দুই মেয়েরই বিয়ে হয়েছে কাছে, তারা প্রায়ই আসে। পাড়ার দোকান থেকে আনা হয় সিঙ্গারা আর সন্দেশ। জামাইদের স্টীলের গেলাশে জল দিতে ভালো লাগে না। তাছাড়া এ ফ্ল্যাট ও ফ্ল্যাট থেকে যাওয়া-আসা তো লেগেই থাকে। তাই কটা কাচের গেলাশ না কিনলে চলছিল না। পিচ-বোর্ডের বাক্সতেই ছটা গেলাশ বেশ সুরক্ষিত অবস্থায় থাকত কাচের পাল্লা দেওয়া শো-কেসটায়। দরকার মতো বার করা হতো।
ছটা কিন্তু বেশিদিন রইল না। একদিন সকালে বাসন ধোয়ার মেয়েটির হাত ফসকে প্রথমটা গেল। গিন্নিমা শব্দ পেয়েই ছুটে এলেন। ঝি বলল, “সাবানের হাত, পিছলে গেল, কী করব! এদিকে এসো না, কাচ সরাই আগে--”
“সাবধানে কাজ করতে পারিস না! এই সেদিন কিনলাম আর এরই মধ্যে ভাঙ্গলি।”
***
শনিবার সন্ধেবেলা। দুই জামাই আসাতে জমজমাট আড্ডা চলছে। তখন জয় প্রকাশ নারায়ণ খবরের কাগজের প্রথম পাতায় রোজ থাকতেন। কিন্তু তাঁর আন্দোলন কি গান্ধিজির কুইট-ইন্ডিয়ার মতো সফল হচ্ছে? হাত নেড়ে জোর তর্ক। ইংরেজ সেই কবে চলে গেছে – তাই কুইট-ইন্ডিয়া আন্দোলনের হাতের ঝাপটা এসে লাগল একটা জলভরা গেলাশে। ফটাস করে মেঝেতে পড়ে সে তৎক্ষণাৎ বীরগতি পেয়ে গেল। ‘এ হে, কেউ ওদিকটা যেও না’ ‘আরে তুমি চটি না পরে ঝাঁট দিতে যাবে না’ ‘আরে থাক থাক, তোমাকে হাত লাগাতে হবে না, কাচের গেলাশ কতদিন আর টেকে’ – গেলাশটির সৎকার না হওয়া অবধি তর্কসভা মুলতুবি রইল।
***
আজ নাতিবাবু এসেছে। সাড়ে তিন, কথার আড় ভাঙ্গেনি কিন্তু অসম্ভব দুরন্ত। এসেই ‘ঘোষণা’ করল “দল থাব।” স্টীলের গেলাশে জল দেওয়া হলো, তা সে সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলল তাকে কাচের গেলাশে দিতে হবে। দেওয়া হলো তবে তার মা গেলাশটা ধরে রইল। সে বলল “না না নিজে নিজে দল থাব।”
এই টানাটানিতে নাতিবাবুর কচি হাতের ফাঁক দিয়ে মেঝেতে সটান অবতরণ করল তিন নম্বর গেলাশটি। বলাই বাহুল্য পলকেই স্বর্গবাসী।
***
দিন যায়, বয়স বাড়ে। লোকের টিভি সিরিয়ালের নেশা এত বেড়েছে যে বাড়ি বাড়ি আসা যাওয়া কমে গেছে। কর্তাবাবু আজকাল সকালে এক গেলাশ হরলিক্স খান। সেদিন রান্নার মেয়েটি দু-চামচ হরলিক্স গুঁড়োর ওপর ফুটন্ত জল ঢালতেই গেলাশে একটা লম্বালম্বি চিড় পড়ল। চতুর্থ জনের নিঃশব্দ প্রয়াণ।
গেলাশ গেছে তার জন্য ঠিক নয়, ব্যাপারটা কেমন যেন ভালো ঠেকল না। এর মধ্যে কি কোনো সংকেত ছিল? অশনি সংকেত? কাচের গেলাশ যে এভাবে ফেটে যেতে পারে তা কোনো নতুন কথা নয়। বয়স হয়েছে তো তাই বোধ হয় অশুভ মনে এসে ভীড় করে।
এর কয়েকটা দিন পরের একটি সকাল। শ্রাবণ হলেও বাইরে আকাশে তেমন ঘন মেঘ নেই। বাড়ির ঝি এসেছে ঠিক সময়। দুধ আর খবরের কাগজও এসেছে যেমন রোজ আসে। এহেন স্বাভাবিক একটি সকালে কর্তাবাবু ঢলে পড়লেন বিনা নোটিশে। ডাক্তার! ডাক্তার!! ডাক্তারবাবুকে পাওয়া গেল। একটু পরীক্ষা করলেন। তারপর নীরবে ব্যাগ থেকে প্যাড বার করে ওষুধের বদলে লিখলেন মৃত্যু-সারটিফিকেট।
***
বাড়িতে থাকেন শুধু গিন্নিমা। এক একবার ভাবেন চৈত্রমাস আসছে, কাউকে বলবেন কি ছটা গেলাশ কিনে আনতে। তারপর ভাবেন, আর কীই বা হবে। ওই দুটোতেই কাজ চলে যাবে। বাড়িতে আর কেই বা আসে।
দুটোও অবশ্য আর রইল না। ওনারই হাত পিছলে গেলাশ ঠোক্কর খেল রান্নাঘরের সিঙ্কের কলে। পুরো ভাঙ্গেনি, কিন্তু ওপরের কিনারা থেকে একটা অর্ধচন্দ্রের মতো টুকরো আলাদা হয়ে গেল। ব্যবহার করা সম্ভব নয়, আবার ফেলে দিতেও মায়া লাগে। ওর জায়গা হলো রান্না ঘরের কোণে। ওর ভেতরে খাড়া করে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো পুরোনো দাঁত মাজার ব্রাশ একটা। ওটা দিয়ে বেসিনের কোনাগুলো পরিষ্কার করা হয় মাঝেসাঝে। অবসর-প্রাপ্ত ব্রাশটি ধরে রাখা ছাড়া অথর্ব গেলাশটির আর কিছু করার সামর্থ নেই, স্থানও হয়েছে সংসারের অপরিছন্ন কোণে। তবে অর্ধচন্দ্রাকার ভাঙ্গনটা এমন ভাবে হয়েছে যে দেখে মনে হয় সে হাসছে! অনেকটা মোবাইল ফোনের ইমোজি বুড়োর মতো। এ ধরনের মানুষও সংসারে দুটো-একটা দেখা যায়, কোনো অবস্থাই যাদের মুখের হাসিটুকু মুছে ফেলতে পারে না।
***
এক এক করে কত ক্যালেণ্ডার দেওয়ালে ঝোলানো হলো – তারা মাস-দুমাসে নতুন নতুন ছবিটবি দেখিয়ে একদিন-না-একদিন পুরোনো হয়ে বিদায় নিয়েছে। ছবিওয়ালা ক্যালেণ্ডার আজকাল আর বড় একটা পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যায় তাতে শুধু কালো কালো তারিখের সারি।
সেভাবেও অনেক মাস চলে গেল, ক্যালেণ্ডারের দরকারও শেষ হলো একদিন।
***
ছেলের বাস কিছু দূরের একটা শহরে। নমাসে ছমাসে কোলকাতায় কাজ পড়লে এই বাড়িতেই এসে ওঠে। চাবি তার কাছে থাকে।
ব্যাঙ্ক আর কীসবের গোটা কয়েক কাজ নিয়ে গতমাসে সে একবার এসেছিল। দিন তিনেকের জন্য। তালা খুলে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালায়। বাড়িতে তো আর কেউ থাকে না, শুধু দেয়ালে কতগুলো ছবি টাঙ্গানো।
কাজ যা ছিল তা তিন দিনে শেষ হলো না – কাজ আর কার শেষ হয়, বাকি কিছু রয়েই যায়। আর দু-একটা দিন পেলে হতো, তবে আগে থেকে টিকিট কাটা আছে বলে এবার আর থাকা যাবে না। বিকেলের ট্রেনে ফেরা। এই সময়টায় কোলকাতার রাস্তায় প্রায়ই যানজট লেগে থাকে তাই কম করে ঘন্টা দেড়েক সময় হাতে নিয়ে বেরোতে হয়। মোবাইলে অ্যাপ-ট্যাক্সি ডাকবে এমন সময় চোখে পড়ল পুরোনো শো-কেসটার ভেতরের দিকে ছটা গেলাশের একটা এখনো রয়েছে।
ফোন রেখে শো-কেস খুলে সাবধানে গেলাশটা বার করল সে। ধুলো পড়ে গেছে। সাবান দিয়ে একটু ধুলে হতো, কিন্তু ভয় করল যদি পিছলে যায়। একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে পুঁছে দিল।
গেলাশটা দু-এক পল হাতে ধরে রাখতে মনে হলো অনাদরে পড়ে থাকা এই সামান্য জিনিসটা যেন আশ্চর্য এক টাইম-মেশিন।
গেলাশের কাচে অনেকগুলো অতিক্রান্ত বছরের অনেক চেনা মানুষের মুখচ্ছবি যেন মিছিলের মতো সরে সরে যাচ্ছে। গেলাশটা যত্ন করে তুলে রাখতে রাখতে সে মনে মনে বলল – তুইই এ বাড়ির সব কিছু ধরে রেখেছিস রে এখনো, থাক যতদিন পারিস থাক।