• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | প্রবন্ধ
    Share
  • লেখকের ভূমিকা : মারিস কোঁদে
    translated from English to Bengali by শুভময় রায়



    ‘কবে লেখালেখি শুরু করেছিলেন?’ অথবা ‘কীভাবে লেখক হলেন?’ এ জাতীয় প্রশ্নের সামনে লেখকদের প্রায়ই দাঁড়াতে হয়। এর উত্তর কেউ জানে না বলেই চতুর লেখক তাঁর নিজের ছোট্ট কাহিনি ফেঁদে নেন। আমার বানানোর মত কোনও গল্প নেই যা বলে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। শুধু একটা ঘটনার কথা বলব, ধরে নিন ওই সব প্রশ্নের সেটাই আমার দেওয়া সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ উত্তর।

    আমি যখন সাত-আট বছরের শিশু, তখন আর সব ছোট্ট মেয়েদের মতই মা-কে খুব ভালোবাসতাম। তিনি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন বলে আবার খুব ভয়ও পেতাম। সে আমলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বড় সম্মান ছিল। যেমন, সকালে যখন তিনি স্কুলে যেতেন, তখন প্রতিদিন তাঁর দুই ছাত্রছাত্রী সামনে সামনে চলত। একজনের হাতে থাকত এক গোছা খাতা যা তিনি আগের রাতে সংশোধন করে রেখেছেন। আরেক জনকে বইতে হত দিদিমণির বইগুলো। তিনি নিজে ছাতার তলায় তাদের পেছন পেছন যেতেন। অর্থাৎ, প্রতিদিন ভোরে যেন আফ্রিকার কোনও রানি তাঁর অনুচরদের নিয়ে পরিক্রমায় বেরোতেন! জননী আর শিক্ষিকা হিসেবে মায়ের চরিত্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁর জন্মদিনে আমি একটা একাঙ্ক নাটক লিখব ভেবেছিলাম। নির্দিষ্ট দিনে যখন নাটকটি তাঁকে পড়ে শোনালাম, তখন আমাকে আশ্চর্য করে তিনি বড়ই বিচলিত হয়ে পড়লেন। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তুমি যার কথা বলেছ আমি তো একেবারেই সে নই! আমার সঙ্গে এর তো কোনও মিলই নেই!’

    কাজেই খুব অল্প বয়েসেই জেনেছিলাম লেখালেখি বড়ই বিপদের কাজ। যা সত্য বলে ভাবছ তাই লিখলে পাঠক অসন্তুষ্ট হবে। পরিণামে তুমি মার খেতে পার, তোমাকে কারারুদ্ধ করা এমনকী মেরে ফেলাও হতে পারে। কিন্তু মাকে কাঁদাতে পেরে অন্য এক ধরনের ক্ষমতার স্বাদও পেলাম যা নেশা ধরিয়ে দেয়। সিদ্ধান্ত নিলাম এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বারবার যাব। লেখা হল মূলত মানুষকে অখুশি করতে পারার আনন্দ উপভোগ করা!

    আজ সন্ধেয় আমার লেখা নভেল ‘Tree of Life ’ (ফরাসিতে ‘লা ভি সেলেরাত’) এর ওপর বলার জন্য আমাকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। শুরুতেই জিজ্ঞেস করবেন না যেন যে ‘লা ভি সেলেরাত’ (আক্ষরিক অর্থে পাপিষ্ঠ বা দুরাচারী জীবন) কীভাবে Tree of Life হয়ে গেল! বইয়ের মলাটের নকশার মত এর ব্যাখ্যাও আমার মার্কিন প্রকাশক দেননি। মলাটটি যে সুন্দর তাতে কোনও সন্দেহ নেই, তার গাঢ় কমলা রঙের মধ্যে দিয়ে বিচিত্র সুন্দর কিছু প্রকাশিত হয়েছে। ছবির অর্থ হয়ত এই যে উপন্যাসের রচয়িতা বিশ্বের এমন এক জায়গা থেকে এসেছেন যেখানে জীবন মার্কিন দেশের তুলনায় বর্ণিল।

    তবে ‘Tree of Life ’ মনে হয় ততটা রঙিন বা বিচিত্র নয়। এর উদ্ভব একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে। ১৯৮৫-তে নভেলটি লিখতে শুরু করার সময় আফ্রিকায় আমার বারো বছরের বসবাস সবে শেষ হয়েছে। তার আগে যেসব মূল্যবোধে বিশ্বাস করতাম তার সবই ভেঙে খান খান হয়ে যাওয়ায় সেই সময় সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত অবস্থায় ছিলাম। অল্প বয়সে মার্ক্সবাদের ওপর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। আমার প্রজন্মের মানুষেরা সকলেই মার্ক্সবাদে বিশ্বাস করতেন। আমরা নিশ্চিত ছিলাম সে আদর্শ উপনিবেশবাদের সমাপ্তি ঘটিয়ে তৃতীয় বিশ্বে নিয়ে আসবে সুখ আর স্বাধীনতার নতুন যুগ। আফ্রিকায় অনেকগুলো বছর কাটানোর পরে অবশ্য আমি বুঝতে পারছিলাম না যে মার্ক্সবাদই অনিষ্টের কারণ নাকি নেতারা তাকে চতুর কৌশলে কাজে লাগানোর ফলে সেটি ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। বস্তুত, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে রাজনৈতিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার অনেক আগেই আমার মনে এই বিষয়ে সন্দেহ জাগে। মার্ক্সবাদ যদি ভুল পথ হয়, তা হলে অনুসরণযোগ্য আর কোন পথ আমার জন্য পড়ে রইল?

    আরেকটা চিন্তা ছিল বিপ্লব নিয়ে। আমি ফ্রান্তজ় ফানোঁর (Frantz Fanon) খুব মনোযোগী পাঠক ছিলাম যিনি বলেছিলেন বিপ্লবের অর্থ শুধু দেশের রাজনৈতিক অবস্থানের বদল নয়, বরং মানুষের অন্তর-সত্তার পরিবর্তন। সফল বিপ্লবের পরে নতুন মানব-মানবীর আবির্ভাব ঘটবে যারা নতুন পৃথিবী গড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট শক্তপোক্ত হবে। সেই ধরনের বিপ্লব কি সম্ভব? আফ্রিকায় যে বছরগুলি কাটিয়েছিলাম সে সময় আমি ওই ধরনের কোনও বিপ্লবের সাক্ষী হইনি।

    তৃতীয়ত, আমার উদ্বেগ ছিল জাতি নিয়ে। বাবা-মায়ের সান্নিধ্যে এই ধারণায় বিশ্বাস করে বড় হয়েছি যে কৃষ্ণাঙ্গ অস্তিত্ব প্রকারান্তরে এক ধরনের সংহতি সূচিত করে, একই বর্ণের মানুষদের সঙ্গে অনন্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধে রাখে। প্যারিসে ছাত্রাবস্থায় আমি সমগ্র আফ্রিকার একতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হই। দুর্ভাগ্যবশত, পরে গিনিতে (Guinea) দেখলাম কৃষ্ণাঙ্গ নেতারা কালো মানুষদের ওপরই শোষণ চালাচ্ছে। রাজনৈতিক মতামতের জন্য কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে এমন ঘটনারও সাক্ষী ছিলাম। তখন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে জাতি একটা অর্থহীন শব্দ।

    মার্ক্সবাদ, বিপ্লব, জাতি – এই সব ধারণা চুরমার হয়ে গেল। এমনই এক বিভ্রান্ত অবস্থায় আছি যখন, এমন সময় নাদিয়া নামে এক যুবতীর চিঠি পেলাম। সে লিখে জানাল যে আমার উপন্যাস ‘সেগু’ (Ségou) সে পড়েছে, বইটা তার ভালোও লেগেছে। আমাকে টেলিভিশনে দেখে সে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে জানতে পারে যে সে আমার তুতো বোন, আমার দাদুর ভাই আলবেরের নাতনি। আলবেরের সম্পর্কে আমি কী জানতাম? আমি কি জানতাম তাঁর নিজের নামেই একটি ছেলে ছিল? আলবের জুনিয়র? ছোটবেলায় পোঁয়াতাপিত্র (Pointe-à-Pitre)-এ আমাদের পারিবারিক বাড়ির দেওয়ালে বিভিন্ন ধরনের ছবি ছিল। ক্যারিবিয়ান দ্বীপের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সর্বত্র তাদের পিতামহ-প্রপিতামহের ছবি টাঙিয়ে রাখতে ভালোবাসে – কোথা থেকে তারা এসেছে আর তাদের সামাজিক উত্তরণের প্রদর্শনী হিসেবে। সেই ছবির মধ্যে একটিতে ছ-সাত বছরের বর্ণসংকর এক বালকের ছবি ছিল, পরনে তার নীল-সাদা নাবিকের পোশাক। আমার পরিবারে যেখানে সকলেই খাঁটি কৃষ্ণাঙ্গ এবং তাই নিয়ে গর্বিত, সেখানে সেই ছেলেটির ছবি দেখতে খুবই অদ্ভুত লাগত। সেই অদ্ভুত চেহারার বালকের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে ভাসা ভাসা উত্তর পেতাম। তার নামটি, অর্থাৎ আলবের ছাড়া সে কে তা কেউই ঠিক জানে না বলে মনে হত। নাদিয়া আর আমি তার ঠাকুমা মারি-র সঙ্গে দেখা করতে যাই, যিনি লোয়ার নদীতীরে সোমুর (Saumur) শহরে বাস করতেন, যে শহর সাদা ওয়াইনের জন্য বিখ্যাত। তিনি আমাকে গোটা গল্পটা বলেছিলেন।

    আলবের সিনিয়র ছিলেন আমার ঠাকুর্দার আগের পক্ষের ছেলে। তাঁকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে সোমুরে পাঠানো হয়েছিল। ১৯২০ সালে ফ্রান্সের মফস্বল শহরে এক কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরের জীবন কল্পনা করতে পারেন? মারি-র সঙ্গে যখন তার দেখা হয়, তখন সে ছিল একাকী আর মরিয়া। মারি মদের বোতলের ছিপি তৈরির কারখানায় কাজ করত। দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হলে মারি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সে সময় আমাদের পরিবার ছিল খুবই ধর্মভীরু। গির্জার প্রথম প্রার্থনাসভায় উপস্থিত থাকার জন্য মা সকাল পাঁচটায় উঠতেন। আলবের সিনিয়র অমন পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার জন্যই হয়ত মারিকে ছেড়ে চলে যেতে পারল না – বিয়ের প্রস্তাব দিল। ছেলে শ্বেতাঙ্গ মহিলাকে বিয়ে করছে শুনে আমার ঠাকুর্দা এতই রেগে গেলেন যে পড়াশোনার খরচ চালানোর ভাতা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। বেচারা আলবের সিনিয়রকে ফরাসি বিদ্যুৎ সংস্থায় চাকরি নিতে হল। জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। শেষমেশ একদিন সে আত্মহত্যা করল। মারির কাছে পড়ে রইল তার স্বামীর নাম বহন করা শিশুপুত্রটি।

    তাঁর দুঃখের জীবনের প্রতি আমাদের পরিবারের সহানুভূতি জাগানোর আশায় বছরের পর বছর চিঠি লেখা আর শিশুর ছবি পাঠানোর কাহিনি মারি আমাকে বলেছিলেন। তিনি সে সবের কোনও উত্তর পাননি। কুড়ি বছর বয়েসে আলবের জুনিয়র প্যারিসে গিয়ে সঙ্গীত শিক্ষার সিদ্ধান্ত নিল। স্পষ্টতই তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি কারণ সেও আত্মহত্যা করে, মারিকে তার খুবই অল্পবয়সী কন্যা নাদিয়ার কাছে ফেলে রেখে। এই ধরনের কাহিনি আমার আশঙ্কাই শুধু বাড়াল।

    আমি আমার পরিবারের বিষয়ে লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম – শুধু আনুষ্ঠানিক বিবরণ নয়, বরং না-জানা কাহিনিগুলোও তাতে থাকবে। ঠিক করেছিলাম ভালোবাসার যোগ্য আর মর্যাদাসম্পন্ন মানুষগুলোর ছবি আঁকব যারা একই সঙ্গে নীচ আর নিষ্ঠুরও হতে পারে। আমার কাহিনির আরও পরিব্যাপ্ত তাৎপর্য থাকবে, সংস্কৃতি আর রাজনীতি সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রকাশও সেখানে ঘটবে। ‘Tree of Life ’ আকাদেমি ফ্রঁসেজ় এর পুরস্কার পেলেও গুয়াদলুপে উষ্ণ সংবর্ধনা পেল না। তাদের মতে যে দোষ-ধরা মনোভাব আর জীবনের অন্ধকার দিকগুলি সেখানে তুলে ধরা হয়েছে তা আপত্তিজনক। এখনও পর্যন্ত এটি আমার লেখা একটি বিস্মৃত উপন্যাস। পণ্ডিতেরা Hérémakhonon অথবা I, Tituba, Black Witch of Salem অথবা Crossing the Mangrove নিয়ে গবেষণা করেন। Hérémakhonon নিয়ে আলোচনা করা সহজ কারণ সেটা আফ্রিকায় যেতে উৎসাহী একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মেয়ের গল্প। সমালোচকরা তার রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব আর পুরুষদের ওপর তার নির্ভরতার সমালোচনা করতে আগ্রহী। তিতুবা এক চিত্তাকর্ষক চরিত্র, ক্যারিবিয়ান দ্বীপে দৃশ্যমান আর অদৃশ্য যেভাবে জড়াজড়ি করে থাকে তার মূর্তরূপ। Crossing the Mangrove প্রকৃতি আর গুয়াদলুপের গ্রাম্য জীবনের বর্ণনা নিয়ে আরও কাব্যিক। তুলনায় Tree of Life অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলে ধরেছে।

    কীসের বিনিময়ে আপনি মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠেন? কী ধরনের বোঝাপড়া আপনাকে করতে হয়? আপনার নিজের মানুষদের থেকে কতটা সরে যেতে হয়? উপন্যাসে আমার শৈশবের স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটা দৃশ্য আছে যা আমার বিবেচনায় মধ্যবিত্ত আর দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে বেদনাদায়ক বিচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত চিত্র। পোঁয়াতাপিত্রের সব তল্লাটে আমার বাবা অনেক বসতবাড়ির মালিক হলেও নিজে ভাড়া আদায় করতে যেতেন না। আমাকে আর দাদাকে পাঠাতেন। কল্পনা করতে পারেন দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে ভাড়া আদায় করতে যাচ্ছে? গরিব ভাড়াটে, যারা পয়সা দিতে পারত না, আমাদের লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে গালাগালি দিত। একদিন একটা লোক দাদার দিকে পাথর ছুঁড়েছিল, তার চোখে দাদা তো আমার বাবারই প্রতিনিধি।

    কেন কেউ মধ্যবিত্ত হতে চায়? তাতে লাভ কী? যদি কারও সে ঝামেলা এড়িয়ে আবার তার নিজের লোকদের মধ্যে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হয়, তা হলে তা কি সম্ভব? উপন্যাসে দুটি চরিত্র প্রাণপণে তাদের শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে: প্রথমে থেক্‌লা, যার বিশ্বাস শ্রেণি কাঠামো ভেঙে ফেলতে তাকে একটা বিপ্লব শুরু করতে হবে। কিন্তু সে কাজে কিছুতেই আর সাফল্য আসে না। আর তারপরে জ়ঁ যে পড়াশুনো ছেড়ে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের মধ্যে বসবাস শুরু করেছে। সে তার শক্তি একটা বই লিখতে খরচ করলেও থেক্‌লার তুলনায় বেশি সফল হয় না – নভেলের শেষে সে মারাই যায়।

    গুয়াদলুপের পাঠকদের Tree of Life নিয়ে অখুশি হওয়ার আরেকটি কারণ উপন্যাসের ঘটনাবলীর পটভূমি পানামা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জামাইকা আর হাইতি। ওয়েস্ট ইণ্ডিজ়ের সাহিত্য ওপর ওপর পড়লেও বোঝা যায় যে সব লেখকই তাঁর নিজের দ্বীপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী নই – বরং আমি ঔপনিবেশিক ভাষা আর রাজনৈতিক অবস্থান ব্যতিরেকে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পরিচয়ে বিশ্বাসী। আমার জামাইকাকে ততটাই ঘরবাড়ি বলে মনে হয় যতটা মার্তিনিক অথবা গুয়াদলুপকে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মানুষদের একটা যৌথ ইতিহাস আছে, তাদের অভিজ্ঞতাও সর্বজনীন। এই বিশ্বাসের সঙ্গে আফ্রিকার দেশগুলির সামগ্রিক ঐক্য নিয়ে আমার সন্দেহের মধ্যে কোনও বৈপরীত্য নেই। বরং আমার সেই সন্দেহই এই বিশ্বাসের ভিত্তি। আদি বাসভূমি থেকে দূরে বসবাসকারী সব জনগোষ্ঠীই মাতৃভূমির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটলেই অনাথ শিশুদের মত পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে। জনমানসে আফ্রিকার যে ছবি আছে, তা মেনে নেওয়া তাদের কাছে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রায়ই আফ্রিকার সৌন্দর্য আর হারিয়ে যাওয়া জাঁকজমকের অলীক কল্পকথায় আবদ্ধ থেকে তারা মহাদেশের আসল সমস্যাগুলিকে এড়িয়ে যেতে চায়। বার্কলেতে আফ্রিকান-আমেরিকান স্টাডিজ় কর্মসূচি নিয়ে কাজ করা এক নাইজেরীয় কন্যার সঙ্গে আমার কথোপকথন মনে পড়ছে। তার অভিযোগ ছিল আজকের নাইজেরিয়া নিয়ে সে কখনও তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেনি কারণ তারা তার কথা শুনতেই চায় না। সামরিক অভ্যুত্থান, সেনাবাহিনীর অত্যাচার, আর অসীম দুঃখকষ্টের ব্যাপারে জানতেও চায় না। তাদের আগ্রহ শুধু ইয়োরুবার ব্রোঞ্জ আর বেনিনের মুখোশ নিয়ে।

    Tree of Life এ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্থাপন ঘটেছে: ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান মহিলাদের জীবন কেমন? পুরুষ ঔপন্যাসিকরা তাদের শুধু মা অথবা দিদিমা হিসেবে দেখিয়েছেন। তারা শুধু মহিলাদের মাতৃত্বের ভূমিকায় দেখাতে আগ্রহী। মার্তিনিকের উপন্যাসকার জোসেফ জ়োবেলের ফরাসি-ক্যারিবিয়ান ধ্রুপদী উপন্যাস 'লা র‌্যু কাস্‌-নেগ্র (১৯৫০; ইংরেজিতে Black Shack Alley)-তে দিদিমা ম্যান টাইনে তার সারাটা জীবন নাতি জোসে-র জন্য উৎসর্গ করার পর তার প্রতীকী মৃত্যু ঘটছে নাতি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে। নারী হিসেবে আমি শুধু মাতৃত্বের মধ্যে আটকে থাকতে চাই না, সেটা যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন। আমার পরিবারের মহিলাদের কথা ভাবলে মনে হয় যে তাঁরা যত শিক্ষিত হয়েছেন, ততই তাঁদের স্বাধীনতা কমে গেছে। পরিবারের শিক্ষিতা মহিলারা 'বাড়ির দেবী' এই ভাবমূর্তির সঙ্গে নিজেদের মানানসই করার চেষ্টা করেছে যা অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে ভার্জিনিয়া উলফ-ই দেখিয়েছেন। আমার দিদিমা আর মায়ের মধ্যে দ্রুত একটা তুলনা টানলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। দিদিমা জন্মেছিলেন গুয়াদলুপের সমুদ্রোপকূল থেকে কিছুটা দূরে ছোট্ট দ্বীপ মারি-গালঁত-এ। তিনি প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। ষোল বছর বয়েসে বাড়ি ছেড়ে কাজের সন্ধানে পোঁয়াতাপিত্রে যান যেখানে তার পরে পরেই আমার মায়ের জন্ম হয়। মায়ের বাবা কে ছিলেন? তিনি বোধহয় অনেক আগেই আমার দিদিমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, মেয়ের শিক্ষাদীক্ষার কোনও দায়িত্ব নেননি। এ ব্যাপারটা দিদিমাকে তেমন বিচলিত করেছিল বলে মনে হয় না। তিনি একাই মাকে বড় করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষা দিয়েছিলেন যার পরিণামে মা তাঁর প্রজন্মের মহিলাদের মধ্যে প্রথম স্কুল শিক্ষিকাদের অন্যতম। দিদিমার জীবনকাহিনিটি স্বাধীনতা আর দৃঢ়ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার আখ্যান। অথচ সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষিত হলেও আমার মা তাঁর সমস্ত কর্তৃত্ব স্বেচ্ছায় সেই পুরুষটির হাতে সঁপে দিয়েছিলেন যাঁর সঙ্গে খুবই অল্প বয়েসে তাঁর বিবাহ হয়েছিল, আর যিনি তাঁর চেয়ে বিশ বছরের বড় ছিলেন। মা নিজে 'বইপত্র পড়েছিলেন', কিন্তু আমাদের শিক্ষা, পরিবারের সম্পত্তি কীভাবে ব্যবহৃত হবে অথবা পরিবারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু বলার অধিকার তাঁর ছিল না। তিনি নিজের চেহারার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, তাঁর প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দরী বললে গর্ব অনুভব করতেন। সুতরাং আমি এই লক্ষণীয় সিদ্ধান্তে এসেছি যে যতই নিজের নিরক্ষরতা হারাবেন, ততই নিজের ওপর বিশ্বাস আপনার চলে যাবে। এই বিপরীতধর্মী চিত্রগুলির কারণে নিজের কী ভূমিকা হবে তা স্থির করতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আমি কি পেশাগত সাফল্যের জন্য লড়াই করব, বিভিন্ন জাঁকালো ডিগ্রি অর্জন করে তাক লাগিয়ে দেব? নাকি সন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের সেবায় নিবেদিত থাকব? থেক্‌লার সামনেও ছিল জীবনের পথ বেছে নেওয়ার এই কঠিন পরীক্ষা। তার উচ্চাশা হল উচ্চমেধাসম্পন্ন লেখিকা হয়ে বই লেখার। তাই সে তার মেয়েকে অবহেলা করল, কীভাবে মেয়ের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করবে তাই বুঝতে পারল না।

    তবে Tree of Life এর মূল বিষয় কিন্তু সাহিত্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজের লেখকের কী নিয়ে লেখা উচিত? ক্যারিবিয়ান সমাজচিত্র আঁকতে আঁকতে তিনি কি পূর্ববর্তী লেখকদের বিধান মেনে কোনও বিশেষ আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সাহিত্য সৃষ্টি করবেন? পরিবারের সবার ছোট এবং উপন্যাসের কথক কোকো কী লিখবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছে। উপন্যাসে কোনও নায়ক, কোনও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র থাকবে না। কেবল সাধারণ মানুষ থাকবে। শুধু ধনতন্ত্র অথবা অর্থনৈতিক শোষণ নয়, বরং প্রেম, স্বপ্ন আর ফ্যান্টাসিও তার সঙ্গে জুড়ে থাকবে।

    উপসংহারে, একটি বহু আলোচিত বিষয়কে ছুঁয়ে যেতে চাই: ক্রেওলত্ব (créolité)। এইমে সেজ়ারের নিগ্রোত্ব (négritude) আর এদুয়ার গ্লিসঁ-র অঁতিলত্ব (antillanité)-র পরে এই নতুন সাহিত্য আন্দোলনটি উন্মোচিত হচ্ছে। আমাদের ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতে হবে। ক্রেওল হওয়ার অর্থ কী? ক্রেওল এর সরল অর্থ হল ‘দ্বীপপুঞ্জে জন্ম নেওয়া’। ষোড়শ শতাব্দ থেকে মিশনারি আর পর্যটকরা চিনি বা কফি বাগিচায় জন্মগ্রহণ করেছে এমন শ্বেতাঙ্গ শুধু নয়, কালো মানুষদেরও ‘ক্রেওল’ বলে ডেকে এসেছে। ক্রেওলদের জীবন আর ভাবপ্রকাশের একটি অনন্য ও বিশিষ্ট রূপ আছে। আমরা যদি এই ঐতিহাসিক সংজ্ঞাটি মেনে নিই, তা হলে ক্রেওল পুরুষ ও মহিলাদের নিজেদের খুশিমত ‘ক্রেওলত্ব’ প্রকাশ করার স্বাধীনতা থাকা উচিত। এই পরিচয়ের প্রকাশ ভাষাতাত্ত্বিক ধারাবাহিকতার অঙ্গ হিসেবে শুধু ক্রেওল ভাষা ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। উইলসন হ্যারিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয় কোনও লেখক সেই সীমানা অতিক্রম করেও যেতে পারেন কারণ ‘ভাষা হল ইতিমধ্যেই যা জ্ঞাত তার মধ্যে দিয়ে এবং তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অভ্যন্তরীণ আর সক্রিয় অভিযানের ক্ষেত্র।’ এছাড়াও বিংশ শতাব্দের শেষভাগে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশান্তরী হচ্ছে। রাজনৈতিক দুর্দশা আর অর্থনৈতিক অস্থিরতা তাদের দেশছাড়া করছে। হাইতির দশ লক্ষ মানুষ দেশের বাইরে বাস করছে। গ্রেট ব্রিটেনে জামাইকা আর ত্রিনিদাদের অধিবাসীদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। ব্রিটেন 'কৃষ্ণাঙ্গ ব্রিটিশ' এই মিথ্যা নামকরণ করে সমাজে তাদের অঙ্গীভূত করার চেষ্টা করছে। গুয়াদলুপ আর মার্তিনিকের মানুষ ফ্রান্সে গিয়ে থাকছে। এই পরিস্থিতিতে 'ক্রেওল' শব্দটির অর্থের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন নয় কি? এই শব্দ দিয়ে এমন এক যুগে দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের বোঝানো হত যখন মানুষের পরিযায়ী অথবা দেশান্তরী হওয়ার বিষয়টি জানা ছিল না। এখন এটা বাস্তব সত্য যে অধিকাংশ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রেওল নন। তার মানে কি এই যে তাদের রচনা ক্যারিবিয়ান সাহিত্য থেকে বাদ দিতে হবে? অথবা তাকে দ্বিতীয় শ্রেণির সাহিত্য বলে গণ্য করতে হবে?

    দুঃখিত যে আমি মাত্র কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এত বেশি সংখ্যক প্রশ্ন উত্থাপন করলাম। তবে লেখকের ভূমিকাকে আমি এইভাবেই দেখি।

    ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়, ২৫ মার্চ ১৯৯৩


    সূত্র: The Role of the Writer; Maryse Condé; World Literature Today, Vol. 67, No. 4; Focus on Maryse Condé (Autumn, 1993) pp. 697-699



    [ফরাসি ভাষার ক্যারিবিয়ান লেখিকা মারিস কোঁদের (Maryse Condé) জন্ম গুয়াদলুপের পোঁয়াতাপিত্র (Pointe-à-Pitre)-এ, ১৯৩৭ সালে। ষোল বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়ি ছেড়ে প্যারিসে এসে লিসে ফেনলোঁ ( Lycée Fenelon)-তে ভর্তি হন, পরে পারি-সরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। গিনি, ঘানা, মালি-র মত পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অধ্যাপনা করে ফিরে এসে ১৯৭৫-এ সরবন থেকে ক্যারিবিয়ান সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। ফ্রান্সে বেশ কয়েক বছর পড়ানোর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে, ভার্জিনিয়া, হার্ভার্ডের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পরে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ফ্রেঞ্চ অ্যান্ড রোমান্স ফিলোলজি বিভাগে প্রোফেসর এমেরিটা ছিলেন।

    সত্তরের দশকে নাটক লেখা শুরু করলেও ১৯৭৬-এ Hérémakhonon নামে তাঁর প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। তবে ১৯৮৪-তে আফ্রিকার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে রচিত দুই খণ্ডে ‘সেগু’ (Ségou) প্রকাশের পরেই মারিস পাঠক ও সমালোচক মহলে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। বারোটি উপন্যাস, অসংখ্য ছোটগল্প ও প্রবন্ধের রচয়িতা মারিস কোঁদেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্যারিবিয়ান লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর রচনা ইংরেজি, জার্মান, ডাচ, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, জাপানি ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান ও পুরস্কার ছাড়াও ২০১৮-তে তিনি ‘বিকল্প নোবেল’ হিসেবে খ্যাত নিউ অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বিভিন্ন ভাষা ও সাংস্কৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধ তাঁর রচনা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে যত আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং সাহিত্যে তিনি যে খ্যাতি লাভ করেছেন, তা ফরাসিভাষী খুব কম লেখকের ভাগ্যেই জুটেছে। তাঁর শেষ উপন্যাস ‘The Wondrous and Tragic Life of Juan and Ivana’ জাতিগত বিভেদ, আতঙ্কবাদ, আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের মত বিষয়গুলির অন্বেষণে ব্যাপৃত ছিল। স্বামী এবং অনুবাদক রিচার্ড ফিলকক্সের সঙ্গে জীবনের শেষ বছরগুলি তিনি কাটিয়ে গেলেন দক্ষিণ ফ্রান্সে। গত এপ্রিল (২০২৪) মাসে তাঁর জীবনাবসান হয়েছে।

    ১৯৮৯-র উপন্যাস Crossing the Mangrove-এ মারিস কোঁদে আন্তর্জাতিক বাজারে লেখালেখি নিয়ে সাম্প্রতিক রাজনীতির সংক্ষিপ্ত ছবি তুলে ধরেছিলেন। বিংশ শতাব্দের শেষভাগে গুয়াদলুপের একটি ছোট গ্রামের পটভূমিকায় এমন একগুচ্ছ চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে যারা সকলেই তাদের ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষায় বিভোর। তাদের মধ্যে আছে একজন উচ্চাভিলাষী ঔপন্যাসিক যে তার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের সাফল্য যেমন কল্পনা করছে, তেমনই বইটি বেরোলে তাকে যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেগুলো আগেভাগেই ভেবে রাখতে চাইছে। প্যারিসের কোনও অগ্রণী প্রকাশক বইটি ছাপার পরে পত্রপত্রিকায় প্রশংসিত হলেও স্থানীয় সমালোচকরা তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন: ‘এই উপন্যাসটি কি সত্যিই গুয়াদলুপের পটভূমিকায় রচিত, লুসিয়্যাঁ এভারিস্ত?’ ‘এটা ফরাসি ভাষায় লেখা, কী ধরনের ফরাসি? আপনি কি কখনও আপনার মাতৃভাষা ক্রেওলে লেখার কথা ভেবেছেন?’ বুঝতে কষ্ট হয় না মারিস কোঁদে এখানে নিজের ছবিই এঁকেছেন, তাঁর নিজের রচনা যে সমালোচনার মুখোমুখি হতে পারে সে কল্পনা তিনি আগেই করে নিচ্ছেন। ফ্রেঞ্চ-ক্যারিবিয়ান সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত মডেল থেকে যে তিনি সরে এসেছেন, তাঁর নিজভূমের সাংস্কৃতিক বহুত্বের প্রতিফলন যে তাঁর উপন্যাসে ঘটছে, তাই তাঁকে সমালোচকদের নাছোড়বান্দা প্রশ্নগুলোর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। চিন্তার এই সংকীর্ণতা, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সাহিত্যকে অনুশাসনের গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখার নিন্দা তাঁর ‘ক্রেওলত্বের প্রশংসা’ (Eloge de la créolité) রচনার মাধ্যমে প্রকাশ্যে এনে মারিস কোঁদে দেখাতে চেয়েছেন কীভাবে রাজনৈতিক একতার অজুহাতে ক্যারিবিয়ান লেখকদের বিষয়গত, ভাষাগত আর শৈল্পিক স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলেছে। তাঁর উপন্যাসের ক্রমাগত পরিব্যাপ্ত ভৌগোলিক পটভূমি আর তাঁর নিজের যাযাবরের জীবনও হয়ত এই সব সমালোচনাকে আরও উস্কে দিয়েছে। তাঁর ফরাসি লেখায় যেমন যথেষ্ট ক্রেওল উপাদানের অভাব, তেমনই তাঁর রচনায় আফ্রিকার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা সমালোচকদের মতে অতিরিক্ত নেতিবাচক ও বিদ্রূপাত্মক। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর সংযুক্ত থাকা, বৌদ্ধিক সমাজে উচ্চকোটির প্রতিনিধি অথবা পশ্চিমী নারীবাদের প্রতিভূ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণেও হয়ত তিনি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন।

    তাঁর স্বদেশে দেশজ ভাষা ক্রেওলের বদলে উপনিবেশের ভাষা ফরাসিতে লেখার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মারিস কোঁদের উত্তর ছিল এই: ‘ফরাসি আমার নিজের ভাষা হয়ে উঠেছে, আমি ভাষাটি আত্মীকরণ করেছি। অন্য কোনও ভাষায় আমার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা বা সমস্যাগুলোকে ফুটিয়ে তোলা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি বরং বলব যে আমি ‘মারিস কোঁদে’-তে লিখি, যার অর্থ হল আমি সেই ফরাসি ব্যবহার করি যা আমার অন্তরের ভাষা। বস্তুত, লেখকের কোনও মাতৃভাষা থাকে না, তিনি নিজের প্রয়োজনমত ভাষা গড়ে নেন। এই কারণেও লেখকের ভাষা কী হওয়া উচিত – ফরাসি না ক্রেওল – এই বিতর্কের মধ্যে আমি কখনও ঢুকিনি। প্রথমটিকে ধরা হয় উপনিবেশের ভাষা বলে, আর দ্বিতীয়টি ক্যারিবিয়ান দ্বীপের চিনি, কফি, কোকো বাগিচায় উদ্ভূত দেশজ ভাষা।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments