হাওড়া থেকে মিথিলা এক্সপ্রেস বিকেলে সময়মতোই ছাড়ল।..
নেপাল সাধারণ পর্যটকদের কাছে যেমন আকর্ষণীয়, তেমন আবার পর্বত আরোহী ও ট্রেকার্সদের কাছেও দুর্দান্ত এক ডেস্টিনেশন। গোটা বিশ্বের সেরা পর্বত শৃঙ্গগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই নেপালের দখলে। যারা উচ্চতার বিচারে, সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে সারা বিশ্বকে টেনে নিয়ে আসে নেপালে। তাই সারাবছর নেপাল পর্যটক ও পর্বত আরোহীদের ভিড়ে ঠাসা থাকে। পৃথিবী বিখ্যাত এই সব শৃঙ্গগুলো হল- মাউন্ট এভারেস্ট (৮৮৪৮ মিটার), লোৎসে (৮৫১৬ মিটার), কাঞ্চনজঙ্ঘা (৮৫৮৬ মিটার), অন্নপূর্ণা (৮০৯১ মিটার), মাকালু (৮৪৬৩ মিটার) এবং মানাসলু (৮১৬৩ মিটার)। এই ছয় শ্রেষ্ঠ শৃঙ্গরাজি আট হাজারী ক্লাবের সদস্য। তারপর রয়েছে আরও এক সুন্দর শৃঙ্গ গৌরীশঙ্কর (৭১৩৪ মিটার)। এদের অমোঘ আকর্ষণে নেপাল পর্বত আরোহীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। তার ওপর নেপালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অতুলনীয়।
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সংস্থা (ইউনেস্কো) নেপালের ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যপূর্ণ দ্রষ্টব্যগুলোকে বিশ্ব ঐতিহ্যের শিরোপা দিয়েছে। সেই তালিকায় একে একে অনেকগুলো নাম ভেসে আসে। কাঠমান্ডুর স্বয়ম্ভুনাথ মনাস্ট্রি, বৌদ্ধনাথ মন্দির, পশুপতিনাথ মন্দির, ছাঙ্গুনারায়ণ, দরবার স্কোয়ার হনুমান ধোকা। পাটনের দরবার স্কোয়ার। ভক্তপুরের দরবার স্কোয়ার। লুম্বিনী উদ্যানের বুদ্ধদেবের জন্মস্থান। সাগরমাথা (এভারেস্ট) ন্যাশনাল পার্ক। এবং চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্ক।
নেপাল সারাবিশ্বে একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। কিন্তু এখানে বৌদ্ধ ধর্মেরও প্রভাব রয়েছে। লুম্বিনী উদ্যানে সারা পৃথিবীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষজনরা নিয়মিত আসেন।
নেপাল তিনটি অংশে বিভক্ত - হিমালয় অঞ্চল, পার্বত্য অঞ্চল ও তরাই অঞ্চল। নেপাল হিমালয়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ট্রেকিং রুট। তাই পর্বতে আরোহণ করে, নেপাল হিমালয়ের পথে পথে ট্রেক করে ঘুরে বেড়ানোর সাথে সাথে নেপালের ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যও দেখার আনন্দ ভীষণভাবে উপভোগ করা যায়। আর আছে সবুজ অরণ্য এবং গা ছমছমে অভয়ারণ্য।
আমি পর্বতআরোহী বা ট্রেকার্স হয়ে যাই নি, আমার নেপাল ভ্রমণ ছিল মুসাফিরের মত শহরে, গঞ্জে, জনপদে, পাহাড়ে, জঙ্গলে, রাজদরবারে, হ্রদের ধারে। নেপাল আমার একলা ভ্রমণ। তাই নিজের খেয়ালে সফরসূচি সাজিয়ে হাওড়া থেকে ট্রেনে রক্সৌল পৌঁছে অটোয় করে সহজেই বীরগঞ্জে চলে গেলাম। বিদেশে পা বিশেষ কোনও ঝামেলা ছাড়াই!
নেপালের ভ্রমণসূচীতে জনপ্রিয় ও অপূর্ব সুন্দর বহু জায়গা রয়েছে। আমি তাদের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে গিয়েছিলাম কাঠমান্ডু, ভক্তপুর, নাগরকোট, পোখারা, সারাংকোট, লুম্বিনী ও চিতওয়ান।
রক্সৌলে নেমে সীমান্ত পেরিয়ে বীরগন্জ থেকে শুরু হয়েছিল আমার ন'দিনের নেপাল ভ্রমণ!
চলো মন ভ্রমণে, নূপুর বাজে চরণে!..
।। কাঠমান্ডুর থামেলে দু'রাত্রি।।
বীরগঞ্জ থেকে শেয়ারের টাটাসুমোয় কাঠমান্ডু পৌঁছাতে সময় লেগেছিল প্রায় সাত ঘন্টা। পথ খুব বেশি নয়, ১৪০ কিমি। কিন্তু রাস্তা বড় করা হচ্ছে। পাহাড়, জঙ্গলকে নিকেশ করে চার লেন বানানোর দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়েছে। তাই পথে বিপত্তি অনেক। সময় মেনে পৌঁছতে পারা সম্ভব হচ্ছে না।
বীরগঞ্জ থেকে শেয়ারের টাটাসুমো ছেড়েছিল প্রায় ১১ টা নাগাদ। ভাড়া নিয়েছে নেপালী টাকায় ৮৫০। বীরগঞ্জ সীমান্তে ভারতীয় দশ হাজার টাকা দিয়ে নেপালী পনেরো হাজার আটশো টাকা পেয়েছিলাম। আপাতত এই নিয়ে চলুক। প্রয়োজন মত আবার টাকা পরিবর্তন করে নেওয়া যাবে। দুপুরে লাঞ্চের জন্য গাড়ি থামল যেখানে, সে জায়গাটার নাম সিসাপানিগোড়ি। এখানে নিরামিষ থালি খেলাম। ভাত, ডাল, শাক ভাজা, আলু ফুলকপির তরকারি, কাঁচামুলোর স্যালাড ও আচার। দাম নিল নেপালি টাকায় ২০০।
রোড সাইড ধাবার মতই এই দোকান। লাঞ্চ খেয়ে বেরতেই দুই বালককে দেখলাম হাতে থোকা থোকা রডোড্রেনডন নিয়ে বিক্রি করছে; ৫০ টাকা করে থোকা। দুজন মহিলা সহযাত্রী কিনলেন এক থোকা টাটকা লালিগুরাসের ফুল।
কাঠমান্ডু পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেল। দীর্ঘ সাত ঘন্টার সফর শেষ করে কাঠমান্ডু শহরে নেমে আবার লোকাল গাড়িতে করে চলে এলাম থামেল। কাঠমান্ডুর জনপ্রিয় জায়গা থামেল। এটা টুরিস্ট হাব বলা হয়। সারা বিশ্বের পর্যটক থামেলে এসে ভিড় করেছে। নানান মানের প্রচুর হোটেল, ক্যাসিনো, নাইট ক্লাব ও বার রয়েছে। থামেলকে নিশি শহর বলা যায়। হৈ হুল্লোড়, নাচ -গান, আর হরেক বিনোদনের জন্য থামেল খুবই জনপ্রিয়।
সারাদিনের পথশ্রমে একটু ক্লান্ত ছিলাম। কিন্তু আবহাওয়া এত সুন্দর ছিল যে থামেলের বাজারে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগছিল। দরদাম করে একটা নেপালি টুপি ২৫০ টাকা দিয়ে নিলাম। নতুন নতুন জায়গার টুপি সংগ্রহ করা আমার এক প্রিয় নেশা।
ডিনার করলাম থামেলের খুব জনপ্রিয় একটা হোটেল-THAKALI VANZHA তে । খেলাম ওদের বিখ্যাত Nepali Food থাকালি থালি- দাম নিল ৫৫০ টাকা। খুবই ভালো এবং সুস্বাদু ছিল এই আমিষ থালি। নেপালে খাওয়ার খরচ ও গাড়ি ভাড়া খুব বেশি।
প্রথম দিনের ভ্রমণ সাঙ্গ করে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় যেতেই ঘুম নেমে এলো নয়নে। একে বলে সুখনিদ্রা!
দ্বিতীয় দিন সিটি টুর শুরু হল সকাল দশটায়। পাঁচটা বিখ্যাত জায়গায় ঘোরাবে এই ট্রাভেল কার। পশুপতিনাথ মন্দির, ঘুয়েশ্বরী মন্দির, বৌদ্ধনাথ টেম্পল, স্বয়ম্ভুনাথ টেম্পল ও বুদ্ধনীলকন্ঠ টেম্পল।
দ্বিতীয় পয়েন্ট ঘুয়েশ্বরী মন্দির। এ এক প্রাচীন মন্দির। একসাথে অনেকগুলো বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে দেখলাম।
তৃতীয় দর্শনীয় জায়গায় গেলাম - বৌদ্ধনাথ টেম্পল। এও ইউনেস্কোর শিরোপা পেয়েছে। বিশাল এক সৌধস্তূপ। তার চারপাশে রঙিন ধর্মপতাকাগুলো (লুংদার) হাওয়ায় উড়ছে। বেশ সুন্দর লাগছিল দেখতে। স্তূপের চারপাশে রয়েছে মণিচক্র। এই চক্রগুলো বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্রতার প্রতীক। তাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষজনরা বৃত্তাকারে ঘুরে মণিচক্রগুলো স্পর্শ করে যায়। মন্দিরের অভ্যন্তরে রয়েছে বুদ্ধের দেহাবশেষ।
স্বয়ম্ভুনাথ টেম্পল শহর থেকে ৩ কিমি দূরের পাহাড়ি টিলার মাথায়। চূড়ায় উঠে কাঠমান্ডু, ভক্তপুর, ললিতপুরকে পাখির চোখে দেখতে পাওয়ার একটা আনন্দ আছে। আর দেখা যায় নাগার্জুন জঙ্গলকে। এই মন্দিরের স্থাপত্য খুব সুন্দর। মস্ত বড় চাতাল জুড়ে তিব্বতি হস্তশিল্প ছড়িয়ে রয়েছে। বৌদ্ধ মন্দিরের পাশে হিন্দু দেবদেবীর মন্দিরও চোখে পড়ল। ইউনেস্কোর সম্মান এই মন্দিরও পেয়েছে।
আর সবশেষে দেখলাম বুদ্ধনীলকন্ঠ টেম্পল। এখানে জলের মধ্যে শায়িত বুদ্ধদেবের একটা বড় মূর্তি।
একদিনের সিটি টুরে পাঁচটা দর্শনীয় জিনিস দেখে নেপাল ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন শেষ করলাম।
আগামীকাল ভোরে চলে যাব নাগরকোট।
।। নাগরকোটে একরাত্রি।।
আজ সকাল সকাল তৈরী হয়ে থামেলকে গুডবাই জানিয়ে চলে এলাম লোকাল গাড়িতে করে রত্নপার্ক। সামান্য পথ। এখান থেকে মিনিবাসে করে এগিয়ে চললাম নাগরকোট-এর পথে।
থামেল থেকে নাগরকোট কমবেশি ৪০ কিমি পথ। মাঝে পড়বে কমলবিনায়ক- ভক্তপুর। আজ আমি থাকব নাগরকোটে। আগামীকাল ফেরার পথে রাত্রিবাস করব প্রাচীন শহর ইতিহাসের সুগন্ধ মাখা ভক্তপুর দরবারে।
নাগরকোটে পথের ধারে বড় একটা বোর্ডে সুন্দর এই লেখাটা চোখে পড়ল - NAGARKOT IS MORE THAN SUNRISE AND SUNSET.
নাগরকোটের প্রকৃতি বড় মনোরম। নির্জনতা ওর সম্পদ। এখানে নবনির্মিত বুদ্ধমন্দিরটা অপূর্ব সুন্দর এক পাহাড় চূড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে। একবার এসে পড়লে, ফিরে যেতে মন চায় না। আরও একটা নতুন জিনিস দেখলাম-- দীর্ঘ এক ঝুলন্ত সেতু। দুই পাহাড়ের যোগসূত্র এই ইস্পাতের সেতু। ভীষণ সুন্দর করে বানানো হয়েছে এই হ্যাঙ্গিং ব্রিজ। এই সেতু দিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়ার রোমাঞ্চ আনন্দ ভুলে যাওয়ার নয়। সারাদিন দারুণ ঘুরে বেড়িয়ে সানসেট দেখে মন পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
রাতের নাগরকোট আরও এক অন্যরকমের সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয়। শান্ত পাহাড়, নিস্তব্ধ চরাচরের মধ্যে রাত্রিযাপনের যে কি আনন্দ তা নাগরকোটে এলে খুব সুন্দর অনুভব করা যায়। তাই সত্যিই শুধুমাত্র সানরাইজ - সানসেট নয়, নাগরকোট যেন আরও কিছু বেশি!
পরেরদিন ভোরে চলে গেলাম সানরাইজ পয়েন্টে। আধো অন্ধকারে ওয়াচ টাওয়ারে গিয়ে উঠলাম। একে একে অনেক বিদেশি-বিদেশিনীরাও এসে জড়ো হল ছোট্ট ওয়াচ টাওয়ারটায়। ব্রাজিলিয়ান এক সুন্দরী আমাদের কাউন্ট করে বিড় বিড় করে বলল, "নাউ উই আর থার্টিন! বাট স্পেস ইজ নট এনাফ!..."
সূর্যদেব একটু একটু করে উঁকি দিতে না দিতেই কোথা থেকে একগুচ্ছ মেঘ ভেসে এসে ঢেকে দিল চারপাশ। কাঙ্খিত সানরাইজ আর দেখা হল না। একটু বিষণ্ণ মনে ফিরে আসতে হল।
একটা দিনরাত্রির স্মৃতি নিয়ে নাগরকোট থেকে ফিরে আসার সময় মন কেমন যেন করছিল!
।। ভক্তপুরে একরাত্রি ।।
নাগরকোট থেকে ভক্তপুর কম বেশি ২০ কিমি উৎরাই পথ। একটু একটু করে নেমে আসতে হয়। গতকাল ওঠার সময় যে পথ দিয়ে উঠেছিলাম, আজ সে পথ দিয়ে নামছি না। অন্যপথে, বন্যপথে নামার এক আনন্দ আছে।
ভক্তপুর দরবার এক ঐতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন শহর। মল্লরাজাদের অপূর্ব এক কীর্তি। এর প্রাচীন নাম ছিল বাদগাঁও। ১৪০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই দরবার শহরটা ভ্রমণ এক অন্য অভিজ্ঞতা।
এই দরবার ইউনেস্কোর স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পেরেছে। এখানে প্রবেশ করতে সার্ক অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর পর্যটকদের জন্য নেপালী ৫০০ টাকার প্রবেশমূল্য লাগে।
দরবারে একবার প্রবেশ করার পর মনে হবে হঠাৎ করে যেন চেনা পৃথিবীটা থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। এ এক অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম হয় হৃদয়ে। এর চারপাশ এমন প্রাচীন ও ঐতিহ্যমন্ডিত হয়ে রয়েছে যে নিমেষের মধ্যে মন কেমন বশ মেনে যায়। দারুণ এক ভালো লাগা নিয়ে ভক্তপুর দরবার ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা।
ভক্তপুর পায়ে হেঁটে সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর মজা দারুণ ভাবে উপভোগ করেছি। শহরটা বড় অদ্ভুত। কেমন নিজের মত করে বেশ আছে। মানুষজনরাও খুব পর্যটকবান্ধব। এখানকার দই খুব বিখ্যাত। তাই তার স্বাদ নিতে ভুল করি নি।
ভক্তপুর বাজারে ঘুরে ঘুরে পটারি শিল্প ও থাংকা পেইন্টিং দেখেছি। ভক্তপুরে অসংখ্য ক্যাফে ও সুন্দর সুন্দর রেস্তোরাঁ আছে। বিদেশী পর্যটকদের খুব প্রিয় জায়গা।
সন্ধ্যার নির্জন দরবার স্কোয়ার বড় মায়াবী। চুপ করে বসে থাকলে ইতিহাস ফিস ফিস করে কথা কয়। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। নেপাল ভ্রমণে ভক্তপুর দরবার নিঃসন্দেহে এক স্মরণীয় পর্ব।
।। পোখারায় দু'রাত্রি।।
ভক্তপুর থেকে একদম ভোর রাতে বেরিয়ে স্কুটির পিছনে সওয়ারী হয়ে মুন লাইট গেস্ট হাউসের যুবক রোশন কাওয়ান আমাকে ভক্তপুর লিঙ্ক হাইওয়েতে এসে কলংকীর বাসে তুলে দিয়ে গেল। রোশনকে ধন্যবাদ জানানোর আগেই বাসটা হুড়মুড়িয়ে ছেড়ে দিল। মনে মনে রোশনকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। পথে বেরিয়ে এমন বন্ধুর মত উপকার আমার একলা ভ্রমণকে সব সময়ই মধুর করে তোলে।
কলংকী থেকে পোখারা যাওয়ার এসি সুপার ডিলাক্স বাস পেয়ে গেলাম। ভাড়া বারোশা টাকা। পথের হিসেবে প্রায় দুশো কিমি। সময়ের হিসেবে দশ ঘন্টা। কারণ সেই ফোর লেন বানানো হচ্ছে!.. এই উন্নয়ণ যজ্ঞ এখন সারা নেপাল জুড়ে চলছে। তাই পাহাড়, জঙ্গলও যথেচ্ছ অত্যাচারিত হচ্ছে। পরিবেশপ্রেমী মানুষদের এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে বড় কষ্ট হয়।
পোখারা নেপালের অন্যতম জনপ্রিয় সুন্দর জায়গা। সমতল থেকে মাত্র ৮২৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। তাই আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকে। পোখারার সেরা আকর্ষণ ফেওয়া হ্রদ। এই হ্রদের নীলচে সবুজ জলে তুষারশুভ্র হিমালয়ের ছায়া পড়ে ফেওয়া লেককে অপরুপা করে তোলে।
পোখারায় দু'রাত্রি খুবই স্মরণীয় হয়ে আছে নেপাল ভ্রমণে। পোখারার চারপাশে বহু কিছু দেখার ও উপভোগ করার আছে। আমি প্রথম দিন বিকেলে পৌঁছে সন্ধেটা শহরে ও ফেওয়া লেকের ধারে ঘুরে বেড়িয়েছি।
ফেওয়া লেকের ধারে স্থানীয় সংগীত শিল্পীরা গিটার বাজিয়ে সুন্দর নেপালী ও ইংরেজি গান গেয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। আমিও এমন দুজনের গান দাঁড়িয়ে শুনেছি। ভালো লেগেছে সেই নেপালী গানের সুর।
লেকের জলে নৌকো ভ্রমণের সুযোগ হয় নি কিন্তু লেকটাকে দেখে চোখ জুড়িয়ে নিয়েছি। আমার হোটেলের বারান্দা থেকে ফেওয়া হ্রদের অপূর্ব সৌন্দর্য বেশ রয়ে সয়ে উপভোগ করেছি।
লেকে যাওয়ার পথে সারি সারি খাবারের দোকান। এখানে সুরাপান খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই সব দোকানেই প্রকাশ্যে সুরা বিক্রি হয় এবং দলবেঁধে বসে পান করাও যায়। আর দেখলাম নানারকম মাছ মশলা মাখিয়ে ডিসপ্লে করা আছে, পছন্দ ও দাম অনুযায়ী খেতে পারা যায়।
পোখারার একটা ডে টুর আছে। সারাদিন বাসে করে কয়েকটা জনপ্রিয় জায়গায় ঘুরে আসার জন্য টিকিট নিল ৮০০ টাকা। এই ডে টুরে ঘুরে ঘুরে দেখলাম ডেভিস ফলস, মহেন্দ্র কেভ, শ্বেতী রিভার, বিন্দ্যবাসিনী মন্দির, গুপ্তেশ্বর কেভ, শান্তি স্তুপ ও টিবেটিয়ান ক্যাম্প।
দুটোদিন পোখারা শহর ও ফেওয়া হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করে চলে গেলাম আরও এক অসাধারণ জায়গা সারাংকোট।
।।সারাংকোটে একরাত্রি।।
পোখারা থেকে সারাংকোট সড়কপথে যাওয়া যায় আবার কেবল কারেও যাওয়া যায়। পথ বেশি নয়। ১৫ কিমি। আমি কেবলকারে করে গিয়েছিলাম। আসা যাওয়া এক হাজার টাকা। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
১৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছে সারাংকোট। সড়কপথে গেলে পাহাড়ি পাকদণ্ডীতে ঘুরতে ঘুরতে যেতেও বেশ মজা। ছোট ছোট গ্রামগুলোকে চোখের সামনে দেখা যায়।
আমি কেবলকারে ভাসতে ভাসতে পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছে গেলাম, সেও বেশ সুন্দর অভিজ্ঞতা। দূরের পোখারা শহর, ফেওয়া লেক, জনপদ, সারাংকোটের নীল আকাশ আর অন্নপূর্ণা হিমালয়ান রেঞ্জ দেখার আনন্দ অতুলনীয়।
কেবলকার থেকে নামতেই একজন বললেন, ছুটে যান পাশের মাঠটাতে মচ্ছপূছার ও অন্নপূর্ণা -১ জ্বলজ্বল করছে।
ছুটে নয় যেন দৌড়েই গেলাম মাঠটাতে। একটা উঁচু পাথরে দাঁড়িয়ে দেখলাম সত্যি কেমন ঝলমল করে হাসছে বিখ্যাত দুই শৃঙ্গ। অন্নপূর্ণা - ১ (৮০৯১ মিটার) ও মচ্ছপূছার( ৬৯৯৭ মিটার)। এত কাছ থেকে এই দুই বিখ্যাত শৃঙ্গ দেখার আনন্দ কোনওদিন ভুলব না।
সারাংকোট বিখ্যাত সানরাইজ ও সানসেটের জন্য। পোখারা থেকে অনেকে ভোরের প্রথম আলোয় চলে এসে সানরাইজ দেখে ঘুরে বেড়িয়ে ফিরে যান পোখারায়। কিন্তু আমি সারাংকোটে রাত্রিবাস করব। একদিন সারাদিন- একরাত আমি থাকব সারাংকোটের পাহাড়ে। এই পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অপরুপ নির্জনতা উপভোগ করার আনন্দ সারাজীবনের সেরা সঞ্চয়।
সানরাইজ পয়েন্টের পাশে না থেকে একটু দূরের হোটেলে ঘর নিলাম, আরও বেশি নির্জনতার স্বাদ নেব বলে। অপূর্ব সে এক হোটেল, ও তার বারান্দা। সারাংকোট পাহাড় ও উপত্যকাকে চোখ জুড়িয়ে দেখা যায় এই বারান্দায় বসে বসে। সানসেট দেখা যায় এই হোটেলের খোলা ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে।
সারাটা দিন আপন খেয়ালে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম। প্যারাগ্লাইডিং দেখলাম। বেলুন রাইড দেখলাম। ঝকঝকে নীল আকাশ সারাংকোটকে রুপসী করে তুলেছে।
বিকেলের নরম আলোয় ছাদে উঠে দাঁড়ালাম। সূর্যমামা দেয় হামা... সে অস্তাচলের পথে। উফ কি অসাধারণ সে দৃশ্য, দিগন্ত রক্তিম হয়ে গেল।সূর্য ডুব দিল একটু একটু করে ঝপাং!..
সন্ধ্যায় তাপমাত্রা নেমে গেল অনেক নীচে। বারান্দায় আর বেশি সময় বসে থাকা সম্ভব হল না।
সারাংকোট ভ্রমণ আমার সার্থক হয়েছে। একদিন- একরাত্রি থাকার সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম পোখারায়। এবার আমি নতুন পথে পাড়ি দেব - যাব লুম্বিনী।
।।লুম্বিনীতে একরাত্রি।।
পোখারা থেকে লুম্বিনী এক দীর্ঘ বাসযাত্রা। পথের হিসেবে ২৪০ কিমি। সময়ের হিসেবে ৮ ঘন্টা। ভাড়া ১৩০০ টাকা। রাস্তা নিদারুণ হওয়ার দরুণ লাগল প্রায় দশ ঘন্টা।
লুম্বিনী জগৎ বিখ্যাত এক পবিত্র স্থল- The Birthplace of Sakyamuni Buddha. এখানে গড়ে উঠেছে এক বৃহৎ উদ্যান - লুম্বিনী উদ্যান। ইউনেস্কো এই উদ্যানকে The World Heritage Site বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।
একদম দিনের শেষে লুম্বিনীতে পৌঁছে চটজলদি হোটেলে মালপত্র রেখে ছুটলাম লুম্বিনী উদ্যানকে দেখতে। জানলাম রাত আটটা পর্যন্ত মায়াদেবী মন্দির খোলা থাকে। এই সেই মন্দির যেখানে গৌতম বুদ্ধ জন্মলাভ করেছিলেন মাতা মায়াদেবীর কোলে। মন্দিরের পাশেই রয়েছে সেই পুষ্করিণী, যেখানে জন্মের পর সিদ্ধার্থকে প্রথম শুদ্ধিকরণ করা হয়েছিল। আর রয়েছে ঐতিহাসিক সেই অশোক পিলার। মায়াদেবী মন্দিরকে সংস্কার করে সুন্দর পরিচ্ছন্ন করে তোলা হয়েছে। রাতের আলোয় দুধসাদা এই মন্দিরকে দেখে বেশ ভালো লাগা তৈরী হয় মনে। শান্ত মনে এর চারপাশে পরিক্রমা করাও এক অপরুপ আনন্দ।
পরেরদিন ভোরে উঠে লুম্বিনী উদ্যানের বেশ কয়েকটা বুদ্ধমন্দির ঘুরে বেড়িয়ে দেখলাম। দু'ঘন্টার জন্য টোটো ভাড়া নিয়েছিল ৫০০ টাকা।
দু'ঘন্টার ছোট্ট সফরে যতটুকু সম্ভব দেখে নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। লুম্বিনী ভ্রমণ বড় মন ছুঁয়ে যায়। এমন এক ঐতিহাসিক পবিত্র ভূমিতে পা রাখার সার্থকতা আমার মুসাফির জীবনের সেরা সঞ্চয়। বড় তৃপ্তি নিয়ে আবার নতুন জায়গা - চিতওয়ান এর জঙ্গল ভ্রমণে চললাম।
।।চিতওয়ানে একরাত্রি।।
প্রথমেই বলি, চিতওয়ানে তিনরাত্রি থাকা দরকার ছিল!.. কিন্তু সফর সূচীর কারণে আমি থাকলাম একরাত্রি। তাই আশ মেটেনি চিতওয়ান জঙ্গলে এসে। আমাকে আবার আসতেই হবে চিতওয়ানে আরেকবার।
চিতওয়ান নেপালের সেরা অভয়ারণ্য। ৯৩২ বর্গ কিমি জুড়ে এই ন্যাশনাল পার্ক। চিতওয়ানের প্রধান আকর্ষণ একশৃঙ্গ গন্ডার। নেপালের এই জাতীয় অরণ্য ইউনেস্কোর দ্বারা স্বীকৃত। এর প্রাকৃতিক শোভা অপূর্ব। অরণ্যের আড়ালে রয়েছে দুটো সুন্দর নদী রাপ্তি ও নারায়ণী।
আমি লুম্বিনী থেকে বাসে নারায়ণঘাট এসে, গাড়ি বদল করে সৌরাহা টাঁড়ি চক হয়ে চিতওয়ান পৌঁছেছি। সৌরাহা- চিতওয়ান প্রথম দেখাতেই আমাকে মুগ্ধ করেছে। বেশ শান্ত, নিরিবিলি, পরিচ্ছন্ন এক বনাঞ্চল।
সন্ধ্যায় পৌঁছেই চলে গেলাম থারু ডান্স দেখতে। সৌরাহার কালচারাল কমপ্লেক্সে এই থারু আদিবাসীদের নৃত্যানুষ্ঠান হয়। মূলত কৃষিজীবী এই আদি জনগোষ্ঠীর নাচ গানেও সেই প্রভাব দেখতে পেলাম। খুবই জমজমাট এক ঘন্টার একটা অনুষ্ঠান দেখে ভালো লাগল।
অরণ্যে কিছুটা গিয়েই একটা ময়ূর দেখলাম। ছবি তোলার জন্য সে অনেকটা সময়ও দিল। চিতওয়ান জঙ্গলে খুব প্রাচীন বিশাল বিশাল গাছ চোখে পড়ল না। অনেকটা অঞ্চল আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে বর্ষায় আবার নতুন ঘাস গজাবে। হাতি খাবে। পশু পাখিরা খেলে বেড়াতে পারবে।
এই জিপ সাফারিতে ময়ূরই বেশি দেখলাম। গন্ডার,বাইসন একটা করে দেখেছি। আর দেখেছি কিছু কুমীর। জলাশয়ের পাশে চোখ বুজে রোদ পোহাচ্ছে। পাখিও আছে অনেক।
জঙ্গলে এসে আমার জীবজন্তু, পশু পাখি, বাঘ, হাতি দেখার জন্য মন খুব ছটফট করে না। আমার কাছে জঙ্গলের সান্নিধ্যটাই আসল। জঙ্গলের গন্ধ, জঙ্গলের গান, জঙ্গলের আলো, জঙ্গলের রোদ এসবই বেশি আকর্ষণ করে। তাই দুচোখ ভরে জঙ্গলকে দেখি আর বুক ভরে শ্বাস নিই জঙ্গলের, যাতে বুকের গভীরের ক্ষতচিহ্নগুলো ধুয়ে মুছে যেতে পারে। জঙ্গল সব সময় আমাকে প্রাণিত করে। উদ্দীপিত করে। চিতওয়ানের জঙ্গল ভ্রমণও আমার কাছে খুব মুগ্ধতার হয়েছে।
দুপুরে খাওয়ার পর জঙ্গলের পাশের এক সরু চিলতে নদী ঢুঙরেতে ক্যানো রাইড করলাম। সোজা কথায় ডিঙ্গি নৌকোয় জল ভ্রমণ। এটা খুব রোমাঞ্চকর ছিল। কারণ তিন তিনটে কুমীরকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি। আর জঙ্গলের শব্দ, জঙ্গলের নিস্তব্ধতা, পাখির ডাক, বাতাসের গান এসবও শোনার অভিজ্ঞতা দারুণ এই ভ্রমণে পেয়েছি।
এক সফরে দুই সাফারি করে চিতওয়ান থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল বীরগঞ্জ। মনে অতৃপ্তি নিয়ে ফিরেছি। আরও অনেক কিছু দেখার ছিল চিতওয়ানে। দেখা হল না সময়ের অভাবে। সফর সূচীর কারণে।
তাই আবার কখনো সুযোগ করে আসব চিতওয়ানে। থাকব তিনটে দিন। দেখব নতুন করে আবার সব কিছু।
নেপাল একটা ছোট্ট দেশ হলেও একসাথে সব দেখার ইচ্ছে নিয়ে আসতে হলে, সফরসূচী অন্তত পনেরো দিন করা দরকার। বড় সুন্দর, বৈচিত্র্যময় এই ছোট্ট দেশটায় ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি অমলিন থাকবে বাকী জীবন!..
এক ভ্রমণে সব দেখা হয় না সব সময়!..কিছু বাকি রয়েই যায়। সেই বাকির টানে আবার যাই, যেতে হয় ফিরে ফিরে সে সব জায়গায়।
মুসাফিরের তো পথ চলাতেই আনন্দ!..