• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | গল্প
    Share
  • ডিকেন্স পড়ার কৌশল, দেবীসূক্ত, আর একটা আর্যসমাজী মোহর : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

    (দিল্লী, ১৯৮৩)


    গরমের ছুটি মানে আবিষ্কারের সময়। আমি সবে ইলেভেনে উঠেছি, পম্পা যাবে কলেজে। সেই বছরে শিমলিপুরের দেরাজ, আলমারি আর ভাঁড়ার ঘর ঘেঁটে আমি কয়েকটা হারিয়ে যাওয়া রহস্যের আধুলি বার করে ফেলি, যে ধরনের জিনিস আমাদের চোখের সামনে থেকেও সাধারণের ভিড়ে তলিয়ে যায়। এরকম একটা মোহর আর্যসমাজী মন্দিরের চত্বরের এক পাশে দশ বছর ধরে আমার অপেক্ষায় বসে ছিল।

    আমার বান্ধবী শিমলা চলে যাওয়ার পর আমি ঠিক করেছিলাম দিনে অন্তত দুটো করে গল্পের বই ধ্বংস করব। ইংরেজী বই পড়ার একটা ভালো টেকনিক ধরেছি তখন। পাঁচশো পাতার যে সব ক্লাসিক বইগুলো অবশ্যপাঠ্য, তার প্রত্যেক পাতার গোড়া, মাঝখান, আর শেষের অনুচ্ছেদ থেকে আমি একটা করে বাক্য পড়তাম। এক আধটা সহজ সংলাপ থাকলে তাও পড়ে ফেলা যেত। এইভাবে হাজার দেড়েক সেনটেন্‌সের ইঁটকে অনুমানের সিমেন্ট দিয়ে গেঁথে উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত এক একটি ক্লাসিকের দ্রুতপাঠ কয়েক ঘন্টার মধ্যে করা সম্ভব হত। টেকনিকটা টোটোদা নামক মহাপুরুষের কাছে শেখা (ফাঁকিতে যার জুড়ি ছিল না)। টোটোদা তার নাম দিয়েছিল ‘চুলকে দেওয়া’। টোটোদা শুধু ইংরেজি বই পড়ার সময় পদ্ধতিটা ব্যবহার করত। কিন্তু আমি নির্বিচারে বাংলা আর হিন্দী বইও চুলকোতে শুরু করি।

    প্রথম কয়েক দিনে এক ডজন বই শেষ করার পর দুশো বই চুলকোবার উচ্চাশা একটু ছাঁটতে হল। বাড়িতে জায়গা কম বলে পড়াশোনার কাজটা আর্যসমাজ লাইব্রেরীর রীডিং রুমে করছিলাম। মন্দিরের সবুজ লনের কোণে একটা হলঘরে লুকোনো ছিল সেটা। এই গরমের ছুটিতে আবিষ্কার করি যে তাদের গোদামে বস্তা বস্তা পুরোনো ইংরেজি বই নষ্ট হচ্ছে। আমি পড়তে চাই শুনে দয়ালু লাইব্রেরিয়ান দুজন সারাদিন বসে বইগুলো ক্যাটালগ করতে শুরু করেন। একদিন কথায় কথায় বেরিয়ে গেল যে আমরাও ইস্কুলে ডিউই ডেসিমাল সিস্টেমে ক্যাটালগ করা শিখেছি। তখন কল্পনাজী বললেন – তাহলে তুমিও হাত লাগাও না কেন?

    আর কি, আমি সকালে কল্পনাজী আর দুপুরে মুক্তাজীর কাজে হাত লাগাতে শুরু করলাম। ভিতরের একটা ঘরে মাঝে মাঝে সাদা ধুতি পরা একটি সাধুজী টাইপের লোক এসে বসতেন। তাঁকে সবাই চতুরানন বলে ডাকত। সেটা আসল নাম কি ছদ্মনাম বুঝতে পারিনি। আমরা যত বই ক্যাটালগ করে শেল্‌ফে তুলতাম তার দ্বিগুণ বই চতুরানন পরের দিন কোত্থেকে ছালাভর্তি করে আনতেন।


    একদিন ক্যাটালগ করা থেকে একটু বিরতি নিয়ে আমি ফ্যানের তলায় আরামে বসে একটা পাঁচশো পাতার ডিকেন্স আধ ঘন্টায় চুলকোবার চেষ্টা করছি, এমন সময় চতুরাননজী আমার সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।

    - কিছু চাই? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    - না, না তুই পড়ে যা। আমি তোকে দেখছি।

    খুব অস্বস্তি হল শুনে। - আমাকে দেখছেন? কেন দেখছেন স্যরজী? আমি কিছু করেছি?

    চতুরানন আরো খানিকক্ষণ তাঁর মোটা কালো ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করে বললেন – তুই কি সত্যি বইটা পড়ছিস, না শুধু উলটে পালটে দেখছিস?

    ফেঁসে গেলে কী করে শিমলিপুরের ছেলেরা? সামনের লোকটাকে মিথ্যের পর মিথ্যের জাল দিয়ে তৈরি একটা টুপি পরিয়ে বেরিয়ে যায়। ছেলেবেলা থেকে এটা আমাদের ট্রেনিং। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম - না, না, পড়ছি। নইলে এত কষ্ট করে এখানে আসব কেন?

    - সেটাই তো আমিও ভাবছিলাম। আশ্চর্য! এত তাড়াতাড়ি ইংরেজী পড়তে আমি কাউকে দেখিনি।

    - কিছুই না। মামুলি টেকনিকের ব্যাপার। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।

    - কিছুই না? কী বিনম্রতা! চতুরানন মধুর হিন্দীতে বিড়বিড় করে বললেন।

    মুক্তাজী কাছে ছিলেন। গলা উঁচিয়ে বললেন – চতুরাননজী, জয় তো এক দিনে দুটো-তিনটে বই আরাম সে পড়ে শেষ করে। আমাদের অন্য মেম্বাররা সবাই মিলেও এত বই পড়তে পারে না।

    চতুরানন আরো কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন – নরেন্দ্র কে জানিস?

    - নরেন্দ্র? না তো। মনে পড়ছে না। বললাম আমি।

    - আরেক নাম হল স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি এটা পারতেন। তারপর দেখছি তুই পারছিস। তোর চোখে মুখেও একটা তেজোময় জ্যোতি আছে – এখন বুঝতে পারছি কেন।

    আমি বলতে যাচ্ছিলাম পম্পার পীড়াপীড়িতে মার্গো সাবান এত মাখছি যে স্কিন একেবারে মসৃণ আর সুপার-টাইট হয়ে গেছে। কিন্তু চতুরাননজী আমাকে মুখ খোলার সুযোগ না দিয়ে বললেন – বেটা তোকে সন্ধ্যেবেলা আমাদের সৎসঙ্গের আসরে যোগ দিতে হবে। এরকম প্রতিভা ভুল পথে না চালিত হয়।

    হা হতোস্মি! একদম মরেছি! বলটা সেভ করার বদলে নিজের গোলের দিকে ঠুকে দিলাম নাকি? ধীরবিলম্বিত লয়ে হাতের বই ভাঁজ করতে লাগলাম। মনে মনে পাগলের মতো একটা নতুন মিথ্যে খুঁজছি। কী বলা যায়?

    - বেদ আর উপনিষদ থেকে অধ্যয়ন করি আমরা। চতুরানন কীভাবে আমার উপর অত্যাচার করা হবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আরো মরিয়া হয়ে উঠলাম সেটা শুনে।

    - চতুর-জী, কাউকে বলি না কিন্তু আজ আপনাকে জানাতে দ্বিধা নেই, বেদ আর উপনিষদ পাঠই আমার জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য। খুব যেন একটা চাপা আনন্দের সঙ্গে জানালাম চতুরাননকে। - সমস্যা এই যে বিকেলের পর একটা সংস্কৃত টিউটোরিয়াল ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেছি। পার্কটাউনে যেতে হয়। যেতে আসতে এক ঘন্টা। মূল ভাষায় বেদ পড়ব বলে যতটা সম্ভব খাটছি আর কি। এটা বলার পর সাবধানতার জন্য যোগ করলাম - দয়া করে কাউকে জানাবেন না, কারণ আমার ব্যুৎপত্তি এখনো বড়াই করার মতো নয়।

    পার্কটাউনে যখন ইচ্ছে গিয়ে লুকোতে পারি। ভাবছিলাম প্রয়োজন হলে লোক দেখানোর জন্য হাতে একটা ব্যাকরণের বই নিয়ে যাব।

    চতুরানন আর মুক্তাজী পরস্পরের দিকে চাইলেন। মুক্তাজী বললেন – এ ছেলে আপনাদের থেকেও এগিয়ে যাবে চতুর-জী। আপনাদের তো হিন্দীতে আলোচনা হয়।

    চতুরাননজী চেয়ার থেকে উঠে পড়ে বললেন – একটা দিনের জন্য অন্তত আয় আমাদের আসরে। তোর সংস্কৃত ক্লাসের পরেই কিছুক্ষণের জন্য আয়, আমরা তো আটটা অবধি থাকি। সবাই তোকে দেখুক। চিনুক।

    কী প্রচণ্ড সর্বনাশ! সারাদিন লাইব্রেরিতে বসে কুলারের ঠাণ্ডা হাওয়া খাই। যখন যা ইচ্ছে বই পড়ি। আমার বিদ্যোৎসাহ দেখে এঁরা তিনগুণ খাটছেন। এঁদের ‘না’ বলব কীভাবে?

    অনিচ্ছাসত্ত্বেও বললাম - একটা দিন? দেরীতে এলেও হবে বলছেন? আচ্ছা। চেষ্টা করব নিশ্চয়ই।

    *****

    দিন চার-পাঁচ পরের ঘটনা। এমন দুর্ভাগ্য, বিকেলের পর শিমলিপুর রোডে মুক্তাজীর মুখোমুখি পড়ে গেলাম। বলতে হল সংস্কৃত ক্লাস শেষ করে সবে ফিরেছি।

    - ও আচ্ছা! ওয়াহ্‌, ওয়াহ্‌! সৎসঙ্গে যাবি বলে জলদি-জলদি ফিরে এলি? মুক্তাজী নিজেও জলদি-জলদি বাস স্টপের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন।

    - ওই আর কি।

    সন্ধ্যেটা বরফের চুস্কি খেতে খেতে টোটোদার সঙ্গে গল্প করে কাটাব ভেবেছিলাম। এই ঘটনার পর সেটা হল না। একবার ফিরে যেতে হল লাইব্রেরিতে।

    *****

    যেতে যেতে দিনের আলো নিভে গিয়েছিল। আর্যসমাজী মন্দিরের চত্বরে আলোগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে ওরা। লাইব্রেরির পাশে আরেকটা ঘর। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দশ পনেরোজন অতি বৃদ্ধ পুরুষ সেখানে বসে উপনিষদের ভাষ্য শুনছেন। মনে হল সত্তরের নিচে কেউ নেই। বেশির ভাগের চোখে আতস কাঁচের মতো পুরু চশমা। কেউ কেউ পা নাচাবার বদলে জিভ দিয়ে ঠেলে নকল দাঁত নাচাচ্ছেন। অনেকগুলো পুরোনো কাঠের চেয়ার পাতা। ফ্যানের তলায় জিরিয়ে নেব বলে ঘরে ঢুকে সবার পিছনে গিয়ে বসলাম।

    যে সারিতে আমি বসেছি সেখানে আমি ছাড়া আরো একটি ব্যাকবেঞ্চার প্রাণী আশ্রয় নিয়েছিল। সোনালী রিমের চশমা পরা এক শৌখিন বৃদ্ধ। তিনি বসে পা দোলাচ্ছেন। সবার মতো এঁরও পরনে সাদা কুর্তা। যদিও ধুতির বদলে পরেছেন একটা খয়েরি প্যান্ট। একটু প্রফেসার টাইপের হাব-ভাব। কেমন যেন মনে হচ্ছিল মুখটা কোথাও দেখা, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না কোথায়। আমার দিকে খানিকক্ষণ কৌতূহলের সঙ্গে তাকাবার পর বৃদ্ধটি চোখ নাচিয়ে বললেন – তোর ডেট কবে? বুঝতে না পেরে ওনার মতো আমিও ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম – কীসের ডেট? তারপর কিন্তু ভদ্রলোক আর কিছু না বলে একটা দুর্বোধ্য হাসি হাসতে লাগলেন।

    কতক্ষণ ভাষ্য চলেছিল বলতে পারব না। একটি বর্ণ শুনিনি আমি। চোখ খুলে ঘুমোচ্ছিলাম - যে টেকনিকটা প্রায় দশ বছর আগে বৈজুবাবুর হিন্দী ক্লাসে আবিষ্কার করে এতদিন নিরলস অভ্যাসের পর একটা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছি। মৃদু গুঞ্জনে যখন সংবিৎ ফিরল তখন দেখি ভাষ্য শেষ হয়েছে। তারপর যা ভয় করেছিলাম – চতুরজী ডেকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে আমার যশোকীর্তন শুরু করলেন। পাঁচ মিনিট ধরে চলল সেই গান, যদিও মনে হচ্ছিল পাঁচ ঘন্টা। আগের জন্মে দয়ানন্দ ছিলাম, না বিবেকানন্দ, সেটারই শুধু মীমাংসা হল না। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছি। যেন কেউ আমার সমস্ত জামাকাপড় খুলে কোনো মেয়েদের স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে দাঁড় করিয়ে বলেছে - যাও এবার গিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে দাও। চতুরজীর বলা শেষ হওয়ার পর যখন পালানোর একটা মওকা পাওয়া গেছে ভাবছি, তখন সামনের সারি থেকে অনুরোধ ভেসে এল – দুটো সংস্কৃতের শ্লোক শুনিয়ে দে বেটা। তোকে দেখার মতো এত বড় একটা সৌভাগ্য যখন হয়েছে তখন তোর গলাও শুনে যাই। বাড়িতে গিয়ে বলতে পারব।

    সংস্কৃত আমার মন্দ লাগত না। স্কুলে কালীবাবু পড়ান তো না, সারাক্ষণ ক্লাসে আড্ডা হয়। কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকে পাণিনির সূত্র আর আর কালিদাসের উপমাও এসে ঢুকে পড়ে। টেক্সট বই যাতে খুলতে না হয় সেইজন্য আমরা ভুলভাল ফোড়ন কেটে আড্ডাটা চালু রাখতাম। কিচ্ছু শিখিনি। কিন্তু সেইজন্যই হয়তো সাবজেক্টটা ত্রাসজনক হয়ে যায়নি।

    কী বলা যায়?

    আমার পিতৃদেব যখন জীবিত ছিলেন তখন আমরা কলকাতায় থাকি। মার্ক্‌স্‌বাদী হলে কী হবে – তিনি প্রতি রবিবার হারমোনিয়াম বাজিয়ে পাড়া জানানো গলায় চণ্ডীপাঠ করতেন। মা বলত – আগাপাস্তলা ভড়ং। মায়ের মতে অবশ্য কমিউনিজমটাও ছিল ভেক। আসলে আমার মামাবাড়িতে সুবিধেবাদ ছাড়া কারো অন্য জীবনদর্শন থাকতে পারে এটা কখনো বিশ্বাস করা হয় না। যাই হোক বাবার সেই ভেকপাঠ থেকে দেবীসূক্তটা যৎসামান্য স্মরণে ছিল, এবং জানতাম সেটা বেদ থেকে নেওয়া। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার অনুষ্ঠানে এই মন্ত্রটা গান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

    অহং রুদ্রেভির্ব্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
    অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা।।
      অহং সোমমাহনসং বিভর্ম্যহং ত্বষ্টারমুত পূষণং ভগম্।
      অহং দধামি দ্রবিণং হবিষ্মতে সুপ্রাব্যে যজমানায় সুন্বত।।
    অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসুনাম চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম।
    তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্য্যাবেশয়ন্তীম।।
      ময়া সোঅন্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম।
      অমন্তবোমান্ত উপক্ষীয়ন্তি শ্রুধিশ্রুত শ্রদ্ধিবন্তে বদামি।।

    এর পরেও খানিকটা আছে। কিন্তু গানের ঠিক এখানটা এসে মায়ের চোখ ছল ছল করে ওঠে। ভাবলাম জেনুইন বেদের মাল। আর্যসমাজীদের ভালো লাগতে পারে।

    দেবীসূক্তটা আউড়ে দিলাম। শুনতে চমৎকার লাগলেও বৈদিক সংস্কৃতে শব্দের মানে বোঝা প্রচণ্ড কঠিন। বলার সময়ে একটু একটু ভয় করছিল – কেউ মানে জিজ্ঞেস করবে না তো? তাহলে ভর্তৃহরির দুটো পদ্য শোনালে ভালো করতাম। কিন্তু আমার বলা শেষ হওয়ার আগেই যে কাণ্ডটা হল তার ভয়াবহতার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না।

    আট দশ লাইনের মাথায় সামনের সারিতে বসা দুটি বৃদ্ধ চোখের জল মুছতে লাগলেন। বাকিরা উঠে এলেন আমাকে স্নেহালিঙ্গন দেওয়ার জন্য। একটা ‘সাধু সাধু’ রব ধ্বনিত হয়ে উঠল। এরকম ছেলে নাকি শিমলিপুর কেন, গোটা দিল্লীতে আরেকটা নেই। - দিল্লী কী বলছেন? আরেকজন বললেন – পুরো আর্যাবর্তে নেই। জাপানেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

    একজন বৃদ্ধ আমার মতো তোতলাতে তোতলাতে বললেন – আমি পো-পো-পো-পোল্যাণ্ডে বারো বছর ডেপুটেশানে ছিলাম। সেখানেও দেখিনি।

    চতুরানন উদ্ভাসিত মুখে বললেন – বলিনি আমি?

    সমবেত কন্ঠস্বরে ধ্বনি উঠল - বেটা তোকে আবার আসতে হবে। নইলে আমরা লোক পাঠাব তোর বাড়ি।

    আমার ভিতর থেকে আমার মাতুলালয় বলল – ঝুট বললে কৌয়া কাটে। ঝুট না বললে মানুষ। দ্বিতীয়টা অনেক বেশি বিপজ্জনক। যেখানে যেমন সেখানে তেমন লাগিয়ে যা জয়। আজ তুই আর্যসমাজী। কাল হয়ে যাবি যুব কংগ্রেস।

    বললাম - নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, যেদিন সময় পাব, আসব। কিন্তু আজ ছুটি চাইছি। বাড়িতে হোমওয়ার্ক পড়ে আছে। এই বলে হাত জোড় করে নমস্কার ছুঁড়তে ছুঁড়তে দরজার দিকে সরতে লাগলাম।

    *****

    দরজা দিয়ে গলবার পর গেটের দিকে পা বাড়িয়েছি, এমন সময় শেষ সারিতে বসা যে প্রফেসার মার্কা বৃদ্ধটি আমায় দেখে হাসছিলেন তিনি একটা দেয়ালের পাশ থেকে বেরিয়ে এলেন।

    - কবে আসছিস আবার? দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

    ভদ্রলোকের হাসিটা মোটেও ভালো ঠেকেনি। ইনি কি আমার ভেকপাণ্ডিত্য ধরে ফেলেছেন? দায়সারা ভাবে বললাম - দেখি।

    - ডেটটা হল সুইসাইডের। ভদ্রলোক কাছে এসে কানে কানে বললেন আমার। - এখানে কেউ ক্যান্সার, কেউ কিডনি ফেল নিয়ে এসেছে। এমনিতেই সবার দিন ফুরোল বলে। বছরে একটা করে ক্লাবের ডেট আছে। সেদিন অনশনে সুইসাইড করবে বলে একসঙ্গে দু-পাঁচজন খাওয়া বন্ধ করে দেয়। শোন, খবরটা বাইরে জানিয়ে এখানে ঝামেলা টেনে আনিস না। এদের কমিউনিটিতে এটা একটা ট্র্যাডিশান। হসপিটালে বেশি যায় না কেউ।

    আমার চোখ চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। ভদ্রলোক স্মিত হাসিটা মুখে ফিরিয়ে আনলেন। - তোর শ্লোকপাঠ সত্যি খুব ভালো লাগল। কিন্তু জায়গাটা সবার পক্ষে ভালো না। এখানে আর আসার দরকার নেই। পালা।

    - আপনার কী হয়েছে? মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলাম।

    - কিচ্ছু হয়নি। বললেন সাদা চুল ভদ্রলোক। - আমি চতুরাননের শালা। জোর করে ডেকে এনেছিল লেকচার শোনার জন্য। এখন সবার সঙ্গে আমাকেও একটা ডেট নিতে হয়েছে।

    - সর্বনাশ! কী করবেন তাহলে?

    - তিন বছর পরের ডেট তো। কী করব ততদিনে ঠিক করে ফেলতে পারব আশা করি।

    বড্ড চিন্তা হচ্ছিল ভদ্রলোকের জন্য। বললাম - পোস্টপোন করা যায় না? জবরদস্তি করছে তো আমাকে বলুন, আমার জাট আর গুজ্জর বন্ধু আছে যারা লাঠি নিয়ে চলে আসবে।

    - সে তো আসবে, কিন্তু তিন বছর পর যদি পোস্টপোন করতে ইচ্ছে না হয়?


    বাড়ির দিকে এগোচ্ছি। পকেটে একটা আর্যসমাজী আশরফি, যা বাইরের লোকের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার কথা। আমার মনে হচ্ছিল একদিন এটা কারো সাহায্য ছাড়াই আত্মপ্রকাশ করবে।

    একবার পিছন ফিরে তাকালাম। অমায়িক হাসছিলেন ভদ্রলোক। আমায় থামতে দেখে হাত নেড়ে পালিয়ে যেতে বললেন আবার।


    (অপ্রকাশিত উপন্যাস থেকে)



    অলংকরণ (Artwork) : পরবাস ডিজিটাল আর্ট
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments