• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৪ | এপ্রিল ২০২৪ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • ‘ঢেউ-এ সাঁতরে আসা অভিজ্ঞতার ফসল’: দেবদাস আচার্যের ধন্য হে দেবদাস : অলোক সরকার

    ধন্য হে দেবদাস — দেবদাস আচার্য; প্রচ্ছদ- রাজীব চক্রবর্তী; প্রকাশক- অবভাস, কলকাতা; প্রথম প্রকাশ- ডিসেম্বর ২০২০; ISBN: 978-93-80732-52-7

    সম্প্রতি একটি আশ্চর্য গ্রন্থ হাতে এসেছে। কবি দেবদাস আচার্যের ‘ধন্য হে দেবদাস’। নিজের জীবনকে ছোটো ছোটো অধ্যায়ে বিভক্ত করে টুকরো টুকরো দৃশ্য, ঘটনা বর্ণনার মধ্যে দিয়ে ফেলে আসা সময়ের পাতাগুলো ফিরে দেখেছেন কবি। সেই সঙ্গে ছুঁয়ে এসেছেন তাঁর পারিপার্শ্ব ও সমসময়কে। কবির জন্ম ১৯৪১ সালের আগস্টে। সময়টা ভারতবর্ষের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময় থেকে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের যে সমস্ত পালাবদল ঘটে চলেছে তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। কেবল প্রত্যক্ষ নয়, বলা ভালো, সেই সময়ের অভিঘাত আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাঁকে। তিনি যেমন সাক্ষী ছিলেন স্বাধীনতাকামী মানুষের আপোষহীন সংগ্রামের তেমনই দেখেছেন পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ। দীর্ঘ সংগ্রামে দেশ স্বাধীন হলেও ভেঙে গিয়েছিল তিন খণ্ডের দুটি দেশে। সেই ভাগ এবং তার প্রভাব সহজ ছিল না। সেই অস্থির জীবন, গল্প-কবিতার মতো প্রবহমান রোমান্টিক নিরানন্দ নিয়ে আসেনি। সময়ের ক্যানভাসে জলরং-এ আঁকা ঠাঁইহারা, দেশহারা এ জীবন বড় রূক্ষ, অনিশ্চিত। এই অস্থিরতা, এই বিপন্নতা কেবল দেশভাগ ও দেশহারা মানুষের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল না। চারিয়ে গিয়েছিল এপার বাংলার সাবেকী ভূমিপুত্রদের জীবনেও। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও ভারত, পশ্চিমবঙ্গ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কারণে উত্তাল হয়ে উঠেছে। পূর্ব পাকিস্তানেও তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সীমানা ছাড়িয়ে তারও ঢেউ আছড়ে পড়েছে এপার বাংলায়। মিটিং মিছিল আন্দোলনে উত্তাল সেই সময়ের দিকে ফিরে তাকালে আজও আমরা ভীত, সন্ত্রস্ত হই।

    অসংখ্য উদ্বাস্তুর মিছিলে কবি দেবদাস আচার্যও ছিলেন সময়ের ফসল হয়ে। কবি সেসব দেখছেন, উপলব্ধি করেছেন। এই লেখার ভেতর দিয়ে তিনি তাঁর সেই ছেড়ে আসা শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে চেয়েছেন।

    ‘অবভাস’ প্রকাশনীর উদ্যোগে প্রকাশিত 'ধন্য হে দেবদাস’ গ্রন্থটি একটি অখণ্ড সংস্করণ। এই সংস্করণের আগে কবি দেবদাস আচার্যের জীবনালেখ্য প্রকাশিত হয় চারটি ভিন্ন ভিন্ন নামে। কবি মণীন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত পরমা পত্রিকার ১৯৭৮ সালের বর্ষা সংখ্যায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় কবি জীবনীর প্রথমপর্ব ‘দেবদাসের জীবন-প্রভাত’। পরের পর্বগুলি প্রকাশ পায় অমর দে সম্পাদিত গল্পসরণি পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায়। ১৯৯৬-এর চৈত্র সংখ্যায় 'সকালের আলোছায়া'। দশম সংখ্যা শরৎ ১৪১২ বঙ্গাব্দে 'কহে দেবদাস' এবং সর্বশেষ পর্ব ধন্য হে দেবদাস প্রকাশিত হয় দ্বাদশ সংখ্যায়, ১৪১৪ বঙ্গাব্দে। ১৪১৪ বঙ্গাব্দ খ্রিস্টাব্দের হিসেবে ২০০৭ সাল। অর্থাৎ ১৯৯৬ সাল থেকে নিজের বিগত জীবনের যে ফেলে আসা স্মৃতির অন্বেষণে যাত্রা শুরু করেছিলেন দেবদাস তা এসে থেমেছে ২০০৭-এ। এই দীর্ঘ ১১ বছর ধরে কবি যেন বারবার নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন। হাতড়ে ফিরেছেন ফেলে আসা দিনগুলো। হৃদয়ের জানলা দিয়ে ফিরে গেছেন তার ‘সকালবেলার আলোছায়ায়’— যে আলো তীব্র নয়, যে আলো তীক্ষ্ণ নয়। যে আলোর ভেতর সম্ভাবনার উদ্ভাস, যে আলোর ভেতর সূচিত হয় নতুন দিনের যাত্রা । যে আলোছায়ার রহস্যের ভেতর লুকিয়ে থাকে ভাবী জীবনের ইশারা। সেই আলোর ছায়ায় ফিরে গিয়ে লেখক ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছেন কোমল শৈশব, দামাল কৈশোর, যৌবনের উত্তেজনা এবং প্রৌঢ় বয়েসের ক্ষয়িষ্ণু পায়ের ছাপ। চার খণ্ডে তিনি ধরে রেখেছেন কবিজীবনের ছ-বছর থেকে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত। বাংলা সাহিত্যের আত্মকথা কিংবা আত্মজীবনীর ধারায় সচরাচার লেখকেরা এত দীর্ঘজীবনের কথা বলেন না। শৈশব, কৈশোর কিংবা যৌবনের কিছু পর্বের ছবি এঁকেই ইতি টানেন। তাই আত্মকথক দেবদাসের এই প্রয়াস ব্যতিক্রম।

    ২২৭ পাতার সমগ্র গ্রন্থে ধরা আছে কবির সময়-সমুদ্রের 'ঢেউ-এ সাঁতরে আসা অভিজ্ঞতার ফসল'। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, যে সময় এই গ্রন্থ ধারণ করে আছে তা ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী একজন মানুষ তার নিজের জীবনের ঘটনা বলে গেলেও অদৃশ্য থেকে সমসময়ই হয়ে উঠবে আসল ধারক — কবি সচেতনভাবে তা জানতেন। তাই তার স্বীকার করতে দ্বিধা ছিল না যে, “পাঠকের কাছে প্রায় ছেচল্লিশ বছর-জোড়া সমাজ-ইতিহাসও জীবনের যুগচিহ্ন-রূপে মূর্ত হতে পারে বলে মনে হয়। একক 'একটি জীবনকে' জড়িয়ে চলা একটা কাল-প্রবাহ বৈ, যা আর কিছু নয়।”

    মূলত মণীন্দ্র গুপ্তের অনুরোধেই নিজের জীবনকথা লিখতে রাজি হয়েছিলেন কবি দেবদাস। ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থ কালক্রম ও প্রতিধ্বনি (১৯৭০), মৃৎশকট (১৯৭৫), মানুষের মূর্তি (১৯৭৮), ঠুঁটো জগন্নাথ (১৯৮৩), উৎসবীজ (১৩৯৮ বঙ্গাব্দ), আচার্যের ভদ্রাসন (১৯৯২), তর্পণ (১৯৯৪) প্রভৃতি। তার সঙ্গে সঙ্গে কবি হিসেবে তিনি নিজস্ব স্বর স্পষ্ট করেছেন বলিষ্ঠভাবে। প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বকীয় উচ্চারণ, প্রকাশভঙ্গী, ভাবনার ঘোর। তমসাচ্ছন্ন জীবন ঘেঁটে শব্দের আলোছায়ায় নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্র কাব্যের জগৎ। ঠিক তখনই স্মৃতিকথন লেখার আমন্ত্রণ এল মণীন্দ্রবাবুর কাছ থেকে। সেই অনুরোধ ঠেলে দিতে পারেননি কবি। আর ঠেলে দেননি বলেই আমরা, পাঠকেরা কবির কবিতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি জুড়ে গেলাম কবির আশ্চর্য জীবনের সঙ্গে, জীবনাভিজ্ঞতার সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতা এতটাই বৈচিত্র্যপূর্ণ যে আমরা অনায়াসেই তার সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যাই বাংলাদেশের বন্ডবিল গ্রামে। দেবদাসের এই জন্মগ্রাম অখণ্ড ভারতের নদীয়া জেলার অন্তর্গত হলেও দেশভাগের পর তা পড়ে তৎকালীন পূর্বপাকিস্থানের চুয়াডাঙায়। ফলে সেই জন্মভূমি থেকে কবি বাধ্য হয়ে চলে আসেন এপার বাংলায়। কবির বাস্তুচ্যূতির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও যেন, সেই সব হারানো, দেশ হারানো মানুষের দলে হাঁটতে শুরু করলাম। পৌঁছে গেলাম শিকড় ছেঁড়ার দিনের ভয় আর শঙ্কা নিয়ে পালিয়ে আসার স্মৃতির কাছে। তারপর লেখকের বর্তমান শুধুই প্রবহমান জীবন স্রোতে ভেসে চলা। আশ্রয়ের খোঁজে একের পর এক জায়গায় যাওয়া আর সেখান থেকে ভেসে চলা। কখনও বীরনগর তো কখনও রাধানগর। প্রথমে মাথা গোঁজার জন্য হলেও পরবর্তীকালে চাকরিসূত্রেও তাঁকে যেতে হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। জীবন তাঁকে কোথাও থিতু হতে দেয়নি। ছুটে চলা সেই জীবনের ছাপ, তার হয়ে ওঠার আয়োজন এই গ্রন্থ। ধুলো পথে চলতে চলতে মাথায় করে নিয়েছেন জীবনের আশীর্বাদ ও অভিশাপ। দেখেছেন খাদ্যহীন সময়, ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিলে পুলিশের গুলি, নকশাল আন্দোলন, জরুরি অবস্থা, দাঙ্গা— আরও কত কী? সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য আন্দোলন, ও সেগুলির মধ্যে প্রকট বৈপরীত্য ভাবনার প্রকাশগুলিও ঘটেছে তাঁর সমসময়ে। কৃত্তিবাস-এর তারুণ্যই হোক আর হাংরির বুলেটিনের উত্তেজনা। নিম-প্রকল্পনা-শ্রুতি আন্দোলনের অনুসঙ্গও বিস্তারিতভাবে বলেছেন তিনি। এমনকী নিজে যে কাব্যভাবনার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিলেন এবং সমসাময়িক মৃদুল দাশগুপ্ত, গৌতম চৌধুরী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল হালদার সহ অসংখ্য কবিরা যে সম্মেলনের ভাবনায় জারিত হয়েছিলেন, সেই ‘শতজলঝর্নার ধ্বনি’-র কথা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। দেবদাসের স্মৃতিচারণে এই সময়কাল শুধু বিবৃতি নয় সময়ের সাক্ষ্য হয়ে উঠেছে। তিনি যেন এই সময়কে ধারণ করেছেন, জারণ করেছেন। ধারণ, জারণ ও পর্যবেক্ষণ করতে করতে কখনও তিনি পৌঁছে গেছেন ষাটের দশকের কবিদের কবিতা চর্চায় তো কখনও জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত কলকাতা পত্রিকার রাজনৈতিক সংখ্যাকে কেন্দ্র করে পুলিশের ধরপাকড়ের দিনগুলিতে।

    তবে কবি দেবদাস আচার্যের এই আত্মজীবনী অনেকটা তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত। যা জীবনের সহজ চলার পথে বাধা তৈরি করেছে। জীবনের থেকে ভারী হয়ে উঠেছে ইতিহাস, সময়ের অস্থিরতা। রাজনৈতিক ঘটনার চাপে কিছুটা হলেও চাপা পড়েছে জীবনের মাধুর্য। আবার এও তো সত্যি, সেই সময় আনন্দমুখর ছিল না। ছিল না সকালের আলোছায়ার মতো হাস্যকরোজ্জ্বল। কবিও সেই কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বলেছেন—

    “আমি ইতিহাস বা প্রবন্ধ লিখতে পারি না, অথচ আমার জীবিতকালের উত্তাপটুকু ধরে রাখার বাসনাও আমি পরিহার করতে পারিনি। তাই বিশেষত মান্যবর মণীন্দ্র গুপ্ত ও বন্ধুবর অমর দে মহাশয়ের উসকানি ও প্রশ্রয় পেয়ে এই আত্মজৈবনিক আবরণের আশ্রয় নেওয়া। কোথাও কোথাও দূর-ইতিহাসের দরোজায় টোকা মেরে এসেছি, নেহাতই কৌতূহলবশত। এর হয়ত প্রয়োজন ছিল না। তবু এ রচনা তো অনেকটাই ঝোঁকে চলেছে, তাই, ঐ ঝোঁকটুকু যদি পাঠক দয়া করে মেনে নেন তো প্রীত হব। 'দেবদাসের জীবন প্রভাত', 'সকালের আলোছায়া' 'কহে দেবদাস' এবং 'ধন্য হে দেবদাস' মিলে ১৯৪৮-এর জানুয়ারি থেকে ১৯৯২-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা অর্থাৎ ঠিক ৪৫. বছর সময়সীমা জুড়ে বাঙালী জীবনের মহাদুর্যোগের দিনগুলির কিছু আবেগ-চিহ্ন, কিছু অনুভূতির অনুরণন, কিছু আত্মার-অশ্রুপাত, উচ্ছ্বাস ও ত্যাগ, মোহ, অঙ্গীকার যা ধরতে পেরেছি, তা আজকের পাঠকের হৃদয়ে যদি একটু ঢেউ তোলে তো ধন্য হব।”
    তা সে অগ্নিপরীক্ষায় সফল তিনি। আর আমরা পাঠকেরা একজন কবির চোখে ঘুরে দেখলাম তার জীবন, তার সময়কে। আসলে শিল্পীর জীবনকে বুঝতে পারলে তাঁর শিল্পকর্মের কাছে পৌঁছনো সহজ হয়। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে সেই সুযোগ থাকে না। কবি দেবদাস আচার্য আমাদের সেই জানলা খুলে দিয়েছেন। সেই জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে পাই তাঁর কবি জীবনের রস ও রসদ। এ প্রসঙ্গে মণীন্দ্র গুপ্তের কথাটা আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। ধন্য হে দেবদাস-এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন—
    “সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টির পক্ষে তার ছেলেবেলার গুরুত্ব অপরিসীম। নিজের ছেলেবেলাটাই বার বার লুকিয়ে উঁকি দেয় তার শিল্পে, কবিতায়, সাহিত্যে। কবির ছেলেবেলাটাকে জানলে পাঠকের পক্ষে তাঁর কবিতার জট ছাড়ানো সহজ হয়।”
    বস্তুত পক্ষে এই গ্রন্থ আমাদের লুকোনো সেই পথ, যে পথের রেখা ধরে পৌঁছে যেতে পারব দেবদাস আচার্যের আশ্চর্য জীবনের কাছে, তার ফেলে আসা ভদ্রাসনের কাছে। তখন আরও একবার তাঁর উচ্চারণ, তাঁর কবিতা আমাদের কাছে দীপ্র হয়ে উঠবে ভোরের শিশিরের মতো।
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments