কাঁথা আমাদের সবার পরিচিত, সবার চেনা। অনেকেরই বাক্সে, আলমারিতে হয়তো একটি প্রিয়, স্মৃতিজড়িত পুরনো কাঁথা আছে। আহা! হাতে সেলাই করা নরম কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুতে কি আরাম! এটা একেবারেই ঘরোয়া জিনিশ, লেখালেখির যুগ্যি নয় হয়তো। তবু ভাবলাম লিখি। কাঁথা সেলাই আমার হবি, তাই কিছু তো অভিজ্ঞতা হয়েইছে।
পৃথিবীর অনেক দেশে, অনেক যুগ থেকে অনেক ধরনের কাঁথার চল। সবথেকে পুরনো কাঁথার নাকি ৬৫০০ বছর বয়েস! মিশরের ফারাওদের আমলের জিনিশ, এখন মিউজিয়ামে সাজানো।
কাঁথার নানা দেশে নানা নাম। বাংলাদেশে কাঁথা, বিহারের লোকেরা বলে সুজনি, ইয়োরোপে, আমেরিকায় কুইল্ট, উত্তর ভারতে একে বলে রজাই বা রেজাই। রেজাই বা লেপ কাঁথার থেকে বেশি গরম। ভেতরে তুলো থাকার জন্য মোটাও বেশি। এরকম রেজাই বা লেপ উত্তর ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, সব জায়গায় ব্যবহার হয়। বেশি শীতের সময় তুলো ভরা লেপের দরকার হয়।
বাঙালি কাঁথা এর থেকে পাতলা ও কম গরম। তুলোর বদলে তিন চারটে পুরনো শাড়ি বা ধুতি থাক করে একসঙ্গে সেলাই করে দেওয়া। এই হল কাঁথা। পূর্ব ভারতে, বাংলাদেশে, আসাম ও উড়িষ্যায় এই কাঁথার চল। ছোটবেলায় আমরা পুরনো শাড়ির পাড় থেকে খুব সাবধানে রঙিন সুতো টেনে বের করতাম। সেই সুতো দিয়ে কাঁথার ওপর ফুল, লতা, পাতা, ময়ূর, প্যাঁচা ইত্যাদি সেলাই হতো। কাঁথা ছাড়াও তৈরি হতো নানা সাইজের আসন-- পুজোর আসন, খাবার, বা অতিথিদের বসার আসন, বাক্স-পেঁটরার ঢাকনি, আরও কতো কি। আমার কাছে আছে প্রায় দেড়শ বছরের একটি পুরনো কাঁথা --আমার দিদিমার মায়ের বিয়ের সময় দেওয়া হাতের কাজের উদাহরণ। পাড় থেকে তোলা লাল আর কালো সুতোর সূক্ষ্ম কাজ, তলায় নাম লেখা--'কামিনী '।
এইধরনের 'নকশী কাঁথা' বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পাওয়া যায়। আজকাল কাঁথা স্টিচ খুব জনপ্রিয়। সেটা এইরকম ছোট ছোট সমান মাপের সোজা সেলাই- শাড়ি, ব্লাউজে খুব দেখা যায়।
পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কাঁথার নাম কুইল্ট (quilt)। ইয়োরোপে নানা দেশে অনেক পুরনো যুগ থেকে এর চলন। এটা লেপ ও কাঁথার মাঝামাঝি মোটা। দুই প্রস্থ কাপড়ের মধ্যে পাতলা তুলোর আস্তরণ (ব্যাটিং)। এই তিন স্তর স্যান্ডউইচ একসঙ্গে করে সেলাই করে আটকে দিন, ব্যস, হয়ে গেলো কুইল্ট। ওপরে ইচ্ছেমত রংবেরঙের কাপড় দিয়ে ডিজাইন করে দিন, সুন্দর এমব্রয়ডারি করুন, রঙিন বর্ডার লাগান। অনেক কিছুই করা যায়।
কলম্বাসের সময় থেকেই ইয়োরোপ থেকে হাতে হাতে কুইল্ট এসে পৌঁছল আমেরিকায়। তার আগে নেটিভ আমেরিকানরা কম্বল বুনতো কিন্তু এরকম তুলো দেওয়া কাঁথার চল ছিলো না। এদেশে কুইল্ট গোড়া থেকেই খুব পপুলার। বিরাট জোড়াখাট সাইজের কাঁথা সেলাই করতে অনেক সময় লাগে। অনেকের সাহায্যও দরকার। একলা পেরে ওঠা যায় না। তাই চার্চ বা অন্যান্য সংগঠন ও ক্লাব আছে যেখানে পাড়ার বান্ধবীরা (হ্যাঁ, এটা প্রধানত মহিলাদেরই কাজ) দল বেঁধে সেলাই করেন। একে বলে Quilting Bee. ছুটির দুপুরে, সবাই মিলে একটু একটু করে সেলাই করেন। সঙ্গে গল্পগাছা ও চা জলখাবার। ঐরকম 'বী' গ্রামে গ্রামে ছড়ানো। বিয়ের উপহার, পারিবারিক উত্তরাধিকার, নবজাত শিশুর জন্য তৈরি, অনেক পুরনো কাঁথা এখন অ্যান্টিক বলে ভীষণ দামি ও মিউজিয়ামে সংরক্ষিত।
কুইল্ট বা কাঁথার তিনটে স্তর একসঙ্গে করার পর শুরু হয় আসল কুইল্ট স্টিচের সেলাই। সরু ছুঁচে তিনটে স্তর একসঙ্গে ফুঁড়ে সেলাই করতে হয়। সেলাইটা সোজা রানিং স্টিচ --ঠিক কাঁথার সেলাইয়ের মতই --ছোট ছোট সমান মাপের হওয়া চাই। ভেতরে তুলোর জন্য বেশ ফোলা ফোলা দেখায়, quilty effect যাকে বলে। হালকা পেন্সিলে (যা সহজে ধুয়ে ফেলা যায়) লতাপাতা বা আলপনার মত ডিজাইন এঁকে তার ওপর সেলাই করা যায়, বা কাপড়ের প্রিন্টের ওপর আউটলাইন করা যায়, যেরকম ইচ্ছা। তিন-চার ইঞ্চির বেশি জায়গা খালি রাখা চলবে না। তাহলে ভেতরের তুলো সরে দলা পাকিয়ে যেতে পারে। যত ঘন সেলাই, তত মজবুত কুইল্ট।
এই কুইল্ট ষ্টিচটা আমার খুব ভালো লাগে। ওপরের স্তরে রঙিন কাপড়ের টুকরো বেশ মন দিয়ে, মেপে, কেটে জোড়া দিতে হয়। তার চেয়ে সেলাইটা অনেক সোজা আর মনটাকেও শান্ত করে।
গত শতাব্দীর শেষ থেকে আমার কুইল্ট হবির শুরু। প্রথমে এক বন্ধু হাতে ধরে বেসিক ব্যাপারটা শিখিয়ে দিলো। তারপর বই পড়ে আর ছবি দেখে দেখেই শেখা। আমার সেলাই মেশিন নেই, তাই পুরোটাই হাতে করি। সময়ের ভাবনা না থাকলে হাতে করাতেই বেশি তৃপ্তি ও আনন্দ। গত পঞ্চাশ বছরে কুইল্ট-এর জনপ্রিয়তা খুব বেড়েছে। বিশেষ করে হাতে করা জিনিশগুলোর। ইন্টারনেটে প্রচুর নির্দেশ পাওয়া যায়। ইউ টিউব-এও অনেক ভিডিও পাবেন। হাতের কাজের দোকানে পাবেন নানা রঙের ও প্রিন্টের কাপড়, ছুঁচ-সুতো, বর্ডারের কাপড়, তুলোর ব্যাটিং, ইত্যাদি। কাঁথা সেলাইয়ের আগে সব কাপড়গুলি একবার কেচে নেবেন। যাতে পরে রং ধুয়ে না যায়। আর নতুন কাপড়ে অনেক সময় কেমিক্যাল থাকে, সেগুলোও ধুয়ে ফেলা আবশ্যক। আজকাল কুইল্ট-এর স্পেশাল সেলাই মেশিন বেরিয়েছে। ঝটপট বড়ো বড়ো কুইল্ট তৈরি করে ফেলা যায়। কম্পুটার-এ জ্যামিতিকভাবে টুকরো কাপড় জোড়া দেওয়ার প্রোগ্রামও পাওয়া যায়। অবশ্য এতে হাতে করার তৃপ্তিটা হারিয়ে যায়।
পুরনো দিনে, ১৭ শতাব্দীতে 'হোল ক্লথ' কুইল্ট-এর চল ছিল। একটা বিরাট কাপড়ের ওপর নানারকম ডিজাইন এঁকে তার ওপর সেলাই হয়। আমি গ্যারেজ সেল-এ একটি জটিল ডিজাইন আঁকা কাপড় পেয়েছিলাম, অনেকদিন লেগেছিল এই কুইল্টটা শেষ করতে।
এর পরে এল প্যাচ-ওয়ার্ক করার ফ্যাশন। এটায় ছোট ছোট কাপড়ের টুকরো জোড়া দিয়ে ওপরের টপ-টা বানানো হয়। রঙের সামঞ্জস্য রেখে জটিল জ্যামিতিক ডিজাইন তৈরি করা যায়। (ছবি -৪, ছবি-৬) আজকাল বেশির ভাগ কাঁথা এভাবেই তৈরি হয়। দেশের নানা জায়গা থেকে নানা সময় কিছু ট্র্যাডিশনাল ডিজাইন উদ্ভূত হয়েছে। যেমন লগ কেবিন, স্টার, ফ্লাইং গীজ, ফ্যান, হাতের তাস, পিন হুইল ইত্যাদি।
প্যাচ ওয়ার্কের অঙ্ক কষতে আলস্য হলে টি-শার্ট ব্যবহার করতে পারেন। পুরনো টি শার্টগুলোর ছবি কেটে জোড়া দিয়ে কুইল্ট-এর টপ টা বানাতে পারেন। আমি দেশবিদেশে বেড়াতে ভালবাসি। নানাদেশের টি-শার্ট দিয়ে এই কুইল্টটা বানিয়েছি। ছবি-৬। বাচ্চাদের সুন্দর কিন্তু ছোট হয়ে যাওয়া জামাকাপড় দিয়েও বানানো যায়। স্মৃতি ধরে রাখার উপহার।
প্যাচ ওয়ার্ক ছাড়াও আছে আরেকটি পপুলার পদ্ধতি -- অ্যাপলিকে বা applique. এটায় রঙিন কাপড়ের টুকরো ফুল, লতাপাতার আকারে কেটে বড়ো কাপড়ের ওপর সেলাই করে বসিয়ে দেওয়া। উনিশ-শ শতাব্দীতে ফ্রান্স থেকে এর আমদানি। দামি সিল্ক, লেস, বা ব্রোকেডের কাপড় এইভাবে ছোট টুকরো করে ব্যবহার করা হতো। সেই সঙ্গে হাতের এমব্রয়ডারি, পুঁতি, বোতাম ইত্যাদি দিয়েও আর্ট ওয়ার্ক করা যায়।
আমেরিকায় আমিশ সম্প্রদায়ের নিজস্ব কাঁথা বানাবার স্টাইল আছে। গাঢ় নিখাদ রঙের কাপড় দিয়ে জ্যামিতিক নকশায় প্যাচ ওয়ার্ক করা হয়। কোন ফুল, পাখি বা অন্য কিছুর প্রিন্ট দেওয়া মানা। এগুলি হাতে করা, দেখতে সুন্দর, দামও বেশ।
আরেক ধরনের প্যাচ ওয়ার্ক-এর নাম 'ক্রেজি কুইল্ট', crazy quilt. এটা বেশ মজার। মাপজোক করে কাটার চাইতে এলোমেলো যেমন খুশি টুকরোগুলো কাটুন আর পাশাপাশি জোড়া দিয়ে সেলাই করে দিন। কোনো ডিজাইন বা প্যাটার্নের ঝামেলা নেই। কিন্তু একেবারে ক্রেজি নয়। একটু মাথা খাটাতে হয় রং ম্যাচ করা আর খাপ খাইয়ে বসানো নিয়ে। সলিড রং হলেই ভালো। কাটাছাঁটা কাপড়ের টুকরো ফেলে দেবার বদলে এভাবে ব্যবহার করা যায়।
কুইল্ট আত্মীয়-বন্ধুদের উপহার ছাড়াও নানা সংস্থায় দান করতে পারেন। ক্যান্সারের থিম দিয়ে বানানো কুইল্ট নিলাম করে চাঁদা তুলেছি ক্যান্সার রিসার্চ-এর জন্য। এ ছাড়াও কুইল্ট পাঠিয়েছি মিলিটারি হাসপাতালে আহত সৈনিকদের সেবায়। প্রতি বছর দু-তিনটে কাঁথা দিই হাসপাতালের বাচ্চাদের জন্য। এগুলি আকারে ছোট কিন্তু সেলাই করতে খুব মজার। একটি ছবি দিলাম।
প্রথম প্রথম কুইল্ট করতে প্রচুর ভুলভাল হতো। মাপে ভুল, ডিজাইনে ভুল। তারপর আমার পারদর্শী বন্ধু উপদেশ দিলেন-- 'ভুল নিয়ে ভেব না। ভুল সবাই করে। একমাত্র ভগবানই নির্ভুল।' আরও দেখলাম, এক্সপার্ট শিল্পীরাও ভগবানের নামে ইচ্ছে করেই একটি ছোট্ট ভুল এককোণে দিয়ে রাখেন।
উপদেশটা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও মনে রাখবার চেষ্টা করি।