সাইকেল চালকের জীবনে এ এক চিরপরিচিত সার্বজনীন শব্দ-দৃশ্য। সময়ের পদসঞ্চারে আজ হয়তো সাইকেলের কদর কিছুটা কমের দিকে। কিন্তু বছর চল্লিশ আগেও গ্রাম-শহর জড়িয়ে ছিল সাইকেল- যুগ। মোটরসাইকেলের রমরমা তখন চলচ্চিত্রের পর্দায়। মোটামুটি সাইকেলের ভার বইবার ক্ষমতা হলেই মাঠেঘাটে হাফপ্যাডেলে মকসো। শৈশব তখন কৈশোরের দোরগোড়ায়। কয়েকদিন খোলা মাঠে হাফপ্যাডেলে চক্কর কেটেই ফুলপ্যাডেল। সিটে বসে গোল্লাছুট। সাইকেল তখন পক্ষীরাজ। চোখের সামনে ডালি সাজিয়ে নতুন দৃশ্য, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অনুভূতি । অনেকটা এভাবেই ছোটছোট বৃত্ত পেরিয়ে বড় বৃত্তে পৌঁছে যাওয়াই জীবন। হাফপ্যডেলের পর্ব পার করে ফুলপ্যাডেলের ইতিকথায় যেন সেই অনন্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি।
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর লেখা খণ্ড জীবনস্মৃতি "হাফপ্যডেলের কাল"-এর কাহিনি শিরোনামে ব্যঞ্জিত পর্বকে শিরোধার্য করে বালককাল থেকে জীবনের দ্বিচক্র-যানে ভর করে চলতে চলতে থেমে গেছে হাজারো প্রশ্ন, কৌতূহল ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে জর্জরিত অহরহ নিষেধের বেড়া টপকানো আড়ষ্ট কৈশোরকালের সীমানা পেরিয়ে প্রাকযৌবনের চৌকাঠে। লেখক তখন পুরনো প্যাটার্নের হায়ার সেকেন্ডারির দশম শ্রেণির ছাত্র। ততদিনে হাফপ্যডেলের পর্ব পার করে তাঁর পদোন্নতি হয়েছে ফুলপ্যাডেলে — সাইকেলের সিটে বসে অবলীলায় প্যাডেলে চাপ দিয়ে পাড়ি দিতে পারেন মাইলের পর মাইল অজানা পথ। সময়টা ১৯৬১ থেকে ৬৫। ২৮২ পৃষ্ঠার এই নাতিদীর্ঘ বইয়ে লেখক পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন তাঁর জীবনের সামান্যই। অঙ্কের হিসেবে বছর পাঁচেক। নিজের বালককাল থেকে প্রাকযৌবন পর্বে উত্তরণের অকপট স্মৃতি-আলেখ্য।
“হাফ প্যাডেলের কাল” স্মৃতিকথার পরিচিত পথে পা ফেলেনি। উত্তম পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত উচ্চারণের সারল্যকে সঙ্গী না করে লেখক বেছে নিয়েছেন উপন্যাসের প্রথাগত নৈর্ব্যক্তিক চলনকে। কাহিনির একমুখী গতিও উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতাকে মনে করিয়ে দেয়। পড়তে পড়তে পাঠকের মনে আত্মজৈবনিক উপন্যাস পাঠের পরিচিত আস্বাদ মনে পড়তেই পারে। শুধু এই দুটি ঔপন্যাসিক লক্ষণ নয়, চুলচেরা বিশ্লেষণে আরও অনেকগুলি বৈশিষ্ট চোখে পড়তে পারে। তবে যে কোনও আত্মজীবনীতেই উপন্যাসের বীজ লুকিয়ে থাকে। কেননা একজন লেখক, কবি বা নাট্যকার তাঁর নিজের জীবন বা সারাজীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকেই তো খণ্ডে খণ্ডে তুলে ধরেন নানা লেখায় — আঙ্গিকের বৈচিত্রে তা কখনও কবিতা, কখনও গল্প, কখনও উপন্যাস বা নাটক। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর এ লেখাও তার ব্যতিক্রম নয়।
আদ্যন্ত যার চোখ দিয়ে লেখক কাহিনির সুতো ছাড়তে থাকেন সেই ‘বালক’, নানা চরিত্রের সংলাপ-সম্বোধনে যে ‘অর্দ্ধু’, তাকে রচয়িতার প্রতিবিম্ব হিসেবে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। আত্মপরিচয়কে চেনা-অচেনার আলো-অন্ধকারের আড়ালে রেখে এক আশ্চর্য মুনশিয়ানায় লেখক কাহিনিকে শেষপর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছেন টানটান আকর্ষণের সাবলীল গতিতে, যা “হাফ প্যাডেলের কাল" শিরোনামের আত্মজীবনী কিংবা আত্মজৈবনিক উপন্যাসের এক অনন্য বৈশিষ্ট।
বালক অর্দ্ধুর জন্ম পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা থেকে মাইল পাঁচেক দূরবর্তী হুমগড় লাগোয়া একটি অখ্যাত গ্রামের বর্ধিষ্ণু গোস্বামী পরিবারে। আর্থিক প্রাচুর্য না থাকলেও মোটামুটি স্বচ্ছল একান্নবর্তী এই শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পরিবারের সামাজিক প্রতিপত্তি ছড়িয়ে ছিল আশপাশের গ্রাম-গ্রামান্তরে । সামন্ততান্ত্রিক রীতি- নিয়মের বিপরীতে এই পরিবার মাতৃতান্ত্রিক। বাড়িতে সক্ষম পুরুষের অভাব না থাকলেও লাগাম “বালকের অশীতিপর দিদিগোসাঁই, মানে ঠাকুমা" (পৃ-১৮)-র হাতে। "এই বয়সেও গোপেশ্বরীর প্রতাপ অটুট। তিনি যে ভেলাইডিহার রাজার কন্যা! তাঁর দুটি রূপ। সংসারে তিনি কড়া শাসক, তাঁর হাজারো ফৈজত। আবার নাতিপুতিদের কাছে তিনি রামায়ণ-মহাভারতের আকর্ষণীয় কথক।" (পৃ-১৯)
তবে কাহিনির সূত্রপাত গ্রামীণ একান্নবর্তী পারিবারিক আবহে গোপেশ্বরীর সংসারসাম্রাজ্যে নয়, সুদূর দুর্গাপুরে। গত শতকের ষাটের দশকের দুর্গাপুর এখনকার পাঠকের কাছে অচিনপুর। দাদার সাইকেলে হাফ প্যাডেলে তিনদিন প্র্যাকটিস করার পর একদিন সিটে বসে ফুল প্যাডেলে নির্জন পথে উধাও হয়ে যাওয়া অর্দ্ধু সেই রাতে স্বপ্নে এই দুর্গাপুরেই খুঁজে পেয়েছে তার পরিচিত গ্রামকে — “দুর্গাপুরের বেঁটে বন এক নিমেষেই হয়ে যায় ভালুকখুন্যার জঙ্গল” (পৃ-১২)। সেই অচেনা গ্রাম্য মফস্বলের জীবন্ত ক্যানভাস-চিত্র দিয়েই লেখক শুরু করেছেন কাহিনি।
“আজন্ম খালিপদ পাড়াগেঁয়ে বালকটির পায়ে বুটজুতো পরিয়ে ভালো স্কুলে ভর্তির উদ্দেশ্যে আনা হলো” (পৃ- ৭) দুর্গাপুরে। পরিবেশে নির্জন গ্রামীণতার ছোঁয়া থাকলেও সে সময় থেকেই ধীরে ধীরে এখানে নগর সভ্যতার আঁচ লাগতে শুরু করেছে। তৈরি হয়েছে ‘দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট’ — ডিভিসি। বালকেরও নতুন বাসা এই ডিভিসি-তেই কর্মরত মেজদার কোয়ার্টার। “বালকের আটজন দাদা। গুনতির দিক থেকে ইনি চার নম্বরে।” (পৃ-১৮) নাম হিমাংশু কিন্তু কাহিনির বেশিরভাগ অংশেই তিনি গোস্বামীবাবু। এই সম্ভ্রমসূচক সম্বোধন গোস্বামী বংশের অন্যান্য পুরুষদের ভাগ্যে জোটেনি। চরিত্রগত বৈশিষ্টের দিক থেকেও এই সম্বোধন তাঁর প্রাপ্য। শুধু দায়িত্বশীলতা নয়, পারিবারিক সংকীর্ণ রীতিনিয়মের বিপরীতে আদর্শগতভাবে তিনি কিছুটা বিপ্লবী। এই পরিবারে পুরুষরা কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও স্ত্রীদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে হয়, একমাত্র ব্যতিক্রম গোস্বামীবাবু। ঠাকুমা গোপেশ্বরীর অমত সত্ত্বেও তিনি স্ত্রী আশালতাকে নিয়ে কর্মস্থল দুর্গাপুরেই থাকেন। এই মানুষটিই প্রায় জোর করেই ছোটভাইটিকে নিয়ে এসেছিলেন দুর্গাপুরে ভাল স্কুলে পড়াবেন বলে।
দুর্গাপুরের স্কুলেই বালকের পড়াশোনা চলতে থাকে। কাহিনিও এগিয়ে চলে দুর্গাপুরের পটভূমিতে। মোট ৫৭টি অধ্যায়ের মধ্যে ২৪টি অধ্যায়ে জুড়ে তার বিস্তার। দুরারোগ্য ব্রেনটিউমারে আক্রান্ত গোস্বামীবাবু অসুস্থ হবার পর কাহিনি দুর্গাপুর থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে হুমগড়, গড়বেতায়। অর্দ্ধু ভর্তি হয়েছে গড়বেতার স্কুলে। শুরু হয়েছে মেসজীবন। এই পর্বে তার জীবনে ঘটেছে নানা ঘটনা। শরীরী ও মানসিক প্রেমের রহস্য রোমাঞ্চ, সাহিত্যচর্চা — নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির সিঁড়িতে পা ফেলে সে ক্রমশ প্রবেশ করছে বড়দের পৃথিবীতে। কিন্তু গোস্বামীবাবু রয়ে গেছেন তার জীবনে, কাহিনির কেন্দ্রে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে। শুধু তাঁর মৃত্যুতেই কাহিনির পরিসমাপ্তি হয়েছে বলে নয়, বালক অর্দ্ধুর জীবনের পাশাপাশি “হাফ প্যাডেলের কাল” -গ্রন্থে গোস্বামীবাবু ও আশালতার জীবন, কাহিনির গুরুত্বপূর্ণ ভরকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে। তাই গোস্বামীবাবুর মৃত্যু শেষপর্যন্ত কাহিনিকে পৌঁছে দিয়েছে ট্র্যাজেডির দোরগোড়ায়।
কাহিনির মূল উপজীব্য বালক অর্দ্ধুর বালককাল, তার পড়াশোনা। তাই একটা বড় অংশ জুড়ে বর্ণিত হয়েছে তার স্কুল জীবন — দুর্গাপুরের ভিরিঙ্গি স্কুল থেকে গড়বেতা হাইস্কুল। এই পর্বের নানা ঘটনা পাঠককে নস্টালজিক করে তুলতে পারে। গত শতকের ষাটের দশক থেকে ২০২৪ অনেকটা পথ। সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে বহুকিছু। কিন্তু ঘটনাবহুল স্কুল জীবন বোধ হয় ততটা বদলায়নি। অর্দ্ধুর স্কুলের অংশগুলি পড়তে পড়তে সে কথাই মনে হচ্ছিল।
জীবনীভিত্তিক কাহিনির অন্যতম বৈশিষ্ট সমকালের ছবিকে তুলে ধরা। সুবৃহৎ বিস্তারে না হলেও “হাফ প্যাডেলের কাল" -এর ক্যানভাসে উঠে এসেছে সমাজ ও সময়ের ছবি — হুমগড়ের গ্রামীণ সমাজ জীবনের ও একান্তভাবে একান্নবর্তী গোস্বামী পরিবারের নানা রীতিনিয়ম, বারব্রত, প্রথাচারের বিবরণ, এই অঞ্চলের ভাষাগত বৈশিষ্ট, খেলাধুলোর কথাও। গোস্বামী পরিবারের কাছে ক্রিকেট ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। সে সময় গ্রামীণ ক্রীড়া জগতে ফুটবলের অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তা। অর্দ্ধুরও প্রিয় খেলা ফুটবল। গড়বেতায় তার পরিচয় হয় ক্রিকেটের সঙ্গে। রেডিওয় সম্প্রচারিত ধারাবিবরণী এই পরিচয়ে যোগ্য সঙ্গত করে। অর্দ্ধুর আগ্রহে তার দাদারাও নেমে পড়েন অচেনা অজানা ক্রিকেটের মাঠে। একদিকে নতুন ধরনের খেলার উত্তেজনা অন্যদিকে মেজভাই হিমাংশুর গুরুতর অসুস্থতার মানসিক চাপ কাটানোর বৈপরীত্যের দোলাচলতায় তাড়িত ক্রিকেট খেলার এই আশ্চর্য বিবরণ “হাফ প্যাডেলের কাল” -এর অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ।
অর্দ্ধুর মেজদা হিমাংশু — গোস্বামীবাবুর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে লেখক দাঁড়ি টেনেছেন কাহিনির। শেষ হয়েছে “হাফ প্যাডেলের কাল”। কিন্তু তারপরেও তো রয়ে যায় ফুল প্যাডেলের কাহিনি — বালক অর্দ্ধুর বড়বেলার জীবন। শুধু তাই বা কেন, এই সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশে স্বামী হারানো আশালতার পরবর্তী লড়াইয়ের কথাও তো জানতে চাইতেই পারেন পাঠক। তাই শেষ হয়েও শেষ হয় না অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর “হাফ প্যাডেলের কাল"। সুলিপ্ত মন্ডলের আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ ও অদ্বয় দত্তের মনোমুগ্ধকর অলংকরণে সাজানো দ্বিতীয় পর্বের অপেক্ষায় থাকে পাঠকমন।