“আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা
একা হেঁটে যেতে মনে হয়- ফুল নয়, ওরা
শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদেরই চেতনার রং”।
-“ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯” শামসুর রহমান (১৯২৯-২০১৬)
|| ১ ||
বিংশ শতাব্দী বাংলা ভাষাভাষী মানুষজনের জীবনে একই সঙ্গে উৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্ট সময়। শিল্পে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, চলচ্চিত্রে বাঙালি পৌঁছেছে সাফল্যের শিখর থেকে শিখরে; কিন্তু তার জীবনযাপনের গুণগত মানে ঘটেছে সমস্যা ও গ্লানি। শতাব্দীর সূচনায় ব্রিটিশ-সুপরিকল্পিত বঙ্গভঙ্গের ফলে প্রদেশের দুই জাতিগোষ্ঠীর সংস্কার ও জাতিবিদ্বেষ উন্মোচিত হয় নগ্নভাবে। রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক ভাঙন জোড়া লাগলেও বিভেদ ও বিবাদ থেকেই যায়। চল্লিশের দশাব্দ থেকে শুরু হয় নিয়মিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (যেখানে উভয় পক্ষ অংশ নেয় আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণে এবং ক্ষয়ক্ষতি ঘটে উভয়পক্ষেই) এবং পোগ্রম (pogrom), যেখানে এক সম্প্রদায়ের সুসংগঠিত দক্ষতায় এবং অপরিসীম নৃশংসতায়, অনেক সময়েই প্রশাসনের সক্রিয় সমর্থনে অথবা নীরব অবহেলায় নিকেশ হয় আর এক সম্প্রদায়)। তার সঙ্গে উইনস্টন চার্চিল পরিকল্পিত পঞ্চাশের মন্বন্তরে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ বাঙালির অকালে অপমৃত্যু। এইসব ধ্বংসের পথ ধরে আসে ১৯৪৭-এর শোচনীয় ও মর্মান্তিক স্বাধীনতা।
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ধারাটি ছিল মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত এবং মূলত হিন্দু। মহাত্মা গান্ধী যেখানে প্রাণসঞ্চার করলেন সাধারণ মানুষকে সেই আন্দোলনে সামিল করে। জনগণ পথে নামলেন বটে কিন্তু সেখানে থাকলো না কোনও শ্রেণীচরিত্র অথবা অর্থনৈতিক সুবিচারের ডাক। ভূমি সংস্কার অথবা শ্রমিক ইউনিয়নের ভূমিকাও ছিল নগণ্য। ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত ভয়াবহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে কংগ্রেস বা মুসলিম লিগের পক্ষ থেকে গড়ে তোলা হয়নি সঠিক পন্থা। কমিউনিস্ট পার্টি বা অন্যান্য বামপন্থী সত্তাগুলির আবেদন ও জনপ্রিয়তা ছিল সীমিত। ১৯৪৬ সালের আমন ফসলের মরশুমে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল তেভাগা আন্দোলন--ভাগচাষীরা দাবী করলেন জমির ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ। জোতদারদের বিরুদ্ধে বর্গাদারদের এই সংগ্রামকে কেন্দ্র করে সারা দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। মুসলিম লিগের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা চালু করেছিলেন বর্গাদারী আইন, কিন্তু তার সিদ্ধান্তকে কাজে পরিণত করার আগেই ঘটলো দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক হানাহানি।
ভারতবর্ষের উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের ইতিহাস এক শোচনীয় মৃত্যু আর ধ্বংসের কাহিনি। দেশের সমাজব্যবস্থা ও জীবনযাত্রাকে ইংরেজ ভেঙেছিল দুভাগে। এক:- জমির মালিকানা সীমাবদ্ধ করা হ’ল অল্প কিছু মধ্যস্বত্ত্বভোগী জমিদারদের হাতে আর নিয়মিত বাড়ানো হ’ল ভূমির রাজস্ব। ইংরেজ শাসনের প্রথম তিরিশ বছর বাংলার চাষীদের রাজস্ব বেড়েছিল চারগুণ। ফলে অনাহার, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর। দুই:- পরিকল্পিতভাবে ইংরেজরা ধ্বংস করে ভারতবর্ষের শিল্পকে। যে দেশের তন্তুবায় সমাজ বস্ত্র রপ্তানী করতো সারা পৃথিবীতে, সেই দেশে বস্ত্রের আমদানী শুরু হল ইয়োরোপ থকে। লক্ষ লক্ষ শিল্পজীবী হারালেন জীবিকা। এর পরে ইংরেজ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে এবং ইংরেজ শাসনযন্ত্রের অংশ হিসেবে গড়ে ওঠে বাংলার ও ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী, মূলত হিন্দু। এঁদেরই এক আলোকিত অংশ দিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব। স্বাধীনতার পরে ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা সমর্পিত হয় এই সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে। ফলে আমাদের দেশে সেভাবে ভূমিজ মানুষের শ্রেণীভিত্তিক গণ-আন্দোলন গড়ে অঠেনি এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য লেখকদের সীমিত চেষ্টা সত্ত্বেও কৃষক শ্রমিকদের নিয়ে মহান সাহিত্য রচিত হয় নি।
প্রগতিশীল লেখক হিসেবে এবং সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবেই শুরু হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যিক আত্মানুসন্ধান। সেই হিসেবে তিনি মানিক ও মহাশ্বেতার সফল উত্তরসূরী। এখানে মনে রাখতে হবে যে অকালমৃত্যুর ঠিক আগে ইলিয়াস যে মহতী উপন্যাসটি সমাপ্ত করেছিলেন তার পটভূমি ছিল তেভাগা আন্দোলন।
|| ২ ||
সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের (১৯৪৩-১৯৯৭) জীবন শোচনীয়ভাবে সংক্ষিপ্ত; চুয়ান্নতম জন্মদিনের দেড় মাস আগেই তাঁর মৃত্যু। তার মধ্যে শেষ কয়েক বছর কেটেছে দুরারোগ্য ক্যানসারের প্রকোপে। গোতিয়াগ্রামের মামাবাড়িতে তাঁর জন্ম ফেব্রুয়ারি ১৬, ১৯৪৩। বাবা বদিউজ্জামান মহম্মদ ইলিয়াস বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচিত সদস্য এবং মুসলিম লিগের অন্যতম সম্পাদক। তখন দেশজুড়ে চলেছে পঞ্চাশের মন্বন্তরের বিভীষিকা। ইলিয়াস সাহেব তখন গ্রামে গ্রামে রিলিফ বিতরণের কাজে রত। তাঁর ওইদিনের ডায়েরির পৃষ্ঠায় পেনসিলে কেজো এবং পংক্তির মন্তব্য, “A male child is born at 11:00PM today”. মিনিমালিস্ট পিতার তিনি মিনিমালিস্ট পুত্র--আবেগ এবং উচ্ছ্বাসের অভাব--রূঢ় বাস্তবের ব্যঞ্জনায় তাঁরা উদ্ভাসিত।
পাকিস্তান স্বাধীন হয় ইলিয়াসের শৈশবে; তিনি বেড়ে উঠেছেন স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে। তাঁর চোখের সামনে চলেছে সংখ্যালঘু বিতাড়ন এবং উর্দু ভাষার নিপীড়ন। দেশ ছেড়ে বিদায় নিলেন বর্ণহিন্দু জমিদার ও ধনী কৃষক পরিবারগুলি। তাঁদের স্থান দখল করলেন কিছু প্রভাবশালী মুসলমান। বিদায় নিলেন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার উচ্চপদস্থ ও মধ্যপদস্থ হিন্দু কর্মীরা। তাঁদের স্থলে চাকরি পেলেন শিক্ষিত মুসলমানেরা। অল্পদিনের মধ্যে গড়ে উঠলো শিক্ষিত ও স্বচ্ছল মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কিন্তু পশ্চিম থেকে ভাষার নিপীড়ন আর অর্থনৈতিক শোষণ চললো অব্যাহত। কৃষক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে তাঁদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে গড়ে উঠলো না গণ-আন্দোলন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের তুমুল আলোড়ন ও আত্মত্যাগের কেন্দ্রে ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণী; পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী মানুষ নিম্নবর্ণের নমঃশূদ্র হিন্দু এবং মুসলমানের অংশগ্রহণ তাতে প্রায় ছিল না বললেই চলে। যেমন গণ অভ্যুত্থানের আশা জাগিয়েছিল তেভাগা আন্দোলন, যেমন যৌথ প্রতিবাদের স্বপ্ন দেখেছিলেন বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (১৯০৪-১৯৬৮), তেমন কোনও তত্ত্বভিত্তিক সংগ্রাম গড়ে উঠলো না। ভারতবর্ষে যেমন ব্রাহ্মণপন্থীরা ক্ষমতায়, পাকিস্তানের সরকার হয়ে দাঁড়ালো কট্টর ইসলামপন্থী। গরীব নিম্নবর্ণের হিন্দু কৃষকরাও দেশ ছাড়লেন। তবে রামা কৈবর্তকে তাড়িয়ে হাসিম শেখের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনও উন্নতি ঘটলো না।
১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হলেন প্রায় দেড় হাজার বাঙালি। ওই বছরের মে মাসে মামলা দায়ের করা হল শেখ মুজিব সহ ৩৫ জন আওয়ামী লীগ নেতা, উচ্চপদস্থ সামরিক ও সরকারী কর্মচারীর নামে। প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে বিচার হবে সামরিক আদালতে, কারণ অভিযুক্তদের অনেকেই সামরিক বাহিনীর অফিসার। কিন্তু আসন্ন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কথা ভেবে আয়ুবশাহী শাসকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন বিচার হবে অসামরিক আদালতে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের দেশদ্রোহী বলে সাব্যস্ত করা যায়।
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে পুরো ঘটনাটি কিন্তু দেশদ্রোহের নয়, বরং তাঁদের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর বিরুদ্ধে জঙ্গী সরকারের হস্তক্ষেপ। সারা দেশ তখন প্রতিবাদে উত্তাল। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই সেই বিচারের সমাপ্তি ঘটার কথা, কিন্তু দীর্ঘ ও অবিছিন্ন গণ-আন্দোলনের জন্যে তাকে স্থগিত রাখতে হয়। ফেব্রুয়ারি ১৫, ১৯৬৯ অভিযুক্তদের একজন, পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর অফিসার জহুরুল হককে (১৯৩৫-১৯৬৯) নৃশংসভাবে হত্যা করে একজন হাবিলদার তাঁর জেলখানার কক্ষে। পুড়িয়ে ফেলা হয় সরকারী অতিথিশালা এবং আর অনেক সরকারী অফিস ও দপ্তর। এক হপ্তা পরে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে অভিযুক্তদের মুক্তি দেন। রেস কোর্স ময়দানে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় মুক্তিপ্রাপ্ত সংগ্রামীদের, তাঁদের নেতা শেখ মুজিবকে অভিধা দেওয়া হয় “বঙ্গবন্ধু”। এই হ’ল চিলেকোঠার সেপাই এর উত্তাল পটভূমি।
|| ৩ ||
১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন এবং ভাষা বিক্ষোভ অনেক সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীকেই আলোড়িত করেছিল। যেমন অগ্রজ অবি শামসুর রহমান (১৯২৯-২০০৬), যদিও তাঁর চিন্তাভাবনা ও প্রকাশভঙ্গি অনেকটাই ভিন্ন। কবির “কালের ধুলোয় লেখা” গ্রন্থ থেকে: প্রতিবাদী মিছিলের পুরোভাগে একজন যুবকের হাতে অন্যরকম একটি পতাকা। লাঠির ডগায় জড়ানো রক্তাক্ত শার্ট। বুঝতে অসুবিধে হলো না যে শার্টটি একজন সদ্য শহীদের। … তখন হৃদয় আমার তোলপাড়, কান্না স্তব্ধ দু’চোখে। … অফিসে আমার কামরায় একা বসেছিলাম অনেকক্ষণ। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল লাঠির ডগায় ঝুলে থাকা রক্তাক্ত একটি শার্ট। আসাদের শার্ট…। অফিসের চেয়ারে বসেই আমি আমার অজ্ঞাতে যে নিঃশব্দে উচ্চারণ করছিলাম দুটি শব্দ “আসাদের শার্ট”। … সন্ধ্যারাতে লেখার টেবিলে ঝুঁকে প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে লিখে ফেললাম “আসাদের শার্ট” কবিতাটি… আসাদুজ্জামান, যিনি পুলিসের বুলেটে শহীদ হন, ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের নেতা ছিলেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস কোনও প্রকৃত দেশপ্রেমিক শহীদকে কোনও সংকীর্ণ সংজ্ঞা অথবা একটি বিশেষ কোনও রাজনৈতিক অলের খোপে আটকে রাখা চলে না। তাই, সেকালে আমার লেখনী থেকে নিঃসৃত হয়েছিল এমন তিনটি পঙ্ক্তি:
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা, কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ধেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।
… আসাদ আমার কাছে হয়ে উঠেছিল একটি স্বাধীনচেতা, নির্যাতিত কিন্তু বীর দুর্জয় জাতির প্রতীক- কোনও সংকীর্ণ গণ্ডিতে শৃংখলিত করা কঠিন” (শামসুর রহমান “গদ্য সংগ্রহ”, পুনশ্চ, পৃষ্ঠা ২২৫-২২৬)
মিছিলের পুরোভাগে সেই যুবকটি হতে পারতো ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ওসমান গণি অথবা তার বন্ধু আনোয়ার অথবা আলতাফ। তবে শামসুর তার কবিতাটি লিখেছেন তাৎক্ষণিক অনুভূতির উপরে ভর করে। ইলিয়াস উপন্যাসটি লিখেছেন দেড় দশক পরে।
|| ৪ ||
১৯৬৮-৬৯ সালের পূর্ব বাংলা--প্রতিবাদে মুখর, আন্দোলনে উত্তাল। মিটিং, মিছিল, গুলিবর্ষণ, ধর্মঘট, সরকারী ইমারতে অগ্নিসংযোগ। কার্ফিউ এবং কার্ফিউ ভাঙা, মিলিটারির গুলি আর মিলিটারির গাড়িতে ইট-পাটকেল। উত্তেজনায় টান টান ঢাকা মহানগরী, তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে, শহরে বন্দরে। উত্তেজনার আগুন পোহায় ইনডিয়া থেকে আসা এক শিক্ষিত যুবক, শেখ ওসমান গণি, ডাকনাম রঞ্জু। আন্দোলনের আলোড়নে বিস্ফোরিত শহর, কিন্তু তার কাজ কেবল দেখে যাওয়া--কখনও রাস্তায় নেমে খুব নিকট থেকে, কখনও ছাদের নিরাপদ দুরত্ব থেকে। সে বাস করে এক ভাড়াবাড়ির চিলেকোঠায়। একতলায় জুতোর কারখানা- ‘গওসল আজম স্যু ফ্যাকটরি’; দোতলায় অন্য দুজন ভাড়াটে, চিলেকোঠার ঘরে সে একা। ঘরগুলোর পুরো দেওয়াল মোটা থাম। আগে মালিক ছিল সাহা অথবা বসাক অথবা পোদ্দার--১৯৫০ সালে রহমতউল্লার কাছে বাড়ি বেচে চলে গিয়েছে ইনডিয়া। সে কাজ করে ইপি আই ডি সি অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন নিগমের আপিসে- সেখানে কোনও দিন গেলেও চলে, না গেলেও ক্ষতি নেই।
ঢাকা শহর ভেসে যায় মুক্তির আবেগে আর যৌবনের স্পর্ধায়, চিলেকোঠায় ওসমান ভাসে গড্ডলিকা প্রবাহে। রাতে বাঙলার পরিমাণটা বেশি হয়ে গিয়েছে; পাকিস্তান অবজার্ভার সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় চার কলম জুড়ে বিশ্বসুন্দরীর ছবি। “সিসিলিরূপসীর পুরুষ্টু ঊরুতে শীতল বৃষ্টিপাত ঘটছে। ঐটা সামনে রেখে কম্বলের নিচে নিজের ঊরুসন্ধি থেকে দিব্যি ঘন প্রস্রবণ বইয়ে দেওয়া চলে।” বাইরে চলেছে সামরিক শাসনের ভ্রূকুটি আর নির্যাতন- ভেতরে ওসমানের ডানায় বিহ্বল কামনা বাসনার বেগ। দোতলায় ভাড়াটের ছেলের নামও রঞ্জু- সমনামী দুজনের ডাকনাম। রঞ্জুর ছোটবোনের নাম রানু- মেয়েটি কালো, তার চাপা ঠোঁটদুটোর রঙ বেগুনি। ভাইবোন দুজনেই পড়তে আসে তার কাছে। রানুর বেশ পছন্দই তাকে, কিন্তু রানুকে প্রেম নিবেদনের বদলে সে হয়ে ওঠে নার্সিসাস। ধ্বংসমুখী সেই আত্মপ্রেম।
|| ৫ ||
জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১) বেঁচে ছিলেন ৫৮ বছর, উপন্যাস লিখেছেন কুল্লে তিনটি, কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র কমেনি তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতি। ইলিয়াসের মতন তাঁরও ফেব্রুয়ারি মাসে জন্ম, আর জানুয়ারি মাসে মৃত্যু। চল্লিশ বছরের জীবনে ফ্রানৎস কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪) উপন্যাস লিখেছেন তিনটি, তার মধ্যে একটি অসমাপ্ত এবং মৃত্যুর পরে প্রকাশিত। এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ইলিয়াসের দুটি উপন্যাসও আজ ক্লাসিকের পর্যায়ে পৌঁছেছে তাদের শাশ্বত সাহিত্যমূল্যের জন্যে। প্রথম উপন্যাসটির পটভূমি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, পরে পূর্ব পাকিস্তানের গণ-অভ্যুত্থান; দ্বিতীয়টির পটভূমি ১৯৪০-এর দশাব্দে খেতমজুর আর অতীতের দিকে। “বেহেশতের কুঞ্জি” নামে একটি উপন্যাসের কিছু অংশ পাওয়া যায় তাঁর মৃত্যুর পরে, তার পটভূমি প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তী খিলাফত আন্দোলন। তাঁর রচনারীতি ব্যতিক্রমী, তাঁর দৃষ্টি নিরাসক্ত, তাঁর প্রকাশভঙ্গি উচ্ছ্বাসহীন।
১৯৭৬ সালে তাঁর তেত্রিশতম জন্মদিনে তিনি খেদ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ডায়েরিতে; যিশুর মৃত্যু হয়েছিল তেত্রিশ বছর বয়েসে, কিন্তু তার আগে তিনি তাঁর আরব্ধকর্ম সম্পন্ন করেছিলেন এবং তাঁর পুরস্কার হিসেবে ঈশ্বর তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন ও স্থান দিয়েছিলেন স্বর্গে। লেখকের নিজেরও আজ তেত্রিশ বছর বয়েস- তিনি বিবাহিত, সন্তানের পিতা, কিন্তু লেখক ও শিল্পী হিসেবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ; সত্যি কথা বলতে কী, তাঁর সক্রিয় লেখক জীবনের সূচনাই হয় নি। সেদিনের ডায়েরি শেষ করেন এই লিখে, “How does he justify his existence? Or does he have any?” কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেন নি, কলম শানিয়ে ধরেছেন নতুন উদ্যমে। পরবর্তী বছরগুলিতে ফলেছে তাঁর লেখক জীবনের সেরা ফসলগুলি। ১৯৬৯ সালে তিনি ‘চিলেকোঠায়’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন, ছাপা হয়েছিল “আসন্ন’ সাহিত্যপত্রে- এই বড়গল্পটির বিষয়বস্তু নিয়ে আবার তিনি ভাবনাচিন্তা শুরু করলেন। ১৯৭৮ সালে ‘উত্তরকাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হ’ল ‘পরিচয়’ নামে আরেকটি গল্প। সেখানেও একটি দীর্ঘতর রচনার প্রস্তুতি পর্ব। ১৯৮০ সালের জন্মদিনে তিনি ডায়েরিতে লিখলেন, “Freedom has no purpose. And it is not found on this earth. All we can find here is the struggle to obtain the unattainble. That is what separates man from beasts.”
‘চিলেকোঠার সেপাই’-এর রচনাসমাপ্তি ও প্রকাশের পরে লেখক হিসেবে তাঁর পরিণতি এবং আত্মবিশ্বাসের প্রসার। ১৯৮৮-এর জন্মদিনের ডায়েরিতে প্রকাশ পায় তাঁর জীবনদর্শন এবং সাহিত্য বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি: “To know what is right and not to do it is cowardice-- Confucius. I would rather be guilty of what I do than what I don’t.” এই উক্তিটি তিনি মেনে চলছেন তাঁর সংক্ষিপ্ত সাহিত্য জীবনে- যে কারণে অল্প পরিমাণে লিখেও ইনি কালজয়ী।
ইলিয়াসের জীবনের শেষ কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গের যে কয়েকজন লেখকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল, মহাশ্বেতা দেবী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। দুজনই রাজনীতি সচেতন লেখক, ইতিহাসকে মুখর করে তোলাই তাঁদের অভীষ্ট- দুজনের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠতে সময় লাগে নি। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ছিল মহাশ্বেতার প্রিয় উপন্যাস। তিনি চেয়েছিলেন বিভিন্ন ভাষায় উপন্যাসটির অনুবাদ হোক। নিজে উপন্যাসটির একটি পরিচ্ছেদ অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে এবং সেটি পাঠিয়েছিলেন মালয়ালম ভাষার সুখ্যাত কথাসাহিত্যিক পি. সচ্চিদানন্দকে (১৯৩৬- )। তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন উপন্যাসটি মালয়ালম ভাষায় অনুবাদের জন্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই ভাষার কোনোটিতেই অনুবাদ হয়েছিল কিনা জানি না। তাঁর দুয়েকটি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন অমর কুমার মজুমদার।
|| ৬ ||
নিম্নবর্গীয় কয়েকটি চরিত্র এই উপন্যাসের অন্যতম সম্পদ। যেমন হাড্ডি খিজির, শহুরে প্রলেতারিয়েত, সে রিকশা চালায় নিজে এবং কয়েকটি রিকশা ও একটি স্কুটারের দেখাশোনা করে। “এই লোকটি খুব লম্বা, তবে তার নামের আগের উপাধিটি অর্জন করেছে তার অস্থিসর্বস্ব দেহের জন্যে। তার হাতে সবসময় স্ক্রু ড্রাইভার ও প্লায়ার থাকে।” তার বাবাকে তা সে নিজেই জানে না, তার মা বহুভোগ্যা এবং মৃত, এ বড় হয়েছে রহমতউল্লার গ্যারাজে। তার বিবির নাম ‘জুম্মনের মা’, যাকে ত্যাগ করেছে জুম্মনের বাবা কামরুদ্দীন। জুম্মনের মাও কাজ করে সেই একই মহাজনের বড়িতে- সেখানে সে যৌন নিপীড়নের শিকার আবার তাদের সুখাদ্য সে চুরি করে আনে বাড়িতে।
খিজির বিশেষ কিছু না জেনেই এই আন্দোলনে সামিল হয়, সংগঠিত করে রিকশাওয়ালাদের। আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দীনের ডাকা সভায় সে স্লোগান দেয় মহাজনের বিরুদ্ধে। তার মা ও স্ত্রীর ওপরে মহাজনের অনাচারকে সে আরোপ করে মিলিটারি প্রশাসনের অপশাসনের সঙ্গে। সে যোগ দেয় মিছিলে, নেতৃত্ব দেয় সরকারী দপ্তরে অগ্নিসংযোগে। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ঘটে ওসমানের, ওসমান ও তার বন্ধুরা মুগ্ধ তার সরল, মুখর জীবনযাপনে। একদিন কারফিউ অমান্য করে মিছিল পরিচালনায় পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু।
কিন্তু মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসে তার ভূমিকার পরিসমাপ্তি নয়- সে আকাশে ঝুলে থাকে আর শূন্যে ভর দিয়ে হাঁটে। ওসমানকে বার করে আনে তার চিলেকোঠার কোটর থেকে, তাকে জড়িয়ে দেয় আন্দোলনে, ঘুচিয়ে দেয় তার মধ্যবিত্তের নির্মোক। মৃত খিজিরের ডাকে ওসমান তার পাতি বুর্জোয়া ধ্যানধারণা, বন্ধন আর বিচ্ছিন্নতাকে ত্যাগ করে পথে নামে, বদলে ফেলে তার শ্রেণীচরিত্র। কাহিনীর আর একটি সমান্তরাল শাখা বয়ে চলে যমুনা নদীর তীরের গ্রামে। বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিক আনোয়ার চোখের সামনে দেখে জোতদারদের অনাচার। তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক নিম্নবর্গীয় চরিত্র চেংটু- তারও মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় ধানখেতে। জাতীয়তাবাদের কাছে হার মানে শ্রেণী সংগ্রাম।
|| ৭ ||
“টেবিলের ওপরকার শূন্যতায় রানুর খোলা চুলের হালকা গন্ধ” (পৃষ্ঠা ৮০)
“শুয়ে থাকা মহিলার গলা থেকে একটানা আওয়াজ বেরোয়। কখনো কখনো তার স্বর অস্পষ্ট হয়ে এলে অনেক দূরে এবড়োখেবড়ো মাঠে গোরুর গাড়ি চলার রেশ আসে।” (পৃষ্ঠা ৯)
“যুবক অল্পবয়েসী, শরীরের চামড়া কাঁচা ও টাটকা। ৩০৩ রাইফেলের একটি গুলি তার বুককে গেঁথে রেখেছে দেওয়ালের সঙ্গে। মাথাটা বাঁদিকে ঝুলছে। বুকের নীচে তার দীর্ঘ শরীর রেলিঙে মেলে দেওয়া শাড়ির মতো আস্তে আস্তে কাঁপে…” (পৃষ্ঠা ৯)
“খিদে ভোলবার আশায় ওসমান তখন ঘরের শূন্যতার দিকে দ্যাখে। কিন্তু ঘর তার পেটের মতোই শূন্য। গুলিবিদ্ধদের খাড়া কোনো সচল কিংবা অচল মিছিল দেওয়ালের মাঝের শূন্যতাকে এতোটুকু গয়না পরিয়ে দেয় না” (পৃষ্ঠা ২১০)
এমন অনেক মণিমুক্ত ছড়ানো রয়েছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। ঢাকার পথে পথে আবেগবিহ্বল জীবন সংগ্রাম। লেখক কিন্তু সংহত- একটিও বেশি শব্দ তিনি খরচ করবেন না বর্ণনার খাতিরে।
বাইরে ঢাকা শহর যখন স্লোগানে বিহ্বল, ওসমান অথবা রঞ্জু তলিয়ে যায় তার আত্মপ্রেমের অবগাহনে। সমনামী কিশোরকে সে চুম্বনে চুম্বনে রক্তাক্ত করে, তার বোনকে প্রেম নিবেদনের বদলে। বন্ধুরা হাবে যে সে বদ্ধ পাগল- দিনের চব্বিশ ঘন্টা কেউ না কেউ তার সংগে থেকে পাহারা দেয় আর শুশ্রুষা করে। অনুরাগী সহৃদরা তাকে বন্দী করে রাখে তার ঘরে। কে তাকে উদ্ধার করবে এই মধ্যবিত্ত সাবধানতার হাত থেকে।
মৃত হাড্ডি খিজিরের প্ররোচণায় ওসমান ঘরের তালা ভেঙে বেরোয়, পথে নেমে আসে কার্ফিউয়ের দাপটে নির্জন রাস্তায়, অগ্রাহ্য করে মিলিটারিকে। “বস্তি এলাকার টায়ার আর ন্যাকড়াপোড়া লোমশ ধোঁয়ার ভিতর ঝুলতে ঝুলতে” সে হাঁটে। তার সামনে বিস্তৃত পূর্ব বাংলা- যে কোনও দিকে যেতে পারে সে- উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম। মৃত খিজিরের সঙ্গে জীবিত অথবা মৃত ওসমান গভীর রাতে নির্জন ঢাকার পথে এগিয়ে চলে- সে বিপ্লবী নয়, সে চিলেকোঠার সেপাই।