মূল উর্দু গল্পটি নেওয়া হয়েছে দিল্লির এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত ‘কুল্লিয়াত-এ-মান্টো’ (মান্টো কে আফসানে)’-র তৃতীয় খণ্ড (পৃষ্ঠা ১৫৪৫ – ১৫৫১) থেকে। —অনুবাদক
প্রথম দিকে দু-একটা ছুরি চালানোর ঘটনা। এই হতে হতেই এবার দুই পক্ষের মধ্যে পুরোদস্তুর লড়াইয়ের খবর আসতে শুরু করল। তাতে চাকু-ছুরি ছাড়াও কৃপাণ, তলোয়ার এমনকী বন্দুকও চলত। কখনও সখনও ঘরে-বাঁধা বোমা ফাটানোর খবরও মিলছিল।
অমৃতসরের প্রায় সকলেই ভেবেছিল এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দীর্ঘদিন ধরে চলবে না। আবেগে ভাঁটা পড়লে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এর আগেও অমৃতসরে এমন দাঙ্গা হয়েছে, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দশ-পনেরো দিন মারকাটারি হাঙ্গামা চলেছে, তারপরে নিজে থেকেই শান্ত হয়ে গেছে। তাই পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকে লোকে মনে করছিল এই আগুন শক্তি হারিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু তা হল না। দাঙ্গাহাঙ্গামা দিনের পর দিন বেড়েই চলল।
হিন্দুদের মহল্লায় যে মুসলমানেরা বাস করত তারা ভাগতে শুরু করল। একই ভাবে মুসলমানদের মহল্লার হিন্দুরা ঘরবাড়ি ছেড়ে আরও সুরক্ষিত বাসস্থানের খোঁজে চলল। তবে সকলেই মনে করছিল এই ব্যবস্থা সাময়িক। সেই সময়টুকুর জন্য যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিবেশ দাঙ্গার ক্লেদ আর মলিনতা থেকে আবার মুক্ত হয়ে ওঠে।
রিটায়ার্ড সাব জজ মিয়াঁ আব্দুল হাই এই ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে খুব তাড়াতাড়ি অবস্থার উন্নতি ঘটবে। তাই উদ্বেগ তাঁকে গ্রাস করেনি। তাঁর এগারো বছরের একটা ছেলে আর সতেরো বছরের মেয়ে ছিল। তাছাড়াও বছর সত্তর বয়েসের পুরোনো চাকর ছিল। ছোট পরিবার। দাঙ্গা শুরু হলে মিয়াঁ সাহেব পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে অনেক রেশন ঘরে এনে জমা করলেন। এতে তিনি একদম নিশ্চিত হলেন যে যদি পরিস্থিতির একটু বেশি অবনতিও হয়, দোকানপাট ইত্যাদি বন্ধও হয়ে যায়, খানাপিনার জিনিসপত্র নিয়ে তাঁর কোনও চিন্তা থাকবে না। কিন্তু তাঁর জোয়ান লেড়কি সুঘরার খুব দুশ্চিন্তা ছিল। তাদের বাড়িটা তিনতলা। অন্য সব বাড়ির তুলনায় বেশ খানিকটা উঁচু। ওপরের গম্বুজ থেকে শহরের চার ভাগের তিন ভাগই খুব স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যেত। সুঘরা বেশ কয়েক দিন ধরেই দেখছিল যে কাছে অথবা দূরে – কোথাও না কোথাও আগুন লেগেই রয়েছে।
শুরুতে তো ফায়ার ব্রিগেডের টং-টং আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন সেও বন্ধ হয়ে গেছে, হয়ত এই কারণে যে একসঙ্গে অনেক জায়গায় আগুন লাগানো হচ্ছে।
রাতের ছবিটা আরও কিছুটা অন্যরকম। গাঢ় অন্ধকারে আগুনের লেলিহান শিখা এমনভাবে উঠত যেন দেবতার মুখ থেকে বেরোচ্ছে আগুনের ফোয়ারা। তা ছাড়াও অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যেত যা ‘হর হর মহাদেব’ আর ‘আল্লাহু আকবরের’ সঙ্গে মিশে ভয়ঙ্কর ত্রাসের সঞ্চার করত।
সুঘরা বাপের কাছে তার ভয়ভীতি আর আশঙ্কার কথা বলত না। বোধহয় এই জন্য যে তিনি আগেই বলে রেখেছিলেন ভয়ের কোনও কারণ নেই – সব ঠিক হয়ে যাবে। মিয়াঁ সাহেবের কথা যেহেতু প্রায়ই সত্য প্রমাণিত হত, তাই সুঘরা কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ চলে গেলে, কলে জল আসাও বন্ধ হয়ে গেলে সে মিয়াঁ সাহেবের কাছে তার উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেলল, দ্বিধাগ্রস্তভাবে এই প্রস্তাবও দিল যে কিছুদিনের জন্য শরিফপুরে চলে যাওয়া যাক যেখানে আশপাশের সব মুসলমানই ধীরে ধীরে পালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মিয়াঁ সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন: ‘বেকার ঘাবড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। পরিস্থিতি খুব তাড়াতাড়ি শান্ত হয়ে যাবে।’
অথচ অবস্থার উন্নতি তো হলই না, বরং দিনকে দিন আরও বিগড়ে যেতে লাগল। যে মহল্লায় মিয়াঁ আব্দুল হাইয়ের বাড়ি সে পাড়ার সব মুসলমান ভেগে পড়ল। আর খোদার দয়া এমনই যে হঠাৎই একদিন মিয়াঁ সাহেব পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বিছানা নিলেন। মিয়াঁর বেটা বশারত আগে একলাই বাড়ির মধ্যে ওপরে বা নিচে বিভিন্ন ধরনের খেলায় মজে সময় কাটাত। কিন্তু সেও এখন বাপের চারপাইয়ের পাশ ছেড়ে আর ওঠেই না, বরং পরিস্থিতি কতটা সংকটজনক তা বোঝার চেষ্টা করে।
তাদের বাড়ির লাগোয়া বাজারটা শুনশান হয়ে গেল। ডাক্তার গুলাম মুস্তাফার ডিসপেনসারি তো বেশ কিছুদিন ধরেই বন্ধ ছিল। সুঘরা বারান্দা থেকে দেখল একটু দূরে ডাক্তার গোরান্দের চেম্বারেও তালা ঝুলছে। মিয়াঁ সাহেবের অবস্থা খুবই সংকটজনক। সুঘরার দুশ্চিন্তা এতটাই যে তার মাথা যেন আর কাজ করছে না। বশারতকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে পীড়াপীড়ি করল, ‘খোদার দিব্যি, তুই কিছু কর। আমি জানি বাইরে বেরোলে বিপদের ভয় আছে, তবু তুই যা – যাকে পারিস ডেকে নিয়ে আয়। আব্বাজির শরীর খুব খারাপ।
বশারত বেরোলো বটে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। মুখটা ভীষণ ফ্যাকাশে। চকে রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকা একটা লাশ সে দেখেছে। আর পাশেই একদল মুখোশ-বাঁধা লোক দোকানে লুটপাট চালাচ্ছে। ভয়ার্ত ভাইটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সুঘরা চেষ্টা করে চলল আরও ধৈর্য ধরার। কিন্তু বাপের দিকে তো আর তাকানো যায় না। মিয়াঁ সাহেবের শরীরের ডানদিকটা পক্ষাঘাতে পঙ্গু – যেন কোনও প্রাণই নেই। কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে – অধিকাংশ সময় ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করেন। সুঘরাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন যে ঘাবড়ানোর কোনও কারণ নেই। খোদার কৃপায় সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু কিছুই ঠিক হল না। রোজা শেষ হয়ে আসছিল। ইদের আর দুদিন বাকি। মিয়াঁ সাহেবের আশা ছিল ইদের আগেই পরিবেশ একদম শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে হয়ত ইদের দিনটাই দুনিয়ার শেষ দিন হবে। গম্বুজের ওপরে উঠলে চোখে পড়ছিল শহরের সব প্রান্ত থেকেই গাঢ় ধোঁয়া উঠছে। রাতে বোমা ফাটার এমন ভয়ঙ্কর সব আওয়াজ শোনা যাচ্ছে যে সুঘরা আর বশারত এক পলক চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে পারছে না। সুঘরাকে তো এমনিই বাবার শুশ্রূষার জন্য জেগে থাকতে হচ্ছিল – কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিস্ফোরণগুলো তার মাথার মধ্যেই হচ্ছে। একবার সে তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাপের দিকে তাকায়, পরক্ষণেই আতঙ্কে দিশেহারা ভাইয়ের দিকে। এছাড়া ছিল সত্তর বছরের বুড়ো চাকর আকবর – যার থাকা না থাকা সমান। সে সারা দিন সারা রাত নিজের কুঠুরিতে বসে কাশে, গলা খাঁকারি দেয়, আর থোকা থোকা কফ ফেলে। একদিন আর থাকতে না পেরে সুঘরা তাকে চিৎকার করে বলল, ‘তুমি আছ কী করতে? দেখছ না, মিয়াঁ সাহেবের অবস্থা কেমন? আসলে তুমি হলে এক নম্বরের নিমকহারাম। এখন যখন তাঁর সেবা করার সময়, তখন তুমি হাঁপানির বায়না তুলে এখানে পড়ে থাকছ! সে আরেক যুগ ছিল যখন চাকর-বাকরেরা মনিবের জন্য তাদের জান কুরবানি দিতেও তৈরি থাকত।’
সুঘরা ঝাল ঝেড়ে মনটাকে হালকা করে চলে গেলেও পরে ওই গরিব লোকটাকে শাপ-শাপান্ত করার জন্য তার আফশোস হল। রাতের খাবার থালায় নিয়ে কুঠুরিতে গিয়ে দেখল ঘর খালি। বশারত বাড়ির অন্যত্র খোঁজাখুঁজি করলেও আকবরের কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। বাইরের দরজার খিল খোলা দেখে মনে হল সে হয়ত মিয়াঁ সাহেবের জন্য কিছু করতে গেছে। সে যেন কিছু করতে পারে এই আশায় সুঘরা অনেক প্রার্থনা করল – খোদা যেন ওর উদ্দেশ্য সফল করেন। কিন্তু দুদিন পরেও সে ফিরল না।
সন্ধের সময় সেটা। সুঘরা আর বশারত ইদের আগে এমন অনেক সন্ধ্যা দেখেছে যখন চারপাশে হুলস্থুল পড়ে যায়। তাদের নজরও আকাশের দিকে থাকে, না জানি কখন ইদের চাঁদ ওঠে।
পরদিনই ইদ। শুধু চাঁদ ওঠা দেখে ইদের ঘোষণা হওয়া বাকি। এই ঘোষণার জন্য তারা দুই ভাই-বোন কী ব্যাকুলতা নিয়েই না অপেক্ষা করত! আকাশের যেখানে চাঁদ ওঠে সে জায়গাটা যদি কখনও এক টুকরো নাছোড়বান্দা মেঘ ভেসে এসে ঢেকে দিত, তা হলে তারা কী দুঃখই না পেত। আর এখন সেখানে চারদিকে ধোঁয়ার মেঘ। সুঘরা-বশারত গম্বুজের ওপর চড়ল। দূরে কোথাও কোথাও বাড়ির ছাদের ওপর মানুষজনের অস্পষ্ট ছায়া দেখা যাচ্ছে। তবে বোঝা যাচ্ছে না যে তারা চাঁদ দেখতে ছাদে উঠেছে নাকি এখানে ওখানে লেলিহান আগুনের শিখার ওপর নজর রাখছে!
চাঁদটাও এত একরোখা যে ধোঁয়ার চাদরের মধ্যে দিয়েও তাকে দেখা যাচ্ছে। সুঘরা হাত তুলে দোয়া জানাল। খোদার যেন দয়া হয়, তার বাপ যেন সুস্থ হয়ে ওঠে। বশারতের মনে খুব দুঃখ – এই সব গোলমালে সুন্দর একটা ইদের পরব নষ্ট হয়ে গেল।
সূর্য তখনও পুরো অস্ত যায়নি। সন্ধের অন্ধকারও গাঢ় হয়নি। মিয়াঁ সাহেবের চারপাইটা জল ছেটানো উঠোনে পাতা হয়েছে। তিনি তার ওপরে স্থির হয়ে শুয়ে দূর আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। কে জানে কী ভাবছেন! ইদের চাঁদ দেখে সুঘরা তাঁর পাশে এসে সেলাম জানালে তিনি ইশারায় জবাব দিলেন। সুঘরা মাথা নিচু করলে সুস্থ হাতটা তুলে পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বোলালেন। সুঘরার চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ল, মিয়াঁ সাহেবের চোখও ছলছল করছে। কিন্তু তিনি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য অতি কষ্টে পক্ষাঘাতগ্রস্ত জিভটাকে নাড়িয়ে বললেন, ‘পরম করুণাময় আল্লাহ্ সব ঠিক করে দেবেন।'
ঠিক সেই সময় বাইরের দরজায় শব্দ হল। সুঘরার বুকটা ধক করে উঠল। সে বশারতের দিকে চাইল। ভাইয়ের মুখ তখন কাগজের মত সাদা!
দরজায় আবার কড়া নাড়ার আওয়াজ। মিয়াঁ সাহেব সুঘরাকে বললেন, ‘দেখো কে এসেছে!'
সুঘরা ভাবল হয়ত বুড়ো আকবর হবে। তার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বশারতের বাহুটা ধরে সে বলল, ‘যা দেখ – হয়ত আকবর এসেছে।'
শুনে মিয়াঁ সাহেব এমনভাবে মাথা নাড়লেন যেন বলতে চাইছেন: ‘না – এটা আকবর নয়।’
‘তা হলে আর কে হতে পারে, আব্বাজি?’ সুঘরা শুধোয়।
মিয়াঁ আব্দুল হাই শক্তিতে ভর দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় বশারত ফিরে এল। দেখা গেল সে ভীষণ ভয় পেয়েছে আর হাঁপাচ্ছে। সুঘরাকে মিয়াঁ সাহেবের চারপাইয়ের পাশ থেকে টেনে সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘একজন শিখ এসেছে।’
সুঘরা চেঁচিয়ে উঠল, ‘শিখ? ….কী বলছে?’
‘বলছে দরজা খোলো।’
সুঘরা কাঁপতে কাঁপতে বশারতকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরল। বাপের চারপাইয়ের ওপর বসে আব্বার মুখের দিকে ক্লান্ত চোখে চেয়ে রইল।
মিয়াঁ আব্দুল হাইয়ের পাতলা পাতলা নিস্তেজ ঠোঁটে অদ্ভুত হাসির আভাস ফুটে উঠল ‘যাও....গুরমুখ সিং এসেছে।’
বশারত মাথা নাড়িয়ে জানাল, ‘অন্য কেউ মনে হচ্ছে!’
কিন্তু মিয়াঁ সাহেব নিশ্চিত। বললেন, ‘যাও সুঘরা, উনিই এসেছেন।’
সুঘরা উঠে দাঁড়াল। সে গুরমুখ সিংকে চিনত। অবসর নেওয়ার আগে তার বাপ ওই নামের এক শিখের কোনও কাজ করে দিয়েছিলেন। ঘটনাটা সুঘরার তেমন ভালো মনে নেই। বোধহয় কোনও ছোটখাটো মামলা থেকে তাকে বাঁচিয়েছিলেন। তখন থেকে সেই ব্যক্তি ছোট ইদের আগে এক থলি রুমালি সেমুই নিয়ে আসতেন। সুঘরার আব্বা বেশ কয়েকবারই তাঁকে বলেছিলেন, ‘সর্দারজি, আপনি এই কষ্ট করবেন না।’ কিন্তু সেই শিখ হাত জোড় করে জবাব দিত, ‘মিয়াঁ সাহেব, ওয়াহে গুরুজির কৃপায় আপনার সবই আছে। এটা তো সামান্য একটু উপহার যা আমি জনাবের জন্য প্রতি বছর নিয়ে আসি। আপনি আমার যে উপকার করেছিলেন সে ঋণ তো আমার পরের শত প্রজন্মও শোধ করতে পারবে না... খোদা আপনাকে খুশি রাখুন!’
ইদের একদিন আগে সর্দার গুরুমুখ সিংয়ের এক থলি সেমুই নিয়ে আসা এতকাল ধরে চলেছে যে সুঘরা আশ্চর্য হল ভেবে কেন দরজা ধাক্কার আওয়াজ শুনে তার সেই শিখ মানুষটির কথা মনে পড়ল না! কিন্তু বশারতও তো তাঁকে অসংখ্য বার দেখেছে – তা হলে সে কেন বলল অন্য কেউ এসেছে? আর কেই বা হতে পারে? এই ভাবতে ভাবতে সুঘরা দেউড়ি পর্যন্ত এল। দরজা খুলবে না ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করবে এই যখন ভাবছে তখন আরও জোরে কেউ কড়া নাড়ল। সুঘরার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠল। অনেক কষ্টে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল, ‘কে?'
বশারত পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে দরজার ফাটলের দিকে ইশারা করে বলল, ‘ওর মধ্যে দিয়ে দেখো!' সুঘরা সেই চিড়ের মধ্যে চোখ ঠেকাল। গুরমুখ সিং এ নয়, উনি তো খুব বুড়ো মানুষ। বাইরে সিঁড়ির ধাপে যে দাঁড়িয়ে আছে সে যুবক। সুঘরা তখনও ছিদ্রপথে চোখ ঠেকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কে এসেছে। আবার খটখট আওয়াজ। সুঘরা দেখল আগন্তুকের হাতে কাগজের থলি – ঠিক তেমনই যেমনটা গুরুমুখ সিং নিয়ে আসতেন। সুঘরা দরজা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে জোর গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে?'
বাইরে থেকে আওয়াজ এল, ‘জি... জি ম্যাঁয়... আমি সর্দার গুরুমুখ সিংয়ের বেটা – সন্তোখ!' সুঘরার ভয় অনেকটা দূর হল। সে অত্যন্ত ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘বলুন, আপনি আজ কীভাবে এলেন?'
‘জি...জজ সাহেব কোথায়?'
‘উনি অসুস্থ।'
সর্দার সন্তোখ সিং আফশোসের সুরে বলল, ‘ওহ্...' তারপরে কাগজের থলেটা খড় খড় করে নাড়িয়ে বলল, ‘এতে সেমুই আছে...সর্দারজির দেহান্ত হয়ে গেছে...উনি মারা গেছেন!'
সুঘরা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘মরে গেছেন?'
বাইরে থেকে আওয়াজ এল, ‘জি হাঁ...এক মাস হয়ে গেল...মরার আগে উনি আমাকে বলে গিয়েছিলেন...দেখো বেটা, আমি জজ সাহেবের জন্য প্রতি বছর ছোট ইদের সময় সেমুই নিয়ে গেছি – আমি মরে গেলে এই কাজটা তোমাকে করতে হবে। আমি তাঁকে কথা দিয়েছিলাম – যা রাখার জন্য এখন এসেছি। ...সেমুইটা নিয়ে নিন।'
কথাগুলো সুঘরার এমনই মন ছুঁয়ে গেল যে তার চোখে জল এল। সে দরজাটা একটু খুলল। সর্দার গুরমুখ সিংয়ের ছেলে সেমুইয়ের থলেটা এগিয়ে দিল। সুঘরা সেটা ধরে বলল, ‘খোদার কৃপায় সর্দারজির যেন স্বর্গলাভ হয়।'
গুরুমুখ সিংয়ের ছেলে একটু থেমে বলল, ‘জজ সাহেব অসুস্থ?'
সুঘরা জবাব দিল, ‘জি হাঁ!'
‘অসুখটা কী?'
‘পক্ষাঘাত।'
‘ওহ্...সর্দারজি বেঁচে থাকলে এটা শুনে খুব দুঃখ পেতেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জজ সাহেবের উপকারের কথা তাঁর মনে ছিল। বলতেন, উনি মানুষ নন – দেবতা! আল্লাহ্ মিয়াঁ যেন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখেন। ওঁকে আমার সেলাম জানাবেন!’
এই বলে যুবক সিঁড়ির ধাপ থেকে নেমে দাঁড়াল।
জজ সাহেবকে ডাক্তার দেখানোর বন্দোবস্ত করতে তাকে বলবে কি না সুঘরা এই ভাবতে ভাবতেই সন্তোখ সিং চলে গেল।
সর্দার গুরমুখ সিংয়ের বেটা সিঁড়ির ধাপ থেকে নেমে কয়েক পা মাত্র এগোতেই মুখোশ বাঁধা চারজন তার সামনে এসে দাঁড়াল। দুজনের হাতে জ্বলন্ত মশাল, অন্য দুজনের হাতে কেরোসিন তেলের ক্যানেস্তারা আর কিছু সহজদাহ্য জিনিস। তাদের মধ্যে একজন সন্তোখকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী সর্দারজি, আপনার কাজ হল?’
সন্তোখ মাথা হেলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হয়ে গেল।’
সে লোকটি মুখোশের মধ্যে থেকে হাসতে হাসতে বলল, ‘তা হলে এবার জজ সাহেবের মামলা ঠাণ্ডা করে দিই?’
‘হ্যাঁ, যেমন তোমাদের মর্জি!’
এই বলে সর্দার গুরমুখ সিংয়ের পুত্র সেখান থেকে সরে পড়ল।
(মূল গল্পের প্রকাশকাল: ১৫ অক্টোবর ১৯৫১)