একদা অসুস্থতার জন্যে একটি চোখ দৃষ্টিহারা, আর একটি চোখের নজর অত্যন্ত ক্ষীণ, ফলে বিনোদবিহারী স্বাভাবিক বাল্যজীবন পাননি, তিনি লিখছেন, ‘দেখি সকলেই স্কুল যায়, কেবল আমিই যাইনা’, ‘শৈশবে ও বালক বয়েসের অনেকগুলো দিন আমার কেটেছিল সঙ্গীহীন— না ছিল সঙ্গী, না ছিল খেলা’। অল্প বয়েসের এই গৃহবন্দী জীবনেই প্রকৃতি তাঁকে মুঠোয় নিয়েছিল। দুচোখ ভরে দেখতেন প্রকৃতি আর গাছপালা। ‘বাড়ির পেছনে সামনে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে লম্বা হয়ে উঠেছে বড় বড় গাছ, যেন মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত সবুজের প্রাচীর। … দূরে একটা ছাতিম গাছ, ছাতার মতন পাতা মেলে উঁচু হয়ে উঠেছে অনেকখানি। এই গাছের চারিদিকে ঘুরে বেড়াই। অন্যান্য গাছের সঙ্গে এর আকার প্রকার পাতা কিছুই মেলে না, তাই এই গাছের প্রতি ছিল আমার বিশেষ আকর্ষণ’। ছোটবেলায় পাবনা রোড ধরে চলে গেছেন বহুদূর। একদিকে ঘন বাবলা বন আর ফাঁকে ফাঁকে লম্বা শিমূল গাছ। অতিকায় অশত্থ, মস্ত স্থলপদ্মের গাছ— এসব দৃশ্যে মন ভরে যেত তাঁর।
নিজের মধ্যে শিল্প-প্রতিভা খুঁজে পাবার আগেই, অল্প বয়েসেই প্রকৃতি ও শিল্পকলা একত্রে এসেছিল বিনোদবিহারীর কাছে। দাদা বিমানবিহারী তাঁকে করে তুলেছিলেন প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ, যিনি তাঁকে নিয়ে যেতেন পাড়া-গাঁ অভিযানে। ‘… সকালবেলা বিমানের সঙ্গে আমি বেরিয়ে যাই এডভেঞ্চার করতে… পদ্মার ধার দিয়ে আমরা হেঁটে যাই বহুদূর… বিকেলবেলা জেলে নৌকো পাড় ঘেঁষে চলে, পাড়ের ওপর মাছ কিনবার জন্য লোক দাঁড়িয়ে যায়… তারপর নদী বেঁকে গেছে হাট বাজারের দিকে। ফিরে আসি আমরা আবার নদীর ধারে ধারে নানারকমের পাখির আওয়াজ শুনতে শুনতে’। আর এক দাদা বিজনবিহারী, যিনি পেশায় মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার হলেও ছবি আঁকা তাঁর একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি, যার হাত ধরে হ্যারিসন রোড ও কলেজ স্ট্রীটের সংযোগস্থলে ফুটপাতের রেলিঙের ওপর ফ্রেমে বাঁধা ছোট্ট ছোট্ট অয়েল পেণ্টিং দেখেছিলেন বিনোদবিহারী। এখানেই দেখেছিলেন তিনি প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী। তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার এক্কেবারে সূচনাপর্ব। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ‘শিল্পীর নিজস্ব উপলব্ধি অর্থাৎ যেটি তাঁর মূল প্রেরণা, সেটি সে প্রথম জীবনেই পেয়ে যায়। যা সে লাভ করে তার শ্রীবৃদ্ধি অবশ্য অভ্যাস ও অভিজ্ঞতার পথে হয়ে থাকে’। প্রকৃতি আর মানুষ বিনোদবিহারীর মৌল প্রেরণা, গোড়ায় মানুষের চেয়ে প্রকৃতির ভুমিকাই বেশি ছিল। শৈশবের ক্ষীণ দৃষ্টির জন্যেই এমনটি ঘটেছিল। সঙ্গীসাথী নেই, খেলাধুলো নেই, প্রকৃতি প্রথম প্রথম যেন এক বিষণ্ণ উপস্থিতি, তারপরে প্রকৃতিই তাঁর অন্যতম নিবিড় সঙ্গী।
১৯১৭-য় বিনোদবিহারী এলেন শান্তিনিকেতনে। নিঃসঙ্গ শৈশব পেরিয়ে এখানেই তিনি প্রথম সমবয়সীদের সঙ্গ পেলেন। অনুভব করলেন এ তাঁর আপন জায়গা। একখানা মাদুর, সামনে নড়বড়ে জলচৌকি আর জলের গামলা। এই সামান্য উপকরণ নিয়েই শুরু হল শিল্পসাধনা। অচিরে শিক্ষকরা তাঁর মধ্যে আবিষ্কার করলেন শিল্পের প্রতি তাঁর টান। বিনোদবিহারীর কথা রবীন্দ্রনাথের গোচরে আসে। শান্তিনিকেতনের অন্যতম শিক্ষক জগদানন্দ রায়ের লেখা ‘পোকামাকড়’ বইটির ইলাসট্রেশনের কাজ দেওয়া হল বিনোদবিহারীকে। এই অভিজ্ঞতায় তরুণ বিনোদবিহারীর আত্মপ্রত্যয়ের ভিত তৈরি হল।
শান্তিনিকেতনে বিনোদবিহারী আবিষ্কার করে নিতে থাকেন প্রকৃতিকে, প্রকৃতিও নিজেকে মেলে ধরে তাঁর কাছে নর্ম সহচরের মতো, চিনিয়ে দেয় নিজের কঠোর ও মোহিনী রূপ, দুটোই। শান্তিনিকেতনের প্রবল রুক্ষতা আর অবিরল বর্ষা তাঁর সত্তাকে জাগিয়ে রাখে নিরন্তর। শান্তিনিকেতন ভূপ্রকৃতির সব থেকে চিরস্থায়ী রূপ তাঁর কাছে খোয়াই। এই খোয়াই তাঁর মনের মধ্যে ঢেউ তোলে। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। এই খোয়াইয়ের পট এক গভীর অর্থে বিনোদবিহারীর আত্মউন্মোচনের চিত্ররূপ। জানা যায়, বিবাহের পর তাঁর স্ত্রীকে উপহার দেওয়া একটি স্কেচবুক, যার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ক্যালিগ্রাফিক শিল্পরীতিতে ধরা আছে শান্তিনিকেতন ও তাঁর চারপাশের গ্রামীণ জীবন ও ভূপ্রকৃতি। এটি তাঁর কাছে খুব মূল্যবান ছিল, কেননা এখানেই তিনি নিজের অন্তরঙ্গ সত্তাকে দেখতে পেয়েছিলেন, যুগপৎ মানুষ ও শিল্পী হিসেবে। সত্যজিৎ রায় যখন তাঁর মাস্টারমশাইকে নিয়ে তথ্যচিত্র ‘দ্য ইনার আই’ বানাচ্ছিলেন, জানা যায় বিনোদবিহারী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোমার ফিল্মে খোয়াই দেখাবে তো? আরও বলেছিলেন, ‘খোয়াই বাদ দিও না। খোয়াই, আর তাতে একটি সলিটারি তালগাছ। ব্যস। আমার স্পিরিট, আমার জীবনের মূল ব্যাপারটা যদি কোথাও পেতে হয়, ওতেই পাবে। বলতে পার— ওটাই আমি’।
অনেকদিন পর গ্রীষ্মের ছুটিতে জনবিরল শান্তিনিকেতনের ‘সেই দুপুর ও অন্ধকার রাত্রির’ কথা মনে করতে করতে তিনি লিখেছিলেন: ‘এই নির্জনতাই বোধ হয় আমার দৃশ্য-চিত্রের প্রধান বিষয়’। কেবল শান্তিনিকেতন বা বীরভূমের রুক্ষ প্রকৃতি নয়, বেনারস, নেপাল, মুসৌরি যেখানেই বিনোদবিহারী গেছেন, সেখানকার পরিবেশ ও প্রকৃতি প্রায় সরাসরি প্রভাবিত করেছে তাঁকে, তাঁর আঙ্গিককে। পর্যবেক্ষণ করেছেন নিজের চারপাশ, বাস্তব পর্যবেক্ষণ হচ্ছে তাঁর ছবির উৎস ও ভর। বিনোদবিহারীর এই পর্যবেক্ষণের সূত্রে মনে পড়ে যায় কবি মণীন্দ্র গুপ্ত’র কবিতার একটি লাইন, ‘কখন হলদে তালি জামা গায়ে রোদ চুপি চুপি রাঙা মুখে বাঁশবনের মগডালে চড়ে’। বিনোদবিহারী বাস্তব জগতের এই উদ্দীপনাকে ছবির ভাষায় রূপান্তরের শিক্ষাটা তিনি পেয়েছিলেন নন্দলালের কাছ থেকে। নিজের পর্যবেক্ষণকে তিনি স্মরণে রেখেছেন। এটাই ছিল তাঁর সহজাত স্বভাব। দৃশ্যস্মৃতি তাঁর ছেলেবেলা থেকেই ছিল প্রখর।
‘সারি সারি কৈ মাছ, পাশের জলা জমি থেকে কানকো মারতে মারতে এগিয়ে চলেছে একটা গাছের দিকে। ইতিমধ্যে গাছের গুঁড়ি ধরে কতকগুলো কৈ মাছ ডালপালার উপর উঠেছে এবং মাঝে মাঝে পড়েও যাচ্ছে। ঢালু জমি থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে চলেছে, সেই জলের উল্টোদিকে কৈ মাছেরা অভিযান চালিয়েছে। অপূর্ব সে দৃশ্য। হয়ত নয়-দশ বছর বয়স হবে, কিন্তু সেই অপূর্ব দৃশ্য এখনো মনে আছে এবং অনেককে এই গল্পও করেছি’। ছেলেবেলায় তিনি দেখেছেন কাঁসি বাজাতে বাজাতে বাসনওয়ালা, চুড়িওয়ালার হাঁক, কত রঙের চুড়ি, বেলোয়ারি চুড়ি—রেশমি চুড়ি। তিনি দেখেছেন দুপুরবেলা দাওয়ায় বসে কুসুম ঝির ঠোঙা তৈরি করা। তিনি বলেছেন, ‘তার কাছে আমি বসি, ঠোঙা তৈরি করি। কাগজ ভাঁজ করি, আঠা দিয়ে পরিষ্কার করে জুড়তে পারি। কুসুম প্রশংসা করে বলে, ‘তোমার হাত খুব পরিষ্কার, ঠোঙা খুব সুন্দর হয়েছে’। এ ধরনের বেশ কিছু স্মৃতিকথা ছড়িয়ে আছে ‘চিত্রকর’ লেখাটিতে। নিজেই লিখেছেন, ‘শৈশব কাল থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখবার অভ্যেস আমার হয়েছিল’।
বিনোদবিহারী রোমান্টিক ছবি বা পৌরাণিক ছবি কোনোটাই আঁকেননি। তাঁর ছবির বিষয় ছিল মূলত শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি ও সেখানকার মানুষের জীবন। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির জন্যে ছোট ছোট পশু পাখির ছবিও আঁকতেন। তবুও ব্যতিক্রম ছিল, তিনি লিখেছেন, ‘এই সময়ের ছবির মধ্যে একটি মাত্র ছবি আমি করেছিলাম যা আমার সমস্ত শিল্পীজীবনের ব্যতিক্রম বলা চলে। ছবির বিষয় ছিল এইরকম: অবনীন্দ্রনাথের ‘সাজাহানের মৃত্যু’ ছবির অনুকরণে করেছিলাম ‘থামওয়ালা বারান্দা’। রাজপুত্র বসে আছেন সিংহাসনে, মোঘল ধাঁচের পোশাক ও পাগড়ি, পাশে পারস্য রমণী সারেঙ্গি জাতীয় যন্ত্র বাজাচ্ছেন, দুজনের মাঝখানে একখানা টেবিল, তার ওপরে ফল ও সুরাপাত্র ইত্যাদি …’। ছবিটি নন্দলাল প্রশংসা করেছিলেন, প্রশংসা করলেও বিনোদবিহারী এ রকম ছবি করার চেষ্টা জীবনে আর করেননি। ছবিটা বিক্রিও হয়েছিল। এই প্রথম ছবি বিক্রি করে কিছু টাকা হাতে পেলেন বিনোদবিহারী।
১৯২৫-এ শেষ হল তাঁর কলাভবনের পাঠ। তারপর তাঁকে পাঠভবনে শিল্পকলা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হল। কিছুপরে তিনি পেলেন কলাভবনের গ্রন্থাগারটির দায়িত্ব। তাঁর সামনে খুলে গেল জ্ঞানচর্চার বিপুল পরিসর। শিল্পের সীমা ছাড়িয়ে জ্ঞানের নানা শাখায় বিচরণের অলিখিত ছাড়পত্র। জীবনের বাকি সময়ে তিনি নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন শিল্পকলা-সাহিত্য-দর্শন ও ইতিহাসের। তাঁর অর্জিত এই জ্ঞান তাঁকে শিল্পপ্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে সজাগ রাখে। বই থেকে যা জ্ঞান আহরণ করেছেন আর গুরু নন্দলালের ও প্রকৃতির প্রভাব থেকে যা অর্জন করেছেন, তার তুলনা করতে গিয়ে বিনোদবিহারী লেখেন, ‘তাই ভাবি আমি শিখলাম কার কাছ থেকে? নন্দলালের কাছ থেকে, না লাইব্রেরি থেকে, অথবা শান্তিনিকেতনের এই রুক্ষ প্রকৃতি থেকে? নন্দলাল না থাকলে আমার আঙ্গিকের শিক্ষা হত না, লাইব্রেরি ছাড়া আমার জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব হত না, আর প্রকৃতির রুক্ষ মূর্তি উপলব্ধি না করলে আমার ছবি আঁকা হতো না’।
বিনোদবিহারীর শেষ সাতটি বছর কেটেছিল দিল্লিতে। প্রয়াণ ১৯৮০ সালে। তার কয়েকবছর আগে ১৯৭২ সালে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান বরাবরের মতো। কিন্তু মন পড়েছিল শান্তিনিকেতনেই। ঋতেন মজুমদারের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় শান্তিনিকেতনের কথা প্রায়ই বলতেন। বলে উঠতেন, ‘চীনা ভবনের কাছে ওই কমলা শিমূল গাছটা নিশ্চয়ই ভরে উঠেছে ফুলে এখন’, কিংবা কলাভবনের এক প্রাক্তন ছাত্র দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে বিনোদবিহারী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ধীরেনদা কি এখনও খোলা মাঠে, তালবনে ঘুরে বেড়ান?’— এ উচ্চারণ বিনোদবিহারীর স্মৃতি-কাতরতা নয়, ভাবাবেগ নয়। এ হল তাঁর মনের খোলা আকাশের নির্জন এক ছায়াপথ।
একটা সময় শান্তিনিকেতনের পরিসরেই কম উচ্চারিত হয়েছে বিনোদবিহারীর নাম। স্বল্প উচ্চারণেও ছিল না অন্তরঙ্গতা, বরং অনেক বেশি ছিল সম্ভ্রম-মাখা দূরত্ব। নন্দলালের ছাত্র দুজনেই— বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর। রামকিঙ্কর যত বেশি প্রকট, বিনোদবিহারী যেন অনেকটাই অন্তরালে। রামকিঙ্করের বহেমিয়ানিজম, তাঁর জীবনচর্চা, তাঁর অন্যধারার ভাস্কর্য তাঁকে নিয়ে গেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, অন্যদিকে বিনোদবিহারীর শিল্পচর্চা তাঁর অন্তরের নিহিত আলো-ছায়া। তাঁকে ঘিরে যে নৈঃশব্দ্য, যে দূরত্ব বা অন্তরাল তা আসলে শিল্পীরই আপন স্বভাবের অন্তর্জাত। তাঁর শিল্প অনুসন্ধিৎসু মনের আড়ালে তিনি সযত্নে লালন করেছিলেন এক অন্তর্মুখী মন। মুখরতা ও কোলাহলের চেয়ে তাঁর কাছে অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত ছিল নির্জনতা। কিন্তু রামকিঙ্করের সঙ্গে বিনোদবিহারীর সখ্যতা ছিল আত্মীয়সুলভ। দুজনে বসেছেন আড্ডায়, চলেছে মত বিনিময়, সঙ্গে মদ্যপান। বিনোদবিহারী কোনো কিছুই গোপন করেননি। কিন্তু রামকিঙ্করকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে যেমন মিথিক্যাল গল্পের জন্ম হয়েছিল, বিনোদবিহারীকে ঘিরে তা হতে পারেনি।
নিঃসঙ্গতা ও অন্তর্মুখীনতা বিনোদবিহারীর স্বভাবগত বৈশিষ্ট হলেও, এমনকি তাঁর শিল্পচর্চার আবশ্যিক শর্ত হলেও, তিনি কখনই ছিলেন না জীবনবিমুখ। তাঁর নিভৃতচারিতা ও জীবনসংলগ্নতা— এই দুয়েরই সম্মিলনে গড়ে উঠেছিল তাঁর শিল্পের ভুবন। তাঁর শিল্পকর্মে প্রায় অধরা থাকে তাঁর ব্যক্তিসত্তা। সমস্ত মন-প্রাণ-সত্তা জড়িয়ে শিল্পচর্চা করলেও, সেই চর্চা থেকে বিনোদবিহারী সরিয়ে নেন তাঁর ‘introvert self’-কে। মিলে মিশে যায় তাঁর ব্যক্তিসত্তা ও শিল্পীসত্তা— ‘…আমার মধ্যে বাল্যকাল থেকেই এক রাস্তায় চলার ঝোঁক ছিল (হয়তো আমার সঙ্গীহীন যৌবন, বাল্যকাল, হয়তো চোখ খারাপ হওয়ার দরুন বেশি হুড়োহুড়ি করতে পারিনি বলেই এরকম ধারণা হয়েছে।) ছেলেবয়েস থেকেই আমি introvert’। তাঁর ব্যক্তিসত্তা ও শিল্পীসত্তা মিলেমিশে থাকলেও শেষপর্যন্ত তাঁর শিল্পকর্ম ও ব্যক্তিসত্তার মধ্যে তৈরি হয় একটা দূরত্ব। ‘এই নীরব দূরত্বের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় বিনোদবিহারীর একান্ত নিজস্ব সাধনা— এক আত্মবিলোপী আধুনিকতার সাধনা’।
বিনোদবিহারীর এই ‘introvert’ মন, এই ‘এক রাস্তায় চলার ঝোঁক’ তাঁর গোটাজীবনের শিল্পসৃষ্টিতে ঠিক কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, সেই সন্ধানে এসে আমাদের একটু থমকে দাঁড়াতেই হয়। সৌমিক নন্দী মজুমদার সঠিক ভাবেই বলেছেন, ‘যে শিল্পীর, তাঁর সৃষ্টিকর্ম তো বিস্তৃত হয়ে আছে নানান আঙ্গিকে, বিভিন্ন মাধ্যমে, বিচিত্র শৈলী ও অভিমুখে! সেই বিশাল পরিসরে কোথায় সেই অন্তর্মুখী মন, কোথায় সেই নিঃসঙ্গতা, কোথায় বা সেই অন্তরাল?’ কলাভবন ছাত্রাবাসের সিলিং-এ ‘বীরভূম নিসর্গ’, চীনাভবনের ভেতরে শান্তিনিকেতন জীবন নিয়ে ‘ফ্রেসকো’, হিন্দিভবনের ভেতরে ‘মধ্যযুগীয় সন্ত’ ও কলাভবন ক্যান্টিন-দেয়ালে চীনা মাটির টালিতে ‘ম্যুরাল’, তুলির ডগায় উঠে আসা মুসৌরির নিসর্গ— সব কিছুতেই হারিয়ে যায় তাঁর অন্তর্মুখীনতা বা নিঃসঙ্গতা।
১৯৩৮ সালে কয়েক মাসের জন্যে জাপানে গিয়েছিলেন বিনোদবিহারী। পরিচয় হয়েছিল সত্তর বছর বয়সী জাপানী শিল্পী তাকেউচি সেইহো-র সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকেই জেনেছিলেন অনুভবের পথে আয়ত্ত করতে হয় আঙ্গিককে। আঙ্গিক বাইরের বস্তু নয়, ভিতরের বস্তু। বস্তুর ভেতর মানবিক প্রজ্ঞার সংযুক্তি থাকে, তাকে অবহেলা করতে নেই। বিনোদবিহারীর চিন্তার সঙ্গে এ চিন্তার সাযুজ্য আছে, শুধু কিছুটা আলাদা। কিন্তু পরম্পরা আছে— তাকে ফিরিয়ে আনতে হয় এটা বড় শিক্ষা। এই শিক্ষা আয়ত্ত করার শিক্ষা, অনুভবকে গাঢ় করে নিতে হয়।
ব্যক্তিগত স্তরে নানা সমসাময়িক ঘটনাবলী তাঁর সংবেদনশীল মনে প্রশ্ন তুলত কিন্তু তিনি নিজের মধ্যে স্থিতধী ছিলেন, লোকদেখানো প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি একজন প্রকৃত মানবতাবাদীই ছিলেন। বরং শিল্পের উপলব্ধিতে তাঁর জীবন নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত থেকেছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার জীবনে যা মূল্যবান তা প্রকাশ পেয়েছে আমার ছবিতে। তাই আমার ছবি না দেখলে আমার জীবনের বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যাবে না’। তিনি এতটাই বলে গেছেন তাঁর ছবি ও জীবন সম্পর্কে। তবুও সব আধুনিক চিত্রকলার মতোই তাঁর কাজের সঙ্গে আত্মজীবনের ছাপ নেই, সবই নৈর্ব্যক্তিক।
বিনোদবিহারী লিখেছিলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে কতকগুলো ছায়া ঘুরে বেড়ায়— মৃত্যুর ছায়া, রোগ-শোকের ছায়া, অপমান-লাঞ্ছনার ছায়া ইত্যাদি নানা ছায়া সদা-সাথীর মতো সর্বদা আমাদের অনুসরণ করছে। আমি জন্মেছিলাম সামনে লম্বা অনিশ্চিতের ছায়া নিয়ে’। এই ‘অনিশ্চিতের ছায়া’ ঘনিয়ে এলো জীবনের বাহান্ন বছর বয়েসে যখন তিনি সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন। ‘চিত্রকর’ রচনাটির শেষাংশ এইরকম ‘…হাসপাতালে কয়দিন কাটিয়ে একদিন অপরাহ্ণে কালো চশমা চোখে লীলার হাত ধরে বেরিয়ে এলাম নার্সিংহোমের বাইরে। বাইরে রৌদ্রের উত্তাপ বুঝছি, কিন্তু আলো দেখতে পাচ্ছি না। তারপর প্রায় বিশ বছর হতে চলল, আলো আর আমি দেখিনি। সাদা কাগজের ওপর নানা রঙের ছোপছাপ দিয়ে ছবিও আর আমি করিনি। আজ আমি আলোর জগতে অন্ধকারের প্রতিনিধি’। তিনি নিজেই বলেছেন, Blindness is a new feeling, a new experience, a new state of being’— একথা বলার অর্থ অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণ নয়, আবার অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে, আগের মতোই ছবি আঁকার জগতে ডুবে থাকার মতো কোনো অহংকারও নয়। আছে কেবল আলিঙ্গন। অন্ধকারকে আলিঙ্গন করে নতুন আঙ্গিকে সৃষ্টিমুখী হবার আত্মবিশ্বাস। সাদা কাগজের ওপর নানা রঙের ছোপ দিয়ে আর ছবি আঁকেননি ঠিকই, কিন্তু অজস্র ড্রইং, মাটি-মোম ও প্লাস্টিসিন দিয়ে নির্মিত ভাস্কর্য ও কোলাজ— এই হয়ে উঠল তাঁর নিয়মিত মাধ্যম। অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই অন্ধকারকেই চ্যালেঞ্জ করলেন অন্য শিল্প সৌকর্যে, অন্য মাধ্যমে। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিকই লিখেছেন, ‘… বিনোদদা দৃষ্টিহীন ছিলেন না এ আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। চোখ খোলা আর বন্ধ করার পার্থক্যকে মুছে দিতে পেরেছিলেন বলেই আর-এক বিনোদবিহারী আমাদের পাওয়া সম্ভব হয়েছে’। সদাজাগ্রত মনের আলোর কাছে পরাজিত তাঁর চোখের অন্ধকার। দৃষ্টিহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই হয়ে উঠল বিনোদবিহারীর অস্ত্র, ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী যেমন রাজাকে দীপ্ত সাহসে বলতে পেরেছিলেন, ‘মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই। আমার অস্ত্র মৃত্যু’। কোথায় যেন নন্দিনীর অস্ত্র আর বিনোদবিহারীর অস্ত্র এক হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র-
১। এক্ষণ/ শারদীয় সংখ্যা ১৩৮৪ (চিত্রকর: বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়)
২। বঙ্গদর্শন/ জানুয়ারি-ডিসেম্বর, ২০০৪ (ক্রোড়পত্র: বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়)
৩। শিলাদিত্য/ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
৪। এক চিত্রকরের প্রেরণা-জগত/ সৌমিক নন্দী মজুমদার/ ছবিলেখা
৫। বিনোদবিহারীর চিত্রকথা/ শান্তি নাথ