মানসাই উত্তরবঙ্গের অন্যতম জীবনরেখা জলঢাকা নদীর স্থানিকনাম। এ ব্যাপারে অবশ্য দ্বিমত আছে। কেউ কেউ বলেন জলঢাকা এবং মুজনাই নদীর মিলিত প্রবাহের নাম মানসাই। তবে অর্থ যাই বহন করুক না কেন সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নদী সভ্যতার জন্মদাত্রী। উত্তরবঙ্গের একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাজবংশীদের কাছেও মানসাই মাতৃস্বরূপা। এই উপন্যাসটিতে মানসাই প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে না থাকলেও গল্পের মধ্যমণি এবং গোটা উপন্যাসটিকে শাসন করেছে যে চরিত্র সেই প্রীতিলতাকেই মানসাইয়ের মানবীরূপ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। দিবাকর চন্দের প্রচ্ছদে নদীর পাড়ে সাইকেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর ছায়াছন্ন ছবি, মনে হয় উপন্যাসের এই মূল ভাবনাকেই যথাযথ ভাবে মূর্ত করতে চেয়েছে।
অশক্ত বৃদ্ধা শাশুড়ি ও একমাত্র ছেলে ভাস্করকে নিয়ে প্রীতিলতা - রমনীমোহনের সুখ অথবা অসুখের সংসার। সংসারের ঊনকোটি চৌষট্টি রকম কাজের ফাঁকে সুখ আর প্রেম এখানে চোরাস্রোতের মতো বয়ে যায়। রমনীমোহনের রাজনৈতিক জীবন, প্রয়োজনাতিরিক্ত সততা এবং নির্ভীকতা বারবার আশঙ্কার অসুখ হয়ে কড়া নেড়ে যায় প্রীতিলতার ভাবনার অন্দরমহলে। তবুও এ ভাবনার চৌহদ্দি পেরিয়ে জীবন বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে রাতে পায়রার খোপ বন্ধ করা হল কিনা সেই দুশ্চিন্তায়, পাছে ভামে ধরে। বেঁচে থাকে ভোরবেলা কালো বোষ্টমের খঞ্জনী আর গানের সুরে।
রাষ্ট্রের শোষনযন্ত্রকে উপেক্ষা করে নতুন রাষ্ট্রবাদ এবং শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে যারা বন্দুকের সামনে বুক পাতে, আসলে তো চোয়াল শক্ত করতে হয় তাদের পরিবারকেই। সশস্ত্র রাজনীতির সর্বগ্রাসী ভুখ কেড়ে নেয় আদর্শগত ভাবে নিয়মতান্ত্রিক বাম প্রীতিলতার স্বামী রমনী আর অতিবাম রাজনীতির পথিক ছেলে ভাস্করকে। স্বামীর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ হয়তো চাক্ষুষ করেছিল প্রীতিলতা, কিন্তু একমাত্র ছেলে জীবনমৃত্যুর মাঝখানে একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার আর কালো প্রশ্নচিহ্ন হয়েই সারাজীবন ঝুলে রইল তার মনে।
নিয়মনির্দিষ্ট জীবনে শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা। প্রীতিলতার খাঁখাঁ জীবনে অবলম্বন হয়ে এল কুসুম। দুরসম্পর্কের ভাইয়ের মেয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় খান সেনাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য হাজার হাজার মেয়ের সাথে দেশের সীমা পেরোতে বাধ্য হয়েছিল কুসুম। কুসুমের কাছেও প্রীতিলতা ছিল একটা নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু সেদিনের সেই অস্থির সময়ের উত্তাল জোয়ারে শুধু স্রোতে ভেসে থাকা খুব সহজ ছিল না। তৎকালীন শাসকের মদতপুষ্ট গুন্ডাবাহিনীর নজর পড়ল সদ্য ডাগর হওয়া কুসুমের শরীরের ওপর। আসলে হায়নাদের কোনও জাত হয় না কোনও দেশ হয় না।
কুসুম নামক অবলম্বনটিও একদিন প্রীতিলতার স্নেহের আগল ভেঙে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল দিকশূন্যপুরে। কুসুমের নিথর দেহের সামনে দাঁড়িয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না প্রীতিলতা। মহাভারতের যুদ্ধপর্বের কাহিনি সে পড়েছে। সেখানে দুটোই পক্ষ। ন্যায় আর অন্যায়। পরমাত্মীয় বলে কিছু হয় না। তাই শোকের সময় এটা নয়। তবে মুখে বললেই তো আর বুকে পাথর চাপা দেওয়া যায় না। কন্যাসমা কুসুমের মৃত্যু ভেতরে ভেতরে প্রীতিলতাকে ভেঙে খানখান করেছিল। ভাস্কর বাবার তৈরি করা আদর্শের পথে হাঁটেনি। সে ছিল সশস্ত্র সংগ্রামীদের একজন। কিন্তু প্রীতিলতা বাকি জীবনটা স্বামীর দেখানো পথেই হাঁটতে চেয়েছিল। হয়তো যেখানে সে সর্বস্ব হারিয়েছিল সেখান থেকেই নতুন করে শুরু করার আশায়। কিন্তু যেদিন ভাড়াটে এবং রমনীমোহনের সহযোদ্ধা সত্যেন পুলিশি ধরপাকড় ও অত্যাচারের কারণে স্ত্রী হৈম এবং তাদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতের দায়িত্ব প্রীতিলতার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে অন্ধকারে গা ঢাকা দিল সেদিন প্রীতিলতার অসাড় হয়ে যাওয়া বুকের বাঁ দিকটায় আবার সাড় ফিরে এলো। বাঁচার জন্য বাঁচা নয়, সংগ্রামের জন্য বাঁচা।
‘মানসাই’ আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। রাজনীতির অপ্রশস্ত গলিপথ ধরেই এ গল্পের চলন। রাজনৈতিক চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনও একটি চরিত্র হয়তো এই উপন্যাসের প্রধান চালিকাশক্তি হতে পারতো। বিশেষ করে রমনীমোহন কিংবা ভাস্কর। এছাড়া সত্যেন ডাকুয়া, বিমলা প্রসাদ শুক্ল — এই প্রত্যেকটি চরিত্র তৎকালীন সমাজের বাস্তব চালচিত্রকেই তুলে ধরেছে। কিন্তু এরা কেউই পাঠকের প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। এই উপন্যাসটির শরীরে রক্তপ্রবাহের যে মূল ধমনী তার নাম প্রীতিলতা। এ তারই জননী থেকে বিজয়ীনি হয়ে ওঠার গল্প। তাই রাজনীতির উঠোন পেরিয়ে এক অভাবনীয় উত্তরণের নাম ‘মানসাই’। কাহিনির নানা দ্বন্দ্ব-বিক্ষোভ ,আলো-অন্ধকারের মধ্যে মাঝেমাঝে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ উপন্যাসটিকে অলংকৃত করেছে।
সমাজের সর্বস্তরীয় লিঙ্গ বৈষম্যের একটি বাস্তব চিত্র অতি সুক্ষ্ণতার সঙ্গে লেখিকা তুলে ধরেছেন এই গল্পে। স্বামী ও ছেলের প্রতি তীব্র অভিমানে ধস্ত-হৃদয় প্রীতিলতার স্বগত ভাবনায় ধরা পড়ে সেই দ্বি-খন্ডিত সমাজের ছবি, মেয়েদের অধিকারহীন দৈনন্দিন যাপনের সাদাকালো বাস্তবতা —“সংসারটা কি শুধু মেয়েদের? আর ইচ্ছামতো যাপনে শুধু পুরুষদেরই অধিকার! জীবনের পরোয়া করে না যে রাজনৈতিক যুদ্ধ, দেশে দেশে পালাবদলের নির্ণায়ক তাই - ই। কিন্তু পেছনে যারা পড়ে থাকে, তারা তো বেশির ভাগই কন্যা, জায়া বা মা, যাদের দুর্দশা পিন্ডদানের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় না। সমাজ সংসারের প্রতিকূলতা, প্রতিশোধ, লালসা, দায়িত্ব, কর্তব্যের ভার সব ঠেলে চলতে চলতে একা হয়ে যাওয়া মেয়ের যে কী ক্লান্তি, প্রীতিলতার থেকে বেশি আর তা কে জানে!" (পৃ-৬৪)
উপন্যাসটিতে আর একটি উল্লেখযোগ্য নারীচরিত্র হল কুসুম। প্রীতিলতার রুক্ষ জীবনে সে এক পশলা বৃষ্টি, চৈত্র শেষের মিঠে দখিনা বাতাস। কুসুমের উৎসাহেই প্রৌঢ়ত্বে এসে প্রীতিলতা সাইকেল চালানো শেখে —
"পিসি উইঠা পড়, কোনো ভয় নাই, পড়বা না। প্রীতি রোগা দুটো হাতে হ্যান্ডেল চেপে সাইকেলে উঠে পড়ে। প্রথম দু-তিন দিন খুবই কষ্ট হয়। হাঁটু ঘসে রক্তাক্ত হয়, হাতে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। সর্ষের তেল কালোজিরে দিয়ে ফুটিয়ে কোমরে মালিশ করে দেয় কুসুম। রান্নার জল তুলে দেয় কুয়ো থেকে। সান্ত্বনা দেয় পিসিকে। আর মাত্র কয়টা দিন, দেখবা তুমি পাখির মতো হাওয়ায় উইরা উইরা বেরাইতেছ।" (পৃ-১২২)সব শেষে যার কথা না বললে এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় সে রাসু দাই। সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি। একটি গঞ্জের অশিক্ষিত দাই হলেও তার ভাবনার সূতিকাগারে কোনও অন্ধকার ছিল না। এই চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে লেখিকা সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন মেয়েদের জীবনযুদ্ধের যে ফল্গুধারা লোকচক্ষুর অন্তরালে ক্রমাগত বয়ে চলে সেখানে শুধুমাত্র প্রীতিলতা নয়, সমস্ত নারীই বিজয়ীনি। এ গল্পে রাসু দাই-ই হয়ে ওঠে প্রীতিলতার ভবিষ্যত পথের দিশারী—
"তুমার হাতজোড়ার জন্মই হইসে বাচ্চা খালাসের জন্য। যাও বাপের বাড়ি গিয়া দাই-এর ট্রেনিং নিয়া আসো। কাজের কুনো ছুটোবড় নাই। তুমারেও তো বাঁচতে হইবে বৌদি। আমি থাইক্যা যামুনে তুমার ঘরবাড়ি পাহারা দিবার জইন্য, তুমার হাঁস, পায়রা, অম্বা, সব যত্নে থাইকবে। কুনো চিন্তা নাই তুমার।" (পৃ-১৪১)উপন্যাসের শেষাংশে রাসুর দেখানো আলোকবর্তিকায় মিলে যায় প্রীতিলতার স্বপ্ন। সে দেখতে পায় দিগন্তের লাল আলোকরেখায় ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে এক বিরাট শৈশবের মানববন্ধন। ওরা বড় হবে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ওরাই ভাঙবে অচলায়তন।