উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র বিভা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য দাদু এবং মায়ের হাত ধরে আসে শান্তিনিকেতনে। ভর্তি হয় বিশ্বভারতীর ইকনমিক্স বিভাগে। নতুন বন্ধু, নতুন অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বভারতীর রাবীন্দ্রিক পরিবেশে ক্রমশ বদলে যায় বিভার জীবন। খুব অল্প সময়েই সে আত্মস্থ করে ফেলে বিশ্বভারতীর প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতা ও নিয়মানুবর্তিতা। পড়াশোনার পাশাপাশি গান, নাটক সব ক্ষেত্রেই বিভা তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে। সখ্যতা তৈরী হয় বাংলা বিভাগের সিনিয়র ছাত্র, ন্যাশনাল স্কলার রঞ্জনের সঙ্গে। এলোমেলো শৈশব আর বাবা-মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত রঞ্জন বিভার মধ্যে খুঁজে পায় জীবনের রামধনু রং। প্রেমের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে ওদের বিয়ে হয়। কিন্তু মধুচন্দ্রিমা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অদৃষ্ট লেখক, কোনও এক ছায়াপুরুষের অঙ্গুলীহেলনে পট পরিবর্তন হয় ভাগ্যের। প্রথম সন্তান মেঘা জন্মানোর পরই আদর্শবাদিতার কারণে চাকরি ছাড়ে রঞ্জন। এর পিছুপিছু হীনমন্যতা আর অনটন এসে জোটে সংসারে। তিনটে মানুষের দায়িত্ব নিতে অপারগ রঞ্জন সংসারের বেড়াজাল ছিঁড়ে পালিয়ে বেড়াতে চায়। অন্যদিকে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে রাস্তায় নামে বিভা। শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই, বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।
ঘাত-প্রতিঘাত নয়,সম্পর্কের টানাপোড়েন, সংসারের প্রতি স্বামীর উদাসীনতা এবং গভীর ডিপ্রেসন এসব কিছুকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র হার না মানা মানসিকতা, আর রঞ্জনের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা বিভাকে বারবার লড়াইয়ের ময়দানে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। অনুযোগ, অভিমান কখনওই সেখানে জায়গা করে নিতে পারেনি। এ লড়াইয়ে সে পাশে পায়নি কোনও কাছের মানুষকে; তবুও নিজের গন্তব্যে সে ছিল অটল। এখানেই বিভাবতী আর পাঁচটা সাধারণ গড়পড়তা মেয়ের থেকে নিজেকে অনেকটা আলাদা করতে পেরেছে। পাশাপাশি রঞ্জন তার চরিত্রগত বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট থাকা সত্ত্বেও খানিকটা ম্লান। যদিও এই চরিত্রটির অনেকগুলো স্তর আছে যা লক্ষণীয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, চরিত্রটি দ্বৈতসত্তা যুক্ত। বিভার স্বামী প্রেমিক রঞ্জন —-যে চায় তার স্ত্রী-সন্তানদের সুখে রাখতে। উল্টোদিকে একজন বাউন্ডুলে কবি এবং গায়ক —-যে ঘরছাড়া, ঠিকানাহীন। এছাড়াও ছোট ছোট দু-একটি চরিত্র মন ছুঁয়ে যায়। যেমন, শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন বিভার বন্ধুরা—--পাঞ্জাবি মেয়ে সতওয়ান্ত, নাগাল্যান্ডের ছেলে ফঙ বেনদাজল। আছে এদের সঙ্গে কিছু মজার স্মৃতি। ভাললাগে বিভার দিদি-শাশুড়ি অর্থাৎ রঞ্জনের দিদিমার খুব ছোট্ট অথচ উজ্জ্বল উপস্থিতি। একদিকে কঠোরভাবে বৈধব্য পালন, সন্ন্যাসিনীর জীবনযাপন, অন্যদিকে অসম্ভব সংসারী। জমিদারির হিসেবনিকেশ রাখতেন কড়ায়-গন্ডায়। ছিলেন শরৎচন্দ্রের সমসাময়িক লেখিকা। বিভার বিবাহ পরবর্তী জীবনে এই মানুষটিই ছিলেন মরুভূমিতে মরুদ্যান।
"বিভাবতীর ডায়েরী" গল্পের আকারে বর্ণিত হলেও এর কোনও ঘটনা ও চরিত্রই কাল্পনিক নয়। এখানে কোনও সময়কালের উল্লেখ না থাকলেও পড়তে পড়তে পাঠক সঠিক সময়কালকেই স্পর্শ করবেন। লেখিকা বলছেন, "আমরা যে সময় শান্তিনিকেতনে ছিলাম সেটা একটা স্বর্ণযুগ ছিল। একাধারে শান্তিদা (শান্তিদেব ঘোষ) মোহরদি (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) বাচ্চুদি (নীলিমা সেন) মোহনদা (মোহন সিং) মঞ্জুদি (মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়) কিংকরদা (রামকিংকর বেইজ) আরও অনেক গুণীজনেরা। যেন ঘরের মানুষ।" (পৃ-১৯) এখানে ছোট ছোট কিছু বাক্যবন্ধ মন ছুঁয়ে যায়, "বৃষ্টি স্নাত হয়ে দুজনেই চুপচাপ। এবার অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে ঠিক সাঁওতালিদের নাচের ঢঙে এঁকেবেঁকে।" (পৃ-২৬) অনেকগুলি ছোট ছোট ঘটনার সমন্বয়ে লেখিকা উপন্যাসটির কাহিনি শরীর গড়ে তুলেছেন। এরমধ্যে কিছু ঘটনা মনে হয় প্রত্যাশিত পরিণতিতে পৌঁছনোর আগেই দাঁড়ি টেনে দেওয়া হয়েছে। যথার্থ সময়ে বৃত্ত সম্পূর্ণ করলে হয়তো কাহিনির পাঠপরবর্তী অনুভূতির ষোলকলা পূর্ণ হত।
উপন্যাসটির শেষ অধ্যায়ে সময়ের নিপুণ তুলির টানে আবার জুড়ে যায় বিভা ও রঞ্জনের একসাথে চলার পথ। "পরবর্তী তিরিশটা বছর কেটেছে আনন্দেই। রঞ্জনের গান, অধ্যাপনায় স্বীকৃতি, ছাত্রদরদী গুরু, কবিতা রচনা, গুণীজনের সাহচর্য পেয়ে সফল হয়েছে জীবন। গানের জগতে আমাদের দুজনের অবাধ বিচরণ, অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর ভালবাসা পেয়েছি গুরুর আশীর্বাদে। কোনও অভিযোগ নেই, নেই কোনও আফসোস। আছে গভীর মর্মবেদনা। যা কিছু অপ্রাপ্তি ছিল, তা কানায় কানায় পূর্ণ।" (পৃ-৫৮) শব্দের আতিশয্য নয়, শুধুমাত্র সাদামাটা, সাবলীল বর্ণনায় উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি। আটান্ন পাতার একটা ছোট্ট উপন্যাস, যার মধ্যে বাঁধা হয়েছে একটা গোটা জীবন। কাজটা খুব সহজ ছিল না, যা অনায়াসেই করেছেন লেখিকা শ্রীলা বিশ্বাস। দেবাশীষ সাহার অনাড়ম্বর প্রচ্ছদ যোগ্য সঙ্গতের দাবি রাখে।