মলিকে ক্লাসের সবাই বলে, “তুই কেন ওই বিদ্ঘুটে মেয়েটার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখিস?”
মলি অবশ্য ওই সব কথা শুনলে খুব বিরক্ত হয়, বলে, “ও বিদ্ঘুটে কেন হতে যাবে? তোরাই বরঞ্চ বিদ্ঘুটে। তৃষা একটু অন্যরকম। আর হ্যাঁ, ওর বিরুদ্ধে আমি কোন কথা শুনতে চাই না। ও আমার বন্ধু।”
তৃষা যে একটু অন্যরকম সেটা মলি জানে। সে অন্য মেয়েদের মতন কথায় কথায় খিক্ খিক্ করে হাসে না। হিরো হিরোইন বা টিভি সিরিয়াল নিয়ে গল্প করে না। মোটা ফ্রেমের চশমা পরে আর ঘাড় গুঁজে বই পড়ে। মোবাইল, ভিডিও গেম ইত্যাদিতেও তার কোন উৎসাহ নেই। খুব লাজুক আর গম্ভীর। কারো সঙ্গে চট করে মেশে না আর পোকামাকড়ে ওর প্রচণ্ড আগ্রহ। তাতেই ক্লাসের সবাই মনে করে ও অদ্ভুত। ওদের ক্লাসে একবার একটা বড়ো আরশোলা দেখা দিয়েছিল। সবাই যখন ভয়ে জড়োসড়ো তৃষা তখন অম্লানবদনে সেটাকে হাতে নিয়ে বাইরের বাগানে ফেলে দিয়ে এল। অন্য মেয়েগুলো তখন ওয়াক থু করছিল কিন্তু মলির বেশ গর্ব হচ্ছিল তৃষা ওর বন্ধু ভেবে।
মলির সঙ্গে তৃষার বন্ধু হওয়াটাও বেশ অদ্ভুতভাবে। তাও সেটা সম্ভব হত না যদি না ওরা একই কমপ্লেক্সে থাকত।
সেদিনটার কথা আজও মলির পরিষ্কার মনে আছে। ওরা তখন সবে নতুন ফ্ল্যাটে এসেছে। বাড়িতে লোক আসবে বলে মা ওকে পাড়ার দোকানটা থেকে মিষ্টি আনতে পাঠিয়েছিলেন। একেবারে কমপ্লেক্সের গেটের পাশেই দোকান তাই ভয়ের তো কিছু নেই। খুচরো ছিল না বলে একটা বড়ো নোট দিয়েছিলেন মা। মিষ্টি কিনে অনেকগুলো টাকা ফেরত নিয়ে মলি যখন ফিরছিল তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। শীতের সন্ধ্যা বলে লোকজন বিশেষ নেই চারিদিকে। হঠাৎ লিফটে ওঠার আগে দুটো ছেলে কোথা থেকে উদয় হয়ে বলল, “মিষ্টি আর টাকাগুলো আমাদের দিয়ে দে নাহলে তোকে মেরে একেবারে ভর্তা বানিয়ে দেবো! খবরদার চেঁচাবি না! তুই এখানে নতুন এসেছিস তাই আমাদের চিনিস না। এখানে সবাই আমাদের ভয় করে। আমাদের খাজনা না দিয়ে লিফটে ওঠার নিয়ম নেই!”
মলি বুঝেছিল ছেলেগুলো ওর ওপর নজর রেখেছিল। এমনিতে তারা মলির চেয়ে বয়সে খুব একট বড়ো নয় কিন্তু বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। মলি ছোটখাটো আর রোগা তাই ওকে মারতে ওদের অসুবিধা হবে না। সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। অতগুলো টাকা আর মিষ্টি, এরা সব নিয়ে নিলে মাকেই বা কী বলবে।
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে ছেলেগুলো অধৈর্য হয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, “কিরে অত ভাবছিস কি? দে বলছি!” আর ঠিক সেই সময় তৃষা সেখানে এসে পড়ল। সে ছেলেগুলোকে চিনত তাই একঝলকে বুঝে ফেলল ওখানে কী হচ্ছে।
তৃষা গম্ভীরভাবে বলল, “এই নয়ন আর কালু, কী হচ্ছে রে? দাঁড়া কাকু-কাকিমাদের ডেকে নিয়ে আসছি এখুনি। তাঁরাও দেখুন তাঁদের ছেলেরা কেমন ভালো গুন্ডা তৈরি হয়েছে! নয়ন তোর দাদু তো খুব খুশি হবেন তোকে এই সব কাজ করতে দেখে। ওই রকম নামকরা আর সম্মানিত শিক্ষকের নাতি কী সুন্দর ছিনতাই করতে শিখেছে! গর্বে বুক ফুলে উঠবে ওঁর!”
ওর কথা শুনে নয়ন আর কালু একেবারে কুঁকড়ে কেঁচো হয়ে গিয়ে বলল, “এই তৃষা ওইরকম করিস না। আমরা তো শুধু একটু মিষ্টি খেতে চাইছিলাম!”
তৃষা ভেংচি কেটে বলল, “মিষ্টি খেতে চেয়েছিলি! মিথ্যে কথা বলার আর জায়গা পাসনি! আমি সব শুনেছি! যা পালা এখুনি! ফের যদি ওকে বিরক্ত করেছিস তাহলে দেখবি কেমন মজা দেখাই তোদের। ছিনতাই করে মিষ্টি খাওয়া বের করে দেবো একেবারে। যা পালা নাহলে এখুনি তোর দাদুকে ফোন করছি নয়ন!” বলে সে পকেট থেকে একটা ফোন বার করল! ওর কাছে ফোন দেখে ছেলে দুটো প্রচণ্ড ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল।
ওরা চলে যেতে তৃষা বলল, “আমি তৃষা। পাশের সি ব্লকে থাকি। রমেশকাকু ওঁর ফোনটা আমাদের বাড়িতে ফেলে এসেছিলেন তাই সেটা দিতে আসছিলাম। এটা আমার ফোন নয় কিন্তু ওদের ভয় দেখাতে বেশ ভালো কাজে লেগে গেল। ওরা আর তোমাকে বিরক্ত করবে না কোনদিন।”
মলি ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, “আমি মলি। তুমি আজকে যা করলে আমি কোনদিন ভুলব না। আজ থেকে আমরা বন্ধু, কেমন?”
তৃষা শুধু বলেছিল, “হুঁ! বন্ধু হওয়া কিন্তু অত সহজ নয়! প্রকৃত বন্ধু খুব কম হয়।”
মলি তাই শুনে হেসে বলেছিল, “তাই নাকি? দেখা যাক!”
সত্যি কথা বলতে কি তৃষা সেদিন ছেলেগুলোকে তাড়াতে যত কথা বলেছিল অত কথা ওকে কারো সঙ্গে বলতে শোনেনি মলি। এর পর মলি আবিষ্কার করেছিল যে ওর নতুন স্কুলে তৃষা ওর ক্লাসেই পড়ে। সেই থেকেই ওরা বন্ধু। মলির আরো অনেক বন্ধু আছে কিন্তু তৃষা একটু আলাদা বলে তার আর কোন বন্ধু নেই। তৃষার অনেক গুণ কিন্তু সে লজ্জায় কাউকে কিছু বলবে না।
স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবসে ওদের ক্লাস থেকে যে নাটকটা হচ্ছিল সেই ‘মিঠুয়ার বন্ধুরা’ নাটকটাতে মলি মিঠুয়ার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছিল। প্রচুর পার্ট তার, অনেক মুখস্থ করার ব্যাপার। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে তাই তৃষাই ওকে মুখস্থ করতে সাহায্য করছিল। বেশ কয়েকদিন ধরে রোজ বিকেলে ওরা দুজন মিলে সব পার্ট মুখস্থ করছিল। ক্রমে মলি বুঝতে পারছিল যে তৃষা ওর চেয়ে অনেক ভালো অভিনয় করতে পারে। অথচ টিচার যখন ওদের জিজ্ঞেস করেছিলেন কারা কারা অভিনয় করতে চাও তারা বলো। তখন কিন্তু তৃষা কিছু বলেনি! মলি বাড়িতে প্র্যাকটিস করতে করতে তৃষাকে বলেছিল, “আমি টিচারকে বলি তোকে একটা পার্ট দিতে?” তৃষা বলেছিল, “ভাগ! আমি কি ওসব করব নাকি? তাছাড়া তুই বললেই যেন টিচার আমাকে পার্ট দিয়ে দেবেন!”
প্রতিষ্ঠা দিবসের নাটক খুব ভালো হল। সবাই প্রচুর হাততালি দিল। মলির অভিনয়ের প্রশংসা হল অনেক কিন্তু তাও মলির মনে শান্তি নেই। ওর কেবল মনে হচ্ছিল মিঠুয়ার পার্টটা তৃষা পেলে আরো ভালো করত সে। অথচ তৃষার যা হাবভাব ওই ব্যাপারটা কাউকে বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাইকে সেটা দেখাতে হবে। কিন্তু কি করে তৃষা তো মলি ছাড়া অন্য কারো সামনে মুখই খোলে না তাহলে আর লোকে বুঝবে কি ভাবে?
কারো ভাল করার সুযোগ সব সময় আসে না কিন্তু মলি প্রাণপণে চেয়েছিল বন্ধুর উপকার করার তাই সেই সুযোগটাও সে পেয়ে গেল।
প্রতিষ্ঠা দিবসের কয়েকদিন পরই স্কুলে একজন বিশেষ অতিথির আসার কথা শোনা গেল। তিনি আগে ওদের স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন কিন্তু এখন ব্যাঙ্গালোরে একটা স্কুলের প্রিন্সিপাল হয়েছেন। তিনি আসছেন জেনে স্কুলে সাজো সাজো রব। নতুন করে প্রোগ্রাম করার আর সময় নেই তাই ঠিক হল প্রতিষ্ঠা দিবসের প্রোগ্রাম থেকেই সব চেয়ে ভালো কয়েকটা নাচ, গান, নাটক ইত্যাদি আবার মঞ্চস্থ করা হবে। নাটকের মধ্যে ‘মিঠুয়ার বন্ধুরা’ নাটকটাকে বাছা হল।
অনুষ্ঠানের দিন হাজির কিন্তু মলির পাত্তা নেই! ওদের নাটক যিনি করিয়েছিলেন সেই স্বপ্নাদি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ছিলেন। সবাইকে তৈরি করাতে হবে আর মিঠুয়ার পার্টটা তো সব চেয়ে বেশি তাই মলি না এলে তো নাটক বাতিল হয়ে যাবে। এমন সময় মলি এসে হাজির। কিন্তু একি কাণ্ড! তার মাথায় ঢাউস একটা পট্টি আর পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে!
স্বপ্নাদি ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “একি মল্লিকা? কী হয়েছে তোমার?”
মলি বলল, “কাল সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেছি!”
স্বপ্নাদি মহা চিন্তিত হয়ে বললেন, “কিন্তু তাহলে নাটকটা তো আর করা যাবে না। মিঠুয়া তো আর মাথায় পট্টি আর খোঁড়া পা নিয়ে স্টেজে যেতে পারবে না!”
মলি এই সুযোগটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল, সে ফট করে বলল, “একটা কথা বলব? তৃষা প্রতিষ্ঠা দিবসের আগে রোজ আমার সঙ্গে নাটকটা প্র্যাকটিস করেছে এবং গতকালও করেছে। ওর সব পার্ট মুখস্থ। আপনি ওকে একটা চান্স দিয়ে দেখুন ও আমার চেয়ে ভালো মিঠুয়া হয়ে দেখাবে!”
স্বপ্নাদি যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “তৃষা? কিন্তু, কিন্তু…”
মলি চট করে বলল, “আমি ওর জন্যে একটা জামাও এনেছি। আমার কিছুটা বড়ো হয় তাই ওর ঠিক হবে আর ওর চশমার পাওয়ার খুব কম আর তাও দূরের জন্যে, ওটা খুলে নিলেই হবে। আপনি চাইলে ওকে দিয়ে কয়েকটা ডায়ালগ বলিয়ে দেখতে পারেন। ও আমার চেয়ে ভালোই করবে, খারাপ করবে না!”
নাটকের অন্য মেয়েরাও তখন জোর দিতে লাগল। নাটক বাতিল হয়ে যাক সেটা তো আর কেউ চায় না! অগত্যা স্বপ্নাদি তৃষাকে মিঠুয়া সাজিয়ে স্টেজে পাঠাতে রাজি হলেন। তৃষা প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। কী হচ্ছে বুঝতে পারেনি তারপর মলি ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে মুচকি হাসতে সে বুঝেছিল কাজটা কার।
দর্শকের আসনে বসে মলি আনন্দের সঙ্গে দেখেছিল যে সে প্রতিভা চিনতে ভুল করেনি। তৃষা অসাধারণ অভিনয় করেছিল মিঠুয়ার চরিত্রে। টিচাররাও সবাই একেবারে থ! কেউ ভাবতেও পারেনি যে তৃষা কোনদিন ক্লাসে মুখই খোলে না সে কিনা অত ভালো অভিনয় করবে।
সেদিন বিকেলে তৃষা মলিদের বাড়িতে গিয়ে প্রচণ্ড অবাক হয়ে দেখল মলির মাথার ঢাউস পট্টি আর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা দুটোই হাওয়া! আর হবে নাই বা কেন, আসলে তো ওর কিছুই হয়নি। পুরো ব্যাপারটাই তো তৃষাকে সুযোগ দেওয়ার জন্যে করেছিল মলি।
তৃষার মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছিল না।
ওর অবস্থা দেখে মলি হেসে বলল, “আমি বুঝতে পারছিলাম তোর বিশাল প্রতিভা কিন্তু তুই নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু করবি না তাই আমাকেই যা করার করতে হল!”
তৃষার চোখে জল, সে বলল, “আজ বুঝতে পারছি তুই সত্যিই আমার প্রকৃত বন্ধু!”