অক্ষাংশ ২৪.২উঃ, দ্রাঘিমা ৮৬.৮পূঃ। মধুপুরের দু'পাশ দিয়ে দুটি নদী গিয়ে পড়ে অজয় নদে। দক্ষিণেরটি জয়ন্তী, অপেক্ষাকৃত বড়। আর উত্তরেরটি পাথরো বা পাথরোল, একটু সংকীর্ণ। সে গিয়ে অজয়েতে পড়ে ঐ যে জায়গাটির হিসেবী ভৌগোলিক অবস্থান এইমাত্র বললাম, ঠিক ওই খানে। সামান্য উত্তরে দোমোহানির শিব মন্দির, দোমোহানির মেলার মাঠ। মেলাটি ছিলো উঠতি বয়সের কিশোরদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়, কেন না দু' তিন জনে মিলে আনা আষ্টেক চাঁদা তুলে ফেলতে পারলেই জগতের বেশ কিছু বিস্ময়কর বিষয়ের সামনের যবনিকা সরে যেতো।
দোমোহানির মাইল দশেক উত্তরে ছিলো পাথরোল গ্ৰাম, জাগ্ৰত দেবীর মন্দির এবং সেই মন্দিরের দৌলতেই বর্ধিষ্ণু স্থানীয় জমিদারী যাকে অনেকেই বলতো রাজ।
অনেক দূরে উত্তর দিকে ভাগলপুর জেলায় গঙ্গার ধারে শহর সুলতানগঞ্জ। অজগৈবীনাথ শিবের মন্দির। ভগীরথের ডাকে নীচে নামতে নামতে বারাণসীর কাছে জাহ্নবীর প্রবল ইচ্ছে হয় মহাদেবকে আরেকবার দেখতে। হন তিনি কিছুক্ষণের জন্য উত্তরবাহিনী। কিন্তু ভগীরথের তপস্যা বলে কথা! ফিরতে হয় সুরধুনীকে আবার। সুলতানগঞ্জ পৌঁছে আবার হয় সেই ইচ্ছে। পুনরায় ভাগীরথী উত্তরবাহিনী। কিন্তু আদিদেব জানতেন জটাশ্রিতা আবার হবেন অসফল। তাই তিনি স্বয়ং সুলতানগঞ্জে থিতু হয়ে গেলেন। ওই যে বললাম অজগৈবীনাথ। যে মন্দিরে যাওয়ার সহজ পথ ছিলো গঙ্গার ওপর, নৌকোয় যেতে হতো। ডাঙার দিকটা খাড়া পাহাড়।
এ কাহিনী লোকমুখে শোনা। তাও বিস্কুটোয়া দিয়ে চায় খেতে খেতে।
যাই হোক আজও স্বীয় মানত মাফিক লোকে দল বেঁধে কাঁধে ছোট ছোট বাঁকে উত্তরবাহিনীর জল নিয়ে দেওঘরে গিয়ে শিবের মাথায় ঢালে। ওদের বলে কাঁওয়ারিয়া।
ঘাটের ধারে ছোট ছোট নৌকো থেকে মুসলমান মাঝিরা চেঁচিয়ে কাঁওয়ারিয়াদের ডাকতো--
- আরে হো ভাইয়া হো সেঠজী, ই ঘাটোয়া মে পানি ঠিক নেহি বা, বাবাকে ইবাদৎ কে লিয়ে মায়ীকা আচ্ছা পানি লেনা হো তো ইস সফিনামে আও, দর্মিয়ানী দরিয়াসে পানি লিও, তীন কাঁওয়ারিয়ে ইক পায়সা।
আর তাই শুনে ত্রিশূল বসানো মুসলমান মাঝির ডিঙিতে চড়ে মাঝগঙ্গায় ঘটি ভরতো পুণ্যার্থী হিন্দু দেওঘর যাত্রীরা।
১৯০০ সাল নাগাদ বোধ হয় আপনাদের এই কাহিনীর শুরু। সুলতানগঞ্জে মাঝি হুসনলাল পাথরোল রাজের দেওয়ানকে নৌকোয় ডাকে। বজরায় হেলান দিয়ে ফর্শী টেনে অভ্যস্ত দেওয়ানজী সেই নৌকোর চেহারা দেখে ঘাবড়ে যান। জলটুকু শেষ পর্য্যন্ত হুসনলালই এনে দেয়। বরকন্দাজ দিয়ে জলটা দেওঘরে পাঠানো হয়, পুণ্যটুকু গিয়ে ঢোকে দেওয়ানজীর কুর্তার জেবে।
ওই মাঝিরা আসলে বংশগত পেশায় গঙ্গার মাছধরা জেলে। এককালে নবাবের সনদওয়ালা পানিদারদের খাজনা দিয়ে পেশা চালাতো। ইংরেজ আমলে নবাবী আইন কানুন ঢিলে হয়ে যাওয়ায় ওরা কাঁওয়ারিয়াদের সঙ্গে উপরি রোজগারের ওই ব্যবসাটিও করতো।
রাজবাড়ীর কাছে পাথরোল নদীতে শ্রাবণ ভাদ্র মাসে জল থাকতো, খেয়া চালাবার তখন একটা মানে হতো। আবার কাছেই দু'দুটো বাঁওড়ও ছিলো, তাদের ছোটটা গিয়েছিলো মজে। শুধু মাঝে মাঝে দুয়েকটা মাগুর মাছ দেখা যেতো। বড় বাঁওড়টা কিন্তু মাছে ছিলো ভর্তি - সোনা বোয়াল, মাগুর আর কুঢো চিংড়ি। তার অবিশ্যি একটা কারণ ছিলো - বন্য বরাহের ও ছাগের মাংস ও দিগরে সহজলভ্য ও বেশী জনপ্রিয় ছিলো, মাছ বিশেষ কেউ খেতো না।
ওই মাছের, আর বছরে দুমাস খেওয়ানেহারের কাজের বছরভর মাইনের লোভ দেখিয়ে হুসনলালকে দেওয়ানজী পাথরোলে নিয়ে এলেন। সঙ্গে এলো বিবি ও শিশুপুত্র প্যারেলাল।
প্যারেলালের বিয়ে হয় বছর কুড়ি পরে, আর আমাদের কালকেতু, মানে জীবলাল ভূমিষ্ঠ হয় ওই তারও কিছু পরে।
আমি? তা আমি এখানে কি করছি? বলি।
আপনারা জানেন হেমন্ত কালে কালীপুজো হয়। পাথরোলে আরো দুবার হয় বছরে। শীতে আর গরমকালে। বাঙালী পুরোহিত। ঠাকুরদাদা অবসর নেওয়ার পর পৌত্র নারায়ণ চন্দ্র ভট্টাচার্য পুরোহিত হয়েছিলেন, কেন না ওনার বাবা ছিলেন ন্যাটা।
তা একবার, বোধ হয় ১৯৬৩ সালে, গরমের পুজো দেখতে যাই দিদার সঙ্গে। সেখানে দেখি একজন ফর্সা সুন্দরী বিধবা প্রৌঢ়া পাশের চাতালে বসে রয়েছেন। পরিচারিকারা বাতাস টাতাস করছে। আর তিনি নানা খোঁজ খবর নিচ্ছেন তাঁর থেকেও আরো অনেক অনেক ফর্সা একজন দৈত্যের কাছে। সাড়ে ছ ফুট তো হবেই সেই কালকেতু।
আমি দিদাকে জিগ্যেস করলুম - উনিই কি রাণী? তা দিদা বললেন - না রে উনি রাণীর ননদ, মানে কুমারের বিধবা বড়পিসিমা।
গাঁয়ের থুড়থুড়ে বুড়ো মুদি ছিলো আমার বিশেষ পরিচিত। চা বিস্কুটও ওর দোকানে পাওয়া যেতো, কলকাতা ফেরত লোক, ওই প্রথম আমাকে ডবল হাফ খাওয়ায়। নিজে তৈরী করে।
বাকী ইতিহাস ঐ লাছুচাচার জবানে সেদিনই শোনা। আপনাদের বাংলাতেই লিখছি, পড়ে ফেলুন।
...............................
ঐ তুই যে তালগাছটাকে কালকেতু বলছিস, ও হলো হুসনলাল মাঝির ছেলে প্যারেলাল জেলের ব্যাটা জীবলাল। ওরা সুন্নি। হুসনলাল এসেছিলো সুলতানগঞ্জ থেকে। উত্তরবাহিনীর মাঝি ছিলো ও সেখানে।
আমি যখন কালীঘাটে দোকান দিয়েছিলাম, সেই তখন ওরা হয়। ওরা মানে প্যারেলালের ঘরে জীবলাল আর রাজবাড়ীতে এই বড় রাজকুমারী। ওনার তখন ডাকনাম ছিলো রামনী। এক বছর আমি কাজে দেশে এসেছিলাম, সে বছর একটা কাণ্ড ঘটে। এক গাদা ফুল কোঁচড়ে নিয়ে রামনী দৌড়ে দালানে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। জীবলালটা কাছেই ছিলো, এগিয়ে এসে ধরে তোলে রামনীকে।
একটা পাইক দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে, সে তখন জীবলালটাকে ধরে ভীষণ মারে, মুসলমান হয়ে রাজকুমারীর গায়ে হাত দিয়েছে বলে। রামনী কান্নাকাটি করে অনেক কষ্টে জীবলালকে বাঁচান।
রাজামশাই সব জানতে পেরে যান।
তারপর থেকেই জীবলাল আর ওদিকের সব ছেলেপুলেরা রাজবাড়ীর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশেছে, খেলাধুলো করেছে, অবিশ্যি রাজামশাইয়েরই হুকুমে। আর এরা দুজন তো বন্ধু, বীরভূমের ওদিকে রামনীর শ্বশুরবাড়ি, সেখানেও জীবলালকে কাজে পাঠানো হয়েছে। রাজামশাই আর বেরোন না, বয়স হয়েছে, দরকারী কাজে ওই জীবলালটাকেই ডাকেন।
পুজোর দিনগুলোয় দেখবি জীবলাল ঠিক অশ্বত্থ তলায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ওর বাপ প্যারেলালটা আজ থাকলে মজা পেতো।
বিস্কুট খাবি?
...............................
চণ্ডীর বড় ঘোড়ার টাঙায় আরামে দিদার সঙ্গে মধুপুরে ফিরতে ফিরতে দিদাকে সদ্য শোনা ইতিহাস বললাম। দিদা সব শুনে একটু হাসলেন। তারপর বললেন
- বাগবাজারে নিকিরী পাড়াটা কাছেই ছিলো তো, মুসলমান মাঝি আর জেলে অনেক দেখেছি। ওদের দেবতা অন্য, তার নাম বদর। হিঁদু পুরুত দিয়ে কখনো কখনো পুজো টুজো করায়। ওই যুগীর বাউন আর কি। তা হ্যাঁ রে তুই এত দূর সাইকেলে আসিস? সাবধানে চালাস বাপু!