ভোটের ফলাফল যা হবার তা তো হয়ই, তা নিয়ে আমাদের গল্প নয়। ভোটপর্বের সঙ্গে কতশত সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষ জড়িয়ে গিয়ে কান্না, বিবাদ, বুদ্ধি-খাটানো চুটকি হাসির ফোড়ন দেওয়া যে খিচূড়ি রাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তারই পাঁচমিশেলি সুগন্ধ নিয়ে লিখেছি ‘ভোটকে ঘিরে’
ভোট হয়ে গেছে। এখন হয়ত ভোটপরবর্তী আরও অনেক কিছু ভালো-না-লাগা পর্ব। অতশতর মধ্যে না গিয়ে নিজের কাছে করা সংকল্প অনুযায়ী কেলেপচা সুপথে চলার চেষ্টা চালাচ্ছে, যদিও কদিন পারবে সে বিষয়ে একটা বড় জিজ্ঞাসা চিহ্ন তো আছেই।
বস্তির সামনেই যে বড় বাড়িটা আছে তার মালিক ভুবনবাবু কেলেকে পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও স্নেহের চোখেই দেখেন। (সে তো চা-আলা দিলীপদাও—ওর সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করেন। বলেন, ‘তোর বৌদি আজ ছ মাস পড়ে আছে আর কদিন কে জানে!’ আবার চোখও রাখেন কেলে চা খেতে খেতে জার থেকে একটার জায়গায় দুটো নেড়ে বিস্কুট তুলল না তো, সূক্ষ্ম হাত তো ওর!) সে যাইহোক, বাবুর হাতে পায়ে ধরে কেলেপচা বাগানের আগাছা বাছা, গাছে জল দেওয়ার কাজটা পেয়েছে। খুকুমণিকে ইস্কুল বাসে তুলে দেওয়া নামিয়ে নেওয়ার কাজটাও ও চেয়েছিল। ভুবনবাবু অতটা ছাড়তে চাননি, কেলেও বুঝে নিয়ে আর জোরাজুরি করেনি। এ ছাড়া বাজারে লরি থেকে আলু পেঁয়াজের বস্তা নামানোর কাজটা তো ওর আছেই। সব মিলিয়ে ওর এই নতুন জীবন ঠিকই এগোচ্ছে।
এত কথা বলা হ’ল, কিন্তু কেলেপচা কে তাই বলা হয়নি। ও হ’ল কালো শিঙ্গি মাছ মার্কা এক পকেট চোর। বংশ পরম্পরায় ওদের এই ‘মহান’ কাজ। (ওর বাবা এই ‘মহান’ কথাটা সব সময় কাজের আগে লাগাতে বলেছিল।) থাকোহরি বাবুদের পকেট থেকে দামি ফাউন্টেন পেন সরাতো, কেলে তোলে মোবাইল ফোন। কিন্তু সেদিন এক ষণ্ডার পকেটে হাত দিতেই বুড়ো আঙ্গুলটা এমন মুচড়ে দিলে যে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। সুবাস বৌয়ের চূণ হলুদের যত্নে কিছু্টা ব্যথা কমেছে। খানিক এই কারণেই লজ্জায় ঘেন্নায় কেলের এই পথ পরিবর্তন।
সুবাসের তাতে কোনো হেলদোল নেই। আসলে সব দিন তো আর কেলে চোর ছিল না। গেরাম থাকতি পেলিয়ে বিয়ে করে অনেক ভাল স্বপনই দেখেছিল ওরা, তারপর আর কি! যে কে সেই। কিন্তু ওর রোজগার কিসে সুবাস প্রশ্ন করেনি কোনোদিন, তাই কেলেও বানিয়ে বলেনি। কেবল ওর রং-তুলির শখ, তাই নিয়ে কেলেকে প্রায় উদ্ব্যস্ত করত সুবাস। রাঁধবাড়ার পর দিনে হোক বা রাতে, ছবি আঁকা তার নেশা। মনে মনে খুশি হলেও কেলে ভাবে চোরের বৌয়ের কি এ শখ মানায়? কিন্তু বিধি যা ঠিক করে দিয়েছেন তার অন্যথা তো হবার নয়।
সেই আঁকাই একদিন কেলের এমন কাজে লাগবে ও কি ভাবতে পেরেছিল? সবাই ভোটপর্বে দু পয়সা কামিয়ে নেয়। কেলেও একে-তাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে ভোট মিছিলে যোগ দিলে চা-জলখাবার, চালটা-ডালটা জুটেও যায়। কেবল যে দলে ভিড়ছ তাদের ভোট চিহ্ন দেওয়া কিছু একটা হাতের কাছে বা নিদেনপক্ষে গলায় একটা চাদর ঝোলালেই কেল্লা ফতে। (কেলে ভেবেই নিয়েছিল ওর পাতলা আঙ্গুল পকেট ফাঁকের মত সূক্ষ্ম মহান কাজেই রপ্ত থাকবে, পেটোবাজি, ছুরি পিস্তলে ভিড়ে ও নাম খারাপ করবে না।)
তবে আরও একটু প্যাঁচ বুদ্ধি খাটিয়ে কেলেপচা বৌকে দিয়ে ওর একটা ফতুয়ার সামনে ঘাস ফুল আঁকালে আর পিঠের দিকে ভিতরে ডবল তাপ্পি দিয়ে পদ্ম, যাতে চট করে বোঝা না যায়। যদি কোনও ক্রমে ঘাসফুলের স্লোগান দিতে দিতে আগের দিনের পদ্মফুল দাদারা ঘাড় চেপে ধরে বলেন ‘এই-ই, তুই কাল আমাদের সঙ্গে ছিলি না?’ কেলে জিভ কেটে বলবে, ‘এজ্ঞে ওতো আমার যমজ ভাই প সা’ বা কখনো দু দল আমনে-সামনে হ’লে দূর থেকে আঁচ করে গাছের আড়ালে ফতুয়া উল্টে পদ্মে ভিড়ে যায়, --ও জানে দলের একেবারে পিছনে কি হচ্ছে অত কেউ চোখ পেতে দেখে না। কেউ ধরলে বলে, ‘আমি তো প সা। মনে-প্রাণে পদ্ম, যারে দেখলেন ও দলে সেতো ভাই কেলে,--অর নাম করতি আমার ঘেন্না ক রে।’
এই করে কেলেপচার ভোটের দিনগুলো ভালোই কেটেছিল। কিন্ত চোর হ’লেও ও বোঝে নেহাত কারে পড়লে কখনোসখনো উল্টো পথে হাঁটতে লাগে। তবে সেটা স্বভাবে না দাঁড়ালেই হ’ল। তাই ওই বাগানের আগাছা বাছা, গাছে জল দেওয়া, আলুর বস্তা নামানো।
আর সুবাস বৌ? তার আহ্লাদ দেখে কে। এক বাড়ি রান্না সেরে, নিজেদের দুটি ফুটিয়ে নিয়ে রং-তুলি নিয়ে বসে পড়ে। জীর্ণ চাদর কাঁথার গায়ে আঁকে ফুল; পুরানো শাড়ির পর্দা রঙের ছিটেয় করে ঝলমল। আলপনার পাড়ে সেজে ওঠা উনানশাল, জলের কুঁজো খাদ্য-পিপাসার সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও মনের খিদে মেটায়। আর টিনের চালের ফুটো দিয়ে চাঁদ যখন মেঝেয় অন্য এক হিলিমিলি আলপনা দেয়, কাঁথায় আধা মুখ ঢেকে মিটি মিটি চোখ কেলে ভাবে এই বেশ, লোক ঠকানো দলবাজি আর নয়।