- সায়ন্তনী চক্রবর্তী, সায়ন্তনী চক্রবর্তী।
তৃষা রিসেপশনের পাশে অন্যদের সঙ্গে একটা সোফায় বসে কিছু ভাবছিল। রিসেপশনিষ্টের ডাক সে শুনতে পায়নি। সাড়া না পেয়ে মেয়েটি শেষে কাউন্টার থেকে উঠে এসে বলল, তুমিই সায়ন্তনী তো? ম্যাম তোমাকে যেতে বললেন।
তৃষা তাড়াতাড়ি উঠে সুইং ডোর ঠেলে ভিতরে ঢুকল। তার একটু ভয় ভয় করছিল। ঢুকে দেখল বেশ বড় ঘর। ডানদিকে একটা বিশাল সোফা রাখা আছে। সামনে আর একটু এগিয়ে বিশাল টেবিল, পিছনে সঙ্ঘমিত্রা আন্টি বসে আছেন। তাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, এসো তৃষা৷
সে উল্টোদিকের চেয়ারটায় গিয়ে বসল। আন্টিকে সে আগে দেখেছে তার কলেজের বন্ধু দীপার বাড়িতে, কথাও হয়েছে। উনি দীপার মাসি হন।
সঙ্ঘমিত্রা বললেন, তুমি আসবে দীপা আমাকে বলেছিল। এখন কলেজ থেকে আসছ? খাবারটাবার কিছু আনাতে বলি?
সে লজ্জা পেয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, আমি খেয়ে এসেছি। আরও দু-চারটে কথার পর সে দেখল বেশ হাল্কা লাগছে। আন্টি কিছু জিগ্যেস করার আগেই সে নিজে থেকেই বলল, আমার. . . মাঝেমধ্যে খুব ভয় করে।
সঙ্ঘমিত্রা হাসিমুখে বললেন, সে তো সবারই করে। আমার ছেলে বাইরে একা থেকে চাকরিবাকরি করে, এখনও কুকুর দেখলে ভয় পায়। তোমার কি এরকম বিশেষ কিছুতে ভয়?
সে দুদিকে মাথা নেড়ে বল৷ না, না৷ এমনি একটা ভয় ভয় ভাব। ছোটখাট ব্যাপারে টেনসন হয়।
- যেমন?
সে একটু ভেবে বলল, যেমন বাবার অফিস থেকে ফিরতে বেশি দেরি হলে। কিম্বা বাড়িতে কিছু দুলে উঠলে মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে।
সঙ্ঘমিত্রা বললেন, এটা কি অনেকদিনের সমস্যা না ইদানীং হচ্ছে?
--হয়ত আগেও ছিল, তবে এখন বেশি ফিল করি ... আর…
--হ্যাঁ বলো।
-- মাঝেমধ্যে রাত্রিবেলা ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসি৷ তখন খুব ভয় করে।
-- স্বপ্ন দেখে?
-- তা জানি না৷ ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর কিছু মনে থাকে না।
সঙ্ঘমিত্রার কপালে ছোট একটা ভাঁজ পড়ে দ্রুত মিলিয়ে গেল। তিনি বললেন, এই সমস্যা নিয়েও অনেকে আসে। তোমার কি কখনও খুব ভয়ের কোনও অভিজ্ঞতা বা ট্রমা জাতীয় কিছু হয়েছিল? বা ছোটবেলায়? ধর কেউ তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল। বা ভিড়ের মধ্যে বাবা-মার থেকে আলাদা হয়ে গেছিলে... তৃষা দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, না, সেরকম কিছু আমার মনে পড়ে না।
সঙ্ঘমিত্রা বললেন, ইন এনি কেস, কয়েকটা সেসন করলে ঠিক হয়ে যাবে। এখন তোমার যে সমস্যাটা হচ্ছে, সেটা কোন ঘটনার জন্য হচ্ছে না, হচ্ছে সেই ঘটনা নিয়ে তোমার ব্যাখ্যা বা ইন্টারপ্রিটেশনের জন্য। সেটা নিয়েই আমরা আলোচনা করব।
তৃষা ঘাড় নাড়ল। সঙ্ঘমিত্রা বললেন তবে আজ আমরা চেষ্টা করে দেখব যদি অতীতের কোন স্মৃতি থাকে তা তোমার মনে ভাসিয়ে তোলা যায় কি না। সেক্ষেত্রে তোমার পক্ষে কাজটা সহজ হবে। এসো।
তিনি তৃষাকে সোফায় বসিয়ে নিজে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পাশে বসলেন। ঘরের আলোটা কমে গেল।
বললেন, আমার কথা শুনতে থাকো। শরীর, মন ছেড়ে দাও। ঘুম ঘুম লাগতে পারে, তবে ঘুমিয়ে পড়ো না৷
তৃষা ভয়ে ভয়ে বলল, আমাকে কি হিপ্নোটাইজ করবেন?
সঙ্ঘমিত্রা হেসে বললেন, হিপ্নোটাইজ কথাটা খুব ভারী। ধরে নাও আমি তোমাকে রিল্যাক্স করতে সাহায্য করব।
তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো, আমার কথা শেষ হলে তুমি যা মনে আসছ বা দেখছ বলবে।
ঘরের আলোটা আরও কমে এল। সে চোখ বন্ধ করল। কোথাও হাল্কা করে একটা মিউজিক বাজতে শুরু করেছে৷ খুব সুদিং। সঙ্ঘমিত্রা কি কিছু বলছেন? ওনার স্বর যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।
একটু পরে তৃষার মনে হল সে জেগে থেকেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। শরীর জুড়ে অদ্ভুত প্রশান্তি।
সঙ্ঘমিত্রার গলা এবারে কাছ থেকে শোনা গেল। উনি মৃদুস্বরে বললেন, ছোটবেলার কথা ভাব তৃষা। তোমার স্কুল… বাড়ি… খেলার মাঠ... যা তোমার মনে আসে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে তৃষা সঙ্ঘমিত্রার কথামত খুব ধীরে ধীরে উঠে বসল। তার পর সঙ্ঘমিত্রার মুখোমুখি এসে বসল। তার শরীরে মনে এখনও আচ্ছন্ন একটা ভাব। সঙ্ঘমিত্রা বললেন, যখন ঠিক লাগবে কথা বোল।
তৃষা আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অনেক কিছু দেখলাম। কিছু ভুলে যাওয়া জিনিস।
সঙ্ঘমিত্রা হেসে বললেন, সে তো ভালই।
তৃষাও হাসল, বলল, একটা বিশাল টেডি বেয়ার দেখলাম। ওটা বোধহয় বাবা আমার পাঁচ বছরের জন্মদিনে কিনে দিয়েছিলেন। এখন মনে পড়ছে।
তারপর বলল, আমার একটা কুকুর ছিল। সেটা দেখলাম সবসময়ে পায়ে পায়ে ঘুরছে।
বলতে বলতে সে হঠাৎ থেমে গেল। সঙ্ঘমিত্রা তাকে দেখছিলেন। বললেন, আর কিছু? ভয় পাওয়ার মত কিছু?
তৃষা ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নেড়ে আবার চুপ করে গেল। সঙ্ঘমিত্রা বললেন, ঠিক আছে। পরের দিন থেকে আমরা শুরু করব।
সেদিন গভীর রাতে তৃষা ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসল। ভয় নয়, অবিশ্বাস, লজ্জা আর ঘৃণা মিলিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি৷ সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
তৃষা চেম্বারে ঢুকে দেখল, ঘর ফাঁকা, কেউ অপেক্ষা করছে না৷ রিসেপশনিষ্ট মেয়েটি হাসিমুখে বলল, যাও, ম্যাডাম তোমার জন্যই অপেক্ষা করছেন।
সে সুইং-ডোর ঠেলে ভিতরে ঢুকল। সঙ্ঘমিত্রা হাসিমুখে বললেন, এসো। সে তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারে বসল, বসে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। একটু পরে সঙ্ঘমিত্রা বললেন, তোমাকে খুব স্ট্রেসড দেখাচ্ছে। টেক ইওর টাইম।
তৃষা কেঁদে ফেলল। দুহাতে মুখ ঢেকে সে অনেকক্ষণ কাঁদল, কান্নার ফাঁকে একবার মুখ তুলে বলল, আমার মনে পড়েছে, আন্টি। সঙ্ঘমিত্রা চুপ করে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে কান্না থামিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বলল, সরি আন্টি।
সঙ্ঘমিত্রা মৃদুস্বরে বললেন, ইটস ওকে।
তৃষা ধীরে ধীরে বলল, একটা ঘর মনে পড়ছে। হয়ত আমাদের পুরনো ফ্ল্যাট। আমার কুকুরটাকে দেখছি ... ডাকছে... উনি কথা বলছেন, তাও মনে আছে… আমাকে কাছে ডাকলেন... তারপর...
সে থেমে গিয়ে আবার দুহাতে মুখ ঢাকল। সঙ্ঘমিত্রা আবার বললেন, ইটস ওকে।
তৃষা একটু পরে মুখ তুলে বলল, আমি এখন কি করব আন্টি?
সঙ্ঘমিত্রা নরম গলায় বললেন, সেটা তোমাকেই ঠিক করতে হবে, তৃষা। থেরাপিস্টের কাজ ঠিক উপদেশ দেওয়া নয়, সমস্যাটা বুঝতে সাহায্য করা। এটা ভাল যে সমস্যাটা এখন বাইরে এসেছে, হয়ত আর অহেতুক আতঙ্কে থাকতে হবে না।
তুমি এখন চাইলে ব্যাপারটা ভুলে যেতেও পার।
তৃষা অসহায় ভাবে বলল, আমার মাথা কাজ করছে না আন্টি আপনিই বলুন।
সঙ্ঘমিত্রা বললেন, আমার মনে হয় প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে কিছু আদিম প্রবৃত্তি লুকিয়ে থাকে। এর সামনে মানুষ অসহায়। সমাজ ও শিক্ষার প্রভাবে সেটা চাপা থাকে, কখনও বেরিয়ে আসে। তুমি একটা ঘটনা দিয়ে একজনকে বিচার করতেই পার, আমরা অনেকেই করি, তবে স্নেহ-ভালবাসা, কর্তব্যনিষ্ঠা, কিছুটা আত্নত্যাগ এসব নিয়েই তো মানুষটা।
তৃষা চোখ বন্ধ করল। ঠিক এই কথাগুলি তারও মনে হয়েছে।
একটু পরে সে বলল, কিন্তু এতবড় একটা ব্যাপার মার কাছে লুকিয়ে রাখব ভাবতে পারি না। জানি উনি কষ্ট পাবেন তবু।
সঙ্ঘমিত্রা বললেন, অবশ্যই ওনার জানার অধিকার আছে। মেয়ে হিসাবে তোমারও সেটা কর্তব্য। সবদিক ভেবে তোমাকেই ঠিক করতে হবে। যাই হোক, তুমি এবার রেগুলার থেরাপি সেসনটা চালু কর। মন শান্ত থাকলে সিদ্ধান্ত নেওয়াও সহজ হয়।
চেম্বার থেকে তারা একসঙ্গেই বেরল, সঙ্ঘমিত্রা গড়িয়াহাটের দিকেই যাবেন৷ তাকে কিছুটা এগিয়ে দেবেন বলেছেন। সে গাড়িতে উঠে তাঁর পাশে বসল। শীতে ভেজা আলো-ঝলমল সন্ধ্যায় রাসবিহারী দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল। চালাতে চালাতে সঙ্ঘমিত্রা বললেন, থেরাপিস্ট নয়, শুভার্থী হিসাবেই তোমাকে একটা কথা বলি। জীবনকে বেশি জটিল না করাই ভাল। কিছু সমস্যা, কিছু বিপর্যয় সব মানুষের জীবনেই আসে। এটা মনে রাখলেই দেখবে অনেক হাল্কা লাগছে।
তৃষা চা বানাচ্ছিল। ছোটখাট রান্নাঘরের কাজ সে অনেকদিন ধরেই করছে, এখানে এসে সে অনেকটাই করে। গীতাদি অবশ্য সকালে ও-বাড়ির কাজ সেরে বিকেলে এখানে আসে, যতটা পারে করে দিয়ে যায়। মাকে সে প্রায় মেয়ের মত আগলে রেখেছে।
চা ভিজিয়ে রেখে সে সুদেষ্ণাকে ডাকল। সুদেষ্ণা আসতে আসতে সে চা ছেঁকে দু কাপ চা আর প্লেটে বিস্কুট নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখল।
মা - মেয়ে মুখোমুখি বসে চায়ে চুমুক দিলেন। ও-বাড়ি ছেড়ে আসার পর সুদেষ্ণা কথা কমই বলেন, তৃষার মনে হয় না-বলা কথাগুলি সুদেষ্ণাকে ঘিরে বাতাসে ঝুলে আছে। সে চেষ্টা করে নানা প্রসঙ্গ তুলে তাঁকে স্বাভাবিক করে তুলতে। কিন্তু সুদেষ্ণা খালি হুঁ-হাঁ করে যান। সঙ্ঘমিত্রা বলেছেন ওটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। মার মুখের দিকে তাকিয়ে ইদানীং যেন কষ্টের থেকে ক্লান্তির ভাব বেশি চোখে পড়ে। শোকেরও কি নিজস্ব একটা ক্লান্তি আছে?
সে বলল, মা, কাল কলেজে প্র্যাক্টিক্যাল আছে, আসতে দেরি হবে। বিকেলে চা-টা করে খেয়ে নিও।
সুদেষ্ণা ঘাড় নাড়লেন। তৃষা আবার বলল, গীতাদিকে বোল রাতের জন্য কটা রুটিটুটি যা হয় করে রাখতে।
সুদেষ্ণা ঘাড় নেড়ে বললেন, ঠিক আছে। রুটির সঙ্গে কি খাবি?
তৃষা বলল, কালকের তরকারি অনেকটা আছে, গরম করে নিলেই হবে।
চা পর্ব শেষ হল। সুদেষ্ণা উঠে যাবার আগে বললেন, আমার ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আর রিপোর্টগুলো ওবাড়িতে পড়ে আছে, গীতাকে বলব নিয়ে আসতে।
তৃষা কিছু বলল না৷ তার মনে হল গীতাদি কি খুঁজে পাবে? গীতাদি আসার আগেই বাবা বেরিয়ে যান, ফোনে বলে দিলে যাবার আগে টেবিলে রেখে যেতেন। সুদেষ্ণা শোবার ঘরে গিয়ে একটা বই নিয়ে খাটে হেলান দিলেন। তৃষার কলেজের প্রোজেক্টের কিছু কাজ আছে, সে ল্যাপটপ নিয়ে বাইরের ঘরে সোফায় গিয়ে বসল। ফ্ল্যাটটা ওয়ান বি এইচ কে, তবে খুব ছোট নয়। দুজনে দিব্যি থাকতে পারে। সুদেষ্ণার এক বন্ধু বাইরে থাকেন, তাঁর ফ্ল্যাট। খালিই পড়ে ছিল।
তৃষা কাজ শুরু করল। এক বন্ধুকে ফোন করে কটা জিনিস জেনেও নিল। ঘন্টা খানেক কাজ করে দেখল আর মন বসছে না।
সে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। এই ফ্ল্যাটটাও একটা কমপ্লেক্সের মধ্যে। এখনও সন্ধ্যা হয়নি, তবে আকাশে লাল ছোপ লেগেছে। নীচে ছোট পার্কে বাচ্চারা হুটোপুটি করে খেলছে। পাশে কাঠের বেঞ্চে কয়েকজন বয়স্ক লোক বসে গল্প করছেন।
খুবই পরিচিত দৃশ্য। তবে ইদানীং তার মনে হয় চেনা শহরের ছবিগুলির উপর সুপার-ইমপোজ করে কে যেন আরও কিছু ছবি লাগিয়ে দিয়েছে। এখন যেমন কদিন আগের সেই সন্ধ্যার ছবিটা সে দেখছে।
বাবা তখনও অফিস থেকে ফেরেননি। তারা দুজনে আজকের মতই টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল। মা বোধহয় বলেছিলেন, ইয়ার এন্ড আসছে, কিছুদিন ওর খুব খাটনি যাবে।
তার মাথার মধ্যে হঠাৎ কিছু একটা হল। সে বুঝতে পারল সে আর নিজের বশে নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলে হয়ত ঝটকাটা চলে যেত, কিন্তু তার আগেই তাকে দিয়ে কেউ বলিয়ে নিল, মা, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
সুদেষ্ণা বিস্মিত ও উদ্বিগ্নভাবে বললেন, বল। কদিন থেকে তোকে কেমন যেন দেখছি।
সে বলতে শুরু করল। কিছু বলে কিছু না-বলে কথা শেষ করে সুদেষ্ণার দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। মার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কথাগুলি যেন সাকার হয়ে তাঁর গলা টিপে ধরেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরল। সুদেষ্ণা একটু পরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্খলিত গলায় বললেন, তুই ঠিক বলছিস তিষু? বলে তিনি তৃষার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তৃষা কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই সে বলল, আমি বলতে চাইনি মা।
সুদেষ্ণার মুখ ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে এল। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে একটু একা থাকতে দে তিষু। তিনি উঠে শোবার ঘরে চলে গেলেন। তৃষা বসে রইল। কি করবে বুঝতে না পেরে সে একবার সঙ্ঘমিত্রাকে ফোন করে দেখল, লাইন বিজি আসছে।
কিছুক্ষণ পরে সুদেষ্ণা বেরিয়ে এসে বললেন, তিষু, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আর এখানে থাকব না। শুভমিত্রার ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে, চাবি কেয়ারটেকারের কাছেই। আমি ওখানে চলে যাচ্ছি, পরে একটা ফ্ল্যাট খুঁজে উঠে যাব। তুই কি করবি দ্যাখ।
তৃষা আকুল ভাবে বলল, মা, আমি তোমাকে ছাড়া কি করে থাকব? কিন্তু দুটো দিন পরে ডিসিশন নিলে হত না। আন্টি বলেছিলেন, এই সমস্যা নাকি অনেকেরই হয়। তুমি কাল একবার ওনার সঙ্গে যদি কথা বলে নিতে...
সুদেষ্ণা বললেন, হ্যাঁ, ওর সাহায্য আমার দরকার হবে। কিন্তু প্রশ্নটা শুধু আমার মানসিক শান্তির নয়। এটা ততটাই নীতির প্রশ্ন। আমি ঘটনাটা কোনওদিন মেনে নিলেও একছাদের তলায় থাকা ঠিক হবে না। তুই যাবি তো স্যুটকেস গুছিয়ে নে।
অমিতাভর জন্য তিনলাইনের নোট লিখে তারা চলে আসে। অমিতাভ এবাড়ির ঠিকানা জানেন না। তিনি ফিরে এসে পাগলের মত বারবার ফোন করেছিলেন। সুদেষ্ণা তোলেননি, তৃষা একবার শুধু নোটে যা লিখে এসেছে সেটাই মেসেজ করেছিল, বাবা, এমন কিছু ঘটেছে তা তোমাকে বলা যাবে না।
আমরা আপাতত আলাদা থাকব ঠিক করেছি। সেইসঙ্গে শুধু একটা কথা যোগ করেছিল, পরে কী হবে জানি না।
তারপর অমিতাভ অনেকবার কল, মেসেজ করেছিলেন, তারা উত্তর দেয়নি। এখন অভিমানে আর করেন না। গীতাপিসীকে বলা আছে সে যে এখানে কাজ করে বাবা যেন কোনভাবেই জানতে না পারে।
আরও কিছু দিন কেটে গেছে। অমিতাভ আর যোগাযোগ করেন না৷ সে চুপি চুপি গীতাপিসীর কাছে খবর নেয়। বাবার শরীর ঠিকই আছে, তবে পিসী বলল, ট্র্যাশক্যানে নাকি প্রায়ই হুইস্কির বোতল পাওয়া যায়। বাবাকে সে বাড়িতে কোনদিন এসব খেতে দেখেনি। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। আন্টির সঙ্গে সেসনগুলির পর সে এখন অনেকটাই খোলামনে ভাবতে শিখেছে, ও বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারেও সে চিন্তা করে। তাদের আলাদা থাকার ব্যাপারটা এখন জানাজানি হয়ে গেছে, তার ও সুদেষ্ণার বন্ধু, আত্মীয়রা তাদের খুঁচিয়ে মারে। এদের মধ্যে অনেকেই প্রিয়বন্ধু ও শুভার্থী, তাদের সামনেও চুপ করে থাকতে হয়।
এর মধ্যেই একদিন স্কুল থেকে ফিরে সুদেষ্ণা বললেন, তিষু তোর সঙ্গে একটা কথা আছে। এভাবে অনির্দিষ্ট কাল থাকা যায় না। আইনি ব্যাপারটা এবার মিটিয়ে ফেলব ভাবছি।
কথাটার একটাই মানে হয়। তবু তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, তোমরা ডিভোর্স করবে?
সুদেষ্ণা চুপ করে রইলেন। তৃষাও চুপ করে গেল। মা আগেও বলেছিলেন, হয়ত একদিন না একদিন বাবাকে ক্ষমা করে দেবেন, হয়ত যোগাযোগও রাখবেন। কিন্তু ওনার সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
সে বলল, বাবা কি মিউচুয়ালে রাজি হবে?
সুদেষ্ণা বললেন, না হবার তো কারণ নেই। আমার তো কোন দাবি থাকবে না। আর তুই তো অ্যাডাল্ট, তুই নিজের ইচ্ছেয় আমার সঙ্গে থাকলে কেউ বাধা দিতে পারে না৷
তৃষা শান্ত গলায় বলল, কারণ আছে মা। বাবা জানতে চাইবেন, কেন আমরা চলে এলাম, কেন তুমি ডিভোর্স চাইছ।
সুদেষ্ণা চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, বললেই কি ও স্বীকার করবে? মনে হয় না। যাই হোক, অন্তত চেষ্টা করেছিলাম জানলে নিজের কাছে সৎ থাকতে পারব।
তৃষা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও মা, আমি তোমার সঙ্গে আছি।
সুদেষ্ণা তাকে দেখলেন। তারপর উঠে এসে স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তৃষা তাঁর বুকে মুখ গুঁজে দিল। একটু পরে সে বুঝতে পারল সুদেষ্ণা কাঁদছেন। ওবাড়ি ছেড়ে আসার পর বোধহয় এই প্রথম। সে সুদেষ্ণাকে তার ছোট শরীরের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে জড়িয়ে ধরল। একটু পরে সুদেষ্ণা স্বাভাবিক হলেন, মৃদুস্বরে বললেন, ছাড়। সে সরে এসে দেখল সুদেষ্ণার চোখেমুখে কান্নার ছাপ থাকলেও কোথাও যেন কাঠিন্য সরে গিয়ে একটু হাল্কাও লাগছে। তার মাথায় হঠাৎ একটা চিন্তা এল, সে সাহস করে বলল, মা একটা কথা বলব।? কোথাও আমাদের বুঝতে ভুল হচ্ছে না তো?
সুদেষ্ণা বিস্মিত হয়ে বললেন, কী করে?
এ প্রশ্নের উত্তর তৃষার কাছে নেই। সে চোখ বন্ধ করলেই ঘটনাটা স্পষ্ট দেখতে পায় সে চুপ করে গেল। সুদেষ্ণা ধীরে ধীরে বললেন, তোর একটা ঘটনাই মনে আছে। আমার তোকে নিয়ে ছোটছোট বেশ কিছু ঘটনা মনে পড়ে। ওর অনেক ব্যবহারই আমার ভাল লাগত না। ভুল ভাবছি ভেবে চুপ করে থাকতাম।
অমিতাভ ভোরবেলা স্বপ্ন দেখছিলেন। তৃষাকে নিয়ে স্বপ্ন। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি জুড়ে সুন্দর একটা কোলাজের মত।
সাতটায় অ্যালার্মের শব্দে স্বপ্ন ভাঙল। তিনি চোখ বন্ধ করে আরও কিছুক্ষণ শুয়ে রইলেন। হঠাৎ মনে হল তৃষা চলে গেলেও এখনও অনেককিছু তার কাছেই রেখে গেছে।
অমিতাভ উঠে রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল বসিয়ে ব্রাশে পেস্ট চাপিয়ে বেসিনে গেলেন। ততক্ষণে জল ফুটে গেছে। তিনি চা পাতা দিয়ে গ্যাস কমিয়ে দিলেন। দরজা থেকে খবরের কাগজ নিয়ে আসার পথে বাঁ-দিকে তৃষার ঘর। আশ্চর্য, মেয়েটা গেছে একমাস হতে চলল, এখনও ঘরে যেন ওর গায়ের গন্ধ ভেসে বেড়ায়।
এই সময় শোবার ঘরে মোবাইল বাজল। তিনি বিস্মিত হয়ে দ্রুত গিয়ে ফোন ধরলেন। ও প্রান্ত থেকে একজন মার্জিত গলায় এত সকালে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে বললেন, আমি অ্যাডভোকেট সুজিত চৌধুরী।
অমিতাভ স্থির হয়ে গেলেন। একটু পরে শান্তগলায় বললেন, বলুন।
সুজিত ফোন করার উদ্দেশ্য জানালেন। কথা শেষ হবার পরেও অমিতাভ অনেকক্ষণ মোবাইলে কান পেতে রইলেন যেন সুজিত আরও কিছু বলবেন। তারপর বললেন, আমার আপত্তি নেই। কোথায় কী সই করতে হবে পাঠিয়ে দেবেন, আমি করে দেব।
সুজিত বললেন, আপনি হয়ত জানেন কেস ফাইল করার পর বিচারক আপনাদের ডাকবেন ও দুজনের কথা শুনবেন। নিয়মানুযায়ী, ছ মাস আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে, যদিও সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী বিচারক চাইলে এটা কমাতেও পারেন।
তবে কেস ফাইল করার আগে বিষয়-সম্পত্তি বা অ্যালিমনি ইত্যাদি নিয়ে আপনাদের একটা বোঝাপড়া হওয়া দরকার। আপনার অ্যাডভোকেট যদি কেউ থাকে তার সঙ্গে বসে আমি ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে পারি।
অমিতাভ বললেন, আমার দিক থেকে কোন উকিল থাকবেন না। আর কোন শর্তও নেই। আপনি ওর কথামত কাগজপত্র তৈরি করে আমাকে পাঠাবেন, আমার সাধ্যের বাইরে না হলে আমি সই করে দেব।
সুজিত বললেন, সেটাই তো সমস্যা, ওনারও কোন দাবি নেই। উনি অ্যালিমনিও নেবেন না জানিয়েছেন।
যাইহোক, আমি মোটামুটি একটা তৈরি করে আপনাদের দেখাব...
কথা শেষ হলে অমিতাভর প্রথমেই মনে হল, চায়ের জল অনেকক্ষণ ধরে ফুটে যাচ্ছে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলেন চা ফুটে প্রায় কালো হয়ে এসেছে। তিনি ফেলে দিয়ে নতুন করে বসালেন।
চা আর খবরের কাগজ নিয়ে শোবার ঘরে এলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে দেখলেন ভুল করে চিনি দিয়ে ফেলেছেন। বিরক্ত হয়ে চায়ের কাপ সরিয়ে রেখে কাগজে চোখ রাখলেন।
গীতার কাছে চাবি দেওয়া থাকে। ঢুকে অমিতাভর সাড়া না পেয়ে সে শোবার ঘরে এসে দেখল অমিতাভ খাটে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে আছেন, পাশে টেবিলে না খাওয়া চায়ের কাপ। কাগজের ভাঁজ খুলে গিয়ে ভিতরের পাতাগুলি ফ্যানের হাওয়ায় সারা ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছে। সে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পাতাগুলি জড়ো করে গুছিয়ে রাখল, চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বেসিনে রাখল। আন্দাজমত একটা রান্না চাপিয়ে সে বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াল।
--আপনাদের মিউচুয়াল পিটিশন বলছে আপনাদের একে অন্যের কাছে কোন দাবিদাওয়া নেই।
অমিতাভ ও সুদেষ্ণা বললেন, হ্যাঁ।
--এখানে লেখা আছে যে আপনাদের একমাত্র সন্তান তৃষা জানিয়েছে সে তার মার কাছে থাকবে এবং এতে তার বাবার কোন আপত্তি নেই।
অমিতাভ সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। বিচারপতি সুদেষ্ণাকে বললেন, আপনি আর্থিক দিক থেকে ওর যাবতীয় দায়িত্ব বহন করতে পারবেন?
সুদেষ্ণা বললেন, আমার বাবা আমার জন্য কিছু অর্থ রেখে গেছেন। তাছাড়া আমি অনেকদিন স্কুলে পড়াচ্ছি, আমার নিজস্ব সঞ্চয় ও মাসিক উপার্জন থেকে আমাদের মোটামুটি ভালভাবেই চলে যাবে।
বিচারপতি বললেন, ভাল কথা। আপনাদের ইচ্ছাকেই আমি মান্যতা দেব। তবে কিছুদিন আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। আপনারা দুজনে আলাদা করে আমার চেম্বারে দেখা করুন।
প্রায় একঘন্টা পরে বিচারক ফিরে এলেন। অমিতাভ, সুদেষ্ণা, সুজিত তিনজনেই আছেন। সুদেষ্ণার মুখ ভাবলেশহীন। অমিতাভর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি সদ্য একটা দুঃস্বপ্ন দেখে উঠেছেন, এখনও ঘোর কাটেনি।
বিচারপতি বললেন, আমার সিদ্ধান্ত হল আপনারা ছ মাস আলাদা থাকবেন। এইসময়ে আপনাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমি একজন আরবিট্রেটর বা মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করছি। আমি ড: কৌশিক মুখার্জির নাম সাজেস্ট করছি। উনি দীর্ঘদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিদ্যার অধ্যাপক ও গবেষক ছিলেন এবং সমাজকল্যাণ মূলক বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন। এখনও বিভিন্ন কমিশনের সদস্য হিসাবে কাজ করেন। লেখক হিসাবেও ওনার খ্যাতি আছে।
বিচারপতি সুজিতকে বললেন, ওনার ব্যাপারে আপনাদের কোন আপত্তি আছে? সুজিত সুদেষ্ণা ও অমিতাভের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, উনি স্বনামধন্য ব্যক্তি। আমার মক্কেলদের কোন আপত্তি নেই।
ডঃ কৌশিক মুখার্জির বাড়ি শহরের অভিজাত পাড়ায়। গৃহসজ্জায় রুচি ও নান্দনিকতার ছাপ আছে। আজ ওরা তিনজন ছাড়া তৃষাও এসেছে। সে প্রথমে রাজি ছিল না, কৌশিক নিজে কথা বলে তাকে রাজি করিয়েছেন। সে কলেজের পড়ার সূত্রে কৌশিকের নাম শুনেছিল, আজ সামনাসামনি দেখল। কৌশিককে দেখে তাঁর ষাটের উপর বয়েস বোঝার উপায় নেই, শান্ত দীপ্যমান মুখশ্রী, ত্বকে একটাও ভাঁজ নেই।
একটি লোক সুদৃশ্য ট্রেতে করে চা নিয়ে এল, সঙ্গে কুকিজ। কৌশিক সবাইকে চা নিতে অনুরোধ করলেন, তৃষা ছাড়া সকলেই নিল। কৌশিক নিজেও একটা কাপ নিলেন। দু-চারটে সাধারণ কথার পর বললেন, যে জন্য আমরা আজ মিলিত হয়েছি আপনারা জানেন। আপনারা খোলা মনে কথা বলতে পারেন। আলোচনার পরে আপনারা যা ঠিক করবেন সেটাই আমি মাননীয় বিচারপতিকে জানাব।
দুজনে ঘাড় নাড়লেন। তৃষা নিজের অজান্তেই সামনে ঝুঁকে পড়ল।
কৌশিক তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি বুঝতে পারছি তোমার কাছে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা কতটা অস্বস্তিকর। আমি তোমার কাছে শুধু একটা জিনিসই জানতে চাইব, ঘটনাটা তোমার ঠিক কখন কিভাবে মনে পড়ল?
তৃষা বলল, আন্টির সঙ্গে সেসনটার পরেও আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। কী যেন আমার মনে পড়েও পড়ছে না৷ বিশেষ করে আমার কুকুরটাকে বারবার দেখে। তারপর সেদিন রাতে ঘুম ভেঙে দেখলাম সব মনে পড়ে গেছে।
কৌশিক সহানুভূতির ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন। সুদেষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কিছু বলবেন?
সুদেষ্ণা বললেন, আমি এটুকুই যোগ করতে চাই যে তৃষার ছোটবেলায় ওর বেশ কিছু ঘটনা আমার কাছে বিসদৃশ লাগত৷ কিন্তু এই সম্ভাবনার কথা কখনও ভাবিনি।
কৌশিক বললেন, বিশদে না গিয়ে এরকম কোন ঘটনার উল্লেখ করতে পারবেন?
সুদেষ্ণা বললেন, একদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে। তৃষা তখন খুব ছোট। সম্ভবত গান্ধীজয়ন্তী বা ওরকম কোন অনুষ্ঠানের জন্য ওকে ওর বাবার কাছে রেখে আমি আমার স্কুলে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পর অনেকক্ষণ ওকে খুব আপসেট দেখেছিলাম, মাঝেমধ্যে কান্নাকাটিও করছিল।
তৃষা অমিতাভর দিকে তাকিয়ে দেখল তাঁর মুখে ক্ষোভ ও বিস্ময় মাখামাখি হয়ে আছে। কৌশিক বললেন, বাচ্চাদের তো অনেক কারণেই মেজাজ খারাপ হতে পারে।
সুদেষ্ণা বললেন, তা পারে। তবে তৃষা এমনিতে খুব হাসিখুশি ছিল। ওর পক্ষে আচরণটা অস্বাভাবিক বলেই আমার মনে আছে।
কৌশিক এবার অমিতাভর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি মাননীয় বিচারপতির কাছে যা বলেছেন তা উনি আমাকে জানিয়েছেন। তবু বলব, আপনার আপত্তি না থাকলে যদি এঁদের সামনে আরেক বার বলেন।
অমিতাভ ঘাড় নেড়ে বললেন, বিন্দুমাত্র নয়। গত কয়েক মাস আমি নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছি। এই অবিশ্বাসের উপর সম্পর্ক টেঁকে না। তবে তার আগে আমি চাই আমার মেয়ে সত্যিটা জেনে যাক৷ আদালতে এবং আপনার সামনে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আমার আর তিষুর সম্পর্ক যে কোন বাবা ও মেয়ের মতই সুস্থ ও স্বাভাবিক।
তৃষা সুদেষ্ণার দিকে তাকাল। তাঁর মুখে কোন ভাবান্তর নেই৷ হয়ত অমিতাভ যে অস্বীকার করবেন, এটা তিনি ধরেই নিয়েছিলেন। তার নিজের অবশ্য মনে হল, অমিতাভ স্বীকার না করায় একদিকে ভালই হল, অন্তত তার নিজের মনে একচিলতে আশা ও বিশ্বাস থেকেই যাবে৷ ওটুকু তার বড় দরকার ছিল।
কৌশিক বললেন, আজ তাহলে এই অবধিই থাক। আমার কয়েকটা দিন সময় চাই। আপনাদের শীগগিরই আরেক বার আসতে অনুরোধ করব।
তাঁরা উঠে দাঁড়ালেন।
ঠিক এক সপ্তাহ পরে আবার কৌশিকের ড্রয়িংরুম। সকলেই আছেন।
কৌশিক কথা শুরু করে বললেন, আজ আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি কিছু বলতে এবং দেখাতে চাই। আপনাদের কেসে এমনিতে কোন জটিলতা নেই। দেশে-বিদেশে এরকম ঘটনার কথা আমরা প্রায়ই পড়ি। কাজের সূত্রে আমি নিজেও এরকম কিছু ঘটনা দেখেছি। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি যে সেই ঘটনা অস্বীকার করবেন এটাও খুব স্বাভাবিক। তবু মাননীয় বিচারপতির মত আপনাদের কেস নিয়ে আমারও কিছু সংশয় ছিল।
তিনি একটু থেমে সকলকে দেখলেন তারপর আবার বললেন, আমি গত কয়েকদিন এ নিয়ে কিছু পড়াশুনো করেছি। আমেরিকায় আমার এক বন্ধু সেদেশের প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ, তার সঙ্গেও দীর্ঘ আলোচনা করেছি। তবে তার আগে সেদেশের কিছু কেস-হিস্ট্রি আপনাদের দেখাতে চাই।
তিনি রিমোট দিয়ে দেয়ালে লাগান বিশাল টিভি অন করলেন তারপর নিজের মোবাইলে একটি ডকুমেন্ট খুলে টিভিতে কাস্ট করলেন। উপরে সংক্ষিপ্ত হেডিং, অ্যাকুইটাল ইন চাইল্ড অ্যাবিউজ কেসেস।
তৃষা পড়ে দেখল কেস নম্বর ও তারিখ দিয়ে বিভিন্ন কোর্টের কিছু কেস উল্লেখ করা আছে যেখানে শিশুটির স্পষ্ট সাক্ষ্যের পরেও অভিযুক্তকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। পরে অন্যান্য কিছু কেসেরও উল্লেখ আছে যেখানে অপরাধ স্বীকার করার পরেও অভিযুক্তকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
সুজিত বিস্মিতভাবে বললেন, এ তো নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশেও স্বীকারোক্তির পরেও অনেকে ছাড়া পেয়ে যায়। অনেক সময়ে অভিযুক্ত অন্য কাউকে বাঁচানোর জন্য অপরাধের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবার চেষ্টা করে কিন্তু বিচারক অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাঁকে মুক্তিও দিতে পারেন। আর শিশুদের ক্ষেত্রেও অভিযোগ শেখান হতে পারে।
কৌশিক হেসে বললেন, তা বোধহয় নয়। এর মধ্যে অনেক কেসেই অভিযুক্ত বা অভিযোগকারীদের নার্কো টেস্ট করে দেখা গেছে তারা সত্যি কথা বলছে।
সুদেষ্ণার ভ্রূ কুঁচকে গেছে৷ তৃষা প্রায় দম বন্ধ করে শুনছে।
কৌশিক বললেন, এবারে আমি এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
পর্দায় এক মহিলার মুখ ভেসে উঠল। পাশে অনেক কিছু লেখা, লেখাটা পড়ে তৃষা বুঝল ইনি অত্যন্ত বিখ্যাত একজন মনস্তত্ত্ববিদ, আইনি পরামর্শও দেন।
কৌশিক বললেন, ইনি বিশেষ একটি তত্ত্বের প্রবক্তা। এই তত্ত্ব এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। আগে যে কেসগুলি দেখলেন তাদের অনেকগুলিই বিশেষজ্ঞ হিসাবে এনার সাক্ষ্য ও মতামতের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
সুজিত বললেন, তত্ত্বটা কী?
কৌশিক পাতা সরালেন। প্রায় দুপাতা জুড়ে ছোট হরফে লেখা, সকলের পড়তে সময় লাগল। কৌশিক বললেন, সংক্ষেপে ওনার বক্তব্য হল আমাদের স্মৃতি যা দেখায় সবসময় সত্য হয় না। বিভিন্ন কারণে আমাদের ফলস মেমরি থাকতে পারে।
আমাদের শিক্ষা, যুক্তি, বিশ্বাস, প্রত্যাশা পছন্দ-অপছন্দ বা আরও অনেক কিছু স্মৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি অলীক স্মৃতিও তৈরি হতে পারে। ধরুন কেউ প্রবলভাবে অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করে। সে কোনদিন সত্যিই ভূত দেখেছে এরকম ভাবতেই পারে। আর অভিযুক্ত নির্দোষ হয়েও যখন অপরাধ করেছে ভাবে সেটা হয়ত পুলিশী জেরা আর চাপে এমনকি আত্মগ্লানি থেকেও হতে পারে।
কৌশিক থামলেন। সুজিত বললেন এগুলো নাহয় মেনে নিলাম। কিন্তু চাইল্ড অ্যাবিউজের ক্ষেত্রে কেউ নিজের সম্বন্ধে এরকম কেন ভাববে? বিশেষ করে মানুষটিকে যখন সে ভালবাসে।
কৌশিক বললেন, এক্ষেত্রে কারণ সম্ভবত পূর্বজ্ঞান এবং ধারণা। ছোটবেলায় এরকম কিছু হলে যে পরবর্তীকালে মানসিক সমস্যা হয় একথা আজকাল শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা অনেকেই জানে। তৃষাও নিশ্চয়ই জানত। তাছাড়া অনেক থেরাপিস্ট এরকম ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। সেটাও মনের উপর প্রভাব ফেলে। আপনারা শুনলে আশ্চর্য হবেন ক্যালিফোর্নিয়ায় এক ভদ্রলোক তাঁর মেয়েকে সাজেশন দিয়ে এইধরনের স্মৃতি সৃষ্টি করার জন্য কোর্টে মামলা করে মনোবিদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। নেটে "রামোনা ফলস মেমরি কেস" দিয়ে সার্চ করলে পেয়ে যাবেন।
তৃষার মনে হচ্ছে সে যেন একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। তার মধ্যেই সে বলল, আন্টি কিন্তু সেসনের সময় আমাকে এরকম কিছু বলেননি।
কৌশিক হেসে বললেন, অবশ্যই নয়। সঙ্ঘমিত্রা অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও দক্ষ কাউন্সেলর, শুনেছি অনেক জটিল রোগীকে সারিয়ে তুলেছেন। কিন্তু সম্ভবত সেসন শুরু হবার আগে উনি তোমার এরকম কিছু মনে পড়ে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। সেটা তোমাকে প্রভাবিত করতেই পারে। উনি যে পদ্ধতিতে তোমার স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন, তাকে রিগ্রেসন থেরাপি বলে। অনেকে মনে করেন এই পদ্ধতিতে ফলস মেমরি সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা প্রবল। যে কেসগুলি আপনাদের দেখালাম অন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার করে বিচারপতিরা সেরকম সিদ্ধান্তেই এসেছেন।
সুদেষ্ণা নীরব। তৃষার খুব ইচ্ছে করছে ছুটে অমিতাভর কাছে চলে যায়, কিন্তু সে নিজেকে সামলে রেখেছে।
সুজিত বললেন, আপনি "সম্ভাবনা" কথাটা ব্যবহার করলেন। সেক্ষেত্রে অন্য সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কৌশিক বললেন, হ্যাঁ, এই ধরনের থেরাপি করে অবচেতন থেকে যে বিস্মৃত ঘটনা উঠে আসতে পারে সেটা ঠিকই। তবে আমার বক্তব্য হল এক্ষেত্রে অন্য সম্ভাবনাও প্রবল। এবার সিদ্ধান্ত ওনাদেরই নিতে হবে।
তিনি তৃষার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার মনে হয় ওনাদের একটু সময় দেওয়া উচিত। চল আমরা ভিতরে গিয়ে বসি।
তিনি সুজিত ও তৃষাকে নিয়ে পাশের ঘরে এলেন।
তৃষার চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। কৌশিক উঠে এসে তার মাথায় হাত রাখলেন।
ঘরের মধ্যে ঝাপসা একটা পর্দা দুলছে। তার মধ্য দিয়েই তৃষা আকুল চোখে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল।