• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • "হারিয়ে যাওয়া গানের খাতা" স্মৃতির ধারাপাত : পাপিয়া ভট্টাচার্য

    হারিয়ে যাওয়া গানের খাতা — যশোধরা রায়চৌধুরি ; প্রচ্ছদ- সৌরীশ মিত্র; প্রকাশক- ৯ঋকাল বুক্‌স; কলকাতা- ৭০০০২৫; প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০২৩; ISBN: 978-93-93186-22-5

    সুর তাল ও শব্দ এগুলো শুধুই সঙ্গীতের অঙ্গবিশেষ তা নয়, জীবনেরও বটে। মাইলের পর মাইল হেঁটে চলা দিন আর বছরের পর বছর কাটিয়ে আসা রাতগুলো জমা থাকে প্রাচীন কোনও এক রাগের গর্ভে। সেই গর্ভের বন্ধনেই সৃষ্টি হয় জীবনের বন্দিশ। সময় সে তো নদীর মতোই সদা বহমান। তার বহমানতার সঙ্গেই বদলে যায় পৃথিবীর রঙ, রূপ। বদলে যায় চেনা চারপাশ। পলেস্তরা খসা অতীতের গায়ে লাগে বিশ্বায়নের প্রলেপ। তবুও মরসুমি প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা যেমন করে উষ্ণ, শুষ্ক মাটির বুকের ভেতর থেকে চুরি করে আনে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ ঠিক তেমন করেই লেখিকা যশোধরা রায়চৌধুরি তার স্মৃতির ভাণ্ডার উজাড় করে বের করে এনেছেন কিছু অনন্ত মুহূর্তের জলছবি। ঝরিয়েছেন স্মৃতির অবিরাম ধারাপাত। যার নাম "হারিয়ে যাওয়া গানের খাতা"।

    বাংলা সাহিত্য জগতে যশোধরা রায়চৌধুরী এখন একটা নাম। এ নামের সঙ্গে বাঙালি পাঠক মহল অল্পবিস্তর সবাই পরিচিত। এই স্মৃতিকথাটি সেই পরিচিতির মুকুটে নতুন পালক সংযোজন করলো একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। স্মৃতিকথাটিকে ভাগ করা হয়েছে অনেকগুলি পর্বে। পর্ব নয় যেন পসরার ডালি সাজিয়ে বসেছেন লেখিকা। রয়েছে আশৈশবের সঞ্চিত খাজানা – ভাললাগা বইয়ের সম্ভার, রয়েছে আজকের মাল্টিপ্লেক্সের জমানায় সেদিনের সিঙ্গেল স্ক্রিনের রূপকথা। আছে পুরনো কলকাতার কিছু নামিদামি এবং ছোটবড় রেস্তোরাঁর নাম ও খাদ্য তালিকা, যা দেখে অনায়াসেই রসসিক্ত হতে পারে খাদ্যরসিক পাঠকের রসনা। আছে আরও অনেক কিছু যা পাঠকের কাছে প্রকাশের অপেক্ষায়।

    তিন প্রজন্মের অতীত ইতিহাসে জড়িয়ে থাকা হাজার ঘটনার সমাবেশ। স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে উঁকি দিয়ে গেছে সেই সব ছোটবড় গল্পেরা। শুধু গল্প নয়, এখানে জায়গা করে নিয়েছে এমন কিছু গান যে গানে আজও চোখের পাতায় ভিড় করে আসে নস্টালজিয়া। প্রতিটা পর্ব শুরুই হয়েছে এক একটি গান দিয়ে। এখানেই স্মৃতিকথাটির অভিনবত্ব। গানকে সঙ্গী করে স্মৃতির সরণি ধরে পথ চলা। জীবনকে সুর সপ্তকে বাঁধার এক অনন্য প্রচেষ্টা। কখনও লোকগান, কখনও রবীন্দ্রনাথের গান, কখনও রামপ্রসাদী আবার কখনও আগমার্কা সিনেমার গান। কত গান কত সময়ের সাক্ষ্য বহন করে। কত গানের মধ্যে দিয়ে ঘটে যায় জীবনের ঋতু পরিবর্তন। কিছুটা স্মৃতি চুরি করে তারাই উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গেছে লেখিকার গানের খাতায়। বাংলা এবং হিন্দি গানের পাশাপাশি রয়েছে ইংরাজি গান শোনার স্মৃতিও। " এসব গানের মায়া এতই, যে, নস্টালজিয়ায়, আজো কার্পেন্টার আর আব্বার গান শুনলে আমার চোখে জল এসে যায়। আমার বয়স দশ, দিদির পনেরো ষোলো। সময়টা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। এই সব সময়ে দিদি ওই গানগুলো শুনতো আর গাইতো।"(পৃ-১০৫)

    খুব ছোট বয়সে বাবাকে হারানো লেখিকার কাছে মা ছিলেন তার অর্ধেক পৃথিবী। যে সমাজে অভিভাবক বলতে এখনও পুরুষকেই বোঝায়, সেই সমাজে পুরুষ বর্জিত সংসারের গাড়ি একাই চালিয়ে নিয়ে গেছেন মা উমা দেবী। বিশেষ করে সময়টা যখন ষাট থেকে সত্তরের দশক। এই স্মৃতিকথাটিতে তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সমকালীন মহিলাদের তুলনায় তিনি শিক্ষা, রুচি এবং ব্যক্তিত্বে ছিলেন অনেকটাই এগিয়ে। অকাল বৈধব্যকে মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু বৈধব্যের ছুৎমার্গ নিয়ে জীবনকে যাপন করেননি। মেয়েদের হাতেও ধরিয়েছিলেন সেই শিক্ষা এবং উদারতার ব্যাটন। আসলে উত্তরাধিকার সুত্রে উমা দেবীও এই ব্যাটন পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকেই। তিনিও ছিলেন শিক্ষিতা, সঙ্গীতজ্ঞা, সর্বগুণসম্পন্না একজন বিদুষী। লেখিকা তাঁর মা উমাদেবীর ধর্মীয় উদারতার প্রসঙ্গে বলেছেন, " একবার ধূপকাঠি বেচতে আসা ছেলেটার কাছ থেকে বেশ কটা প্যাকেট কিনে তারপর তার নাম জিজ্ঞেস করে জেনেছিলেন সে রফিক বা রহিম, অর্থাৎ মুসলমান। মৃদু হেসে তাকে বিদায় দিয়েছিলেন এই বলে, যে, সবাইকে আবার নামটা বলে দিস না বাপু, তোর ধূপ না- ও বিক্রি হতে পারে। "(পৃ -১৩২)

    আত্মকথাটিতে কাটাছেঁড়া করার তেমন কোনও জায়গা নেই। পাঠ শেষে সুখানুভূতিটুকুই শুধু রয়ে যায়। এখানে লেখিকা যশোধরা রায়চৌধুরি একটি দীর্ঘ সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শব্দের সাবলীলতা তাকে সঙ্গ দিয়ে গেছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তাই তো তার জবানিতে মিলেমিশে কোথাও একাকার হয়ে গেছে কৈশোরের অঙ্ক ভীতি আর যৌবনের প্রেম। এ বিষয়ে মন ছুঁয়ে যাওয়া কয়েকটি বাক্যবন্ধ :- "আমার অঙ্কের ভীতির প্রাচীনতম স্মৃতি তেরোর ঘরের নামতা। আমি পালাচ্ছি আমাদের বিশাল বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে, করিডোর দিয়ে, বাথরুমের কোণে এসে দেখছি আর পালানোর জায়গা নেই। বেশ হরর ফিল্মের মতো। পেছন পেছন মা দৌড়ে আসছেন, উত্তেজিত। একের পর এক প্রশ্ন, চার তেরোং কত, বল? পাঁচ তেরোং কত? ছয় তেরোং?" (পৃ-৬৪) এ যেন অকপট স্বীকারোক্তি। অঙ্কে আতঙ্ক আর নামতায় তেরোয় গেরো— এ তো সবার জীবনেই চিরন্তন সত্য। লেখিকাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ঠিক একই রকম ভাবে সহজ সরল তার প্রেমের প্রকাশ। " সেই এক একটা বর্ষা কেমন অনন্ত স্মৃতির পঞ্জি খুলে দিতে থাকে আজও আমার সামনে। কোনও একবার ২ জুলাইয়ের এই বর্ষায় কলেজের ছেলেবন্ধু, আজকাল যাকে বি এফ বলে ডাকা হয়, সেই বালকটির সঙ্গে ফিরছি এইভাবেই, হাঁটু জল ঠেলে। বাড়ির কোনও কোণের ঘর, গ্যারেজের ওপরে মেজেনাইন ঘর বা চিলেকোঠার ঘরে তাকে চালান করব…. বা সে সমেত চালান হব কিছুক্ষণের জন্য, এই দুরাশা প্রাণে। কোনওমতে ছাতা সামলাচ্ছি,ন্যাতা হয়ে যাওয়া, পায়ে লেপটে থাকা শাড়ি সামলাচ্ছি…. হঠাৎ এ ওর দিকে তাকিয়ে ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ফেলি, আর সেই দিনটা হয়ে যায় স্মৃতির চৌকো সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো রোমান্টিকতম দিনের নমুনা। এক্কেবারে অমিতাভ বচ্চন - মৌসুমী চ্যাটার্জির সেই - 'রিমঝিম গিরে সাওন' - এর সিন।" (পৃ -২৪৬)

    কিছু কিছু স্মৃতিকথা স্বতন্ত্র হয়েই থেকে যায় কিন্তু "হারিয়ে যাওয়া গানের খাতা" পরিবেশনের গুণে সেই স্বতন্ত্রতার বেড়া টপকে হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। সে দিদুর হাতের চিতই পিঠে থেকে ফ্যাশনে গার্ডেন ভারেলি হোক অথবা ফাউন্টেন পেনে লেখা প্রেমপত্র থেকে রেডিওতে বোরোলিনের সংসারই হোক। সত্তর থেকে আশির দশকে যাদের বেড়ে ওঠা তারা এই স্মৃতিকথাটির মধ্যে দিয়ে অনায়াসে ঝালিয়ে নিতে পারেন ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, কিম্বা একবার ঘুরে আসতে পারেন ডাউন মেমোরি লেন।

    তিনশ ছাব্বিশ পাতার এই বইটিতে লেখিকা পরিক্রমা করেছেন জীবনের রাজপথ থেকে কানাগলি। মিলিয়েছেন আলোর সঙ্গে অন্ধকারকে। মিলিয়েছেন হারানোর সঙ্গে পাওয়াকে। নিখুঁত সুরে গেয়েছেন সুখ - দুঃখ - হাসি - কান্নার মেলোডি। নিজেকে বারবার বেসুরো বললেও এখানে কোনওরকম সুরবিচ্যুতি ঘটেনি। একটা সময় একটা প্রজন্মের কথা বলে। কিন্তু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছলেই শুরু হয় তুল্যমূল্য আলোচনা। এ ব্যাপারে লেখিকা একশ শতাংশ আশাবাদী। যা হারিয়েছেন আর যা পেয়েছেন সবটাই অ-তুলনীয়।

    জীবনের জলতরঙ্গ কখনও সাদাকালো সুরে বাজে না। জীবন বৈচিত্র্যময়, জীবন বর্ণময়। আর সেই বর্ণময় জীবনের সাত রঙা রামধনু আশ্রয় খোঁজে সময়ের ক্যানভাসে। বর্ণ থেকে বিবর্ণতার পথে রেখে যায় কিছু স্মৃতির মাইল ফলক। ছোট ছোট টুকরো টুকরো মুহূর্তের কোলাজ আর "হারিয়ে যাওয়া গানের খাতা"।

    সৌরীশ মিত্রের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ অনবদ্য।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments