• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৪ | এপ্রিল ২০২৪ | গল্প
    Share
  • শাহ মহম্মদের টাঙা شاہ محمد کا ٹانگہ : আলি আকবর নাতিক
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়

    [আলি আকবর নাতিকের জন্ম (১৯৭৪) পাকিস্তানের ওকারায়। ম্যাট্রিক পাশ করে পারিবারিক আয় বাড়াতে রাজমিস্ত্রি হিসেবে জীবন শুরু করেন। গম্বুজ আর মিনার নির্মাণে দক্ষ ছিলেন। কাজ করতে করতেই শুরু হয় উর্দু আর আরবি ভাষায় সাহিত্যপাঠ। অধুনা পাকিস্তানের সাহিত্য জগতে তাঁকে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। নাতিক কবিতা, গল্প এবং উপন্যাসও লিখেছেন।

    নাতিকের অনেক ছোটগল্প যেন উপকথার মত। চরিত্র নির্মাণে তিনি দক্ষ। বিষণ্ণতা আর হতাশার মধ্যেও কৌতুকরস খুঁজে পান। ধর্মীয় নেতাদের প্রতি তাঁর অভক্তি চোখ এড়ায় না।

    মূল উর্দু গল্পটি লখনউ এর মেটরলিংক পাবলিশার্স প্রকাশিত ‘শাহ মহম্মদ কা টাঙা’ শীর্ষক গল্প-সংকলন (পৃষ্ঠা ৩৯ – ৫২) থেকে সংগৃহীত। লেখক স্বয়ং এবং উক্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কাজ়ি মুহম্মদ জ়াকারিয়ার কাছে আমি এই অনুবাদটি প্রকাশের অনুমতি দেওয়ার জন্য আন্তরিক ঋণ স্বীকার করছি। —অনুবাদক]

    ভাঙাচোরা দেওয়ালটায় ঠেস দিয়ে টাঙাটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। এদিকটা মাটিতে ডেবে গেছে। আর ওদিকটা একটা শুকনো গাছে হেলান দিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে। সে গাছের পাতাবিহীন ডালের ওপর বসে একটা কাক কা কা করছে। পথচলতি কেউ কেউ আমাকে সালাম আর দোয়া জানাতে ক্ষণিক দাঁড়ালেও আমি তখন আনমনা। ওই কাঠের চাকা আর বাঁশের ভাঙা কাঠামোটা আমাকে তখন তিরিশ বছর পেছনে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে।

    **************************************

    ‘লে ভাই জোয়ান,’ শাহ মহম্মদ কাঠের লাঠিটা টাঙার চাকার মধ্যে ঠেলে ঢোকাতে ঢোকাতে কথা শুরু করেছিল। ‘তখন আমি বোম্বে থাকতাম। রক্তের তেজ ছিল, যৌবনই আমাকে চালাত। গাড়িটা জাপানি, তখন সবে হিন্দুস্থানে ঢুকেছে। আমি জলদি কিনে নিলাম।’ বলতে বলতে সে লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে চাকার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেই ঘষটানিতে গর-গর শব্দ করে ঘোড়াটা জোরে এগিয়ে চলল। ‘আর আমি বোম্বের রাস্তায় গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। মিয়াঁ, জোয়ান রক্ত শরীরে বইলে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। কোথায় ঢিবি আর কোথায় গর্ত খেয়াল থাকে না। সে রক্ত রগের মধ্যে দিয়ে শরাবের মত দৌড়োয়। আর আমার সে দিনগুলো যে কীরকমই না ছিল! গোলাপি গায়ের রঙ আর ভাগ্যের জোরে হাতে এসে গেল একটা গাড়ি। গাড়িতে চড়ে রাস্তায় বেরোলে লোকে ধারে সরে যেত। বলত…ভাই! আড়ালে যাও…আড়ালে! শাহ মহম্মদ সাক্ষাৎ নসিবের মত পথে বেরিয়েছে। সে সব দিনে মোটর গাড়িতে সওয়ারি নেওয়া শরমের ব্যাপার ছিল। তাই একলাই ঘুরতাম। বোম্বের ট্র্যাফিকের ব্যস্ততা তো আপনি জানেন! কিন্তু আমি বললাম…শাহ মহম্মদ, দেখি ভিড়ের রাস্তায় তুই কেমন হাওয়ার বেগে উড়তে পারিস! কিছুদিনের মধ্যেই সার্কাসের কেরামতি দেখানোর হিম্মত যাদের থাকে তাদেরও পেছনে ফেলে দিলাম।’

    আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতাম, ‘তা হলে চাচা! আপনি কি গাড়ি নিয়ে সার্কাসের খেলা দেখাতেন?’

    ‘ও মেরে ভাতিজে!’ শাহ মহম্মদ চাবুক মেরে ঘোড়ার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। ‘সার্কাসের কথাটা তো আমি নজির হিসেবে বললাম। ওই স্টান্টম্যানদের সঙ্গে আমার রিস্তাই বা কী? সে বেচারিরা তো পেট ভরানোর জন্য ওই ধান্দা করে। রুজিরুটি জোগাড়ের জন্য মৃত্যুর দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যায়। তুমি তো জানো না, কিন্তু আল্লাহ্‌র কৃপায় তোমার দাদু আমার বাপকে চিনতেন। আমরা বহু পুরুষ ধরে নবাবের বংশ। এই হাত দুটো দিয়ে লাখ লাখ টাকা মচ্ছব-তামাশায় খরচ হয়েছে। যাক সে কথা! জাপানি গাড়ি বোম্বের সড়কে ছুটিয়ে এতটাই এক্সপার্ট হয়ে গেলাম যে বড় ট্রেলারের তলা দিয়ে বেরিয়ে যেতাম। ঠিক যেন ভূত উড়ে যাচ্ছে! বোম্বেতে আমি মার্কামারা হয়ে গেলাম।’

    কান খাড়া করে শুনছি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেটা কীভাবে করতেন চাচা শাহ মহম্মদ?’

    ‘হা-হা-হা-হা!’ শাহ মহম্মদ তার গোঁফজোড়ার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে আর ঘোড়ার পিঠে চাঁটি মারতে মারতে বলত, ‘তুই জোয়ান, এটা তুই বুঝবি না। চুপ করে শুধু শুনে যা। এক দিন ঘটল এক আজব ঘটনা। আমি তো কার ছুটিয়েছি – এমন সময় খোদার কী শক্তি দেখো, সেদিনই আমার গাড়ির ইস্পিড একটু কম ছিল। সড়কের ধারে একজন জখম হয়ে এই যায় যায়। তবু পালাচ্ছে। মনে হচ্ছিল এখনই মুখ থুবড়ে পড়বে। তার পেছন পেছন পুলিশ হুটার মারতে মারতে তাড়া করেছে। ভাবলাম বেচারা মরে যাবে – একটা মানুষের ভালো করি। জলদি গাড়িটা তার পাশে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে বললাম…ঝটপট উঠে আয় ভাই। তা সে যেই গাড়িতে উঠেছে, আমি দিলাম অ্যাক্সেলেটরে চাপ।’

    শাহ মহম্মদ ঘোড়াটাকে আবার চাবুক মারল। ‘তো তখন পেছনে পুলিশ আর তাদের হুটার আর সামনে আমি। সে বান্দা তো খুবই ভয় পেয়েছে। এই বুঝি ধরা পড়ে! গাড়লটাকে কেই বা জানাবে সে কার পাশে বসে আছে! সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি তো জানতাম বোম্বে পুলিশের দৌড়! এক শো বছরের ট্রেনিংয়েও আমাকে ছুঁতে পারবে না। হাঘরে বেচারা কতগুলো সেপাই, রুটিরুজির ধান্দায় ফেঁসে গেছে। এরা আমার মোকাবিলা করার জন্য তৈরি থোড়ি! তো তখন ছিল বোম্বের খালি সড়ক, আমার গাড়িটা আর তার পেছনে দশ-দশটা পুলিশের গাড়ি। আমি চলতে চলতে পুছলাম…ভাই, কী লফড়া করে পালাচ্ছ যে এতগুলো গুণ্ডা তোমার পেছনে? …সে শান্তভাবে বলল…শেঠ ভীমদাস খতরির সিন্দুক লুট করেছি। উনি চাকু মেরেছিলেন, এখন তো বেশ ফেঁসে গেছি। ধরা পড়লে ফাঁসিকাঠে তো চড়তেই হবে। …আমি তো তাজ্জব বনে গেলাম। হায়, মুর্দা যেন আল্লাহ্‌র দয়া পায়!’

    ‘ভীমদাস খতরি কোটি টাকার মালিক। পুরো বোম্বেতে তার সুদের কারবার চলত। তার সিন্দুক লুট করার মানে এক রাতেই শেঠ বনে যাওয়া। আমি জিজ্ঞেস করলাম…কিন্তু তোমার হাত তো খালি দেখছি? …বলল…এই এক্ষুনি চন্দ্রা খেম পুলের নিচে ফেলে দিয়ে এলাম। ব্যস, একবার এই হারামজাদাগুলোর হাত থেকে যদি বাঁচিয়ে দাও, তা হলে তোমাকেই আমির করে দেব!…আমার রাগ তো খুবই হচ্ছিল, এই ভেবে যে আমাদের মত নবাবদের ধনী বানানোর এ কে? কিন্তু সে কিছু বোঝেনি দেখে রাগ ঝেড়ে ফেলে অ্যাকসেলেটরে পায়ের চাপ এমন বাড়িয়ে দিলাম যে গাড়ি দৌড়োনোর বদলে উড়ে চলল!’

    এই সময় এক দল ছাগল রাস্তা দিয়ে যাওয়ায় শাহ মহম্মদ ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল। তার গল্প বলাও বন্ধ হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আর এই রাখালগুলো, খোদাই জানেন, নিশ্চয়ই ভুঁইকাঁপের মধ্যে জন্মায়। যেখান দিয়ে যাবে সব নষ্ট করে দেবে। সড়ক তো ওদের বাপের, ওখানে তাদের নামও লেখা আছে! দেখো, কাঁধে লাঠি নিয়ে কেমন সুখে চলেছে। যেন নাদির শাহের শালা!’

    শাহ মহম্মদ রাখালদের আওয়াজ দিল, ‘আরে ভাই, জলদি কর! এই ঘোড়াটা পাগলা কুকুরের মত। ছাগেদের তাড়াতাড়ি ছোটা। উফ্‌, খোদাবন্দ, এ কী শয়তান ছাগলের দল!’ রাখাল যেন শাহ মহম্মদের আওয়াজ শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে তেমনই নিজের সম্মান নিয়েই একদম সড়কের মাঝখান দিয়ে চলতে লাগল।

    যেন কয়েক শতাব্দ ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে – কিন্তু শাহ মহম্মদ অপেক্ষা করা ছাড়া আর কীই বা করতে পারত? আমি গল্পটা শোনার জন্য অধৈর্য হয়ে পড়লেও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলাম। খোদার নাম নিতে নিতে শেষমেশ যখন টাঙাটা বেরিয়ে যেতে পারে এমন জায়গা পাওয়া গেল, তখন শাহ মহম্মদ খোদাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার ঘোড়াটাকে চাবুক মারতেই টাঙার গতি বেড়ে গেল। আর তখন আমিও বলার সুযোগ পেলাম, ‘চাচা, তারপরে কী হল?’

    ‘ইয়ার, এই রাখালটা তো গল্প বলার মজাটাই নষ্ট করে দিল। যাই হোক, আমি তো বলছিলাম যে যদিও চোরটার ওই কথা শুনে আমার খুব রাগ হয়েছিল, তবু এটা মনে করে নিজেকে সামলে রেখেছিলাম যে লোকটা অবুঝ, ছেড়ে দাও। জানি না গাড়ি কত মাইল ইস্পিডে ছুটছিল, মিটারের কাঁটার ওপর তো আর আমার নজর ছিল না, চাকা কখনও জমিতে, কখনও বা হাওয়ায় ভাসছিল। আর ঠিক সেই সময় আমাদের সামনে বাহাত্তর ইঞ্চি চাকার দুটো ট্রাক এসে পড়ল। একটা ডানদিক থেকে, আরেকটা বাঁদিক থেকে। তখন অবস্থাটা হল পেছনে পুলিশ, সামনে ওই ট্রাক, আর রাস্তা সরু। আমি বললাম…নে ভাই শাহ মহম্মদ, এই সময় তোর ইজ্জত বাঁচানোর। আর আরেকজনের ঝামেলা তুই ঘাড়ে নিয়েছিস, জান গেলেও ওকে পালাতে সাহায্য কর। লো জি, আমি ঝটপট ফয়সালা করে নিলাম। ওকে বললাম…কাকা…সাহস করো, শক্ত করে ধরে রাখো, আর আমি একটা চলন্ত ট্রাকের তলা দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে ট্রাকের সামনে চলে এলাম!’

    ‘ট্রাকের নিচ দিয়ে? চলন্ত ট্রাকের তলা দিয়ে? উফ্‌, মেরে আল্লাহ্‌!’ আমার চেহারায় আশ্চর্য হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। ‘যদি ট্রাকের তলায় পিষে যেতে তা হলে?’

    ‘হা-হা-হা-হা! বেটা এই সব কাজ তো হুঁশিয়ার হয়ে এলেম নিয়ে করতে হয়।’ শাহ মহম্মদ গর্বে বুক ফুলিয়ে বলল। ‘পলকের হিসেব রাখতে হয়। এক লহমার ভুলচুকে বান্দা আল্লাহ্‌র হয়ে যেতে পারে!’

    ‘যাই হোক, আরও শোন! ট্রাক পেরিয়ে দেখলাম আগে রাস্তাই নেই। লম্বা, গভীর খাল একটা। আশ্চর্য! সেখানেও ঝাঁ করে বুদ্ধি কাজে লাগালাম। মিনিটের হাজার ভাগের এক ভাগে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিলাম। ব্যস, এটুকু বুঝে নাও যে তখন সুলেমান পয়গম্বরের চেয়েও ফটাফট কাজ করেছি – যিনি চোখের পাতা ফেলার আগেই বিলকিস্‌-এর সিংহাসন উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আমার সেই তেজি ভাবের জন্য হল কী গাড়িটা তখন ডানদিকের দুটো চাকার ওপর দাঁড়িয়ে। খালে গিয়ে পড়ার থেকে তো বেঁচে গেলাম, কিন্তু স্কুটারের মত এক দিকের চাকার ওপর ভর রেখেই গাড়ি তো এগিয়ে চলল।' শাহ মহম্মদ জোরে হেসে উঠল। ‘ভাই, ওখানে সে তো দেখার মত এক ঘটনা! তামাশা দেখার জন্য বোম্বাইয়ের মানুষ সব রাস্তার ধারে এসে জমা হয়েছে। ঘোড়াকে চাবুক মেরে আরও জোরে দৌড় করাচ্ছে তখন শাহ মহম্মদ।…আমি ভাবলাম বিপদটা আমাদের জানের, কিন্তু এরা তো মজা লুটছে। গাড়ির গতি তখন এমনই যে বেচারা মিটারের কাঁটাটা পাগলের মত কাঁপছে। গাড়িটা চার চাকার ওপর চললে তো আলবাত উল্টে যেত। আমি ভাবলাম গাড়িটা এভাবেই চলুক। সে বেহায়াটা একবার বলল…ভাই, এটাকে সোজা করো, না হলে আমরা মরে যাব।…আমি সঙ্গে সঙ্গে ডাঁট দেখিয়ে বললাম…চুপ কর হারামজাদা! যে কাজের কিছু জানিস না, সেই কাজের মাঝে কথা বলিস না!…গাড়িটাকে ওইভাবে দু-চাকার ওপর চালিয়ে তিন মাইল এগিয়ে গেলাম। আমরা যেন ভূতের মত মিলিয়ে গেলাম। নওজোয়ান, সে সব কী দিন ছিল! আর আজ আরেকটা দিন, যখন একটা রাখালও আমাকে রাস্তা ছাড়ে না!’ শাহ মহম্মদের কথা তখনও শেষ হয়নি, আমার গ্রাম এসে গেল। সে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘নে নওজোয়ান, বাকি কিস্‌সা কাল হবে।’ লাফ দিয়ে আমি টাঙা থেকে নিচে নেমে এলাম।

    এই শহরেই আমার বাস। ইসলামিয়া হাই স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বাজতেই বেরিয়ে গেটের বাইরে চলে আসতাম। সেখান থেকে পঞ্চাশ কদম ফেললেই ভেনাস চক, সেটা পেরিয়েই টাঙা স্ট্যান্ড। তারপরে শাহ মহম্মদের টাঙার সামনের সিটে জমিয়ে বসতাম। সওয়ারি কম থাকলে স্ট্যান্ডে বেশ খানিক অপেক্ষা করতে হত। টাঙা স্ট্যান্ডের ছাদটা চারটে খালকে ঢেকে ছিল। কাঠের বিম হুক দিয়ে জুড়ে ওপরে নলখাগড়ার খড় বিছিয়ে তৈরি ছাদ। সেই ছাউনি মাথার থেকে সামান্য উঁচু ছিল। অর্থাৎ টাঙার ওপর বসে হাত তুললে সহজেই ছুঁতে পারা যেত।

    গরমের দিনে থামগুলোতে সুগন্ধি খড় ঝুলিয়ে জল ছিটিয়ে দেওয়া হত। ঘোড়াগুলো ঠাণ্ডা বাতাস পেত। বাইরে বইতে থাকা লু ভেতরে ঢুকত না। তাই সে জায়গাটা খুবই নিস্তব্ধ, শান্তির সরাইখানা বলে মালুম হত যেখানে কখনও ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, কখনও বা পাখিদের উড়ে যাওয়ার ফড়ফড় শব্দ পাওয়া যেত। পাখিরা ওপরের বিমগুলোর মধ্যে দিয়ে উড়ে বেড়াত। তিন-চারটে হোটেলও ছিল। হোটেলের ভিসিআরে ইন্ডিয়ান উর্দু আর পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ফিল্ম দেখানো হত। কোচোয়ানরা সেখানেই কড়া চা খেতে খেতে এক টাকার টিকিট কেটে সিনেমা দেখত।

    এমনিতে তো টাঙা স্ট্যান্ড পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হত। তাও ঘোড়ার মলের হালকা গন্ধ এমনভাবে ছেয়ে থাকত যে বাইরের কেউ গেলে তার অসহ্য লাগত। কিন্তু কোচোয়ান, হোটেলের লোকজন আর প্রতিবেশীদের কাছে সেই গন্ধটাই যেন ছিল মনের শান্তি। চা-খাবার খেতে খেতে তারা সেটা উপভোগ করত, অন্য কোথাও চা খেলে আনন্দে যেন কম পড়ত। খুবই ছোট, সস্তার সে হোটেলগুলো হালকা আঁধারে ঢাকা, তাদের মেঝে জমির দুফুট নিচে। হোটেলের দেওয়াল আর ছাদ ঝুলকালির এমন পুরু আস্তরণে ঢাকা যে যত উজ্জ্বল বাতিই লাগানো হোক না কেন, আঁধার কাটত না। কেরোসিন তেলের চুল্লির ধোঁয়া যেন প্রতিটি নতুন দিনে অন্ধকার আর ঝুলকালি আরও বাড়িয়ে দিত। হোটেলের দেওয়ালে হেমা মালিনী, নুর জাহান, দিলীপ কুমার, আরও কত অভিনেতাদের ছবি লাগানো ছিল! তারও পরে ছিল কোরানের আয়াত, আব্দুল কাদির জিলানি আর অন্যান্য মৌলানা-ইমামদের পোস্টার। সে সবই ধোঁয়ার ঝুলকালিতে ঢাকা। হোটেলের মালিকরা ওই সব ছবি লাগিয়ে যেন ভুলে গেছে। মুসলমান ধর্মীয় নেতাদের পোস্টারগুলো যে অন্তত পরিষ্কার রাখা উচিত তাও তারা ভাবেনি। সব কোচোয়ান আশপাশের গাঁ থেকে সওয়ারি এনে শহরে ছেড়ে দিত। টাঙা আবার না ভরা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করত। স্ট্যান্ডে বিশ-পঁচিশটা টাঙা সব সময় থাকত। আর আস্তাবলে বাঁধা ঘোড়াগুলো চোখ বুঁজে দানাপানি খেত। কোনও ঘোড়া হয়ত কোচোয়ানরা আবার তাদের টাঙার সঙ্গে যুতে না দেওয়া পর্যন্ত সাধুর মত মাথা নিচু করে ধ্যান করত। আস্তাবলে বিশ ফুট লম্বা তিন ফুট চওড়া জলের ট্যাঙ্কও ছিল। কোচোয়ানরা যেমন একে অন্যকে চিনত, ঘোড়াগুলোও তেমনি যেন অন্য ঘোড়াদের সঙ্গে পরিচিত। কোনও ঘোড়া সওয়ারি নিয়ে বেরিয়ে গেলে পাশের ঘোড়াটা কান উঁচিয়ে হালকা চিঁহি চিঁহি রবে তাকে বিদায় জানাত।

    শাহ মহম্মদ আমারই গ্রামবাসী। যখন শহরের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হল তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তারই টাঙায় চড়ে আমি যাতায়াত করব ঠিক হল। টাঙায় চড়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করছি বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল। সেই সময় তার জীবনের যে সব কাহিনি শাহ মহম্মদ আমায় শুনিয়েছিল তাতে তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। প্রতিটি ঘটনাই কোনও না কোনও বড় শহরের। সে যে কখন ওই সব শহরে ঘুরে বেড়াল তা কেউ জানত না। গত পনেরো বছর তো সে এই টাঙা স্ট্যান্ড থেকেই গাড়ি চালায়। তবে গল্পগুলো এমন আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে শোনাত যে বিশ্বাস না করে উপায় থাকত না। শাহ মহম্মদ বাঁশের সঙ্গে লাগানো সেই তক্তাটার ওপর বসত যা সব টাঙায় চালকের বসার জন্য থাকে। সিটে বসার ভাগ্য তার কমই হত। কিন্তু আমার খুব রাগ হত যখন টাঙায় যাত্রী বেশি হলে আমি বাচ্চা বলে সে আমাকে ঘোড়ার পিঠে হাওদার ওপর বসিয়ে দিত। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে গল্প বলতে শুরু করলে অবশ্য আমি নিজের বেইজ্জতির কথা ভুলেই যেতাম। সে শহরে সেটাই আমার প্রথম বছর, আর দ্বিতীয় সালটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সময়টা কেটেছিল দারুণ।

    স্কুলে খুব কমই গরহাজির হতাম। এমন নয় যে লেখাপড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শাহ মহম্মদের কিস্‌সা শোনার এমন বদ অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল যে পরদিন সকালের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকতাম। বাড়ির লোকেরা ভাবত আমি বোধহয় খুব মনোযোগী ছাত্র হয়ে উঠেছি। টাঙা চালকের সে সব কাহিনি বইয়ে পাওয়া না গেলেও ছিল রোমহর্ষক – যার উৎস বিভিন্ন শহর আর দেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা।

    ঘটনাবলীর নকশা সে এমনভাবে আঁকত যে আমার চোখের সামনে সব ভেসে উঠত। শৈশবেই সে অনেক শহর চিনেছিল। আমি শাহ মহম্মদের দক্ষতাকে ঈর্ষা করতাম। এত রকম কাজ করার পরে সে আজ এখানে টাঙা চালাতে এসেছে! কিন্তু তৃতীয় বছরে আমার সেই আকর্ষণ হারিয়ে গেল। বাড়িতে হাত-পা ছুঁড়ে আবদার করে একটা সাইকেল কিনে ফেললাম। ম্যাট্রিক পর্যন্ত সেই সাইকেল চড়েছিলাম। সুবিধে হল এই যে শহরের সব গলিঘুঁজি চেনা হয়ে গেল। বিশেষ করে বসন্তকালে রাস্তার ধারের গাছের ছায়ায় সাইকেল চালিয়ে ঘোরা আমার কাছে ছিল স্বর্গে ভ্রমণের সমান। কোম্পানি বাগ, পেহেলবানোঁ কা বাগ, স্টেডিয়াম আর দোআবা নহর থেকে শুরু করে হিরা মাণ্ডি পর্যন্ত যাওয়া – এসবেরই ক্রেডিট পাবে আমার সাইকেলটা। তাই তখন টাঙা স্ট্যান্ডে খুব কমই যেতাম। একবার বাড়ি থেকে চারপাইয়ের দড়ি কিনে আনতে বলেছিল। দড়ির দোকানগুলো সব টাঙা স্ট্যান্ডের আশপাশে হওয়ায় আমাকে সেখানে যেতে হয়েছিল। অনেকবার ঠাকুর্দার হুঁকোর ছিলিমও সেখান থেকে কিনেছিলাম। পরে ম্যাট্রিক পাশ করেই গ্রামকে বিদায় জানিয়ে শহরে এসে বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। আগে গ্রাম থেকে শহরে যাবার সময় টাঙার সঙ্গে সাইকেলটাকে বেঁধে নিতাম। এখন সে সম্পর্কও চুকে গেল। পরের দুবছর বোধহয় বার দুয়েকই শাহ মহম্মদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

    নতুন বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে বছরগুলো ঝড়ের মত কেটে গেল।

    এফ.এ. পাশ করে গ্র্যাজুয়েশনের জন্য লাহোরে চলে এলাম। তখন দু-চার মাস পর পর বাড়ি যেতাম। সেই সফরগুলোর সঙ্গে শাহ মহম্মদের টাঙার কোনও সম্পর্ক ছিল না। কারণ গ্রাম ছিল দুটি শহরের মধ্যে যোগাযোগের সড়ক থেকে তিন মাইল দূরে। সে সময় যোগাযোগের সড়কের ওপর অনেক বাস চলা শুরু হয়ে গিয়েছিল – যদিও আগে মাত্র দু-তিনটে বাসই চলত। বাস থেকে নামা যাত্রীদের গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকটা টাঙা দাঁড়িয়ে থাকত। আমিও সেই টাঙায় চেপেই গ্রামে যেতাম। এইভাবে আরও দুবছর কাটলেও শাহ মহম্মদের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।

    এর পরে যখন গ্রামে ফিরলাম, তখন বসন্ত। গাছের শাখাপ্রশাখা ছোট ছোট সবুজ পাতায় ভরে উঠছে। ইচ্ছে হল একবার শাহ মহম্মদের টাঙায় চড়ে সফর করি। যে শহরে থাকতাম সেখান থেকে গ্রামে যাবার জন্য সোজা টাঙা স্ট্যান্ডে এলাম। কিন্তু স্ট্যান্ডে ঢুকতেই ধাক্কা! চার-ছটা টাঙা ছাড়া বাকি সব স্কুটার-রিক্সা! ফাটা সাইলেন্সার আর ইঞ্জিনের কান-ফাটানো আওয়াজে মনে হচ্ছিল যে স্ট্যান্ডের ছাদটাই বুঝি উড়ে যাবে। সেই অনাসৃষ্টির মধ্যে বেচারা ঘোড়াগুলো ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে। কত দ্রুতই না সব কিছু বদলে যাচ্ছে!

    মনটা দমে গেল। হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তারপরে সাহস করে এগিয়ে গেলাম। নিশ্চিত ছিলাম শাহ মহম্মদকে সেখানে পাব। স্ট্যান্ডের চারপাশ পরখ করে নিলাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই শাহ মহম্মদের টাঙা নজরে এল – তার প্রতিটি কলকব্জা যে আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। টাঙার অবস্থা খুবই খারাপ হলেও চিনতে কোনও অসুবিধে হয়নি। তবে আগের সেই ঘোড়াটা আর ছিল না। টাঙাটাকে দেখে অদ্ভুত আনন্দ হল। আমি সোজা সেই হোটেলটার দিকে এগিয়ে গেলাম যেখানে তার থাকার কথা। ঢুকতেই শাহ মহম্মদ আমাকে দেখতে পেয়েই লাফ দিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরল। এমনভাবে আলিঙ্গন করল যেন বহুদিনের হারানো সাথীকে সে আবার খুঁজে পেয়েছে।

    ‘ভাইপো, কতদিন দেখা নেই। তুমি বোধহয় ভেবে নিয়েছিলে যে শাহ মহম্মদ মরে গেছে? মানছি, শহুরে বাবু বনে গেছ, কিন্তু খবরাখবর নিতেও তো মানুষ আসে! তা হলে তো অন্তত বুঝবে যে আমিও বেঁচে আছি। আমিও অনেক বড় বড় শহরে থেকেছি, কিন্তু তুই পুত্তর – তোর মুখটাও তো দেখাস না! কয়েকবার শুনেছি যে তুই গ্রামে এসেছিস, কিন্তু দেখা না করেই চলে গেছিস। আমি ভাবছিলাম ভাতিজা তো এমন ছিল না, কে জানে কী ব্যাপার?’

    শাহ মহম্মদ বলে চলেছিল আর আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম। বাঁচার জন্য বললাম, ‘কাকা, অন্য কথা পরে হবে, আপনার যা মনে হয় বলবেন। এখন বাইরে গিয়ে ঘোড়ার জিন-রেকাব লাগান যাতে আমরা গ্রামের দিকে রওনা দিতে পারি। আপনার যা অভিযোগ আর নালিশ আছে, টাঙায় চড়ে শুনব।’

    ‘একটু চা তো খেয়ে নে,’ বলে শাহ মহম্মদ চা-ওয়ালার উদ্দেশে চেঁচাল, ‘ভাই, এক কড়ক দুধ পাত্তি বনা দে! আজ অনেক দিন পরে ভাইপো স্ট্যান্ডে এসেছে।’

    ‘না, না, আপনি জানেন আমি চা খাই না।’ আমি মানা করলাম।

    ‘আও, বৈঠ পুত্তর!’ ম্লান আলোয় জবরদস্তি লকড়ির বেঞ্চের ওপর বসিয়ে হোটেল মালিককে আবার হাঁক দিল।

    হোটেলের অবস্থা দেখে ভয় হল। এটাকেও ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে সব হোটেলগুলোর জায়গায় কংক্রিটের একটা বড় প্লাজ়া তৈরি হবে না তো? সেখানে হয়ত চায়ের বদলে কোল্ড ড্রিংকস্‌ আর পিৎসা বিক্রি হবে। আর এই কাঁচা-পাকা, ধোঁয়ায় ধূসর, পৌরাণিক দেওয়ালে যে ধর্মীয় আর ফিল্মি পোস্টার লাগানো আছে তার বদলে হয়ত ঝুলবে আধুনিক ফ্লেক্স! ভাবতেই মাথা ঘুরতে শুরু করল। তবে চায়ের নতুন পেয়ালাটা তাড়াতাড়ি এসে যাওয়ায় তাতে চুমুক দিয়েই ওই সব দুশ্চিন্তাকে একদম ঝেড়ে বিদায় করে দিলাম।

    স্ট্যান্ডের বাইরে আসতেই শাহ মহম্মদ আবার নালিশ শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ শুনে শেষমেশ বললাম, ‘চাচা, কাজকর্মে ঢুকে গেলে কোনও সময়ই আর মেলে না। অনেক বার আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসব ভাবলেও সময় হয়ে ওঠেনি। আজ ভাবলাম, যাই হোক, চাচা শাহ মহম্মদের টাঙায় চড়েই যাব। যাকগে, টাঙার খবর বলুন। কেমন চলছে? আমি তো স্ট্যান্ডের অবস্থা দেখে কষ্ট পাচ্ছি।’

    ‘বেটে, স্ট্যান্ডের হাল আর কী বলব?’ শাহ মহম্মদের গলার স্বরে হতাশা। ‘খোদার অভিশাপ যেন ওই তিন চাকার ফটফটিগুলোর ওপর পড়ে। স্ট্যান্ডের কথা তো বাদই দাও, ওরা সারা শহরের শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে। আল্লাহ্‌ জানেন কোন শয়তান স্কুটারের পেছনে লোহার পিপে বেঁধে এই ডাইনিটাকে বানিয়েছিল। এখন যেদিকে তাকাও শয়তানের এই ডিবেটি দৌড়োচ্ছে! এদেরই জন্য কসম খেয়ে বলছি, আমি কানে একদম কালা হয়ে গেছি। কিছুই শুনতে পাই না। একদিকে তেল আর ধোঁয়ার বদবু, ফুসফুস আর কলজের ওপরেও কালির পরত পরে যাচ্ছে। ওদের কারণে কালী দেবী সম্পর্কে আগে যা শোনা যেত, এখন তার ছায়া গোটা শহরের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাফসুতরো শহর নোংরা হয়েছে। আর শান্তি তো যা নষ্ট হওয়ার হয়েছেই, জান যাওয়ারও ভয় আছে।

    ‘জান যাওয়ার ভয় কেন?' আমি শাহ মহম্মদকে একটু উসকে দিলাম।

    ‘নে ভাই, তুই এমনভাবে কথা বলছিস যেন কিছুই জানিস না।' শাহ মহম্মদ এবার জমিয়ে গল্প শুরু করল। ‘রোজ এরা অ্যাকসিডেন্ট করে। হামেশা এমন হয় যে একটা তাজা, সবল মানুষ ঘর থেকে বেরোল, তারপরে তাকে পাওয়া গেল হাসপাতালে। কারণ জিজ্ঞেস করলে স্কুটার-রিক্সার নাম নিয়ে চুপ করে যাবে। এখনই বড় হাসপাতালে গিয়ে দেখো, যারা শুয়ে আছে তাদের আদ্ধেক এই কারণেই জখম হয়েছে। সরকারের স্টকে পটি-ব্যাণ্ডেজ কম পড়ছে আর হাড় জোড়ার ডাক্তাররা ধনী হয়ে যাচ্ছে।'

    'এত অ্যাকসিডেন্ট কীভাবে হচ্ছে?' আমি শাহ মহম্মদের যুক্তিকে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

    শাহ মহম্মদ এবার একদম বিদ্রূপের স্বরে বলল, ‘এর কারণ হল যারা ঠিক করে সাইকেলও চালাতে পারে না, তারাই এই বেচারিগুলোকে কিনেছে সওয়ারিদের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য। কারও টায়ার খুলে গেল, কারও চেন ভেঙে গেল, রাস্তার মাঝখানে ভেঙে পড়ে রইল। ভাই, আল্লাহ্‌ যেন আমাকে মাফ করেন – দেখে মজাও লাগে। এমন ভাবে টলতে থাকে যেন কফিন ওপর থেকে পড়ে গেছে। প্রায়ই তো ওদের অ্যাকসিডেন্টের জন্য আমার ঘোড়াটা ভয়ে পেয়ে যায়। এখন তো স্কুল থেকে ভাগিয়ে দেওয়া বারো-তেরো বছরের কমবখত ছোকরারা – যাদের এখনও মুখ টিপলে দুধ বেরোয় – ওই ফটফটি জুতে নিয়েছে। সে একদিন ছিল যখন লাহোরে ছিলাম আর আমার হোন্ডা স্কুটার ছিল। এমন উড়োজাহাজের মত চালাতাম যে দশ-দশটা গাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে বেরিয়ে যেতাম। সেটা যেন একটা হাওয়াই মিসাইলের মত উড়ত!'

    শাহ মহম্মদ তার পুরোনো অভ্যেসের মত গল্প ফেঁদে বসল।

    ‘সেটা কীভাবে হত?' আমি শোনার আগ্রহ দেখালাম।

    টাঙা ততক্ষণে শহর থেকে বেরিয়ে খোলা সড়কের ওপর দিয়ে চলেছে। শাহ মহম্মদ ঘোড়াটাকে বেতের একটা বাড়ি মেরে কথা শুরু করল। ‘একদিন তখন আমি স্কুটারেই বসে। স্কুটার তখন নতুন মিটারে জ়িরো দেখাচ্ছে। শুধু হাতের ইশারা করলেই উড়তে শুরু করত। আমি ধীরেই চলছিলাম। এমন সময় দেখি উল্টো দিক থেকে দশ-বারোটা ছেলে স্কুটার উড়িয়ে নিয়ে আসছে। সামনের চাকা হাওয়ায় তুলে ঝনাঝন আওয়াজ করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মনে হল তারা আমাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করছে। ব্যস, তখনই আমারও মিটারের কাঁটা পুরো ঘুরে গেল। বললাম…নে ভাই শাহ মহম্মদ, তুইও ওদের কেরামতি দেখিয়ে দে!… সঙ্গে সঙ্গে স্কুটার ঘুরিয়ে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ওদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। তারপরে চেঁচিয়ে বললাম…নে ভাই, তোদের মধ্যে কেউ যদি বাপের বেটা হোস, তো আমাকে ধরার চেষ্টা কর।… ব্যস, তখনই দৌড় শুরু হয়ে গেল। স্কুটার যেন হাওয়ার সঙ্গে উড়ছে।' শাহ মহম্মদ হেসে বলল, ‘হারামিগুলোর এলেম ছিল, কখনও আমার পেছন থেকে কখনও সামনে দিয়ে কেটে বেরিয়ে যাচ্ছিল!'

    'ওরা তো চাইছিল বেইজ্জতির বদলা নিতে। এদিকে আমিও ইস্পিড তুলে নিজেকে বাঁচিয়ে ওদের কেটে বেরিয়ে যাচ্ছি। মনে করো সেই সময় আমরা সব একেকটা ইজ়রায়েলের১ চাচা! বেচারা মুসাফিরদের কথা তো ভুলেই যাও, আমাদের সামনে যদি ষাঁড়ও এসে পড়ত, মরে যেত। সেই শয়তানি রেসের কারণে ফিরোজপুর রোডের পুরো ট্র্যাফিক রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কেউ স্কুটারের ভয়ে ফুটপাথের ওপর উঠে পড়ল, কেউ দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে গেল। তাদের অবস্থা দেখে আমার হাসিও পাচ্ছিল। আমি কখনও সামনের চাকা হাওয়ায় উঠিয়ে দিচ্ছি, কখনও পেছনের চাকাটা তুলে দৌড়োচ্ছি। অদ্ভুত ভেল্কিবাজির নেশা তখন আমাদের ওপর চেপে বসেছে। ওইভাবে চলতে চলতে মুসলিম টাউনের খালের কাছে পৌঁছে গেলাম। খোদার কৃপা এমনই যে তখন সেই খালের ওপর পুল তৈরি হচ্ছিল। অনেক মেশিন আর মজদুরেরা সড়ক আটকে দাঁড়িয়ে। মজদুররা তো আমাদের আসতে দেখেই পালাল, কিন্তু মেশিনগুলো যাবে কোথায়? ওই দেখে ছেলেগুলো সব স্কুটার থামিয়ে দিল। কিন্তু আমি মনে মনে বললাম…শাহ মহম্মদ, এখানে থামলে তো তোর বেইজ্জতি হবে। ব্যস, আমি স্কুটারটাকে ডান দিকে ঘুরিয়ে অ্যাকসেলরেটরে জোরে চাপ দিলাম। স্কুটার খালের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়িয়ে গেল। উড়তে উড়তেই হাতের ইশারায় ওদের বললাম…বেটা, সাহস থাকে তো আমার পেছনে আয়! ব্যস, আমি বেরিয়ে গেলাম আর ওরা শরমে মুখ লুকিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। এখন এই কিছু রিক্সাওয়ালা আছে যাদের গাধায় টানা গাড়ি চালানোরও যোগ্যতা নেই – কিন্তু তারা আমার ঘোড়াটাকে ভয় দেখাতে ছাড়ে না। কী আর বলব মিয়াঁ, কেয়ামতের দিন এল বলে!'

    ‘যদি ওদের এতই অ্যাকসিডেন্ট হয়, তা হলে সওয়ারিরা ওদের গাড়িতে বসেই বা কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    ‘মিয়াঁ, যদি আধুনিক যুগের আক্কেল থাকত, তা হলে কি স্কুটারের পেছনে ডাব্বা বেঁধে রাখে? যদি জাপানিরা এসে দেখত যে এই হারামজাদাগুলো তাদের স্কুটারের কী হাল করেছে, তা হলে খোদার কসম, তারা এদের নিশ্চয়ই টানতে টানতে আদালতে নিয়ে যেত। সারা জীবন জেলের সঙ্গে জরিমানাও করাত। এবারে আমাকে বল, এটা কেমন বিচার? যে জিনিসটা একজনের জন্য বানানো হয়েছিল, সেখানে তুমি বিশজনকে চড়িয়ে দিচ্ছ? আসলে এই দেশের হাওয়াটাই উল্টোপাল্টা, এখানকার লোকজন শুধু ঘাস খায় – তাই তাদের মাথাটা গোবরে ভরা।’

    ‘চাচা, এ তো খুব খতরনাক ব্যাপার তা হলে! তোমরা সব কোচোয়ানরা এই রিক্সাগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে না কেন? এমনও তো হতে পারে আগামী দিনে এই পুরো স্ট্যান্ডটাই তাদের কব্জায় চলে গেল? এদের উচিত অন্য কোথাও গিয়ে তাদের ফটফটির স্ট্যান্ড বানানো!’

    ‘আরে নওজোয়ান, এ তুমি কী বলছ? প্রথম কথা তো হল এই যে অনেক কোচোয়ানই তাদের ঘোড়া বেচে ওই তিন চাকার স্কুটারই কিনে নিয়েছে। এখন তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কেন কথা বলবে? তারপরে যারা যাত্রী তাদের আবার পায়াভারি। সওয়ারিরা এখন টাঙার দিকে ফিরেও তাকায় না! তাই আমাদের জোর যাচ্ছে কমে। খবর এসেছে এক হপ্তা আগে কমিটির লোকেরা উল্টে কোচোয়ানদেরই দুমাসের নোটিশ ধরিয়ে জানিয়েছে যে টাঙাগুলো নাকি অনেক বেশি জায়গা নিয়ে নিচ্ছে। ঘোড়ার জলের বদবুও খুব। তাই এই স্ট্যান্ড রিক্সার জন্য অ্যালট করা হল – তোমরা টাঙাওলারা নিজেদের জায়গা খুঁজে নাও। ঘোড়াদের জলের জন্য যে চৌবাচ্চা ছিল তা ছমাস আগেই বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছ থেকে আটজন টাঙাওলা এখনও এখানে পড়ে আছে। আমরা ওই নোটিশটা নিয়ে ডেপুটি কমিশনার সাহেব বাহাদুরের কাছে গিয়েছিলাম। সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি কমিটির কাজে নাক গলান না। আমাদের জানতে ইচ্ছে হয়…তুই নাক গলাবি না তো কি তোর মা গলাবে? যিনি তোকে পেটে ধরে আমাদের কপালে তোর নাম লিখে দিয়েছেন, তিনি করবেন? আমি তো সেখানেই বলে দিলাম…কমিশনার সাব, যদি তোর বাপ টাঙা চালাত, তা হলে দেখতাম তুই আমাদের নিয়ে কেমন ফয়সালা করিস! আমাদের কাছে পাকা খবর ছিল সে কমিটিওলাদের কাছ থেকে ঘুস খেয়েছে।’

    ‘তারপরে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    ‘তারপরে আমরা আল্লাহ্‌র ওপর ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলাম। আর আল্লাহ্‌র ওপর ছেড়ে দেওয়া কাজের যে কী হাল হয়, সে তো তোমার জানাই আছে!’

    ‘তা হলে এবার কী হবে?’ আমি মনের দুঃখে জিজ্ঞেস করলাম।

    ‘হওয়ার আর কীই বা আছে! আমি তো ভেবেছি মাস দুয়েক পর থেকে টাঙা শহরে না এনে বাত্তি মোড়েই চালাব। সেখানে এখনও টাঙাদেরই শাসন।’

    ‘কিন্তু সেখানেও তো স্কুটার রিক্সা এসে গেছে?’

    ‘এসে তো গেছে, তবু দেখা যাক!’ মনে হল শাহ মহম্মদ সিদ্ধান্ত করেই ফেলেছে।

    আমি লাহোর চলে গেলাম। তবে তিন-চার মাস পর পর গ্রামে গেলেই শাহ মহম্মদের সঙ্গে মোলাকাত হত। সে তার টাঙা শহর থেকে সরিয়ে বাত্তি মোড়ে নিয়ে এসেছিল। সেই স্ট্যান্ডে রোজগার কম হলেও সওয়ারি জুটে যেত। আরও দুটো বছর পরিস্থিতি শান্তিরই রইল। কিন্তু কতদিন? ধীরে ধীরে এখানেও স্কুটার-রিক্সায় লোকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। শাহ মহম্মদের টাঙা বেকার বসে থাকত। আমি গ্রামে গেলেই তার টাঙা ভাড়া করে নিলেও শুধু আমার কাছ থেকে আর কীই বা কামাই হত?

    এইভাবে আরও দুটো বছর গেল। হঠাৎ একদিন বাত্তি মোড়ে গিয়ে দেখি যে শাহ মহম্মদও একটা রিক্সায় বসে যাত্রীর অপেক্ষায় আছে। আমি ভীষণ অবাক হলেও এই ভেবে শান্তিও পেলাম যে চলো, ভালোই হয়েছে…সওয়ারি তো অন্তত পাবে। সোজা তারই রিক্সার কাছে এগিয়ে গেলাম। সে আমাকে দেখেই স্কুটার রিক্সায় স্টার্ট দিয়ে দিল। আমাকে এগোতে দেখে আরও দু-একজন রিক্সাওলা থামিয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘ভাইজান, আমাদের গাড়িতে চলে আসুন – ও রিক্সা চালাতে জানে না। কিন্তু আমি তাদের উপেক্ষা করে শাহ মহম্মদের রিক্সাতেই গিয়ে বসলাম। রিক্সা চলতে শুরু করল। কথা বলার খুব ইচ্ছে থাকলেও রিক্সার আওয়াজ এমনই ছিল যে আমরা না চাইলেও চুপচাপ সফর করতে হচ্ছিল। সেই সফরে আমি এটাও বুঝলাম যে অন্য রিক্সার চালকেরা ঠিকই বলেছে। শাহ মহম্মদের রিক্সা বার বার রাস্তার এক পাশে চলে আসছিল। বেশ কয়েকবার আমরা রাস্তার ধারে গভীর নালায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। সারাটা রাস্তা দোয়া পড়তে পড়তে এলাম আর মনে মনে ঠিক করে নিলাম ওর রিক্সায় আর ভুলেও চড়ব না।

    পরে শুনলাম তার রিক্সাটা নাকি দু-মাসের মধ্যেই ভেঙে চুরে গিয়েছিল। এতবার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল যে চাকা, পুলি, চেন, হ্যান্ডেল – সবেরই সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় বেশ কয়েকজন সওয়ারিরও চোট-আঘাত লাগায় তারা তার রিক্সায় চড়া ছেড়ে দিয়েছিল। তখন থেকে স্কুটার রিক্সাটা আর কোনও কাজে লাগেনি। উপরন্তু, শাহ মহম্মদ যে বয়েসে পৌঁছেছিল, তাতে তার পক্ষে আর স্কুটার চালানো সম্ভব ছিল না। তার পরের বার গাঁয়ে গিয়ে দেখলাম যে স্ট্যান্ডের প্রথম হোটেলটাতে বসে শাহ মহম্মদ চা খাচ্ছে। কিছুক্ষণ তার পাশেই বসে রইলাম। মনে হচ্ছিল সে যেন অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। বয়েস যদিও ষাটের অল্প কিছু বেশি ছিল, তাকে এত কমজোরি আগে কখনও দেখিনি। গায়ের রঙ হলদেটে, চোখগুলো গর্তে ঢুকে গেছে। চায়ের কাপ ওঠানোর সময় হাতও কাঁপছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না এই লোকটাই সেই শাহ মহম্মদ যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত শক্তপোক্ত আর জীবনীশক্তিতে ভরপুর ছিল। তার স্বাস্থ্য এত খারাপ হয়ে গেছে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা শাহ মহম্মদ, আপনার শরীরটা এমন ভেঙে গেল কেন?’

    শাহ মহম্মদের দৃষ্টি চায়ের কাপ থেকে সরে গেল। ‘আমি জানতাম তুই এটাই জিজ্ঞেস করবি। কিন্তু কিছু কথা এমনই থাকে যে জবাব না দিলেও ইয়ার-বন্ধুরা বুঝে নেয়।’

    ‘তবু, হলটা কী?’ আমি তার অবস্থা পরখ করতে করতে বললাম।

    শাহ মহম্মদ গভীর শ্বাস নিল। ‘ভাতিজা, ছোড় ইন বাতোঁ কো! আমার রোগটা তুই বুঝবি না। শরীরটা তো সে দিনই খারাপ হয়ে গেছে যেদিন ঘোড়া বেচে দিয়ে লোহার ওই জাহান্নমি ফটফটিটা কিনেছিলাম। তবু ভালো হল যে টাঙাটার কোনও খদ্দের জোটেনি। যদি ওই নিশানিটুকুও না থাকত, তা হলে শাহ মহম্মদ এতদিনও বেঁচে থাকত না। যাক গে, তুই নিজের কথা বল। তেরা নোকরি কা ধান্দা ঠিক চল রহা হ্যায়?’

    ‘যখন রিক্সা কিনেই ছিলেন, তখন সেটা বেচলেন কেন? মোটামুটি রুজিরুটির ব্যবস্থা তো হয়ে যাচ্ছিল।’ আমিও ফের শুধোলাম।

    বলল, ‘বেটা, কী আর বলি? তুই তো জানিস সারা জীবন ঠাটবাট নিয়ে থেকেছি। টাঙায় যখন বসতাম, ওই সাড়ে-পাঁচ ফুটের চাকাগুলো মাটির এত ওপরে থাকত যে পায়ে চলা মানুষদের সব ছোট ছোট লাগত। টাঙার চালকের সিটে বসলেই লম্বাই বেড়ে যেত। টাঙা হল নবাবদের গাড়ি – ইজ্জতের নিশান। অন্যরা জোরাজুরি করায় স্কুটারটা তো কিনেছিলাম। কিন্তু যখন ওই দেড় ফুটি চাকার ওপর ফটফটিতে বসতাম, তখন মনে হত যেন জমির ওপর ঘষটাতে ঘষটাতে চলেছি। শরমে মুখ লুকোনোর জায়গা পেতাম না। ভাবতাম শাহ মহম্মদ এমন পেশার থেকে তো মৃত্যুও ভালো। শেষমেশ চার ভাগের একভাগ দামে বেচে দিয়ে ওই অভিশাপটার হাত থেকে রেহাই পেলাম।’

    শাহ মহম্মদের কথা শুনে হাসি পেলেও নিজেকে সামলে নিলাম। সত্যিটা হল ওর বয়েসটা আর রিক্সা চালানোর পক্ষে উপযুক্ত ছিল না। শুধু তাই নয়, সে সারা জীবনে কখনই তো রিক্সার মত কিছুতে হাতই দেয়নি। কিন্তু তার ওজর-অজুহাত আমার ভালোই লেগেছিল। লুকিয়ে কিছু পয়সা বার করে শাহ মহম্মদের ‘না-না’ সত্ত্বেও তার পকেটে গুঁজে দিয়ে ঘরে চলে এলাম। সেই ছিল তার সঙ্গে শেষ মোলাকাত। তারপরে আমি দীর্ঘদিনের জন্য দেশের বাইরে ছিলাম। ফিরে এসে দেখি সে আর এই দুনিয়ায় নেই।


    **************************************

    গ্রামে ফিরে প্রথমেই আমার পা দুটো আমাকে যেন শাহ মহম্মদের ঘরের দিকে টেনে নিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছোলাম। সে মারা যাওয়ার পর পনেরো বছর কেটে গেছে। তার ভেঙে পড়া মাটির ঘরের সামনে শুকিয়ে যাওয়া আকাশমণি গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি টাঙাটার দিকে চেয়ে আছি। টাঙার বাঁশের পাটাতনটার আদ্ধেক অবশিষ্ট আছে। কাঠের চাকাগুলোতে ঘুণ ধরে মাটিতে বসে গেছে। সিট আর লকড়ির তক্তাগুলো কেউ খুলে নিয়ে চলে গেছে। টাঙাটার ভাঙাচোরা কাঠামোটাই যা পড়ে আছে। তার না আছে কোচোয়ান, না টেনে নিয়ে যাওয়ার ঘোড়া।

    চোখ বন্ধ করে ফেললাম। স্কুল থেকে বেরিয়ে সোজা টাঙা স্ট্যান্ডের দিকে ছুটেছি – তারপরে শাহ মহম্মদের টাঙায় চড়ে বসেছি। কিছুক্ষণ পরেই শাহ মহম্মদ ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরেছে। টাঙা গ্রামে যাওয়ার সড়কের ওপর তুলে নতুন একটা গল্প বলতে শুরু করেছে।



    অলংকরণ (Artwork) : শুভময় রায়
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments