[লেখাটি পাঠের সময়ে একটি সবিনয় অনুরোধ : হিন্দুস্তান ও হিন্দুস্থান শব্দ দুটির বানান ভেদ খেয়াল রেখে পড়বেন।]
The Loss of Hindustan শোধনবাদী রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রকল্পিত বই নয়। গুরু ও লঘুর মধ্যের অসম-অন্যায় স্থান বদলের মূলবাদী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের ইতিহাস পদ্ধতির (যেখানে আদি-অন্ত-ঘর-বাহির-সত্য-মিথ্যা প্রাক্নির্দিষ্ট) মধ্যে দিয়ে যেতে চাইলেন না ঐতিহাসিক আসিফ, বরং উপনিবেশের ইতিহাস-যুক্তির কাজ ও উপনিবেশ উত্তরকালে সেই নির্মাণের দীর্ঘ ছায়াঞ্চলের critique তৈরি করলেন তার সাম্প্রতিক আলোচ্য বইতে। নতুন করে পড়ে দেখলেন ফারিশতা’র (মহম্মদ কাসিম হিন্দু শাহ্ আস্তারাবাদি) (১৫৭০-১৬২০) দীর্ঘ ইতিহাস গ্রন্থ তারিখ১ । পাঠ ক্রিয়ার মধ্যেই উন্মোচিত হোলো উপনিবেশের হিংসাশ্রয়ী জ্ঞানতত্ত্ব—হিন্দুস্তানের ধারণার অবলোপ ও ইন্ডিয়া/ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার জন্ম। এই পড়াকে অরাজনৈতিক কীভাবে বলি? বলা সম্ভব কি? বিশেষত যখন ভারতের কথা ভাবছি? উত্তরের দিকে পৌঁছনোর আগে আরো কয়েকটি প্রসঙ্গ পড়ে নেওয়া দরকার।
তাঁর আগের বইতে, ২০১৬ সালে প্রকাশিত A Book of Conquest: The Chachnama and Muslim Origins in South Asia-তে আসিফের আলোচনার কেন্দ্রে ফিরে আসে ১২২৬ CE-তে আলি কুফি প্রণীত ফার্সি গদ্য গ্রন্থ চাচনামা২। কুফি সিন্ধ প্রদেশের (ভারতের উত্তরে অবস্থিত) ৬৮০ CE থেকে ৭১৬ CE সময়কালের ইতিহাস বিবরণ লিখেছিলেন। সিন্ধ প্রদেশের হিন্দু ব্রাহ্মণ রাজা চাচ’এর আখ্যান এই ইতিহাসের বই। একই সঙ্গে বোনা চলে সিন্ধ অঞ্চলে মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠাকারী সেনাপতি মোহাম্মাদ বিন কাসিম’এর ইতিহাসও। চলছে এই দুইয়ের নীতিনিষ্ঠ সমাজ গঠনের টানাপোড়েন ও সেটি কীভাবে অন্যের লোভ ও লালসার কাছে পরাজিত হচ্ছে। চাচনামা একাধারে গল্প, ইতিহাস, রোমান্স ও অন্যদিকে একধরণের পাঠক্রম। অথচ কিছুটা সময় সরে এসে, ১৭৮২ থেকে, মূলত অ্যালেক্সান্ডার ডাও’এর অসম্পূর্ণ, ও ‘মুসলিম অংশ বিশেষের’ অনুবাদে আখ্যানমালা হয়ে উঠল ‘প্রামাণ্য ইতিহাস’৩ । এই শুরু, আর ব্রিটিশ প্রাচ্যবাদী, জাতীয়তাবাদী ও সামাজিক ঐতিহাসিকদের কলমের প্যাঁচে, আর পড়ার কায়দায় চাচনামা দ্রুত ভোল বদলে হয়ে উঠল এই অঞ্চলে ইসলামের আদি উৎসের সামাজিক, ভাষাগত ও ঐতিহাসিক বুনিয়াদী গ্রন্থ। আসিফের মতে, চাচনামা ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের উৎস ও দখলদারির আখ্যান তো নয়ই, আর প্রাক্সময়ের আরবি গ্রন্থের অনুবাদও নয় (যেমনটা দাবী করা হয়ে থাকে বিশেষ ধরণের ইতিহাস লেখায়)। বরং এটি নির্দেশ করছে এই দুইয়ের মধ্যে এক ধরণের সংলাপধর্মিতাকে, স্বাগত জানাচ্ছে এমন এক রাজনৈতিক কাঠামোকে যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্নতাকে গ্রহণের পরিসর। চাচনামা তার টেক্সটের শরীরে জুড়ে নিচ্ছে সংস্কৃত, আরবি ও ফার্সি’র গ্রন্থসম্পদ ও পাঠের ঐতিহ্যকে। তাই সাধারণ দাবীর বাইরে চাচনামা মোটেই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের আখ্যানমালা নয়, বরং রাজনীতি তত্ত্ব সম্বন্ধীয় সূক্ষ্ম চিন্তাকে প্রাধান্য দেয়। আর এই নিবিড় সূক্ষ্মতার পরিমণ্ডল তৈরি হচ্ছে ইন্ডিক ও ইসলামীয় চিন্তা-অনুভূতিকে স্বীকারের মধ্যে দিয়ে। বর্তমানের ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে প্রবহমাণ ভেদাভেদের বাস্তবতা, সেখানে চাচনামা'র মতো বইয়ের মূল তর্কগুলি হয়তো অনেকাংশেই এই নির্মিতির নানাদিক নতুন করে ভাবতে সাহায্য করতে পারে। যেমন ধরা যাক একটি শব্দ কেমন করে বদলেছে তার প্রয়োগ ও প্রয়োজন। পরিচিত অথচ অসংবেদি ভাবে ব্যবহৃত শব্দ Hindustan. আমরা অনেকেই কোনো না কোনো প্রসঙ্গে এই শব্দকে ব্যবহার করেছি—গান থেকে ভাষা, বা ভাষা থেকে জাতি পরিচয়ের ক্ষেত্রে। খেয়াল করলে দেখা যাবে সামান্য এই বানানের পার্থক্য, সাধারণের উচ্চারণে হয়তো ধরাও পড়বে না, এমনি এক ছিদ্রপথ যা দিয়ে এশীয় ভূখণ্ডের বিশেষ বিশেষ জায়গার অর্থ বদলে যেতে থেকেছে। আর এই বদলের, হারিয়ে যাওয়ার, হারিয়ে দেওয়ার বৌদ্ধিক সমালোচনা ইতিহাস লিখছেন আসিফ তার সাম্প্রতিক বইতেও (২০২০)। লক্ষণীয় Hindu‘STAN’ থেকে হিন্দুত্বের প্রবক্তা ভিনায়াক দামোদার সাভারকারের কলমে ‘STAN’ এর পরিবর্তে Hindu‘STHAN’ ব্যবহৃত হোলো। ‘স’ আর ‘হ’ এর সম উচ্চারণের অজুহাতে সিন্ধ অঞ্চলের নব্য ইতিহাসে হিন্দুরাই হয়ে উঠলেন মূল ও আদি বাসিন্দা। তাই হিন্দুদের স্থান রূপে হিন্দুস্থানের প্রকাশ। এটা আমাদের জানা কথাগুলির একটা, কিন্তু মাঝে মধ্যে আবার মনে করে নেওয়াও প্রয়োজন—নাম মাহাত্ম্য, স্তান(স্থান) মাহাত্ম্য। ঠিক কখন ও কীভাবে ভারতে প্রবেশ করেছিল ইসলাম এটি দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি ও সমাজনীতিতে সবসময়েই বিতর্ক, সংশয়, ও ইচ্ছাচালিত দাবীর বিষয়। তবে নানা গৃহীত মতে অষ্টম শতাব্দী CE তে সিন্ধ ও পশ্চিম ভারতে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে। এই আখ্যানশৈলীর বিপক্ষে তৈরি হয়েছে আসিফের পাঠকেন্দ্রিক তর্কগুলি।
ওদিকে নাম দেওয়ার, কেড়ে নেওয়ার, মুছে ফেলার, বদলে দেওয়ার, লেখা নামের উপর নাম লিখে দেওয়ার যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যে চলা তা কি সর্বতই নেতিবাচক ও খারাপ? তাহলে আমরা এমন কিছু সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করছি না তো যেখানে নাম পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়; বদলের, নতুন করে পড়ার অতীত অবস্থা। সেই দিকে যেন যাওয়াই যাবে না। আর এই প্রক্রিয়াকে যে প্রতিস্পর্ধা জানাবে সে পরিণত হবে ভিলেনে। নাম যেন অনেকটা এইভাবে আসছে—কারুর দখলে থাকা/রাখা—মালিকানা অর্থে। তবে দলিত অধিকারকামী, বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী, ক্যুয়ের, নারীবাদী, বা আরও অধিকার, এবং ন্যায় আন্দোলনের মধ্যে পুরোনা নামকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করা, নাম ব্যবহারের নীতি-রাজনীতিকে ঘাড় ধরে ঘুরিয়ে দেওয়া, হৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন ও প্রচেষ্টা আছে। তবে প্রত্যেক প্রসঙ্গ ও সেটির যুক্তির [পাথুরে (কারণ পাথরটাও বিশ্বাস দিয়ে নির্মিত হতে পারে), বা ধরে-নেওয়া-বিশ্বাসজাত যুক্তির কথা বলছি না] সঙ্গে পড়ে দেখতে হবে, ছেড়ে দিলে হবে না। আবার এই কাজটিকে দ্বৈধের আকারে ভাবলে এগোনো যাবে না আর! দ্বৈধতার ঘূর্ণাবর্তে সত্য-মিথ্যা, আসল-নকল, আগে-পরের খোঁজে নির্মিত হবে তুলনার স্বৈরতন্ত্র। কাউকে একটা, প্রসঙ্গক্রমে, গরিষ্ঠের কব্জির জোরে জয়ী ঘোষণা করার আশু তাগিদ কাজ করবে। তাই এই পথ দিয়ে ভাবছি না। আর এইরকম করে ভাবলে যে-সমস্ত বিপদের মুখে পড়ে যাব তা নিয়েও আসিফের অস্বস্তি। আবার প্রয়োগের রীতি-নীতি পড়ে নিতে নিতে এগোনোই একটা পথ হতে পারে। The Loss of Hindustan-এ আসিফ অনেকটা এই কথাটাই বলতে চেয়েছেন ‘ভারত-ইন্ডিয়া-হিন্দুস্তান-হিন্দুস্থান’এর নিরিখে। যেহেতু আমি ইতিহাসের ছাত্র নই, যেহেতু লেখাটা লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে যে তথ্যের ফাঁকে পড়ে হারিয়ে যাবে না তো যা বলতে চাইছি আসিফের বইকে কেন্দ্র করে? তাই ফিরে যেতে চাইব The Loss of Hindustan-এর প্রধান তর্কশর্তটির কাছে—নামের নীতি-রাজনীতি। বইটির কাছে ফিরে আসব, কিন্তু তারও আগে ফিরে যাব নামকরণের দর্শনলব্ধ প্রশ্নে।
যে নাম/নামকরণের কাছে পৌঁছোতে চাইছি, সেটির কাছে পৌঁছোনোর কোনো দ্রুত পথ আছে কি? আবার নাম ও তার উচ্চারণ ছাড়া কাজটাই বা করব কীভাবে? চিনব, চেনাবো কীভাবে? চিহ্নিত করার প্রয়োজন কীভাবে মেটাবো নামের অভাবে? নামই সংগঠিত করছে পরিচিতিকে, দূর থেকে নয় বরং নামই হয়ে উঠছে পরিচিতি। আমরা, ওরার ভেদ নির্মিত হচ্ছে নামের মধ্যে দিয়ে, বন্ধুত্ব স্থাপন হচ্ছে একে অপরের নামের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে। আবার আরেকভাবে ভাবতে হলে, তুমি যার নাম জানো না, তাঁর কি তুমি বন্ধু হতে পারো? ইমানুয়েল লেভিনাস ও জাঁক দেরিদা দুজনেই ব্যক্তিনামের সম্ভাব্যতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।৪ সেই আলোচনার সিকিভাগও হয়তো এই পরিসরে ধরা যাবে না। অবিচারী সংক্ষেপে বলতে গেলে তাঁরা দুজনেই হোলোকস্ট ও কমিউনিজম থেকে নানা শিক্ষার মধ্যে দিয়ে গিয়ে এমন এক নামকরণের নীতি-রাজনীতির কথা ভাবতে চাইলেন যেখানে নাম/নামকরণ অপরকে আমলাতান্ত্রিক উপায়ে দখল-শাসনের জন্য নয়,৫ বরং অপরকে স্বাগত আলিঙ্গনের উপায় হয়ে উঠতে পারে। যদিও তাঁদের তর্ক ও সন্দর্ভ একেবারে সরাসরি দেশের, রাজনৈতিক ভূগোল গঠিত অবস্থান নিয়ে কথা বলছে না, তাও তাঁরা অপরের অস্তিত্ব-উপস্থিতির প্রতি যে দায়িত্বের প্রশ্ন কেন্দ্রীয়ভাবে তুলেছেন, সেগুলি আমাদের এই আলোচনায় বরকরার থাকে। আসিফ তাঁর বইতে দাবী করছেন হিন্দুস্তানের ক্ষয়ের বৌদ্ধিক ইতিহাস লেখার কাজটা, তাঁর নিজের কথাতেই, শুধুমাত্র ঘটনাপরম্পরা মিলিয়ে নেওয়ার মতো কাজের মধ্যে দিয়ে সেরে ফেলা যাবে না। তাই সাধারণ ঐতিহাসিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে হয়তো সালতামামির কাজটি সংগঠিত হতে পারে, কিন্তু এখানে যে নিহিত রাজনীতি ও দর্শনের কথা বলা হচ্ছে, সেটির প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। আবার এটি দেওয়া-নেওয়ার মতো করে ভাবলেও হবে না। তাই হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান কেউ কাউকে তৈরি করে দিচ্ছে না, স্ব ও অপরের নিটোল ভেদের জমিতে দাঁড়িয়ে হচ্ছেও না কাজটি।
হিন্দুস্তানের মধ্যেই যে হিন্দুস্থানের বাস ও নির্মিতি, সেটা দেখিয়ে দেওয়ার কাজটি আসিফ করেছেন বহুলাংশে। আঠারো শতকের শেষ ভাগ অবধি হিন্দুস্তানের উপস্থিতি, অথচ উনিশ শতক থেকেই ফিকে হতে শুরু হয় এই শব্দটি। তার বদলে ব্রিটিশ উপনিবেশিক হস্তক্ষেপে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া শব্দবন্ধটির দবদবা তৈরি হয়। প্রাক্- ঔপনিবেশিক হিন্দুস্তানের উপস্থিতির হ্রাসের মধ্যেই জানান দেওয়া হতে থাকে যে ব্রিটিশ শাসনের আগে যেন সেরকমভাবে ভারতের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। মুঘল শাসনের আগেও ১৩২৫ সালের নামাঙ্কিত একটি কবিতায় হিন্দুস্তানের উল্লেখ রয়েছে। আবার ওদিকে ‘early India’ এই ধারণার কাছে চলে যেতে ইতিহাসের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না! অথচ পার্টিশানের পরে কি ‘early Pakistan’ বা ‘early Bangladesh’ ভাবা সম্ভব হচ্ছে? উপনিবেশের জ্ঞানতত্ত্ব উপনিবেশিতের ভাষার প্রয়োগ বল কমিয়ে আনার চেষ্টা চালায়, দেখিয়ে দেয় যে উপনিবেশিতের ভাষার বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক পরিভাষাগত ত্রুটিগুলি—এ পথেই কায়েম হয় উপনিবেশের আধুনিক ভাষা, আক্রমণ করা হয় নানা ধরণের দেশীয় আর্কাইভকে, বুঝিয়ে দেয় যে তাঁদের হস্তক্ষেপের/অনুপ্রবেশের আগে যেন গুছিয়ে বলার মতো কোনো ভারতীয় ইতিহাস ছিল না। যা ছিল, তা খন্ডিত, অসম্পূর্ণ। আবার আধুনিক সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র হয়ে উঠতে গেলে যে জ্ঞানের, ইতিহাস লেখা ও বোঝার যে শৃঙ্খলা দরকার সেটি ধরিয়ে দিতে পারে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ঐতিহাসিকরাই। যখন প্রাক ঔপনিবেশিক সময়ে লেখা ইতিহাস ও স্মৃতি মুছে ফেলার কাজটা চলছে, পাশাপাশি প্রয়োজন আরেক ধরণের রাজনৈতিক বিস্মৃতির পরিমণ্ডল তৈরি করার। তাই ষোলোশ শতক থেকে শুরু করে পর্তুগিজ, ডাচ, জার্মান, ব্রিটিশ, ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি এই উপমহাদেশ সম্পর্কে কী ভাবছে সেই উপাদানেই নির্মাণ হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ার’—ক্রমশ ও দ্রুত মুছে যাচ্ছে হিন্দুস্থান। অথচ হিন্দুস্থানের ধারণা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে খ্রিস্টীয় নবম ও দশম শতকে আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, প্রাকৃত, ও পরে উর্দু ভাষাতেও লেখা নানা ইতিহাস বইতে। সেখানে আছে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক আলোচনা সমূহ।
বিংশ শতকের শুরুতেই, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদের প্রবক্তাদের/ইতিহাসবিদদের কলমে অন্য সুর বাজতে থাকে। ১৯০৮ সালে সাভারকারের লেখা মারাঠি কবিতা ‘আমুচা প্রিয়কর হিন্দুস্থান’ স্পষ্টতই ঘোষণা করে যে মুসলিম ও ইংরেজ, দুপক্ষই বহিরাগত ঔপনিবেশিক শক্তি। এই তত্ত্ব আরো পরে ১৯২৩-এ প্রকাশিত “Essentials of Hindutva” প্রবন্ধে বড় আকার পায়, যেখানে সরাসরি মুসলিমদের ভারত ভূমিতে আক্রমণকারী আখ্যা দেওয়া হয়। হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার ভিত্তি রূপে সাভারকার হিন্দুস্থানের ভৌগোলিক রূপকল্প তৈরি করলেন আগে ।৬ তাই প্রাক ঔপনিবেশিক হিন্দুস্তানের অবলুপ্তি অন্তত দু দিক থেকে সাধিত হচ্ছিল— এক) ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস পদ্ধতিতে, আর দুই) হিন্দু জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের ঘরানায়। মজা হলো, বিশেষ করে শেষোক্ত ঘরানায়, অনেকটাই প্রশ্নাতীত সত্যের মতো করে ধরে নেওয়া হতে থাকে গ্রহণ বর্জনের নীতিগুলিকে। সাভারকারের দাবী অনুযায়ী হিন্দু সভ্যতার সুদীর্ঘ পাঁচ হাজার বছরের সুন্দর ও শান্ত জীবনধারার ইতিহাসে ঘাজনির মোহাম্মাদের আক্রমণ বিপর্যয় ডেকে আনে। সুতরাং তার পরবর্তী সময়ের প্রধান আখ্যান দাঁড়ায় বহিরাগত মুসলিমের আক্রমণ ও হিন্দুর প্রতিরোধ। আক্রমণ ও প্রতিরোধের বয়ানই হয়ে ওঠে ইতিহাসের স্বর। ততক্ষণে হিন্দু আর সিন্ধুর মধ্যের ফারাক যোজন বিস্তৃত। এমনকি ১৯২৮ সালে মাদ্রাজে প্রদেয় বক্তৃতায় ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারও (১৮৭০-১৯৫৮) মুসলিমদের এই ভৌগোলিক পরিসরে হিন্দুদের থেকে একবারে আলাদা ও মুসলিম শাসন হিন্দুস্থানের আবহাওয়ার পক্ষে বিলিতি ব্যাপার বলেই দাবী করেন ।৭ William Jones, Anquetil Duperron, John Z. Howell, Nathaniel Halhed, Charles Wilkins-এর মতো প্রাচ্যবিদরা ঠিক যে পদ্ধতিতে হিন্দুস্তানের ধারণার লোপ ঘটিয়ে ইন্ডিয়াকে প্রতিষ্ঠা করলেন, প্রায় দুশো বছর বাদে সাভারকার ইত্যাদির লেখায় দেখা যাবে সেই একই উপায় অবলম্বন করা হচ্ছে। এই পুনরাবৃত্তির প্রধান শর্ত এই যে পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতায় মুসলিমরা একাধারে সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকারী ও অন্যদিকে ভারতীয় জনমানসে তাঁদের সংযোগ কেবলমাত্র স্বৈরাচারীর সঙ্গে শান্তিপ্রিয় মানুষের যে সম্পর্ক হতে পারে সেটুকুই। তাই ভুলে যাওয়া, ভুলিয়ে দেওয়ার কাজটা শুরু হয়েছিল নানাদিক থেকেই।
এরই মধ্যে প্রায় কেন্দ্রীয়ভাবে জুড়ে গেল অনুবাদের রাজনীতি! ফরিশতার তারিখ-এর অপঅনুবাদের কান্ডারী Alexander Dow ধরেই নিলেন যে ফরিশতার তারিখ ভুলে ভরা। প্রধান অভিযোগ একদিকে ফরিশতা সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন না আবার অন্যদিকে মহাভারতকে তিনি ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করছেন! ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকের কাছে সেটাই গর্হিত অপরাধ—মহাভারত তো কাব্যে লেখা! গদ্য ছাড়া ইতিহাসের উপাদান মহাকাব্যে কীভাবে পেয়ে গেলেন ফরিশতা? অথচ Dow-এর ইতিহাস পৌঁছে যাচ্ছিল ব্যাপক স্তরে। এমনকি ভলত্যের ও ইমানুয়েল কান্টও Dow প্রণীত History of Hindostan পড়লেন। মুসলিম ইতিহাসকার যে বিস্তৃত উপায়ে হিন্দুস্তানের ইতিহাস প্রাক ঔপনিবেশিক সময়েই নির্মাণ করছিলেন, তাকে প্রায় গোড়া সমেত উপড়ে ফেলাই হয়ে দাঁড়ালো আশু কর্তব্য। ঔপনিবেশিক প্রকল্পে একদিকে হিন্দুস্তানের ইসলামী স্বৈরতন্ত্রের ইতিহাস আর অন্যদিকে অনগ্রসর হিন্দুর সময়-কাল সম্পর্কে অদ্ভুত সব ধারণা। এগুলিই, অনুবাদের/লেখার মাধ্যমে হেগেল ও শ্লেগেল-দের মতো দার্শনিকদের প্রভাবিত করে ইতিহাসের দর্শনে ভারতীয়দের আধুনিক ইতিহাসের অযোগ্য হিসাবে দাগিয়ে দিতে। এই তর্কগুলি বহুবিদিত। পরবর্তী ভারত ইতিহাস লেখার/অনুবাদের দীর্ঘ ধারার মধ্যে ক্রমশই মুছে যেতে থাকে ফরিশতার তারিখ-এর মতো ইতিহাস—যেখানে ফার্সির সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে সংস্কৃত সূত্রাবলী, রয়েছে মৌখিক ইতিহাস ও ভ্রমণকারীদের বৃত্তান্ত, সর্বোপরি সেখানে স্থান পাচ্ছে বিরোধীতা ও ভিন্নমত! প্রশস্ত ও বৈচিত্র্যময় হিন্দুস্তানের যে ইতিহাস ফরিশতা তৈরি করেছিলেন সেখানে কোরান ও ধর্মের মিশেলে নানারকমভাবে একই পরিসরের মধ্যে বিবিধ গোষ্ঠীর অধিষ্ঠান ও অধিকারী হওয়া সম্ভব। ফরিশতার কলমে নির্মিত হচ্ছিল নৈতিক ইতিহাসের ধারণা, যেখানে লড়াই-মোকাবিলার আখ্যানকে মানুষের স্থানিক অন্তর্ভুক্তির ইতিহাসের দিকে পুনরায় সূত্রবদ্ধ করা হচ্ছিল। এই অতীতের ঐকতান এক আশ্চর্য ভবিষ্যতের রাজ-নৈতিকতার দিকে পাঠককে নিয়ে যায়! পরিসর, ভূগোল, ও গোষ্ঠী সম্পর্কে দায়িত্বের কথা বলে!
যদিও ঐতিহাসিক আসিফ হিন্দুস্তানের পুনরুদ্ধারের দাবী করছেন না তাঁর আলোচ্য বইতে, তাও যে কাজটা তিনি পুনর্পাঠের মধ্যে দিয়ে করছেন, ঔপনিবেশিকতার সজোর সমালোচনার মধ্যে দিয়ে করছেন, তা যেন প্রয়োজনীয় কাজের মতো অতীতকে বর্তমানের ও ভবিষ্যতের নিরিখে পড়তে সাহায্য করছে। তিনি দাবী করছেন বৌদ্ধিক ইতিহাসের কাজটি তিনি করছেন অথচ ইতিহাসের উপাদানের বাইরে গিয়ে পড়ার কাজটি তাঁর বইতে তুলনামূলকভাবে কম। টেক্সটের মধ্যে বিচরণের যে অগাধ সুযোগ তাঁর ছিল, পাঠের যে অমেয় রাশি তাঁর সামনে, অনেকসময়ে সেটির পুরোপুরি ব্যবহার তিনি করেননি, হয়তো ইতিহাস লেখার পদ্ধতিগত প্রয়োজনে। হিন্দুস্থানের মহাফেজখানা ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিক/প্রাচ্যবিদদের হাতে যে লোপ পাচ্ছে, এটি তিনি বারবার পুনরুক্তির মতো করে দেখিয়ে দিচ্ছেন প্রায় প্রত্যেক অধ্যায়ে। এটি নাও করা যেত। এখানে একটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত অবতারণা করে আলোচনা গুটিয়ে আনবো। আসিফ কীভাবে পড়লেন তাঁর আর্কাইভকে? তথাকথিত ইতিহাসের বই ফরিশতার তারিখ-কে তিনি কি ইতিহাসের বইয়ের মতো করেই পড়লেন? অন্যরা (ঔপনিবেশিক বা জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক) যেমনভাবে ইতিহাসের বিদ্যায়তনিক তাক থেকে নামিয়ে পড়লেন, সেভাবেই? বৌদ্ধিক প্রকল্পে কি ওই পাঠের কাজটিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলা যেত না পদ্ধতিগতভাবে? ফরিশতা কি চেয়েছিলেন তাঁর বই এভাবেই পঠিত হোক? বুঝতে পারছি, প্রশ্নটি ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছি, কিন্তু কোথাও যেন মনে হচ্ছে ওই রচনার অভিপ্রায় কী? পরের কোনো এক কাল-সময়ের ইতিহাস পাঠের আকাঙ্ক্ষায় ফরিশতার তারিখ–কে রাঙিয়ে দিচ্ছি না তো? এর উত্তরগুলি, বলাই বাহুল্য, সহজ নয়। আমি বলছি না আসিফের বই The Loss of Hindustan এই ব্যাপারগুলিকে একবারে স্পষ্টাস্পষ্টি লেপেপুঁছে একাকার করে দিয়েছে। বরঞ্চ অনেক সময়ে ঐতিহাসিক আসিফ এই টেক্সটের (এবং আরো অন্য অনেক টেক্সটের, যেমন ইকবালের কবিতা) সমূহ জটিল তর্কগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এখানেই সাম্প্রতিকে রণজিৎ গুহ’র History at the Limits of World History কে ঘিরে অনির্বাণ দাশের প্রবন্ধের উল্লেখ প্রয়োজনীয়। ফরিশতার তারিখ-কে কি সাহিত্যের কাজ হিসাবেও পড়া যায়? এটা কিন্তু পাঠের ধারাকে উল্টেপাল্টে দেওয়ার মতো ব্যাপার নয়—যে আজ যা ছিল ইতিহাস কাল তা হোলো সাহিত্য! বরং ইতিহাস কথনের মধ্যে, পুনঃকথনের মধ্যে, সৃষ্টির যে নতুন সম্ভাবনা থাকে সেটিকে মনে করে নেওয়া। অবশ্যই অপরের প্রতি নৈতিকতা ও দায়িত্বের প্রসঙ্গকে মনে রেখে। তবে দাশ (২০২৩) যে কথাটা বলছেন ‘পুনর্নির্মিত হওয়ার সৃষ্টিপরতা ইতিহাসকে ধ্বংস নয়, আরো ঐশ্বর্যশালী করে তুলতে পারে। বাস্তব ঘটনা বিবৃতির চাইতে বেশী সত্য ওই ইতিহাস।’—এটি সম্ভব হতে পারে দাগিয়ে দেওয়া ইতিহাসের বইকে যদি অন্যতর সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে পড়া যায়। ইতিহাসের কাজের মধ্যেই, দাশের মত অনুযায়ী, সাহিত্যের প্রণোদনায় যথার্থ সাদৃশ্যের মধ্যেই খুঁজে নেওয়া যাবে অপরিচয়ের বিস্ময়। এটি তাঁর কাছে সাহিত্যশিক্ষিত ইতিহাসের বিশিষ্ট রূপ ৮ হতে পারে (হতে পারত) (কোনটা ঠিক?) এটাই হিন্দুস্তানের স্বরূপ, তবে সারবাদী অর্থে নয়। মানান আহমেদ আসিফের The Loss of Hindustan, কয়েকটি বিষয় সত্ত্বেও, অতীত ও বর্তমান ভারতকে পড়ার জন্য প্রণিধানযোগ্য পাণ্ডিত্যের ফসল।
-----------------------------------------------------------
১) Moḥammad-Qāsem Ferešta, Tārikh-e Ferešta (lithograph), 2 vols., Lucknow, 1864-65.
J. Scott, Ferishta’s History of the Dekkan, 2 vols., Shrewsbury, England, 1794.
২) Asif, Manan Ahmed. A book of conquest: The Chachnama and Muslim origins in South Asia. Harvard University Press, 2016.
৩) Alexander Dow. The History of Hindostan, from the Death of Akbar, to the Complete Settlement of the Empire under Aurungzebe. To Which Are Prefixed, I. A Dissertation on the Origin and Nature of Despptism in Hindostantan, II. An Enquiry into the State of Bengal; With a Plan for Restoring ThatKingdom to Its Former Prosperity and Splendor. London: T. Becket and, P. A. de Hondt, 1772.
——. The History of Hindostan; from the Earliest Account of Time, to the Death of Akbar; Translated from the Persian of Mahummud Casim Ferishta of Delhi: Together with a Dissertation Concerning the Religion and PhiloS'ophy of the Brahmins; With an Appendix, Containing the History of the Mogul Empire, from Its Decline in the Reign of Mahummud Shaw, to the Present Times. London: T. Becket and P. A. de Handt, 1768.
৪) Derrida, Jacques. On the name. Stanford University Press, 1995.
—— The politics of friendship. Verso, 2005.
Levinas, Emmanuel. Proper Names. Trans. Michael B. Smith. Stanford, CA: Stanford U P, 1996.
৫) Moraru, Christian. "“We Embraced Each Other by Our Names”: Levinas, Derrida, and the Ethics of Naming." Names 48, no. 1 (2000): 49-58.
৬) Savarkar,V. D., Hindutva: Who Is a Hindu?, Bombay: Veer Savarkar Prakashan,1969.
৭) Jadunath Sarkar, India through the Ages: A Survey of the Growth of Indian Life and Thought, Calcutta, M.C. Sarkar & Sons, 1928.
৮) দাশ, অনির্বাণ, সাহিত্যের কাজ ও ইতিহাসের সীমা, অনুষ্টুপ, রণজিৎ গুহ বিশেষ সংখ্যা, কলকাতা, ২০২৩।