলেজের অডিও ভিসুয়াল ইউনিটের আর্টিস্ট স্বপন রায়, সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ, সঞ্জীব চক্রবর্তী, বিভাসরঞ্জন দাস, অমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গুণী মানুষেরা।
১৯৮৮ সালে বর্ধমানের টাউন স্কুলের মাঠে বর্ধমান শিশুমেলাতে এই গোষ্ঠীর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম বছরের প্রযোজনা ছিল দুটি। রুশি উপকথার বই থেকে আহৃত বিষয় ‘দাদুর দস্তানা’ আর ‘হলদে ঝুঁটি মোরগটি’। বর্ধমান পাপেট থিয়েটার অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার প্রথম থেকেই একটা নীতি অনুসরণে বিশ্বাসী ছিল। প্রথমত কোন বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করা হবে না যা মৌলিক মানবিকবোধের পরিপন্থী। এবং উপস্থাপনা হবে সরল গল্পকথনের মধ্য দিয়ে যা হয়ে উঠবে সকলের কাছে মনোগ্রাহী।
পুতুলনাচ লোকনাট্যের একটি প্রাচীন মাধ্যম। শিল্পীদের স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে পুতুল তৈরির নির্মাণ কৌশল। প্রথমে মাটি দিয়ে পুতুলের মুখ তৈরি করা হয়। তারপর তাকে দুভাগ করে প্লাস্টার অব প্যারিসে ঢেলে ছাঁচ করে নেওয়া হয়। তারপর সে ছাঁচে আঠা দিয়ে পরতে পরতে টিপে টিপে হাওয়া বের করে কাগজের টুকরো লাগানো হয়। ছয় বা সপ্তম স্তরে সুতির কাপড়ের টুকরো, দুই স্তর কাগজ লাগিয়ে সবশেষে ভালো ব্রাউন পেপার জড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর ভালো করে রোদে শুকোলে সেই কাগজের ছাঁচ আলগা হয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর দুটো খণ্ড আঠা দিয়ে জোড়া দেওয়া। এবার শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে খড়ি বা জিঙ্ক অক্সাইডের সঙ্গে আঠা মিশিয়ে মোটা করে প্রলেপ দেওয়া, তারপর আবার শিরিষ কাগজে ঘষে নিলেই মুখ তৈরি। এরপর রঙ করে চোখ মুখ এঁকে নেওয়া হয়। তারপর চলতে থাকে চুল লাগানো, পোশাক পরানো, হাত লাগানো। ঢিলে পোশাকে সারা শরীর ঢাকা থাকে চরিত্র অনুযায়ী। কানের পাশ দিয়ে সোজা করে হাত তুলে দিতে হয়। তারপর সংলাপ বা গানের ছন্দে পুতুল জীবন্ত হয়ে ওঠে। তবে পুতুল তো কুশীলব মাত্র। নাটকের ভিত্তি তার স্ক্রিপ্ট। স্ক্রিপ্টের প্রাণ তার গল্প।
পুতুল যখন নেচে গেয়ে সংলাপে বা তলোয়ার ঘুরিয়ে আসর মাতায়, তখন তার পিছনে থাকে বহু শিল্পীর শ্রম, নিষ্ঠা, অনুশীলনের সম্মিলিত প্রয়াস। একটি পুতুলনাট্য নির্মাণে দক্ষ মূর্তিশিল্পী ছাড়াও অবশ্য প্রয়োজন পটুয়া, বেশকারী, কামার, কুমোর, চর্মকার, ছুতার, দর্জি সম্প্রদায়ের শিল্পীদের।
ইস্টার্ন কালচারাল জোন (EZCC)-এর আমন্ত্রণে ২০০৩ সালে ইলাহাবাদ শিল্পমেলায় অনুষ্ঠানের পরে বর্ধমান পাপেট থিয়েটার অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার দলটি তার স্বাভাবিক ছন্দ হারায়। যে সৃজনশীল আবেগ নিয়ে এই দলের যাত্রা শুরু হয়েছিল, মাঝপথে এসে সেই নিষ্ঠা আর একাগ্রতার অভাবে, দলগত শৃঙ্খলা আর ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার টানাপোড়েনে দলটির পথ রুদ্ধ হতে শুরু করে। ১৯৮৮ থেকে ২০০৩— এই পনেরো বছরই বর্ধমান পাপেট থিয়েটারের নির্মাণশৈলীর শ্রেষ্ঠ সময়।
পুতুলনাচের পুতুল স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নটাই পুতুল নাচের প্রাণ। পুতুল সঞ্চালনার স্বপ্ন নিয়ে ২০০০ সালে পার্থপ্রতিম পাল নতুন করে শুরু করলেন বর্ধমান ‘দ্য পাপেটিয়ার্স’। প্রথম প্রযোজনা মৌলিক নাটক ‘ইচ্ছাপূরণ’। বিগত কুড়ি বছরে পনেরোটি নানা ধরণের নাটক প্রযোজনা করেছে এই দল। চারশো-র বেশি অনুষ্ঠান করার কৃতিত্ব তাদের। সামগ্রিকভাবে পুতুলনাট্যের উন্নয়নের নিরিখে তাদের নির্দিষ্ট কিছু ইতিবাচক পরিকল্পনা আছে। ঐতিহ্যবাহী পাপেট শিল্পকলার পুনরুজ্জীবন ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে পাপেটের নতুন এই দল। বর্ধমানের পাপেটকে সর্বভারতীয় পাপেট চর্চার মূল স্রোতে পৌঁছে দিতে এঁরা বদ্ধপরিকর।
সকলের অলক্ষ্যে সুতোর টানে পুতুল যখন নেচে ওঠে তখন সেটি হয়ে ওঠে পাপেট্রি। মানুষের কাছে এক জীবন্ত প্রতিকৃতি হয়ে সব সময়ে ধরা দিয়ে এসেছে বলেই এই শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা আজও বহমান। পাপেট থিয়েটারের ইতিহাসে উজ্জ্বল নাম বর্ধমান পাপেট থিয়েটার অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার। এই ইতিহাসের হাত ধরেই শহরের থিয়েটারের সাথে পরিচিত হয় আন্তর্জাতিক পাপেটিয়ার সুরেশ দত্ত। শহর সাক্ষী থাকে কত উজ্জ্বল কর্মশালার। বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন প্রজন্মকে পাপেট থিয়েটারে আগ্রহী করে তুলছে বর্ধমান ‘দ্য পাপেটিয়ার্স’। নতুন নতুন গল্প, তার বিন্যাস, এক্সপেরিমেন্ট ও পাপেটের অভিনয়ে বর্ধমানের এই দুই পাপেট থিয়েটার গোষ্ঠী আমাদের শেখায় কেমন করে পাপেটিয়াররা পাপেটদের অবয়বে প্রাণ এনে দেয়। অদ্ভুত এক মায়াজালে ঘিরে রাখে মঞ্চ। সম্মোহিত করে দর্শকদের। বাংলার বিলুপ্তপ্রায় পুতুলনাচের ঐতিহ্যকে জানতে বর্ধমানের পাপেট চর্চার ইতিহাসের গুরুত্ব যে অপরিসীম এই বইটি আমাদের তা বারবার মনে করিয়ে দেয়।