দক্ষিণ ফ্রান্সে মিশন শেষে ৪৪ বছরের ফরাসি পাইলট অঁতোয়ান দ্য স্যাঁতেগজ়ুপেরিকে (Antoine de Saint-Exupéry) আর পাওয়া যাচ্ছে না।
অ্যাসোসিয়েট প্রেসের কপিরাইটসহ রোম থেকে পাঠানো বার্তাটি ১০ অগস্ট ১৯৪৪-এ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। সাহসী মানুষটির সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুবান্ধবরা আরও তিন মাস তাঁর খবরের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন। তাঁরা হয়ত ভেবেছিলেন জার্মানরা অঁতোয়ানকে বন্দি করে রেখেছে। হয়ত এই আশাও করেছিলেন যে তাঁর প্রায় অলৌকিক ভাগ্যের সাহায্য নিয়ে অঁতোয়ান জার্মানদের কব্জা থেকে পালাতে সক্ষম হতেও পারেন। ফিরে এসে হয়ত শোনাবেন অ্যাডভেঞ্চারের সেই কাহিনি। কিন্তু ১৯৪৪ এর নভেম্বরে সব আশার অবসান ঘটল যখন বিমানের ধ্বংসাবশেষ এবং কারও কারও মতে সেই মহান ফরাসি নায়কের পোড়া শরীরটা তুলোঁর (Toulon) কাছে পাওয়া গেল। পৃথিবী আর আকাশের মধ্যে কোথাও গুলির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। নিশ্চিত হল যে বিমান নিয়ে আবার উড়তে, বিমান আর আকাশযান নিয়ে অনবদ্য সব রচনা লিখতে স্যাঁতেগজ়ুপেরি আর কখনও ফিরে আসবেন না।
অঁতোয়ানের মৃত্যুতে ফ্রান্সের হল অপূরণীয় ক্ষতি। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন তাঁর প্রজন্মের অসামান্য এক মানুষ। একাধারে পাইলট, পথিকৃৎ, সৈনিক, কবি, ঔপন্যাসিক, দার্শনিক তো বটেই, সারা পৃথিবী ক্ষুদে রাজপুত্রের (The Little Prince) স্রষ্টা হিসেবে তাঁকে চেনে। সেই লেখকই আবার আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ এলাকার সঙ্গে বিমান যোগাযোগ উন্মুক্ত করে দেওয়ার কাজে নিয়েছিলেন অগ্রণী ভূমিকা।
‘লিখি অল্পই, আমার সময় নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে যে বইটাকে গড়ে তুলছি সেটা একটা সুন্দর বই হবে।’ আর্জেন্টিনার বুয়েনোস এয়ারেস থেকে ১৯৩০-এ লেখা চিঠিতে অঁতোয়ান দ্য স্যাঁতেগজ়ুপেরি লিখলেন তাঁর মাকে।
কী নিয়ে বই? বিমান চালকের জীবন নিয়ে কি? অঁতোয়ান সেই সময় এয়ারোপোস্তো আর্জেন্তিনা এয়ারলাইনের ডাইরেক্টর। তখনও তিনি মাঝে মাঝেই ডাক-বিমান উড়িয়ে নিয়ে যান। কখনও বা ভেঙে পড়া বিমানের অনুসন্ধানে বেরোন। দক্ষিণ আমেরিকায় বিমান চালনার নতুন পথও আবিষ্কার করেন। না, পাইলটের জীবন নিয়ে তাঁর এ বই নয়।
কিছুদিন আগেই সে বছরের জানুয়ারিতে এর আগের একটি চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন: ‘আমি রাত্রির উড়াননিয়ে বই লিখছি। একটু গভীরভাবে ভাবলে বলতে হয় এর বিষয়বস্তু রাত্রিই।’
ডাক নিয়ে যায় এমন একটি বিমানকে ঝড়ের পরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উড়ানের সেই আদিযুগে বিতর্কিত রাতের ফ্লাইট চালু করার নির্দেশ দিয়েছে রিভিয়ের। পৃথিবীতে বসে তাকে আকাশে পাইলট ফাবিয়ঁর মৃত্যু দেখতে হচ্ছে। পাইলটের স্ত্রী তার ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে। কর্তব্যের ডাকে আর সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রথমে অন্যকে এবং তারপরে নিজেকে বলি দিচ্ছে এমন এক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই নিয়ে কাহিনি ফেঁদেছিলেন ফরাসি ঔপন্যাসিক অঁতোয়ান দ্য স্যাঁতেগজ়ুপেরি। তাঁর ‘রাত্রির উড়ান’-এ (Vol de Nuit, ইংরেজি অনুবাদে Night Flight) আঁকা রইল কর্তব্যে অঙ্গীকারবদ্ধ, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষের গৌরবের ছবি।
রাত্রির উড়ান-এ সেই সময়ের কথা বলা হয়েছে যখন অন্ধকার নামার পরে বিমান চালিয়ে প্রথম ডাক নিয়ে যাওয়া শুরু হল। এর আগে বিমান কোম্পানি রেল বা স্টিমারের মত রাতে বিমান চালাত না। কিন্তু কোনও এক সময়ে পরিবহণের অন্যান্য মাধ্যমের সঙ্গে ডাক সরবরাহে গতির প্রতিযোগিতায় রাত্রির উড়ান শুরু করতে হয়। রাতে বিমান চালানোর অত্যধিক ঝুঁকির জন্য সেই সময় বিষয়টি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল, যতদিন পর্যন্ত না প্রযুক্তির উন্নতির ফলে অন্ধকারে বিমান চালনা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও স্বাভাবিক হয়ে আসে।
রাত্রির উড়ান-ই (১৯৩১) প্রথম উপন্যাস যা লেখক অঁতোয়ানকে বিখ্যাত করেছিল। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রিভিয়ের দক্ষিণ আমেরিকায় একটি ফরাসি বিমান সংস্থার ডাইরেক্টর। ক্লান্তিহীন কর্মী আর কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ সে মানুষটি অনেক লড়াই করে উড়ানের সেই আদিযুগে রাতে বিমান চালিয়ে ডাক পৌঁছোনোর ব্যবস্থা করেছে। এক সন্ধ্যায় সে বুয়েনোস এয়ারেস-এ তার অফিসে উত্তরের প্যাটাগোনিয়ায় বিমান উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া পাইলট ফাবিয়ঁ-র রেডিও বার্তা পেল। বার্তায় বলা হয়েছে ফাবিয়ঁ ভয়ঙ্কর ঝড়ের মুখে পড়েছে। এমন একটা সময়ে যখন তার বিমান আর মাত্র আধ ঘণ্টা চলতে পারে এটুকু গ্যাসোলিন মজুত। ফাবিয়ঁর স্ত্রী এই খবরে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ঠিক খবরটা জানতে পাগলের মত রিভিয়েরের অফিসে উপস্থিত। শেষ বার্তাটিতে জানা গেল বিমানচালক মেঘের মধ্যে দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করলেও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এরপরে বেশ কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ থাকায় রেডিও বার্তার শ্রোতাদের আন্দাজ করে নিতে অসুবিধে হয় না যে ফাবিয়ঁর বিমান নির্ঘাত দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে এবং সে মারা গেছে।
যে অঞ্চলে দুর্ঘটনা ঘটেছে রিভিয়ের সেখানকার পুলিশকে ঘটনাটা জানায়। তারপরে সে বুয়েনোস এয়ারেসের বিমানবন্দরে অপেক্ষারত পাইলটকে বার্তা পাঠায় যে প্যাটাগোনিয়া থেকে আসা ডাকের জন্য সে যেন আর অপেক্ষা না করে। ইউরোপ থেকে আসা চিঠিপত্র নিয়ে যেন নাটালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত পরে রিভিয়ের জানলায় উঁকি মেরে দেখছে ইউরোপের ডাকসহ বিমানটি তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সে দৃশ্য দেখে রিভিয়েরের মনে হল সাম্প্রতিক ভয়াবহ পরাজয় সত্ত্বেও সে তো রাত্রির উড়ানের ব্যবস্থাকে চালু রাখতে পেরেছে!
রিভিয়েরের জটিল মানসিকতায় ধরা পড়ে যায় এই অদ্ভুত সত্য যে সাহসী হওয়ার দায়িত্ব নেই এমন মানুষের শান্তি হল মরীচিকা – সুরক্ষা আর স্বাচ্ছন্দ্যের প্রলোভন যাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। এই স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনই হল মৃত্যু। রিভিয়ের বা লেখক স্যাঁতেগজ়ুপেরির জন্য নয় তেমন শান্তির জীবন।
আমি বিমান চালনার কথা ভাবছি না। বিমান শুধুই একটা মাধ্যম, লক্ষ্য নয়। চাষা যেমন লাঙলের জন্য জীবনের ঝুঁকি নেয় না, বিমানের চালকও তেমনি বিমানের জন্য সে ঝুঁকি নেবে না। কিন্তু বিমানে চড়লে শহর আর তার হিসেব-নিকেশের থেকে দূরে উড়ে গিয়ে বাস্তবের মোকাবিলায় আদাজল খেয়ে লাগা যায়।
আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘মানুষের পৃথিবী’-তে (Terres des hommes, ইংরেজি তরজমায় Wind, Sand and Stars) অঁতোয়ান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন কেন বিমান চালকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কাজ করে চলেন। বিমান চালনা সেখানে নিঃসঙ্গ মানুষের অভিজ্ঞতা, যে মানুষ অনাবিষ্কৃত পথের সন্ধানে যন্ত্রকে সাথী করে বাতাস, বালি আর তারাদের মুখোমুখি হচ্ছে।
তবে আত্মত্যাগ আর কর্তব্যে নিয়োজিত জীবনের বেদনা লেখক জানেন। তাই রাত্রির উড়ান জীবনের গুণকীর্তন সম্বলিত সরল নীতিমূলক কাহিনি নয়। সাময়িক বিরামের লোভটুকুকেও অগ্রাহ্য করে রিভিয়ের কঠোর শৃঙ্খলা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির দ্বারা চালিত। কিন্তু এই নির্বাচন তাকে কষ্ট আর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় না। যন্ত্রণা ভোগ করে তার সহকর্মীরাও – বিমানবন্দরে তত্ত্বাবধানের কাজে নিযুক্ত রিশার (Richard) – দুর্ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকার জন্য যার ভাগ্যে জোটে কড়া শাস্তি। আর ফোরম্যান লর্যু (Leroux) – যে একঘেয়ে পেশা আর তার পরিণাম – একাকিত্ব আর অপমান – নিরুপায় হয়ে সহ্য করে।
রিভিয়ের জানে না তার পাঠানো আদেশগুলো ন্যায্য কি না। স্যাঁতেগজ়ুপেরিও সেটা জানেন না। কিন্তু তারা জানে যে কখনও কখনও ব্যক্তিগত ন্যায়বিচারের তুলনায় সকলের সার্বিক মঙ্গলের দাবি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়:
আমি কি ন্যায় করলাম, না অন্যায়? জানি না। শুধু জানি যে যখন কোনও কর্মীকে কঠোর তিরস্কার করি, তখন দুর্ঘটনা কম হয়। এখানে ব্যক্তি দায়ী নয়, বরং কোনও এক অজানা শক্তিই দায়ী – আর প্রত্যেককে তিরস্কার না করে সেই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। আমি যদি শুধু ন্যায়বিচারের কথা ভাবি, তা হলে রাতের প্রতিটি উড়ানেই মৃত্যুর ঝুঁকি থাকবে।
অ্যাণ্ডিস্ পাহাড়ের অথবা ঝোড়ো হাওয়ায় সাহারা মরুভূমির ওপর দিয়ে প্রথম যখন বিমান উড়ল, তখন পাইলটদের ঠিক-বেঠিক, ন্যায়-অন্যায়ের চিন্তার সময় ছিল না। কারণ প্রাকৃতিক শক্তি মানুষের এই চ্যালেঞ্জকে হালকাভাবে নেয়নি! পাইলটরা হয়েছিল গাঢ় অন্ধকার আর প্রকৃতির বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি। স্যাঁতেগজ়ুপেরির কাছে জীবনের এটাই প্রাথমিক নিয়ম – সংঘর্ষ, জয়, অগ্রগতি, ভয় থেকে মুক্তির জীবন।
বিমান চালনার দায়িত্বে থাকা মানুষগুলোর জীবনের দায় যে তার হাতে রিভিয়ের সে কথা ভোলে না। তার চিন্তায়: ‘আমরা ঘটনাবলীর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করি, চাই যাতে তারা আমাদের আজ্ঞাবহ হয়। সেটা করতে পারলে আমরা স্রষ্টা। এই সরল, সাধারণ মানুষগুলোও আমাদেরই তৈরি। যখন তারা কোনও অন্যায় করে ফেলে, তখন আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের সরিয়ে দিই।’ এই সচেতনতাই রিভিয়েরকে বাধ্য করে আদেশের ব্যাপারে অনমনীয় হতে। অঁদ্রে জ়িদ এই ক্যাপ্টেনের চরিত্র সম্পর্কে বলছেন:
সে নিজে কাজ করে না, অন্যদের কাজ করায়। পাইলটের বুকে সাহস সঞ্চার করে, তার সেরাটা দেওয়ার জন্য দাবি জানায়, তাকে সাহসী হতে বাধ্য করে। তার অনমনীয় প্রত্যয়ে দুর্বলতার কোনও স্থান নেই, সামান্যতম পিছিয়ে পড়াও সে সহ্য করে না।
রিভিয়ের এ বিষয়ে নিশ্চিত যে মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ যদি হয় পাইলট স্বামীর জন্য তার হবু স্ত্রীর উদ্বেগ – তা হলে তার চেয়েও মহৎ কিছু আছে। রিভিয়েরের কাছে এটার খুব স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। আংশিকভাবে কর্তব্য শব্দটাকে দিয়ে সে বিষয়টাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আসল ব্যাপার হল কাজের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা – এমন একটি কাজ যার সঙ্গে ভয়ভীতি, আত্মত্যাগ, সাহস আর আত্মনিবেদন জড়িত। যে কর্তব্যবোধ এমনকী মরুভূমির নিয়ত সরে যাওয়া বালুর মধ্যেই তার চিহ্ন রেখে যায়।
তার ব্যক্তিগত মৃত্যুর জন্য নয়, বরং তার মত অন্য যারা তাদের জন্য করুণা – যারা বালির সমুদ্রের গভীরে ঢাকা পড়ে রইল। আর তাই সে তার লোকদের নিদেনপক্ষে কয়েকটা পাথর বসিয়ে দেওয়ার আদেশ করল, যে পাথরগুলোকে মরুভূমি কখনও ঢেকে দেবে না।
মানুষ অমরত্ব বা নিজের জীবনের চেয়েও বেশি যা চায় এমন কিছুতে স্যাঁতেগজ়ুপেরি বিশ্বাস করতেন:
আমাদের সব কর্মকাণ্ড আর বিষয়-আশয় যেন অর্থহীন না হয়ে পড়ে – কারণ তা হলে তো সব কিছুর চরম নিরর্থকতা প্রকাশ হয়ে পড়বে।
রিভিয়ের, আর আমরা ধরে নিতে পারি স্যাঁতেগজ়ুপেরির কাছেও ব্যক্তির জীবন আর সুখ কাজের সাফল্য অথবা কোনও বিশেষ ধ্যানধারণার চরিতার্থতার তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ। অফিসের প্রধান রিভিয়ের তার অধস্তন ফাবিয়ঁ আর তার স্ত্রীর দুঃখে সহমর্মী – কিন্তু রাতে ডাক নিয়ে বিমান ওড়া যদি বন্ধ হয়ে যায় এই উদ্বেগ যেন তার অনেক বেশি। যদি চিরকালের জন্য রাতের উড়ান বন্ধ করে দিয়ে ফাবিয়ঁর জীবন বাঁচিয়ে তাকে আবার তার স্ত্রীর আলিঙ্গনে ফিরিয়ে দেওয়া যেত, তা হলেও রিভিয়ের যেন সেই পথে না গিয়ে পাইলটের জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও রাতে বিমান ওড়ানো চালু রাখারই চেষ্টা করত। কাজের জন্য যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, জীবনের অনেক ভালোলাগাকে ত্যাগ করতে হয়, তা হলেও পরোয়া নেই:
চল্লিশ বছর ধরে ফোরম্যানের কাজ করে চলা লর্যু-র বার্ধক্যের বলিরেখায় ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে রিভিয়ের জিজ্ঞেস করে, ‘প্রেম-টেম কখনও করেছ, লর্যু? তোমার সময়ে?’
‘প্রেম স্যার! না, আসলে কী জানেন.....’
‘সময় পাওনি, তাই না? আমারই মত!’
‘খুব একটা সময় তেমন তো জোটেনি স্যার।’
রিভিয়ের কান খাড়া করে শুনল। লর্যুর কণ্ঠে কোথাও কোনও তিক্ততার চিহ্নমাত্র নেই। এই মানুষটি যখন তার জীবনের দিকে পেছন ফিরে তাকায়, তখন যে শান্ত সন্তুষ্টির অনুভূতি তার মনটাকে ছেয়ে থাকে, সেটা সেই ছুতোরের মত যে একটা পাটাতনকে মসৃণ করার কাজটা খুব ভালোভাবে করতে পেরেছে।
রাত্রির উড়ানএর এই দর্শন কী মানসিক কোনও টানাপোড়েন ব্যতীত নির্বিঘ্নেই গড়ে উঠেছিল? লেখকের মুখপাত্র রিভিয়ের প্রশ্নটি নিয়ে নিজের মনেই দীর্ঘ বিতর্ক চালিয়েছে। মাদাম ফাবিয়ঁর সঙ্গে কথা শেষ করে তার মনে পড়ছে কোনও ব্রিজ নির্মাণের সময় মাথা গুঁড়িয়ে যাওয়া এক শ্রমিককে সে দেখেছিল। ব্রিজ তৈরি কি মানুষের জীবনের চেয়েও বেশি দামি? রিভিয়েরের কাছে এর পরিষ্কার উত্তর ‘হ্যাঁ’, কারণ শ্রমিকের মৃত্যু হতে পারে জেনেও মানুষ তো ব্রিজ নির্মাণ থামায়নি! কেন এমন হয়? হয়ত এই কারণে যে মানুষের জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাই তার মূল্য তেমন বেশি নয়। তুলনায় মানুষের শ্রমের নির্মাণ বহু যুগ টিকে থাকে। সেখানেই তার মহত্ত্ব।
নাইট ডিউটিতে থাকা একলা এক কেরানিকে সে পেয়ে গেল। অন্য কোথাও কাজ করা সহকর্মীদের জন্য, তাদের জীবন আর শক্তিক্ষয় কমানোর জন্য এখানে লোকটা দিনরাত কাজ করে চলেছে। আর এইভাবেই পোস্ট থেকে পোস্টে, তুলুজ় থেকে বুয়েনোস এয়ারেস পর্যন্ত কাজ এগিয়ে চলেছে – উপর্যুপরি উড়ানের যে শৃঙ্খল তা যেন ভেঙে না যায়।
‘এই লোকটা কিন্তু নিজের মহত্ত্বের কথা জানে না,’ রিভিয়ের ভাবে।
কোথাও বিমানগুলোও যুঝতে যুঝতে এগিয়ে চলেছে। রাতের উড়ান অনবরত চলেছে একটা নাছোড়বান্দা অসুখের মত। তাদের ওপর নজর রাখতে হবে। ওই লোকগুলোকে সাহায্য করতে হবে যারা হাত-পা, বুকে বুক ঠেকিয়ে অন্ধকারের সঙ্গে কুস্তি করে চলেছে – শুধু তারাই জানে ক্রমাগত বদলাতে থাকা সেই অদৃশ্য পৃথিবীটাকে। শেষমেশ তাদের সেখান থেকে লড়ে বেরিয়ে আসতে হবে – সমুদ্র থেকে উঠে আসার মত।
রাত্রির উড়ান-এর ভূমিকায় অঁদ্রে জ়িদ এই দর্শনকেই তুলে ধরছেন যেখানে ব্যক্তির সুখস্বাচ্ছন্দ্য গোষ্ঠীর কল্যাণের তুলনায় গৌণ: ‘মানুষের সুখ নিহিত আছে তার কর্তব্যকর্মে, স্বাধীনতায় নয়।’ অন্য অনেক সমালোচক জ়িদের উদাহরণ অনুসরণ করে রাত্রির উড়ানএর প্রতি তাঁদের অপার মুগ্ধতা জাহির করেছেন। জন শার্পঁতিয়ের বলছেন এই বইটি ‘মানুষের কীর্তি আর তার প্রাণসত্তার সাফল্যের উল্লাস যার প্রভাবে মানুষ তার নশ্বর দেহের সর্বশক্তি দিয়ে কাজ সম্পূর্ণ করা অথবা চিন্তাভাবনাকে জয়ী করার লক্ষ্যে শ্রম দিয়ে চলে।’ ইভন সার্সির মতে ‘কর্তব্যের নিশ্বাস বইয়ের প্রতিটি লাইনের মধ্যে দিয়ে উন্মুক্ত সাগরের বাতাস আর আকাশের উচ্ছলতার মত প্রবাহিত।’
প্রশ্ন তবু থেকেই যায়: কোনও আদর্শের জন্য আত্মবিসর্জন এক জিনিস – আর অন্য এক ব্যক্তির জীবন নেওয়া সম্পূর্ণ অন্য কিছু। তাই হয়ত আরেক সমালোচক বঁজ়াম্যাঁ ক্রেমিউ বলছেন: ‘স্যাঁতেগজ়ুপেরি রিভিয়েরের কঠোর কর্তব্যবোধের যে ব্যাখ্যা চরিত্রের মুখে বসিয়েছেন, তা আমার প্রত্যয় জাগাতে সফল হয়নি।’
আশ্চর্যের নয় যে রিভিয়েরের কোনও কিছুর সঙ্গে আপস করতে রাজি না হওয়া চরিত্রটি একলা থাকতে ভালোবাসবে। এমন নয় যে রিভিয়ের তার কর্মীদের ভালোবাসে না। হয়ত তাই তার এই অদ্ভুত স্বীকারোক্তি:
যাদের আদেশ করছ, নির্দেশ দিচ্ছ, তাদের ভালোবাসবে – কিন্তু তারা যেন সেটা জানতে না পারে!
তবু, ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, রিভিয়েরের লক্ষ্য কোম্পানির কাজে সাফল্যের ওপর নিবদ্ধ। কোনও লাইটহাউসের রক্ষীর মত যার একমাত্র কাজ জলযানের আসা-যাওয়াকে সচল রাখা।
অস্বস্তি আর অশান্তিটা ফিরে আসায় রিভিয়ের একটু হাঁটতে বেরোল। যে মানুষটা শুধু কাজ আর নাটকীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বেঁচেছে, সে এখন অনুভব করছে তার নিজের ব্যক্তিত্বে অদ্ভুত এক নাটকীয় মোড়। মনে হল ছোট্ট শহরের ছোট ছোট মানুষগুলো তাদের বাদ্যমঞ্চের চারপাশে ঘুরে বেড়ালেও – আপাতদৃষ্টিতে তারা নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করছে মনে হলেও – তাদের জীবনেও ট্র্যাজেডি আছে: অসুস্থতা, প্রেম, বিয়োগবেদনা – আর হয়ত ...... তার নিজের সমস্যাটা তাকে অনেক কিছু শেখাচ্ছে – তার নিজের কথায় ‘জানালা খুলে দিচ্ছে’।
এগারোটা নাগাদ একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারায় রিভিয়ের অফিসের পথ ধরল। সিনেমা হলগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে কনুইয়ের গুঁতো মারতে মারতে সে আকাশের দিকে মুখ তুলে সেই সরু রাস্তায় ঝিলিক মারতে থাকা তারার দিকে চাইল। আকাশে জ্বলজ্বল করা নিওন সাইনে প্রায় ডুবে গেছে সব নক্ষত্র-নীহারিকা। রিভিয়ের স্বগতোক্তি করল: আজ রাতে যখন আমার দুটো ডাক-বিমান উড়ছে, তখন গোটা আকাশটার দায়িত্ব আমার। ওই ওপরে যে তারাটাকে দেখা যাচ্ছে, সেটা এই ভিড়ের মধ্যে আমাকেই খুঁজছে – আর ঠিক খুঁজে পেয়েও যাচ্ছে! এই কারণেই আমার নিজেকে বেমানান – সকলের থেকে আলাদা কেউ বলে মনে হচ্ছে।
নিজের মাকে অঁতোয়ান হয়ত বলতে চেয়েছিলেন এ উপন্যাসের আসল নায়ক তারকাখচিত রাত্রি। রাত্রির উড়ানের নিশিযাপনকারী বিমানকর্মীদের প্রকৃত সঙ্গী তো সেই।
তথ্যসূত্র (ফরাসি):
১. Les Oeuvres complètes : D'A. de Saint-Exupéry; Gallimard; Paris 1950
২. Antoine de Saint-Exupéry : Lettres à sa mère, Gallimard, 1954
চিত্রসূত্র: ফরাসি প্রকাশনা সংস্থা গালিমার কর্তৃক ১৯৫০-এ প্রকাশিত লেখকের রচনাসমগ্র