একটা বুড়ো বট। তারই পায়ের তলায় একটা মরা কুয়ো। ভেতর থেকে গোটা পাঁচেক কুমির মুখ বাড়াচ্ছে! গোয়েন্দা দীপক খানিক পায়চারি করতেই... “এই যে দীপকবাবু, শুনলাম বাদামি হায়নার চিৎকারে আপনার কান কটকট করছে?!” মরা কুয়ো থেকে ডানা ঝাপটিয়ে উঠে এলো বাজপাখি। “এর পর আপনার কান পুঁজিবাদী হতে চলেছে। প্যাচপ্যাচে রক্ত, থকথকে ঘা, কান কাটা গেল বলে!” ব্যাকলাইটে দীপকের অবয়ব, সে চুপ। বাজপাখি - “দুশ্চিন্তা করবেন না, ওষুধ আছে। তার জন্য চাই আপনার একটা পাকা চুল, ভয় নেই দাঁত বসাবো না।" এই বলে দীপকের হ্যাট উড়িয়ে মাথা থেকে চুল ছিঁড়ে নিল বাজপাখি। একে ধোঁয়া, তারপরে তাড়াহুড়ো। ঠোঁটের কোণে আরেকটা কাঁচা চুল উঠে এসেছে। সেটা দীপকের হাতে ফেরত দিয়ে উড়ে গেল বাজপাখি।
গলা, ঘাড় ভিজেছে। কুশনটায় ঘামের ছোপ। ওহ! শ্রীস্বপনকুমারের স্বপ্ন চলছিল! যা গরম, ঘরটাও এখন দীপক রাগেই আচ্ছন্ন! পাশে তোতা এসে কখন শুয়েছে। তবে জেগে আছে।
একটা ক্যালেন্ডার অনেকক্ষণ ধরে সিম্পল হারমনিক মোশনে। দেওয়ালে একটা বৃত্তকলা বরাবর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সিলিং ফ্যানের আওতায় সরল দোলগতি। তোতার মনে হল ওটা একটা ঢেঁকির মত। আজ পার্কে গেলে ওটাই চড়ে বসবে। একদিকে ও আর উল্টোদিকে তাতা। ওঘর থেকে বিরক্তিসূচক টোনে, ”ধ্যাততেরিকা ছাতা।" ক্যালেন্ডারের দুলুনি থামল। তোতা তুমুল উত্তেজিত - "যাক বাবা, লোডশেডিং! আর ঘুম পাবে না! চারটে বাজতেই পার্কে ছুট দেব।” গরমকালে দুপুরের লোডশেডিং, এইজন্য তোতার এত্তো ভালো লাগে! আমিও "জাপানযাত্রী"-র নব্বই নাম্বার পাতায় বুকমার্ক রেখে উঠে পড়লাম।
দুপুরের সঙ্গীসাথী নেই। নির্জন। খানিক শব্দহীন। সেদিন এই সঙ্গীহীন দুপুরের হাত ধরলাম। আজ আর ওকে 'সলিটারি ম্যান' গাইতে দেব না! রেল লাইনের পাশের রাস্তা ধরে তখন হাঁটছি। হিন্দ মোটর ফ্যাক্টরির ভেতরে। এদিকটায় মোড়ে মোড়ে লাল-কমলা পতাকারা তাকিয়ে নেই। বসতি বলতে তো কতগুলো টালির ভাঙা ঘর। যারা রেললাইন ন্যাওটা। সুমনের 'দশ ফুট বাই দশ ফুট'। তখনো খানিক রোদ আছে। সারি দিয়ে অনেকগুলো পুরোনো গাছ। গায়ে অজস্র ক্ষত। ব্যথা আছে? জানি না। বড্ড চুপচাপ। শিখছি। তারপর পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। মরা গাছকে জড়িয়ে জীবিত গাছ বাড়ছে। আবার জীবন্ত গাছের কাঁধে মৃত গাছ। শিমুল, পলাশ, নাগচম্পা? আছে। পাশাপাশি। বাছবিচার নেই। ওরা সাম্প্রদায়িক নয়। কটা বাজে জানি না। তবে ডেকরেটারের ভ্যান গাড়িতে চড়ে যে সব স্টিলের বাসনপত্র বেড়াতে যাচ্ছিল? ওদের গায়ে সোনালি হাইলাইট চেপেছে। আকাশের মেঝেয় গাছের পাতার চলন্ত আলপনারা এখন কালচে। নাম-না-জানা একটা গাছের ডালে রাশভারি চেহারার একটা কালো পায়রা। মুখ ফুলিয়ে বসে। হেডমাস্টার হবে হয়তো। ইউক্যালিপটাসের ডাল থেকে ছুটির ঘন্টা শুনিয়েছে একটা কোকিল। চোখটা লেফট রাইট দেড় বার প্যান করতেই ফ্রিজ করলাম, এদিকটায় এখনও কাঠের উনুনে রান্না হয়। চামর দুলিয়ে সাদা ধোঁয়ার ঘাগরা। তার পা ফাঁক করে কারা যেন হেঁটে আসছে। ধিতাং ধিতাং বোলে শালিকের মিছিল।
এখানটায় একটু দাঁড়ালাম। ছায়া আছে। ডোবাটার গা ঘেঁষে একটা পাঁচিল। ডিঙোলেই আপ-এর ট্রেন লাইন। উত্তরপাড়া টু হিন্দ মোটর। সামনের দেওয়ালের বুকটা চিরে গেছে। লাল আভা। বেশ স্পষ্ট। আলতা বাড়ির উঠোনটাও সারা বছর এমন দেখায়। আমাদের দুষ্টু। একটা বিড়াল। ওই উঠোনে রোজ গড়াগড়ি খেতো। আর আলতার ছাপ নিয়ে ফিরতো। আর আসে না।
ডোবাটা সবুজ জঙ্গলে ভরে গেছে। মানুষ কী না পারে! সেখানেও আবর্জনার ফুল ফুটিয়েছে! রঙিন রঙিন! আমার চোখ সামনে, ডোবার আশপাশে ছিপটান দিচ্ছে। কিন্তু মনকে দেখো, বরাবর উড়ুক্কু। পারলে স্মৃতির ইন্টারস্টেলার স্পেসেও ঘুরে আসে আর কি! এই ছিল এখানে! তো এই আবার শাঁই শাঁই...বনবন...এক্কেবারে হাওয়া। বুড়ির চুলে চেপে ইতিহাসের পিছু নিয়েছে। থামল একশো বছর আগের কোনো এক অচেনা পথে এসে। যেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনও অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। ১৯১৬ সালে ঠিক এরকমই এক গ্রীষ্মে বিশ্বকবিও এক জাপানি বাগানে পৌঁছেছিলেন। সে বাগানে ছিল হাজার বছরের পুরোনো রাজকীয় Gingkos. কোরাসে পাইনের দুলুনি। ব্রোকেন কর্ডে রসিক বরই। আরও কত কি! ছায়াপথের অর্কেস্ট্রায় ওরাই কবির দেহরক্ষী।
খালি মনে হচ্ছে, এ তল্লাটে আমি একা নেই। কে যেন অনলাইন, ফলো করছে কিন্তু ঘোস্ট মোডে। এদিকে সামনে কেবল আমার ছায়া পড়েছে। ঘাড়ে কী একটা ছুঁলো! ওহ্, আমারই ঝরে পড়া পাকা চুল! সামনে ফিরতেই আবার পিছুটান। এবার শনাক্ত করেছি! গতকাল ঠিক এই সময়ে পাড়ার গেরুয়া বাড়ির গা ঘেঁষে পালিয়েছিল। একটা জায়েন্ট Quasar, গা ঢাকা দিতে চেয়েছিল। পারে নি। বাড়িটাও ঝলসে উঠেছিল। সূর্যের কেমোফ্লেজিং। আজ টিটাগড় ওয়াগন ফ্যাক্টরির কপালে আলোর টিপ পরাতে ব্যস্ত! হুটার না বাজলেও এবার দেখব। অরুণ মিত্রের "সূর্যাস্ত"!